বেখায়ালি ভালোবাসা পর্ব-১১

0
2286

#বেখায়ালি_ভালোবাসা
#পাট_১১
#লেখাঃসাবেরা_সুলতানা_রশিদ
.
মেঘ তাকিয়ে দেখে সৈকত ওর মুখের দিকে ঝুকে পড়েছে। মেঘ সৈকতের চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। সৈকতের গভীর কালো চোখের চাহনীতে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে।
কিছু টা সময় যেন এভাবে চোখে চোখে কথা হল। ওদিকে মিতু আর ঝিনুক খিলখিল করে হেসে উঠলো।
ওদের হাসিতে দুজনের ভাবনার ছেদ হলো।
সৈকত ওর বাম হাত টা দিয়ে মেঘের ডান হাত ধরে স্বাভাবিক ভাবে দাড় করিয়ে একটু ঝাড়ির সাথে বললোঃ
—যেটা পরে হাটতে পারো না সেটা পরার কি দরকার??
—না মানে,ইয়ে
—কি ইয়ে ইয়ে করছো?পড়ে গেলে কি অবস্থা হতো বুঝতে পারছো??তাকিয়ে দেখ পিছনেই বড় একটি পাথর।
মেঘ তাকিয়ে দেখে সত্যি বড় একটা পাথর। আর পড়লে মাথাটা ঠিক পাথরটার উপরই পড়তো।
—দেখে শুনে হাটো। যদি পারো জুতা খুলে হাটো তাহলে পা স্লিপ কম করবে।
—আচ্ছা।
মেঘ জুতো জোড়া খুলে হাতে নিয়ে আস্তে আস্তে হাটতে থাকে।
বাসায় ফিরতে আটটা বেজে যায়।
সবাই এক সাথে বসে খাওয়া দাওয়া শেষ করে । মেঘ আর মিতু মেঘের কাছে এসে গল্প করে । সৈকত সিগারেটের প্যাকেট নিয়ে বাইরে চলে যায় ।
আজ পূনিমা চাদের আলোয় চারিদিক কেমন ঝলমল করছে। দূরের সব কিছু পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে।
ঝিনুক আর মিতু দু’জনে প্লান করে মেঘকে একটা শাড়ি পরিয়ে খুব সুন্দর করে নববধূর সাজে সাজিয়ে দেয়। তারপর ঘরের মধ্যে মোমবাতি জ্বালিয়ে
আলো আধারির মত করে দেয় ।
—এগুলো কি করছো ঝিনুক??
—চুপ একদম কথা বলবে না তুমি।
—তোমার ভাইয়া এসব দেখলে রাগ করবে।
—মোটেও না। ভাইয়া তোমাকে দেখে আজ অবাক হয়ে যাবে।
—তুমি তোমার ভাইয়া কে জানোনা।
—আমি ভাল করেই জানি। তুমি জানোনা। আজ আমি ভাইয়ার চোখে তোমার জন্য ভালবাসা দেখেছি। ভাইয়া তোমাকে ভালবাসে কিন্তু সেটা মুখে প্রকাশ করতে পারে না।
—ভালবাসা না ছাই। সে তো পুরুষ মানুষ তাহলে তার বলতে সমস্যা কোথায়?
—ভাবি সবাই একরকম হয় না। বুঝলাম ভাইয়ার দোষ। তাহলে ,তুমি কেন নিজের থেকে ভাইয়া কে কিছু বলো না??
—ঝিনুক এবার কিন্তু একটু বেশি হয়ে যাচ্ছে।
—মোটেও না। এখন এ মুহূর্তে আমি তোমার বড় ভাবির রোল করছি সো কোন কথা বলবে না।
—কি বললে তুমি??
—হুম বড় ভাবি। বড় ভাবি আমাকে বলেছিল আমি যেন এই কাজগুলি করি। সো এখন তুমি আর কথা বলো না। আমাকে আমার ডিউটি করতে দাও।
—মেঘ মুচকি হেসে বলে আচ্ছা।
ঝিনুক মতি চাচাকে ডেকে কি যেন বলতেই উনি দৌড়ে চলে যায়।
কিছুক্ষন পর হাতে কিছু গোলাপ ফুল নিয়ে ফিরে আসে ।
ঝিনুক মেঘের খোপায় দু’তিনটা গোলাপ গুজে দিয়ে বাকি ফুল গুলোর পাপড়ী ছাড়িয়ে সারা বিছানায় ছিটিয়ে দেয় ।
মেঘ দাড়িয়ে দাড়িয়ে ঝিনুকের পাগলামি দেখে আর সৈকতের কথা ভাবে।
তাহলে কি সত্যিই সৈকত মন থেকে মেঘকে ভালবাসে । ভালবাসলে মানুষের চোখের ভাষা কেমন হয় সেটা মেঘের জানা নেই। তবে আজ সৈকতের চোখের দিকে তাকিয়ে মেঘ যেন কোন অজানা গভীরতায় তলিয়ে যাচ্ছিল। এক অদ্ভূত রকমের ভাল লাগা কাজ করছিল মেঘের মনে। মনে হচ্ছিল সময় টা তখন থমকে গেলেই বোধহয় ভাল হতো।
হঠাৎ মুখের সামনে ঝিনুক তুড়ি বাজিয়ে বললো কি ভাবছো ভাবি??
—কই কিছু নাতো!।
—জানি কি ভাবছো।
—কি জানো!?
—কিছুনা। তবে তোমার জন্য আমার একটা সারপ্রাইজ আছে।
—কি সারপ্রাইজ??
—এখন না । বাসায় ফিরে দেখাবো।
—ঠিক আছে আপেক্ষায় রইলাম।
হুম।তবে এখন তুমি এখানে বসে অপেক্ষা করো ভাইয়ার জন্য বলে মেঘের হাতটা ধরে বিছানায় বসিয়ে দেয় ঝিনুক।
ঝিনুক আর মিতু রুমের লাইট অফ করে টমি কে নিয়ে দরজা আটকে চলে যায়।
মেঘ বসে বসে ভাবে সৈকত দেখলে কেমন রিএ্যাক্ট করবে কে যানে??
কিছু সময় পর দরজার বাইরে পায়ের আওয়াজ পাওয়া গেল।
এইতো মনে হয় সৈকত আসছে।
আস্তে আস্তে পায়ের আওয়াজ টা যত এগিয়ে আসছে মেঘের বুকের ভিতর টাও কেমন যেন হচ্ছে।
হৃদস্পন্দন বেড়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে এক হাত দূর থেকেও যে কেও তার হৃদস্পন্দন শুনতে পাবে।
মেঘ যতটা সম্ভব নিজেকে কন্টোল করার চেস্টা করছে কিন্তু হচ্ছে না।
পায়ের শব্দটা এখন ঠিক দরজার সামনে এসে থেমেছে । মেঘ লজ্জা পাচ্ছে তাই মাথা নিচু করে লাজুক বউয়ের মত বসে আছে।
সৈকত দরজা খুলে ঘরে ঢুকেই যেন পাগলের মত হয়ে গেল।
জোরে চিৎকার করে উঠলো ।
—আগুন ,আগুন কে কোথায় আছো।
মেঘ সৈকতের চিৎকার শুনে ঘাবড়ে গেল। তাড়াতাড়ি করে বিছানা থেকে নেমে সৈকতের কাছে গিয়ে বললো কোথায় আগুন??কি হয়েছে আপনার??
সৈকত আর কথা বলতে পারছে না।
ওর চোখের সামনে ওর মায়ের আগুনে পোড়া শরীর টা ভেসে উঠছে।
সৈকতের চোখ লাল ও বড় হয়ে গেছে।
চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে।
মেঘ তাড়াতাড়ি করে ঘরের লাইট অন করে দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে ঝিনুক কে ডাকলো।
ঝিনুক ঘরে ঢুকে তাড়াতাড়ি করে মোমবাতি গুলো নিভিয়ে দিল।
—ভাইয়া ,ভাইয়া দেখ কোথাও কোন আগেন নেই। আমি সব আগুন নিভিয়ে ফেলেছি।
মেঘ বুঝতে পারছে না কি করবে। সৈকতের কাছে এসে হাত ধরতেই–
সৈকত নিজের হাতটা ছাড়িয়ে মেঘের গালে ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দিল।
মেঘের মনে হলো চোখ দিয়ে আলো ছিটকে গেল। মাথা টা ভো ভো করে উঠলো । কানের ভিতর শনশন শব্দে হাওয়া বইতে শুরু করলো।
একটার অনুভূতি শেষ হতে না হতেই আরেক টা।
এবার আগের মত।
মেঘের চোখ বেয়ে দর দর করে পানি পড়তে লাগলো।
ঝিনুক কি যেন সৈকতকে বলছে কিন্তু মেঘ কিছুই শুনতে পাচ্ছে না। কানের মধ্যে বইয়ে যাওয়া ঝড় বাতাসের জন্য।
—ভাইয়া তুই এটা কি করলি? তুই ভাবিকে মারলি।!?
—বেশ করেছি।
—তুই না জেনে শুনে ভাবিকে মেরে ঠিক করিস নি।
—এখন কি তোর কাছ থেকে আমাকে শিখতে হবে কোনটা ঠিক আর কোনটা ভুল??
—ভাবির কোন দোষ নেই। সব দোষ আমার।
—আমি কোন সাফাই শুনতে চায় না । বেরিয়ে যা এ ঘর থেকে আর ওকে ও নায়ে যা সাথে করে।
—ভাইয়া তুই না জেনে রাগ করছিস। ভুলটা আমার । আমি ঘরে মোমবাতি গুলো জ্বেলেছিলাম।আমি ভুলে গিয়েছিলাম যে তোর আগুন দেখলে ভয় করে ।
ভাবিতো জানেই না । জানলে ভাবি কখনও আমাকে মোমবাতি জ্বালাতে দিত না।
—আমি আর কোন কথা শুনতে চাই না। তুই বের হবি!?নাকি আমি চলে যাবো?
ঝিনুক মেঘের কাছে গিয়ে বলেঃ
—সরি ভাবি,আজ আমার জন্য তোমার শরীরে আঘাত লাগলো বলে চোখ মেছতে মুছতে বেরিয়ে গেল।
সৈকত আর কোন কথা না বলে লাইট অফ করে বিছানায় গিয়ে অন্যদিক মুখ করে শুয়ে রইলো।
মেঘ তখনও দাড়িয়ে আছে আর চোখ দিয়ে পানি পড়ছে।
হঠাৎ সৈকতের মনে মনে খারাপ লাগতে শুরু করলো। তখন ওভাবে মেঘের গায়ে হাত তোলাটা তার ঠিক হয়নি। কারণ মেঘ কিছুই করেনি। ঝিনুক কখনও মিথ্যা কথা বলে না। তারমানে মেঘ র্নিদোষ। কাজটা ঠিক হলো না। রাগের মাথায় এমন একটা কাজ করা ভাল হয় নি। এমনি তে ওকে অনেক কষ্ট দিয়েছি।
এখনই ওর কাছে সরি বলে ক্ষমা চাইতে হবে। সৈকত পাশ ফিরে বললো সরি মেঘ আসলে আমার তখন ঐভাবে না জেনে তোমাকে চড় মারা উচিত হয়নি।
মেঘের কোন সাড়া নেই।
—মেঘ,মেঘ।
কি হলো কথা বলছো না যে। বললাম তো সরি।
সৈকত তবুও মেঘের সাড়া পেল না।
এবার সৈকতের মনে কেমন যেন হলো।
উঠে লাইট অন করে দেখে ঘরের দরজা খোলা মেঘ নেই।
সৈকতের বুকের মধ্যে কেমন যেন মোচড় দিয়ে উঠলো।
তাড়াতাড়ি উঠে বাইরে বেরিয়ে মেঘ কে খুজতে শুরু করলো।
এদিক ওদিক তাকিয়ে মেঘকে না পেয়ে
ঝিনুকের দরজায় নক করলো। ঝিনুক দরজা খুলতেই সৈকত কোন কথা না বলে ঘরে ঢুকে চারদিকে চোখ বুলালো কিন্তু মেঘ কে দেখলো না।
—কি হয়েছে ভাইয়া?কিছু বলবি।
—হুম । সরি বলতে আসছি। তখন ঐভাবে রিএ্যাক্ট করার জন্য।
—আমাকে সরি না বলে ,যাকে সরি বলার তাকে সরি বল।
—হুম বলবো। তার আগে তোকে বলতে আসছি।
—ভাইয়া আমার মনে ছিল না যে —
—এসব এখন থাক। তোরা ঘুমিয়ে পড় আমি যাই।
সৈকত আর কিছু না বলে বেরিয়ে আসলো।
ঝিনুক দরজা আটকানোর আগে বললো ভাইয়া সব ঠিক আছে তো?
—হ্যা । তুই দরজা আটকে ঘুমিয়ে যা। গুড নাইট।
সৈকত ইচ্ছা করে মেঘের বিষয়টা ঝিনুক কে বললো না। শুধুশুধু ও চিন্তা করবে তাই।
সৈকত বাঙ্গলোর চারপাশে ঘুরে ঘুরে মেঘ কে খুজতে লাগলো। কিন্তু কোথাও মেঘ কে দেখা যাচ্ছে না।
সৈকতের মনে মনে এবার মেঘের জন্য সত্যিই খুব ভয় হতে লাগলো।
এত রাতে মেয়েটা কোথায় চলে গেল তার উপর রাগ করে । মেঘ যে খুব অভিমানী একটা মেয়ে এ কদিনে সৈকত সেটা ভালভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছে।
সৈকত হাটতে হাটতে সেই ছাউনি টার কাছে যেতেই কারো কথা কানে এসে লাগলো। সৈকত আরেকটু এগিয়ে যেয়ে দেখলো মেঘ দাড়িয়ে একা একা বিড়বিড় করছে।
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here