বৃহন্নলার ডিভোর্স পর্ব-আট

#ধারাবাহিকগল্প
#বৃহন্নলার ডিভোর্স
পর্ব-আট
মাহাবুবা বিথী

রুমি বলে,
—-আপু আমি অবশ্যই চাই ওদের শাস্তি হোক। আমি একলা মেয়ে মানুষ। আমার মা অসুস্থ। যত বেশী মামলা দিব তত ফয়সালা হতে দেরী হবে। আমি আমার প্রতি অন্যায়ের বিচার অবশ্যই চাইবো কিন্তু এই বিচার চাইতে গিয়ে আমার উপর যে আর অন্যায় হবে না এর গ্যারান্টি কে দিবে? আমার নিরাপত্তা কে দিবে?আমাদের দেশে ঘটনা ঘটে যায় কিন্তু ভিকটিম কোন বিচার পায় না।

আমার বাসায় কোন পুরুষ মানুষ নাই। আমি আসলেই আর পারছি না। স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে চাইছি। তবে পরমকরুনাময় আল্লাহপাকের উপর ওদের বিচারের ভার ছেড়ে দিয়েছি। অভিশাপ দেওয়া আল্লাহপাক পছন্দ করেন না। কারণ আল্লাহ পাক ছাড় দেন কিন্তু ছেড়ে দেন না। আর প্রতিমূহুর্তে আমার ভিতর থেকে যে দীর্ঘশ্বাস বের হচ্ছে। এই দীর্ঘশ্বাস আল্লাহপাকের দরবারে জমা হচ্ছে। সুতরাং আমার প্রতি যে অন্যায় ওরা করেছে এর ফল ওদের ভোগ করতেই হবে। তারউপর আমি একজন এতিম মানুষ। আপু যারা বাইরে চোখের জল ফেলতে পারে না তারা দেহের ভিতরে রক্তাক্ত হয় বেশী। যেটা শুধু পরমকরুনাময় আল্লাহপাক দেখতে পায়।
ব্যারিষ্টার রাবেয়া বলেন
—ঠিক আছে তোমার মত অনুসারেই সব হবে। তবে আমি আবীরের অফিসে মামলার কপি পাঠিয়ে দিবো। এতে হয়ত আবীরের চাকরি চলে যাবে।
রুমি বলে,
—-আপনার নিয়ম অনুসারে আপনি যা করার করবেন এতে আমার বলার কিছু নাই।
ব্যারিষ্টার রাবেয়া বলেন,
—-রুমি, অনেক সময় লক্ষ্যে পৌঁছাতে গেলে মানুষকে কঠোরতা অবলম্বন করতে হয়। সেই কঠোরতাকে অনেকে নিষ্ঠুরতা বলে। ইতিহাস তাদের জন্যও জায়গা রেখে দেয়। কথাটা মনে রেখো। গুরুত্বপূর্ণ কথাটা তোমাকে বলা হয়নি। কাল সকাল এগারোটায় মামলা কোর্টে উঠবে। তুমি ঠিক সময়ে চলে এসো।
ফোনটা রাখার পর রুম্মান চিন্তিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলো
—-আপু তোমার ল,ইয়ার ফোন দিয়েছিলো।
রুমি বললো,
—-হুম
রুম্মান বললো,
—-মামলার ডেট কবে পড়েছে?
রুমি বললো
—-আগামিকাল। তোর কাল ভার্সিটিতে ক্লাস আছে?
রুম্মান বললো,
—-কাল ক্লাসতো আছে আপু ল্যাবও রয়েছে।
রুমি বললো,
—-ঠিক আছে। কালকে মামলার ডেট পড়েছে আম্মুকে জানাবো না। বাসায় একা থাকবে তখন শুধু টেনশন করবে। এতে হয়ত প্রেসার টা বেড়ে যাবে।
রুমি ওর মার ঘরে গেলো।মা ওর ভাইয়ের সাথে ফোনে কথা বলছে। ওকে দেখে ওর মা বললো,
—-কিছু বলবি
রুমি বললো,
—-তুমি ভাইয়ার সাথে কথা শেষ করো তারপর বলি। রুমির মা ছেলের সাথে কথা শেষ করে রুমিকে জিজ্ঞাসা করেন,
—–কিছু বলবি?
রুমি বলে,
—-কাল আমার একটু বাইরে কাজ আছে। তুমি বাসায় একা থাকতে পারবে তো?
ওর মা বলে,
—-কেন পারবো না? কালকে কি মামলার তারিখ পড়েছে?
রুমি বলে,
—-তুমি কি করে বুঝলে মা?
ওর মা বলে,
—-সন্তানের মুখ দেখে যদি মা মনের কথা না বুঝে তাহলে তো সে মা হতেই পারলো না। মায়ের সাথে সন্তানের নাড়ীর সম্পর্ক। জানিস তুই যখন ও বাড়িতে ছিলি একটাদিনও রাত্রে ঠিক মতো ঘুম আসতো না। নানারকম দুঃশ্চিন্তা আমাকে গ্রাস করতো। এজন্যই তো প্রেসারটা এমন বেড়ে গিয়েছে। মারে আমি নিজহাতে তোর জীবনটা নষ্ট করে দিলাম। আমাকে তুই ক্ষমা করে দিস।
রুমি বলে,
—-মা,তুমি যদি একথাটা আবার বলো আমি তোমাকে কিছুই আর জানাবো না। যেদিকে দুচোখ যায় আমি চলে যাবো।
ওর মা বলে,
—-ঠিক আছে,আর বলবো না। তবে কাল তোর সাথে আমিও কোর্টে যাবো।
রুমি বলে,
—-তাহলে তাড়াতাড়ি ডিনার সেরে শুয়ে পড়ো।ঘুম হলে প্রেসার কন্ট্রোল থাকবে।
দ্রুত রাতের খাওয়া শেষ করে ওরা শুয়ে পড়লো। রুমি একমগ চা নিয়ে বারান্দায় চেয়ারে বসলো। রুম্মান এসে বললো,
—-আপু এভাবে একা বারান্দায় রাতে বসে থাকলে তোমার উপর জ্বীনের নজর পড়বে।
রুমি বলে,
— মুরুব্বিগীরি না করে শুয়ে ঘুম যা। আর আমাকে একটু একা থাকতে দে।
রুম্মান জানে ওর আপুর মনের অবস্থা তবুও স্বাভাবিক করার জন্য দুষ্টুমী করে বলে,
—-তোমার ভালোর জন্যই বলছিলাম। তুমি দেখতে যে পরিমান সুন্দরী জ্বীন না জানি তোমার প্রেমে পড়ে যায়।
রুমি বলে,
—-আজ অবদি কোন মানুষই আমার প্রেমে পড়লো না তুই আবার জ্বীনের প্রেমের পড়ার কথা বলছিস। যা শুয়ে পড়। আউল ফাউল কথা আমার সামনে বলবি না।
রুম্মান আসলেই মুখ ফসকে ফাউল কথা বলে ফেলেছে তাই দ্রুত রুমির কাছ থেকে সরে পড়লো।
রুমি অবশ্য রুম্মানের কথায় কিছু মনে করে না। এমন সময় মোবাইলে টুংটাং শব্দ হলো।তাকিয়ে দেখে রায়হান মেসেজ পাঠিয়েছে।
—-কেমন আছেন?
রুমি বলে,
—-ভাল। আপনি ঘুমাননি
রায়হান বলে,
—আমি ঘুমালে আপনাকে মেসেজ পাঠালো কে?
রুমি বলে
—আপনার ভুতটা মনে হয় পাঠিয়েছে।
রায়হান বলে,
—-আপনিও তো মনে হয় আমার ভুতের মেসেজের জন্য অপেক্ষা করেন।
রুমি বলে,
—-জ্বী না মশাই। শুধু শুধু আমার পিছনে সময় ব্যয় না করে ঘুমিয়ে পড়ুন।
রায়হান বলে,
—-আপনি কি আসলেই কিছু বুঝেন না নাকি বুঝেও না বুঝার ভাণ করেন।
রুমি বলে,
—-আপনার কি মনে হয়?
রায়হান বলে,
—-আসলে যে সত্যি ঘুমায় তাকে জাগানো যায় আর যে ঘুমের ভাণ করে শুয়ে থাকে তাকে জাগানো যায় না।
রুমি বলে,
—-আমিও বুঝি না আপনি কেন আমাকে নিয়ে পড়েছেন?
রায়হান বলে,
—-সমস্যা একজায়গায়। চোখে তো পড়ে অনেকেই কিন্তু মনটা যে একজনকেই ধরে রাখে। ঠিক আছে শুয়ে পড়ুন। গুড নাইট।
চারিদিক নিরব নিস্তব্ধ। সমস্ত পৃথিবী ঘুমিয়ে পড়েছে। শীতের উত্তরী হাওয়ায় শরীরটা হীম হয়ে যাচ্ছে। রায়হান ভাই মনে হয় মাইন্ড করেছে। উনি মাইন্ড করলে রুমির কিছু করার নাই। রুমি বারান্দার দরজা লাগিয়ে ঘরে এসে শুয়ে পড়লো। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে রাত দুটো বাজে।
খুব ভোরে রুমির ঘুম ভেঙ্গে যায়। ফজরের নামাজ পড়ে কিচেনে গিয়ে চা বানায়। মায়ের রুমে উঁকি দিয়ে দেখে মা নামাজ পড়ছে। এক কাপ চা ফ্লাক্সে রেখে দুকাপ চা নিয়ে রুমি মায়ের কাছে আসে। মা রুমিকে বলে,
—–রুমি, দু,দিন আগে রায়হানের মা ফোন দিয়েছিলো। তোর বিষয়ে জানতে চেয়েছে।আমি বলেছি শীঘ্রই তোর ডিভোর্স হবে। তখন উনি বললেন,”তোর যদি কোন আপত্তি না থাকে তাহলে রায়হানের বউ করে তোকে নিতে চায়।
রুমি বলে,
—-তুমি আবারও আমার বিয়ে নিয়ে ভাবছো। মা আমি নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাই। এটাই এখন আমার জন্য সবচেয়ে বেশী জরুরী। তুমি বরং ভাইয়ার বিয়েটা দিয়ে দাও। তোমার ছেলের যে বয়স বেড়ে যাচ্ছে সে খেয়াল আছে। ভাইয়াকে জিজ্ঞাসা কর ওর নিজের পছন্দ আছে কিনা। যদি না থাকে তাহলে মেয়ে খুঁজতে থাক।
রুমির মা রুমিকে বলে,
—-আসলেই রাশেদের জন্য মেয়ে দেখা দরকার। ভাল পরামর্শ দিয়েছিস।
রুমি নাস্তা রেডী করতে কিচেনে চলে যায়। রুমির মা ভাবে এখন আসলে রুমিকে বিয়ের ব্যাপারে জোর করা উচিত নয়। জীবনে এতো বড় একটা ধাক্কা আগে সামলে উঠুক। তারপর না হয় ওর বিয়ের কথা ভাবা যাবে।
ব্রেকফাস্ট করে রুম্মান রুমি আর ওর মা বাসা থেকে
বের হলো। রুম্মান ভার্সিটি চলে গেলো। রুমি আর রুমির মা আদালত প্রাঙ্গনে হাজির হলো। রুমির ল,ইয়ার আগে থেকেই উপস্থিত ছিলো।
কাঠগড়ায় আবীর সারাক্ষণ মাথা নিচু করে থাকলো। ওরাও উকিল ঠিক করেছে। ওর সাথে সাব্বির এসেছে। আবীরকে ঝড়ো কাকের মতো লাগছিলো। এর পরের মামলার তারিখ ওরা একটু পিছিয়ে নিলো। ওদের উকিলের কাছে খবর পাওয়া গেলো ওর বাবা নাকি স্ট্রোক করে আইসিইউতে ভর্তি আছে। আর আপু মামলার কাগজ আবীরের অফিসে পাঠিয়েছে বলে ওরও চাকরি সাসপেন্ড অবস্থায় আছে। ওদের উকিল রুমির ল,ইয়ারকে বললো,
—-আপু অফিসে কি মামলার কপিটা পাঠানো জরুরী ছিলো। বাসার ঠিকানায় পাঠালেই তো পারতেন।
রুমির ল,ইয়ার বললো,
—-আমি নিয়ম অনুসারে কাজ করছি।
আপু আমাকে আর আম্মুকে নিয়ে কোর্ট থেকে বের হয়ে আসলো। আম্মু আপুকে বললো,
—-জানো মা, আল্লাহর বিচার আছে। অনেকে ক্ষণিক লাভ খাইতে চায়। কিন্তু আল্লাহপাক যখন ফয়সালার দায়িত্ব নেন অসহায় মানুষ তখন শ্রেষ্ট ফয়সালায় পায়। আমরা আল্লাহর কাছে পাপ করি। আল্লাহপাক অসীম দয়ালু। তাই উনি আমাদের ক্ষমা করে দেন। কিন্তু আমরা যখন তার কোন অসহায় বান্দার উপর অত্যাচার করি সে মাফ না করলে আল্লাহপাক মাফ করেন না। ওরা আমার রুমির উপর যা অত্যাচার করেছে এর ফল ওদের ভোগ করতেই হবে।
রুমির মার চোখের পাতা ভিজে গেলো।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here