বেখায়ালি ভালোবাসা পর্ব-১০

0
2416

#বেখায়ালি_ভালোবাসা,
#পাট_১০
#লেখাঃসাবেরা_সুলতানা_রশিদ
.
মেঘ দের সিলেট পৌছতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেল। স্টেশন থেকে গাড়িতে করে বাঙ্গলোয় পৌছাতে আরও কিছু সময় পেরিয়ে গেল।
ঝিনুক আর মিতু ওদের রুমে চলে গেল।
মেঘ নিজের রুমে গিয়ে কোন রকম ড্রেসটা চেন্জ করে ফ্রেশ হয়েই বিছানায় শরীর এলিয়ে দিল।
মেঘের একটা বড় সমস্যা সেটা হলো সে অন্যেদের মত জার্নি করার সময় ঘুমাতে পারে না। হোক সেটা লং জার্নি তবুও কেন জানি মেঘের ঘুম পায় না।
সৈকত ফ্রেশ হয়ে টমি কে নিয়ে একটু বাইরে যায়। সারা পথ ট্রেনের মধ্যে বেঘোরে ঘুমিয়ে ছিল সৈকত তাই আর তার কষ্ট অনুভব হচ্ছে না।
একটু খানি বিশ্রাম করে মেঘ উঠে ঝিনুকের সাথে দেখা করতে ওর রুমে যায় । ঝিনুক আর মিতু দুজনই ঘুমাচ্ছে।
মেঘ ভাবে একা কি করবো??
রুমে বসে না থেকে একটু আশপাশ টা ঘুরে দেখি।
মেঘ বাঙ্গলোর সামনের বাগানে একা একা হাটতে থাকে। আর বাগানে ফুটে থাকা লাল আর সাদা গোলাপ গুলো হাত দিয়ে ছুয়ে দেখে। লাল গোলাপ মেঘের পচ্ছন্দের একটা ফুল।মেঘ একটা ফুল ছিড়তে গিয়েও কি ভেবে আর ছিড়ে না।
বাঙ্গলোটা একটা উচু টিলার উপরে অনেক জায়গা নিয়ে তৈরী করা হয়েছে। মেঘ হাটতে হাটতে সামনে একটা একটা ছাউনীর নিচে গিয়ে দাড়ায় ।
দূরে সারি সারি ওপারের পাহাড় দেখা যাচ্ছে। পাহাড় গুলো অনেক উঁচু উঁচু মনে হচ্ছে পাহাড়ের মাথায় সাদা মেঘ গুলো এসে বেধে গেছে।
এখন শীতকাল । দেশের অন্য কোথায় শীত বেশী অনুভব না হলেও শীত যে এখানে অনেক বেশী সেটা মেঘ বুঝতে পারছে।
হঠাৎ পেছন থেকে একটা পুরুষ কন্ঠ শুনে মেঘ পেছন ফিরে তাকালো।
—চা খাবেন মেমসাহেব??
—আপনি কে?
—আমি এই বাঙ্গলোর ম্যানেজারের ছেলে । আমার নাম শাওন।
—ও আচ্ছা।
—চা এনে দিব??চা খাবেন?
—মন্দ হয় না।
—লিকার কেমন?
—বেশি ও না,কম ও না।
—আমি এখনি আনছি।
ছেলেটা চলে যেতেই দূরে দৃষ্টি দেয় মেঘ । দূরে ছোট ছোট ঘর দেখা যাচ্ছে। দূর থেকে দেখলে মনে হচ্ছে যেন জঙ্গলের মধ্যে বাড়ি তৈরি করা।
কুয়াশা পড়তে শুরু করেছে। ঠান্ডা হাওয়া এসে মেঘের শরীরটাতে মাঝে মাঝে কাপুনী লাগিয়ে দিচ্ছে।
লাগেজে গরম কাপড় আছে কিন্তু বের করার অভাবে সেটা না পরে এসে দাড়িয়ে আছে।
ছেলেটা চা দিয়ে চলে গেল। মেঘ ধোয়া ওঠা চায়ের কাপে চুমুক দিল।
আহ এ জন্যেই এটাকে বলে সিলেটি চা।
সিলেটি চায়ের মজায় আলাদা।
মনে হচ্ছে একটু ভিন্ন স্বাদ।
চারিদিক সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে।
হঠাৎ এক বয়স্ক লোক এসে বললো এখানে আর দাঁড়াবেন না রুমে চলে যান।
—আপনি কে?
—আমি মতি এখানকার ক্যাটেকর। দুপুরে যে আপনার রুম দেখিয়ে দিলাম।
—ও আচ্ছা সরি। আসলে তখন ওতোটা খেয়াল করা হয়নি।
—এখন রুমে যান। ঠান্ডা লাগবে।
—যাচ্ছি।
মেঘ হাটতে থাকে আর লোকটার সঙ্গে কথা বলে।
—কোথায় গিয়েছিলে ভাবি?
—এইতো সামনে।
—ডাকলে না কেন?
—তোমরা ঘুমাচ্ছিলে তাই আর ডাক দেয় নি। তোমার ভাইয়া ফিরেছে?
—কেন ভাইয়া আবার কোথায় গেল??
—সে তো এসেই কোনরকম ফ্রেশ হয়ে টমি কে নিয়ে বেরিয়েছিল।
—ওহঃ। ভাইয়া টাও না কেমন যেন!!
এই অচেনা জায়গায় এসে হুট করে একা কোথায় চলে গেল কে জানে??
—চিন্তা করো না । তোমার ভাইয়া তো আর ছোট মানুষ না যে পথ ভুল করবে । দেখ কোথায় অন্য কারো সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছে।
—ভাইয়া তো ফোন ও ব্যবহার করে না যে ফোন করবো।
—এখানে ফোন এনেও কোন লাভ নেই। নিজের ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখ একটাও সিগন্যাল নেই।
ঝিনুক ফোনের দিকে তাকিয়ে বলেঃ
—আরে তাইতো!!!তাহলে এখন কি হবে??
—সেটাই ভাবছি। এখানে পৌছে তো বাসায় কাউকে জানানো হলো না।
—আচ্ছা সকালে না হয় দেখা যাবে।
গল্প করতে করতে রাত দশটা বেজে গেল । তবুও সৈকতের কোন খোঁজ নেই।
মেঘ মতি চাচা কে ডেকে ঝিনুক আর মিতুর খাবার দিতে বললো।
ঝিনুক আর মিতুর খাওয়া শেষ হলে মেঘ ওদের ঘুমাতে যাওয়ার কথা বললো।
মেঘ কে একা রেখে যেতে ওরা প্রথমে রাজি না হলেও পরে মেঘের জোরাজুরিতে ঘুমাতে গেল।
মেঘ গায়ে একটা পাতলা শাল জড়িয়ে বারান্দায় এসে দাড়াল।
এখান কার পরিবেশ এমন যে সন্ধ্যা গড়িয়ে এক ঘন্টা পার হলেই মনে হয় যে মধ্য রাত হয়ে গেছে।
চারিদিকে অন্ধকার । ঝিঁ ঝিঁ পোকা গুলো ঝিঁ ঝিঁ সুরে অবিরত ডেকে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে দূরে জোনাকী পোকা জ্বলছে।
বাঙ্গলোর এরিয়ার ভিতরে লাইট গুলো জ্বলছে। কিন্তু ওপাশে সবটা অন্ধকার।
এখানে ঘনবসতি খুবই কম।
না মেঘ আর সাহস করে বাইরে বেশীক্ষন দাড়িয়ে থাকতে পারলো না। রুমে এসে দরজা আটকে ব্যাগ থেকে ওর ডায়েরী বের করে কিছু লিখতে শুরু করলো।
মেঘ ডায়েরী লিখতে ভালবাসে । যখন অবসর টাইম পায় তখনই ওর জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো ডায়েরীতে লিখে রাখে। কিন্তু বিয়ের দিন থেকে এ
পর্যন্ত আর সে ডায়েরী তে কিছুই লেখেনি।
বিয়ের আগে মেঘ ভাবতো “বিয়ের আগ পর্যন্ত সে নিজের জীবনের ঘটা প্রতিটা ঘটনা সে ডায়েরীতে লিখে রাখবে আর বাসর রাতে তার স্বামী কে সেটা গিফট করবে। বিয়ের পর আর কখনও সে ডায়েরী লিখবে না । তখন প্রতিদিনের সব ছোট বড় ঘটা ঘটনা গুলো সে ওর স্বামীর সঙ্গে শেয়ার করবে।রাতে যখন দুজনে ঘুমাতে যাবে তখন স্বামীর বুকের বামপাশে মাথা রেখে নিজের বাম হাতটা তার স্বামীর ডানহাতের মধ্যে রেখে কথা গুলো বলবে।”
কিন্তু———-
মেঘের কোন আশায় পূরণ হলো না।
বিয়ের প্রথম দিন সৈকতের আচারণ দেখে মেঘ আর তার ডায়েরীটা সৈকতকে দেয় নি।
ডায়েরী লিখতে লিখতে মেঘ ঘুমিয়ে পড়ে। সকালে দরজার খটখট শব্দে মেঘের ঘুম ভেঙ্গে যায়। চোখ মুছে দরজা খুলে দেখে সৈকত দাড়িয়ে আছে ।
—কোথায় ছিলেন আপনি সারা রাত?
—এখন তোমার কোন প্রশ্নের জবাব দিব না। সরো আমি ঘুমাবো।
—আপনি আগে বলুন কোথায় ছিলেন?
—জানোই তো বাইরে ছিলাম তাহলে এত প্রশ্ন করার কি আছে?
—আমরা সবাই চিন্তায় ছিলাম সেটা কি আপনি বুঝতে পারেন না??
—হুম ।
—তাহলে?
—একটা কাজে আটকে গিয়ে ছিলাম।
—ভাল।
—এখন সরে যাও আমি ঘুমাবো।
—আপনি এখন ঘুমাতে পারবেন না।
—কেন!!?
—আপনি ঘুমালে আমাদের ঘুরতে নিয়ে যাবে কে??
—গাড়ি রিজার্ভ করা আছে । যেখানে যেতে চাও ড্রাইভার কে বলে দিও নিয়ে যাবে।
—আপনি তো আজিব। এখানে এসেছি সবাই মিলে এক সঙ্গে ঘুরতে আর আপনি কিনা আমাদের অচেনা পরিবেশে তিন জন মেয়েকে অন্যের ভরসায় ছেড়ে দিচ্ছেন!!?
—কেন তোমরা কি বাচ্চা নাকি যে হারিয়ে যাবে??
—আপনার কি কোন বিষয়ে কোন মাথাব্যথা নেই!!?
—না নেই।
মেঘ আর কথা না বাড়িয়ে দরজা থেকে সরে দাড়াল।
————**——**——**————
ঘুরতে যাওয়ার আগে ঝিনুক এসে সৈকত কে ওদের সাথে যাওয়ার জন্য অনেক রিকুয়েস্ট করল। অবশেষ সৈকত ঝিনুকের কথায় ওদের সাথে ঘুরতে বের হলো।
ঘোরার জায়গা হিসাবে সিলেক্ট করা হল জাফলং ।
চা বাগান ঘুরে দেখে তারপর ঝর্না সেখান থেকে জিরো পয়েন্ট। সবাই মিলে সারাদিন অনেক ঘোরাঘুরি করে অনেক মজা করলো। ঝিনুক আর মিতু সৈকত আর মেঘের সাথে অনেক ছবি আর সেলফি তুললো।
মেঘের ইচ্ছা করছিল একা সৈকত কে সঙ্গে নিয়ে কিছু ছবি তুলতে । কিন্তু সৈকতের হাবভাব দেখে সৈকতকে নিজে সরাসরি আর কিছু বললো না।
ঝিনুক মেঘের মনোভাব কিছুটা বুঝতে পেরে সৈকত কে মেঘের পাশে দাড় করিয়ে দিল।
সৈকত প্রথমে ছবি তুলতে নিষেধ করলেও পরে কিযেন ভেবে আর কোন কথা না বলে চুপচাপ মেঘের পাশে গিয়ে দাড়াল।
মেঘ সৈকতের দাড়ানো দেখে মনে মনে ভাবছে“ মনে হচ্ছে পরের বউয়ের সঙ্গে দাড়িয়ে ছবি তুলছে। নিজের রেজিস্ট্রি করা জিনিস তাও মাঝে একহাত ফাঁকা জায়গা।”
মনে কত আশা ছিল বর খুব রোমান্টিক হবে। অন্যান্য যুগল দের মত তারাও খুব রোমান্টিক মুডে ছবি তুলবে কিন্তু——–
তার নিজের মনের কোন আশা ,কোন স্বপ্নই পূরণ হলো না।
ছবি তোলা শেষ করে সবাই গাড়িতে উঠার জন্য পা বাড়াল। বিকাল হয়ে এসেছে।লাল রঙের সূর্য পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েছ।
এমনিতে মেঘের আগে থেকে কখনো শাড়ি পরার অভ্যাস নেই। আজ ঝিনুকের অনুরোধ শাড়িটা পরে ঘুরতে বেরিয়ে টের পাচ্ছে শাড়ি পরে হাটা কত কষ্টের।
পাথরের উপর দিয়ে হাটার সময় হঠাৎ মেঘের পা স্লিপ করলো।
মেঘ মনে মনে ভাবলো এই বার বুঝি শেষ।
আঃ আঃ বলে চোখ বন্ধ করে চিৎকার দেয়ার জন্য মুখ খোলার আগেই নিজের কোমরে শক্ত এক জোড়া হাতের স্পর্শ পেল।
মেঘ তাকিয়ে দেখে ———
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here