বেখায়ালি ভালোবাসা পর্ব-১৯

0
2413

#বেখায়ালি_ভালোবাসা,
#পর্ব_১৯
#লেখাঃসাবেরা_সুলতানা_রশিদ
.
পাঁচ দিনের মাথায় সৈকত তার অফিসিয়াল ট্যুর শেষ করে বাসায় ফিরে আসে উদভ্রন্তের মত। বাসায় ফিরে সৈকত অনুভব করে বাসার পরিবেশটা কেমন যেন একটু থমথমে ভাব।
বাসায় ফেরার পর কারো সঙ্গে সৈকতের কথা হয়নি ঠিক কিন্তু বাসায় ঢুকেই সৈকতের মনে হল আগের সেই আনন্দমুখর পরিবেশ টা যেন মলিন হয়ে গেছে।
সৈকত একটা কাজের মেয়েকে ডেকে জিঙ্গাসা করে বাসার অন্যে সবাই কোথায় কাউকে দেখা যাচ্ছে না।
কাজের মেয়েটা বলেঃ
—সবাই বাইরে আছে। আর বড় ম্যাডাম অনি বাবুকে ঘুম পড়াছে।
—ঠিক আছে আমি রুমে যাচ্ছি । আমাকে এক মগ কফি দিস একটু পরে।
—আচ্ছা ।
সৈকত নিজের রুমে ঢুকতেই রুমটা সৈকতের কাছে কেমন যেন ফাঁকাফাঁকা মনে হয়।
রুমের চারিদিক চোখ বুলিয়ে দেখে
রুমের জিনিসপত্র তো ঠিকই আছে তাহলে কেন এমন মনে হচ্ছে যে রূমটা ফাঁকা।
এই পাঁচ দিন বাসার বাইরে থেকে এসে কেমন যেন অন্যরকম লাগছে সবকিছু।
সৈকত ফ্রেশ হয়ে এসে বিছানায় শরীর এলিয়ে দেয় । পাশ থেকে ল্যাপটপ টা নিয়ে অন করতেই কয়েকটা ইমেল আসে । অফিসিয়াল কোন ই-মেল হবে ভেবে
ই-মেল অন করতেই কিছু ছবি ভেসে ওঠে অজানা ই-মেল আইডি থেকে।
ছবি গুলো দেখে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারে না সৈকত।
ডুবে যায় ভাবনার জগতে।
আসলে মেয়ে মানুষদের চেনা বড় কঠিন।
এরা এক এক সময় ভিন্নরূপ ধরে ।
অর্থের জন্য এরা সবকিছু করতে পারে সব।
আসলে মেয়েরা ছলনাময়ী তা না হলে সুইটি কেন এমন করবে সৈকতের সাথে??
সৈকত ভাবে যে সুইটি কে আমি আমার কলেজ লাইফ থেকে দেখে আসছি তার সুখে দুঃখে নিজের কাছের মানুষের মত তার পাশে থেকেছি আর সে কিনা!!??
ছিঃ
আমি তো কখনও সুইটি কে বন্ধুর বেশী কিছু ভাবিনি। আর ও কিনা——
আচ্ছা মেঘ ও তো একটা মেয়ে । শুধু মেয়ে বললে ভুল হবে ও আমার বিয়ে করা বউ । কই তবুও তো মেঘ কখনও সুইটির মত এমন কোন কাজ করেনি আমার সাথে ।
মেঘ তো পারতো জোর করে নিজের স্ত্রীর অধিকারটা আদায় করে নিতে কিন্তু সেতো তা করেনি। বরং আমি যখন যেটা
বলেছি সে তাই করেছে কোন কিছুর প্রতিবাদ ও করেনি।
আর সুইটি —ভাবতেও ঘৃনা হচ্ছে।
আমি এতদিন তাহলে ভুল মানুষের সঙ্গে বন্ধত্ব করলাম। যে কিনা আমাকে শুধু তার গ্রুপের তাস হিসেবে ব্যবহার করেছে।
রাতের কথা মনে করতেই সৈকতের কেমন যেন নিজের উপর ঘৃণা হতে থাকে।
সুইটি সৈকতের সেই কলেজ লাইফের ফ্রেন্ড একই সাথে দুজন বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ডিটাও শেষ করে ছিল। হঠাৎ করে একদিন নিজের পচ্ছন্দ করা ছেলেকে বিয়ে করে ফেলে সুইটি। পরিবার মেনে নেয় না। বিয়ের কিছুদিন পর বুঝতে পারে ছেলেটা নেশাখোর আর চরিত্র ও ভাল না। ভেবেছিল ওর স্বামী ভাল হয়ে যাবে কিন্তু
দুবছর ছেলেটার সঙ্গে সংসার করার পরও কোন পরিবর্তন না হওয়ায় চলে আসে ওকে ছেড়ে।
হঠাৎ একদিন সৈকতের সঙ্গে দেখা হয়ে যায় । সৈকত তার অবস্থা দেখে জানতে চাই কি হয়েছে ।
সুইটি তাকে সব কিছু খুলে বলতেই সৈকত সুইটিকে নিজের অফিসে চাকরির অফার দেই।
সুইটি চাকরিটা পেয়ে আকাশের চাঁদ হাতে পায় ।
সৈকত সুইটিকে সঙ্গে নিয়ে তার বাবা মা কে বোঝায় । যে সে ভুল করেছিল এখন সে তার ভুল বুঝতে পেরেছে।
সুইটির বাবা মা সৈকতের কথায় সব ভুলে ক্ষমা করে দেই সুইটিকে।
সৈকত সুইটি কে প্রমোশন দিয়ে নিজের পি এ বানিয়ে নেয় । এ জন্য অফিসের কাজের জন্য সুইটিও সৈকতের সঙ্গে সাত দিনের ট্যুরে যায়।
অফিসের কাজ একদিন আগেই শেষ হয়ে গিয়েছিল। সৈকত কাজটি শেষ করে ফিরে আসার জন্য প্লান ও করেছিল কিন্তু হঠাৎ সুইটি বললো এতদিন পর যখন একটু ঢাকার বাইরে এসেছি তখন একটু ঘুরেফিরে রাতটা থেকে তারপর সকালে না হয় যাওয়া যাবে । অনেকদিন নাকি সুইটি এভাবে সময় কাটাইনি।
তাই সৈকত আর কিছু না বলে রাজি হয়ে যায়।
সারাদিন এখানে ওখানে দুজন মিলে ঘোরাফেরা করে হোটেলে পৌছায় । রাতে দুজন এক সঙ্গে বসে ডিনার ও করে তারপর দুজন দু’রুমে ঘুমাতে চলে যায়।
সারাদিন দৌড়াদৌড়ির পর সৈকত কিছুটা ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। হঠাৎ দরজার টোকার শব্দে উঠে দরজা খুলে দেখে সুইটি দাড়িয়ে আছে
“হ্যাপি নিউইয়ার ২০১৮”
সৈকতের মনেই ছিল না যে আজ থার্টিফাস্ট নাইট। মনে থাকবেই বা কি করে সৈকত এগুলো কখনও পচ্ছন্দ করে না।
—কি হল ঢুকতে দেবে না ??
সৈকত দরজা থেকে সরতেই সুইটি রুমে ডুকে দরজা বন্ধ করে দেয়।
—আরে কি করছো??এত রাতে —
—কেন ভয় পাচ্ছো নাকি??
—কিসের ভয় ?
—এই যে এতরাতে হোটেল রুমে আমি তোমার রুমে এসেছি এটা যদি তোমার বউ জেনে যায় সেই ভয়ে ?
—কি যে বলো না সুইটি তুমি?
—কেন ভুল কি বললাম?তুমি যে হ্যান্ডসাম তাতে তো —
—শোন কে কি ভাবলো না ভাবলো তাতে আমার কিছু যায় আসে না। আমি কেমন সেটা আমি নিজেই জানি।
—তারপরও তোমার বউ যদি তোমাকে ভুল বোঝে বলেই সুইটি হো হো করে হাসতে থাকে।
সৈকত সুইটি কে কখনও বলেনি যে ও মেঘকে মেনে নেয় নি। ও মেঘকে তার জীবন থেকে চলে যেতে বলেছে।
সৈকত বলে তুমি এখন যাও আমি ঘুমাবো খুব ঘুমপাচ্ছে।
—একদম না। তাহলে এটার কি হবে ?বলে সুইটি পেছন থেকে হুইস্কির বোতলটা সৈকতের সামনে ধরে।
—না আমি আজ এসব খাবো না।
—আমি প্লান করে রেখেছিলাম আর তুমি কি না??
—না সুইটি প্লিজ।
—না আজ আর আমি তোমার কোন কথাই শুনবো না।
—আচ্ছা ঠিক আছে তবে খুব অল্প ।
—ওকে
সুইটি দুটো গ্লাসে হুইস্কি ঢেলে একটা সৈকতের হাতে দেয় আর একটা নিজে নিয়ে চেয়ার্স বলে পান করা শুরু করে ।
একটু পান করতেই সৈকত কেমন যেন চোখের সামনে সব ঝাপসা দেখতে শুরু করে।
মাথাটা ঝিমঝিম করে ওঠে সৈকতের।
তারপরের কিছু সৈকতের আর মনে ছিল না।
সকালে ঘুম ভাঙ্গতেই দেখে সৈকতের বুকের উপর মাথা রেখে সুইটি এলোমেলো হয় শুয়ে আছে ।
সৈকত বুঝতে পারে না সে ভুল দেখছে না সত্যি দেখছে।
কিছু সময় ঘোরের মধ্যে কাটিয়ে লাফ মেরে ঠেলে ওঠে সৈকত।
সুইটির ঘুম ভেঙ্গে যায় । সৈকতকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে নিজের দিক তাকিয়ে লজ্জা পায় সুইটি।
সৈকত বলেঃ
—আমি এখানে এই রুমে কি করে এলাম??
—তোমার মনে নেই?
—আমি তো আমার রুমে ছিলাম।
—হ্যা, তুমি তোমার রুমে ছিলে । কিন্তু আমি তোমার সাথে ড্রিংকস শেষ করে এসে আমার রুমে আসতেই —
—কি আসতেই??
—তুমি আমার দরজায় টোকা দিলে আমি দরজা খুলতেই তুমি আমাকে জড়িয়ে ধরে —
—স্টপ ইট। কি বলছো তুমি এসব?
—হ্যা সৈকত আমি ঠিকই বলছি ।
—না,সবটা মিথ্যা । তোমার নিশ্চয় কোন ভুল হচ্ছে?
সুইটি একটু ইমোশনাল হয়ে বললোঃ
—তুমি ঠিকই বলছো সবটা মিথ্যা। আমারই ভুল।
—কি বলতে চাইছো??
—দেহটা হয়তো আমার ছিল কিন্তু তুমি মেঘ কে অনুভব করেছ। হুইষ্কি পেটে পড়ার পর তুমি আমাকে তোমার চোখে মেঘ দেখেছ। শুধু মেঘ মেঘ করে সারা রাত পার করেছ।
সৈকতের মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। সে যে খারাপ সে তা জানে কিন্তু সে এতটা নীচে নামবে ??না ,না এটা কখনোও সম্ভব না। এত বছর ধরে আমি এসব ছাইপাস গিলছি কিন্তু কই এর আগে কখনই তো এমন কিছু হয়নি । তাহলে আজ কি করে!!??
সৈকত আর একটা মুহূর্ত দেরি না করে নিজের রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে পড়ে বাসার উদ্দেশ্য।
সারা পথ শুধু ভেবেছে কিভাবে কি হয়ে গেল? কিন্তু কোন উত্তর খুজে পাই নি সৈকত।
হঠাৎ রোজির কথায় বাস্তবে ফেরে সৈকত
—কি রে কখন এলি ??
—এইতো কিছুক্ষণ আগে।
—কাজ টা কি ঠিক করলি!!?
ভাবির মুখে এমন কথা শুনে সৈকত চমকে ওঠে । মনে মনে ভাবে ভাবি কি তবে জেনে গেছে এসব?? এটা কিভাবে সম্ভব?আমি বাসায় আসার আগে কি কেউ ——
—কি হল বল কাজটা কি ঠিক করেছিস??
—কি করেছি আমি?কোন কাজের কথা বলছো??
—তুই মেঘ কে কি বলেছিস? যার জন্য তুই চলে যেতেই বাবাকে বলে বাবার কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে বাড়ি গেছে মন খারাপ করে ।কেও কারণ টা না বুঝতে পারলেও আমি বুঝতে পেরেছি । নিশ্চয় তুই ওকে বকাবকি করেছিলি যার জন্য ও—-
ভাবি কথায় কথাই সৈকত হাফ ছেড়ে বাঁচলেও মেঘের চলে যাওয়ার কথা শুনে সৈকতের বুকের ভিতরটা কেমন যেন একটু ব্যথা অনুভব করে । এ জন্যই কী তাহলে বাড়ি ফেরার পর থেকে সৈকতের মনে হচ্ছিল কি যেন নেই আর নিজের রুমে ঢুকে মনে হচ্ছিল রুমটা বড্ড ফাঁকা ফাঁকা লাগছে।
—কি হলো ?কি ভাবছিস এত??কিছু বলেছিলির মেঘ কে ?
সৈকত একটু চুপ থেকে বলে না আমি কিছু বলিনি। আমি কেন কিছু বলতে যাবো?দেখ হয়তো বাবা মার জন্য খারাপ লাগছে তাই চলে গেছে ঘুরতে ।
—এই সত্যি করে বলতো তোদের দুজনের কি হয়েছে??
—কি হবে !!!কিছু হয়নি তো।
—তাহলে মেঘ কেন তুই যেতে না যেতেই হুট করে তোকে না জানিয়ে চলে গেল।
—কে বলছে আমি জানিনা??আমি জানিতো । ও রাতে বলেছিল যে বাবা মায়ের জন্য মনটা কেমন করছে । তাই আমি ওকে বলেছিলাম কিছুদিন বাড়ি গিয়ে ঘুরে আসতে ।
—ওহ্ঃ যাক বাবা বাচালি আমায়।
—আমি তোমাকে মেরে ফেললাম কখন যে বাচাবো?
—এই ইয়ার্কি করিস নাতো। আমি তো ভেবে ছিলাম তোদের দুজনের কিছু হয়েছে তাই ——
আচ্ছা আরেকটা কথা
—আবার কি কথা(বিরক্তি নিয়ে)
—তোদের দুজনের বিয়ের পর এভাবে ওকে একা যেতে দেওয়া ঠিক হয়নি। ওর বাড়ির সবাই কি মনে করবে বলতো??
—তুমি নিজেই যদি এতকিছু মনে করো ভাবি তাহলে মেঘের বাড়ির লোক আর কী মনে করবে। এবার না হয় ওদের ভাববার জন্য কিছু রাখ——
—তুই না পারিস ও। ঠিক আছে নীচে আই আমি তোর খাবার দিতে বলি।
—না ,ভাবি আমি এখন খাব না । ক্ষুদা নেই।
—এতটা পথ জার্নি করে এলি আর এখন বলছিস ক্ষুদা নেই?নাকি মেঘ চলে যাওয়ার কথা শুনে–
—আচ্ছা ঠিক আছে তুমি খাবার টা কাওকে দিয়ে পাঠিয়ে দাও আমি খেয়ে নিব।
—এইতো দেখলি!!মেঘ বাসা থেকে দুদিন যেতে না যেতেই আবার তুই আগের মত শুরু করেছিস।
এবার সৈকতের একটু বেশি রাগ হলো
—আচ্ছা কি শুরু করেছ বলতো আসার পর থেকে শুধু মেঘ মেঘ করে যাচ্ছো । এ বাড়িতে কি এই নামটা ছাড়া আর অন্যে কিছু নেই???
রোজি সৈকতের রাগান্বিত ভাব দেখে বলে আচ্ছা ঠিক আছে আমি তোর খাবার পাঠিয়ে দিচ্ছি।
—না ,থাক লাগবে না । আমি নিজেই আসতেছি।
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here