বেখায়ালি ভালোবাসা পর্ব-১

0
5312

#বেখায়ালি_ভালোবাসা,
#পর্ব_১ম
লেখিকা:#সাবেরা_সুলতানা_রসিদ
.
ফাস্ট ক্লাস কুপে কামরায় হানিমুনটা শুরু থেকেই নবদম্পতির প্রেমটা জমে ক্ষীর হবার কথা । একদিকে তরতাজা সুদর্শন একটা যুবক অন্য দিকে সুন্দরী টগবগে তরুনী। কিন্তু প্রেমটা কেন জানি জমলো না। ট্রেনটা স্টেশন থেকে ছাড়তেই সৈকত তার লাগেজের জামাকাপড়ের তলায় সযত্নে শোয়ানো বোতলটি বের করে বসে গেল এবং খুব নিবিষ্টমনে প্রায় একনাগাড়ে মদ খেয়ে যেতে লাগল।
ফলে খাওয়ার পানির বোতলটা কিছুদূর যেতে না যেতেই শেষ।
মেঘ সেটা দেখেও না দেখার ভান করে জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করছে। আড়চোখে সৈকত কে দেখছে আর মনে মনে ভাবছে এ কার সঙ্গে বিয়ে হল তার??
একজন নেতা এবং বড়লোকের ছেলে,এই পরিচয় দেখেই কি বাবা সৈকতের সঙ্গে বিয়ে দিল তার? আর কোন খোঁজখবর করল না?
সৈকত সুপুরুষ সন্দেহ নেই। মেঘ এও জানে,খাওয়া-পরা বা বিলাস-বাসনের কোনো অভাব তার হবে না। কিন্তু সেটাই তো সব নয়।
এ লোকটা বিয়ের দিন থেকেই গন্ডগোল করে যাচ্ছে।
বিয়ের দিন যখন সাজগোজ করানো হচ্ছে মেঘকে সেই সময় একবার খবর এলো সৈকত কে বাড়িতে পাওয়া যাচ্ছে না।
বিয়ের দিন বরের বাড়ির সবাই যখন কনে বাড়িতে চলে এসেছে হঠাৎ করে শোনা গেল বর পালিয়েছে।
মেঘের বড় ভাই পরে নিজে গিয়েছিল মেঘের শ্বশুরবাড়ি কিন্তু সেও হতাশা নিয়ে ফিরে এল সৈকত কে না পেয়ে।
মেঘ কে বউ সাজিয়ে বসিয়ে রাখা হয়েছে।মেঘের কানে যখন কথাটা পৌছাল তখন মেঘ মনে মনে খুশিই হয়েছিল । কারণ মেঘ বিয়েটা এত তাড়াতাড়ি করতে চাইনি।বয়স যে খুব বেশি তাও না (১৯)। সবে উচ্চ ম্যাধমিক শেষ করে বি বি এ তে ভর্তি হয়েছে । মেঘ গ্রাজুয়েসন টা শেষ করে তারপর বিয়ের পিড়িতে বসতে চেয়েছিল কিন্তু হঠাৎ করে নেতা নিজে এসে মেঘের বাবাকে তার ছেলের জন্য বউ করে নিতে চাইলো বাড়ির সবাই একটু সময় চাইলেও মেঘের বাবা আর দেরি করলেন না। এমনকি তিনি তার মেয়ের মতামতটা ও নিলেন না বিয়ের দিন ঠিক করে ফেললো।
এদিকে সন্ধ্যা পেরিয়ে যেতে লাগলো বিয়ে বাড়ির সবাই গুজগুজ হুসহুস করছে। বরের বেপাত্তা হওয়ায় সবাই ঘাবড়ে গেছে। বরের বাড়ির লোকের মুখের কথায় তাদের আরোও ভীত করে তুলল।
তবে রায়হান চৌধুরী(শ্বশুর)অতি ক্ষমতাবান লোক। বাড়িতে বসে শুধু টেলিফোন করে রায়হান তার লোকজনকে সক্রিয় করে তুললেন। সব জায়গায় লোক পাঠিয়েছেন তার ছেলেকে খুজে আনার জন্য। পুলিশ থেকে শুরু করে তার দলের সব নেতাওকর্মীদের কানে কথাটা পৌছাতে তারা ও হন্যে হয়ে সৈকতকে খুজতে শুরু করেছে। রাত নয়টার দিকে সৈকতকে একটা খাবার হোটেলের ভিতর থেকে এটো হাতে তুলে আনা হলো ।
পরনে নীল জিন্স আর সাদা একটা টি-শার্ট। বিয়ে বাড়ির সবাই দেখে মিচকি মিচকি হাসতে শুরু করল।
তাড়াতাড়ি করে কোনরকমে কাপড় পাল্টে তাকে কনের পাশে বসিয়ে বিয়ে পড়ানো হলো সবাই যখন নতুন দম্পতির সুখে থাকার জন্য মোনাজাত করছে আর সৈকত তখন রাগে গজগজ করছে। মেঘ তখনই জানত বাবা সব জেনেশুনে তাকে হাত পা বেধে পানিতে ফেলে দিল। এটা বিয়ে নয়। এই লোকটা হয় পাগল,নয় বদমাশ । সারা জীবন একে স্বামী হিসাবে কল্পনা করাও তার পক্ষে কষ্টকর হবে।
পরে শোনা যায় সেই শুভ দিনে ছেলেকে ধরে আনার পর রায়হান চৌধুরী নিজের হাতে তাকে জুতো পেটা করেন।
মেঘকে ফুলশয্যার ঘরে বসিয়ে দিয়ে সবাই একে একে বিদায় নিয়ে চলে গেছে। মেঘ নিজের লম্বা ঘোমটা সরিয়ে ঘরের চারিদিক টা চোখ বুলিয়ে চুপ করে বসে আছে।
একটু বাদে সৈকত ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে আলমারি থেকে একটা বিয়ারের বোতল বের করে টেবিলে রেখে চেয়ার টেনে বসলো।
সৈকতের ঘরে ঢোকা দেখে মেঘ নিজের ঘোমটা টেনে দিয়েছিল। ঘোমটার ভিতর থেকেই মেঘ সৈকতের কাজ দেখে অবাক হয়ে গেল ।
হঠাৎ সৈকত বললোঃ
—খাবার ঘরের ফ্রিজ থেকে বরফের ট্রেটা আর একবোতল ঠান্ডা পানি নিয়ে এসো।
সৈকতের কথাটা শুনে মেঘ ঘোমটা সরিয়ে চোখ বড় বড় করে সৈকতের দিকে তাকিয়ে বললোঃ
—আপনার লজ্জা করছে না নতুন বউকে পানি আনতে বলছেন তাও আবার মদ গেলার জন্য!!তাও আজ??
—খেলে কী?রোজ খায় আজ নয় কেন?
—আজকের দিনেও খায় কেউ!!?
মুখটায় রাজ্যের বিরক্তি ফুটিয়ে সৈকত বললঃ
—প্যান প্যান করো না। নিজে না পারো তো একটা চাকরবাকর কাউকে বলো। এনে দেবে।
—আমি!!?
—হ্যা ,তুমি ছাড়া এখানে কেই বা আছে যাকে বলবো।
মেঘ আর রাগ সামলাতে পারলো না।
এমনিতে মেঘ রাগী আর জেদী টাইপের আর তারপর কপালে যুটেছে এরাকম এক হতচ্ছাড়া বর। বিয়েটা নিয়ে মেঘের মনে কত স্বপ্ন ছিল বর হিসাবে চেয়েছিল খুব রোমান্টিক কাউকে কিন্তু সব স্বপ্ন সব চাওয়া ধূলিসাত্ হয়ে গেল।
রেগে বললঃ
—আমি পারবো না।
সৈকত একটু স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল মেঘের দিকে। তবে বাড়াবাড়ি করল না। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে চোখ নামিয়ে নিয়ে বলল ,তুমি বেশ সুন্দরী । তবে তোমাকে কিন্তু আমি নিজে পচ্ছন্দ করে আনিনি। সুতরাং আমার বেশী দায়দায়িত্ব নেই।
মেঘ একটু দাপটের সঙ্গে বললোঃ
—আপনার দায়দায়িত্বের বোধ আমি জানি। আমাকে আর বোঝাতে হবে না।
সৈকত এই কথায় অনেকক্ষন চুপ করে বসে রইল। গোলাপ আর রজনীগন্ধা ফুলে সাজানো ঘর মাতাল হয়ে উঠছিল গন্ধে। দামি পারফিউম ছড়ানো বিছানা অপেক্ষা করছিল তাদের জন্য।
এসিতে ঘরের তাপমাত্রা ঠান্ডা হয়ে ছিল। সেই অদ্ভুত মাদকতাময় ঘরে বিছানায় পা তুলে শিকারী বিড়ালের মতো তীব্র চোখে মেঘ লক্ষ্য করছিল সৈকতকে। এই লোকটা কোনদিন তাকে ছুয়ে দেখবে বা আদর সোহাগ করবে ভাবতেও গা ঘিন ঘিন করছিল তার।
অনেকক্ষন চুপ করে অনড় হয়ে বসে রইল সৈকত। তারপর চেয়ারটা মেঘের দিকে ঘুরিয়ে বসল।
মেঘ দেখল সৈকতের মুখে রাগ নেই,বিদ্বষ বা ঘৃনাও নেই। এক ধরনের তীব্র ও গভীর বিষণ্ণতা আছে।
সৈকত ধীর স্বরে বললোঃ
— আচ্ছা তোমার নামটা যেন কি??
—যাকে বিয়ে করেছেন তার নামটাও জানেন না!!?
—হু একবার শুনেছিলাম মেঘ না যেন কি?
—না ,আমার নাম বঙ্গবাসীনি।
—এত রেগে যাচ্ছো কেন?
—তা কি করবো!!?
সৈকত মেঘের দিকে তাকিয়ে একটু হাসল।
—আচ্ছা নামটা আমার জানা উচিত তাই না?
—আপনি কি উচিত অনুচিত মানেন?
সৈকত রাগলো না। ধীর স্বরে বললোঃ
—ঠিক আমার মতো অবস্থায় না পড়লে তুমি কখনোই আমার সমস্যার কথা বুঝতে পারবে না মেঘ। আমাকে ঘৃনা করা খুব সহজ। এই বাড়ির সকলে আমাকে ঘৃনা করে । কারণ তাদের সেটা শেখানো হয়েছে।
কথাটা মেঘ ভাল বুঝল না। তবে চুপ করে রইল।
সৈকত নিজেই খানিকক্ষন বিরতি নিয়ে বলে,
—আমার মা নেই জানো?
মেঘ বললঃ
—আপনার মা নেই তাতে কি!?অনেকেরই থাকে না।
—ঠিক কথা। কিন্তু আমার মায়ের এখনো বেচে থাকার কথা ছিল। মা গায়ে আগুন লাগিয়ে মারা যায়। আমি তখন ছোট,বছর দশেক বয়স হবে হয়তো। পুরাতন বাড়িতে থাকতাম। বাথরুমে ঢুকে মা গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন দেয়। সব পুড়ে গেল কিন্তু মা একটা শব্দ ও করেনি। হান্ডেড পারসেন্ট বারনিং,হাসপাতালে তিন দিন বেচে থেকে মারা যায়। সেই মৃত্যুটা যতদিন মনে থাকবে ততদিন তোমার শ্বশুরের সঙ্গে আমার লড়াই শেষ হবে না।
মেঘ বুঝতে পারছিল না। বললোঃ
—কিসের লড়াই ??
—লড়াইটা বহুমুখী কারণ বহু কিছুর জন্য ঐলোকটা দায়ী। লোকটা ক্ষমতালোভী, নিষ্ঠুর ,অহংকারী। জানো এসব?
—না । মাথা নাড়ল মেঘ।
—ধীরে ধীরে জানবে।
—তবে এই লোকটা নিজের দেশ ও মানুষকে বাস্তবিকই ভালবাসে ।
মেঘ এই শ্বশুর প্রসঙ্গ খুব উপভোগ করছিল না। ছেলের মুখে বাবার নিন্দে এমনিতেও সুস্বাদু নয়। মেঘ বললো আমার মাথা ধরেছে আমি একটু ঘুমাবো।
সৈকত উদাস স্বরে বলল,এ বাড়িতে যে ঘৃনার জীবাণু ঘুরে বেড়াছে তাও তোমাকে অ্যাটাক করেছে বুঝলে!?সেটাই অবশ্য স্বাভাবিক । এনি ওয়ে তুমি ঘুমিয়ে পড়ো। আমার বোধহয় আজ রাতে আর ঘুম আসবে না।
মেঘ শুয়ে পড়লো এবং একসময় ঘুমিয়েও পড়লো। খুবসকালে তুমুল চেঁচামেচিতে ঘুম ভাঙল তার।
.
(চলবে…….)
,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here