#বেখায়ালি_ভালোবাসা,
#পর্ব_১৮
#লেখাঃসাবেরা_সুলতানা_রশিদ
.
দুই তিন দিন পার হয়ে যায় মেঘ নিজের মত নিজে থাকে। সৈকতের সঙ্গে আর কোন কথাই বলে না। সৈকত ও মেঘ কে নিজ থেকে কিছুই বলে না।
সৈকত অফিসে যাবার আগে মেঘ নিজেই আগে থেকে সৈকতের অফিসে পরে যাওয়ার ড্রেস গুলো বের করে রাখে। সকালের নাস্তাও নিজে তৈরি করে রাখে। পরিবারের সবার সামনে দুজন হাসিখুশি থাকে । কেউ দেখলে বুঝতেও পারে না যে বদ্ধ রুমে চিত্রটা ঠিক এর উল্টো।
সৈকত অফিস থেকে ফেরার পর খুব প্রয়োজন ছাড়া মেঘ আর রুমে আসে না।
সবার রাতের খাবার শেষ করার পর যখন সবাই ঘুমাতে যায় মেঘ ও ঠিক তখনই রুমে আসে ।
সৈকত ও ততক্ষনে ঘুমিয়ে যায়।
আবার সৈকত ঘুম থেকে ওঠার আগেই মেঘ রুম থেকে বেরিয়ে যায়।
এই দুই তিন দিনে সৈকত ও তার ফ্যামিলির সবার অনেকটা কাছাকাছি চলে এসেছে। কিন্তু সে শুধু তার বাবাকে এভয়েড করে চলে।
অফিস থেকে ফেরার পর সব ভাই বোন মিলে হল রুমে বসে শুরু করে জমজমাট আড্ডা। কিন্তু চৌধুরী সাহেব বাসায় ঢুকলেই সৈকত সোজা তার রুমে চলে যায়।
মেঘ দূর থেকে দাড়িয়ে শুধু ভাবে কি করে সত্যেটা সামনে আনা যায় ।
কি করে ছেলে আর বাবার ব্যবধান টা কমিয়ে আনা যায়।
দাদীমার কথাই ঠিক ।
শুধুমাত্র সৈকতের ভুল শুধরে দিতে হবে । অন্যেরা যা জানে সেটা না হয় সেভাবে থাক।
কিন্তু কি ভাবে!!?
না আর এত সময় নেওয়া চলবে না।
আজকেই আমাকে সবটা করতে হবে ।
আজ রাতেই আমাকে সৈকত কে সব বলতে হবে।
———**——**——**————
মেঘ রুমে ঢুকে দেখে সৈকত কিছু অফিসের ফাইল নিয়ে বসে কাজ করছে।
আজ সৈকত না ঘুমিয়ে কাজ করছে দেখে মেঘ একটু অবাক হল।
মেঘ কথা গুলো সৈকতকে কিভাবে বলা শুরু করবে বুঝতে না পেরে ইতস্ত বোধ করতে থাকে।
কিছুক্ষন রুমের মধ্য পায়চারি করে বেলকনিতে গিয়ে দাড়ায়।
তারপর মনে মনে কথা গুলো সাজায়। কিভাবে কথা গুলো বললে সৈকত বিশ্বাস করবে । কিভাবে বললে ওর মনে ভুল গুলো ভাঙ্গবে ।
মেঘ মনে মনে কথা গুলো সাজিয়ে রেডি হয়ে রুমে ঢোকে। আর ভাবে আজ কোন রকম ভাবে সে সৈকতের সাথে কোন ঝামেলায় জড়াবে না।
কথা গুলো শোনার পরে সৈকত হয়তো বিরুপ পতিক্রিয়া করতে পারে তাই তার কোন কথা আজ মেঘ তেমন রিএ্যাক্ট করবে না বলে মনে মনে ঠিক করে ।
সৈকত বিছানার উপর বসে কাজ করছিল । মেঘ পাশে গিয়ে দাড়াতেই
সৈকত বললোঃ
—কিছু বলবে??
মেঘ একটু অবাক হয়ে যায় সৈকতের কথায় । কিছু বলার আগেই সৈকত এ কথা বললো তাই।
—হ্যাঁ । আপনার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে।
—কি বলবে বলো।
—আপনার কাজগুলো যদি শেষ হয়ে থাকে তাহলে কথা গুলো বলতে চাই।
—বলো সমস্যা নেই। আমি শুনছি।
—যে কথা গুলো আপনাকে এখন বলবো সেগুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ তাই—-
—এই কাজ গুলোও আমার খুব গুরুত্বপূর্ণ । নতুন একটা প্রজেক্ট এর কাজ । সব যদি ঠিক থাকে তাহলে আমাকে আগামিকাল আমি একসপ্তাহের জন্য ঢাকার বাইরে যাব।
—ঠিক আছে তাহলে আমি না হয় আপনি ফিরে এলেই কথা গুলো বলবো।
—না,না । তার দরকার নেই। তুমি কিছুদিনের সময় চেয়েছিলে আমিও সেটাই দিয়েছি।তার থেকে বেশি সময় আমি দিতে পারবো না।
—মেঘ সৈকতের কথা শুনে একটু চুপ হয়ে থাকে।
—আমাকে দশ মিনিট সময় দাও হাতের কাজ গুলো শেষ করে নিই। তুমি বরং এই ফাঁকে কফি করে নিয়ে এসো। যদিও বা জানি আমার কোন অধিকার নেই এখন তোমাকে দিয়ে কিছু করানোর।
—আপনার জন্য কিছু করার সুযোগ হওয়া আমার জন্য সৌভাগ্যের ব্যাপার বলে মেঘ বেরিয়ে যায়।
কিছুক্ষন পর দুজনেই মুখোমুখি বসে থাকে। মাঝে দুটো ধোয়া ওঠা কফির মগ নিয়ে ।
সৈকত কফির মগে চুমুক দিয়ে বলে
—বলো কি বলতে চেয়েছিলে।
মেঘ কফির মগটা হাতে নিয়ে লম্বা করে একবুক নিশ্বাস টেনে নেই তারপর এক চুমুক কফি পান করে বলে
—আপনার মা বেঁচে আছে।
——————-!!কি বললে তুমি!!??তুমি কি আমার সঙ্গে মজা করছো??আর ইউ কিডিং মি??আর ইউ ক্রেজি মেঘ?তুমি কি জানো তুমি কি বলছো??
—হ্যা আমি সত্যি বলছি। আমি জানি আপনি আমার কথা বিশ্বাস করবেন না। কিন্তু এটাই সত্যে।
—হোয়াট??কি বলছো তুমি!!কে বলেছে তোমাকে এই পাগলের প্রলাপ ??(রেগে)
—আপনি প্লিজ উত্তেজিত হবেন না। আগে আপনি আমার সব কথা শুনুন তারপর না হয় —
—না । আমি কিছু শুনতে চাই না।
—আপনাকে সত্যেটা জানতেই হবে। আপনি দিনের পর দিন এক অন্ধকারের ভিতর ডুবে আছেন। আপনি মিথ্যা টাকে বুকে লালন করে নিজের বাবাকে ঘৃনার সাগরে ডুবিয়ে ফেলেছেন। আপনি চোখে এতটাই কালো কাপড় বেঁধে আছেন যে বাইরের আলো সেই কাপড় ভেদ করে আপনার চোখ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারছে না।
—আমি এত ঙ্গানি কথা শুনতে চাইনি।
—সত্যি আপনার মা বেঁচে আছে। ছোট বেলায় যাকে আপনি গাঁয়ে কেরোসিন ঢেলে আগুনে জ্বলেপুড়ে মরতে দেখেছিলেন সেটা ছিল একটা অন্য মানুষের মৃত দেহ। আর এটা শুধুমাত্র লোক দেখানোর জন্য করা হয়েছিল যাতে সবাই মনে করে উনি মারা গেছেন। আর এ কাজটি উনি করেছিলেন উনার এক কাজিনের সঙ্গে মিলে।
———–
—আপনার একটা ডাক্তার আঙ্কেল ছিল যে আপনাদের কিছু হলে বাসায় এসে ট্রিটমেন্ট করতো মনে আছে।
সৈকত একটু ভেবে বলে হ্যা । সুমন নাম ছিল মনে হয় উনার।
—হ্যা সুমন। উনি আপনার মায়ের কাজিন ছিলেন। আপনাদের বাসায় বেশ যাওয়া আসা করতেন পরে সুমন আঙ্কেল আর আপনার মা মিলে প্লান টা করে যাতে সবাই ভাবে আপনার মা মারা গেছে । আর এই ঘটনা ঘটার পর আপনাদের সেই আঙ্কেল আর কোনদিন আপনাদের বাসায় আসেনি।
—না আসেনি। শুনেছিলাম উনি দেশের বাইরে চলে গেছে।আমি জানি কথাটা পুরোপুরি মিথ্যা। তারপরও যদি কিছুক্ষনের জন্য মেনেও নি তুমি সত্যে বলছো তাহলে বলো এগুলো করে তাদের লাভ??
—লাভ ক্ষতি কি সেটা আমি জানিনা। তবে উনি চাননি যে তার বেচে থেকে অন্যে কারো সঙ্গে সংসার গড়ার কথা কেউ জানুক।
—শাট আপ আর একটা বাজে কথাও বলবে না তুমি আমার মায়ের সম্পর্কে । তোমার কি একটুও লজ্জা করছে না একটা মৃতব্যক্তির নামে মিথ্যা কথা বলতে !!?আমি জানি এসব ব্রেনওয়াশ কথাবার্তা তোমাকে কে বলছে আর কেনই বা বলছে।
তবে তাকে পরিষ্কার করে জানিয়ে দিও তার মনের আশা কোন দিন পূরণ হবে না। সে যদি মনে করে থাকে তোমাকে দিয়ে আমার মায়ের নামে কুরুচিপূর্ণ কথা বলিয়ে আমার মন বিষিয়ে দিয়ে তার নিজের প্রতি সিমপ্যাথি তৈরী করার চেষ্টা করবে তাহলে সেটা সবচেয়ে বড় ভুল।
আমি কোনদিনও ঐ ভদ্র মুখোশ ধারী মানুষটাকে মন থেকে ক্ষমা করতে পারবো না।
—আপনি অযথা বাবার নামে না জেনে আজে বাজে কথা বলছেন। আমাকে বাবা কিছু বলেনি। আর আপনার কি একবার ও মনে হচ্ছে না যে বাবা এতবছর পর আমাকে কেন এসব কথা বলবে?আর কেনই বা আমাকে দিয়ে আপনার কাছে মায়ের এসব কথা বলে আপনার ন বিষিয়ে দেবে।
—হ্যা জানি সে এসব কেন করছে। সে কখনও তার লাইফে পরাজিত হয়নি । শুধু একটা জায়গা ছাড়া আর সেটা হচ্ছে আমার মুখ থেকে তার বাবা ডাকটা না শোনা। কিন্তু জেনেশুনে আমি কখনই তাকে বাবা বলে ডাকবো না। এই জায়গাটাই আমি তাকে কখনই জিততে দেব না। এটাই হচ্ছে তার আর আমার যুদ্ধ। আর এটা চলতেই থাকবে যতদিন সে আর আমি থাকবো।
—আপনি ভুল করছেন । আপনি বাবাকে ভুল বুঝছেন। সত্যিই আপনার মা বেচে আছে আর উনি আপনার সেই সুমন আঙ্কেলের সাথেই নতুন করে সংসার গড়েছেন মেঘের মুখের কথাটা শেষ হওয়ার আগেই সৈকত হাতে থাকা কফির মগটা রাগে ফ্লোরে আছড়ে মারল আর তারপরই মেঘের মুখে কষে একটা চড় মারলো।
মেঘ চড় খেয়ে কিছুক্ষন চুপ করে বসে ব্যথাটা হজম করে আবার বলতে গেলেই সৈকত বললো আমি বুঝতে পেরেছি তুমি এ বাড়ির মায়া ছেড়ে এত আরাম আয়েশ আর ধন সম্পদের লোভ ছেড়ে
যেতে পারছো না তাই এখন এখানে পাকাপোক্ত ভাবে থাকার জন্য শ্বশুরের হয়ে দালালি করতে এসেছ। কিন্তু শুনে রাখ কোন কিছুতেই কাজ হবে না।
আর এক্ষনি আমার রুম থেকে বেরিয়ে যাও । আমি এখনকার পরে আর দ্বিতীয়বার তোমার ঐমুখ যেন না দেখি।
বলে মেঘের হাত ধরে রুম থেকে বের করে সশব্দে দরজা আটকে দিল।
(চলবে)