বেখায়ালি ভালোবাসা পর্ব-২

0
3970

#বেখায়ালি_ভালোবাসা,
#পাট_২
লেখিকা:#সাবেরা_সুলতানা_রসিদ
.
চেচামেচির শব্দে ঘুম ভেঙ্গে মেঘের বুকের ভিতর কেমন ধড়ফড় শুরু হল। কোন রকম বিছানা থেকে নেমে বেলকনিতে এসে দাড়িয়ে দেখল সৈকত বাগানে দাড়িয়ে চিলাচ্ছে আর ওকে বাসার দু-তিন জন সিকিউরিটি গাড ধরে রেখেছে।
একটু পরে রায়হান চৌধুরী সৈকতের সামনে গিয়ে জিঙ্গাসা করলেনঃ
—কি হয়েছে এভাবে ষাড়ের মত চেচাচ্ছ কেন?
—আপনার লোকেরা আমাকে জোর করে ধরে রেখেছে কোথাও যেতে দিচ্ছেনা।
—ওদের কে আমি বলেছি তোমাকে সবসময় নজরে রাখতে যাতে কোথাও পালিয়ে না যাও।
—আমি কোথাও পালিয়ে যাচ্ছি না। একটু হাটতে বেরিয়েছি।
—পালানোর চেষ্টা করলেও তুমি তা পারবে না। এখন উপরে যাও হয়তো বউমা এতক্ষনে উঠে গেছে তাকে গিয়ে সময় দাও।
সৈকত আর কোন কথা না বলে চুপকরে সেখান থেকে চলে আসে ।
মেঘ যে একটু আগের ঘটে যাওয়া দৃশ্য গুলো দেখেছে তা সৈকত কে বুঝতে দেয়না তাড়াতাড়ি করে বেলকনি থেকে রুমে এসে ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নেই।
মেঘ দেখে সৈকত গম্ভীর হয়ে বসে আছে নাক লাল হয়ে আছে মনে হচ্ছে রাগে সারা শরীর জ্বলছে সৈকতের । সৈকতের লম্বা নাকটা ওর নিশ্বাসের সাথে ফুলছে আর কমছে।
সৈকতের নাকের দিক তাকিয়ে মেঘের মনে মনে খুব হাসি পাচ্ছে।
কিন্তু সেটা সৈকতকে বুঝতে না দিয়ে বললোঃ
—কখন উঠেছেন ঘুম থেকে?
—উঠিনি।
—মানে!!?
—ঘুমালে উঠতাম না ঘুমালে কেমন করে উঠবো??
—তার মানে আপনি সারা রাত জেগে ছিলেন ??
—হ্যাঁ ।
মেঘ এতক্ষন খেয়াল করেনি। সৈকতের কথা শুনে বিছানার দিকে তাকিয়ে দেখে সত্যিসত্যিই সৈকত রাতে ঘুমায়নি তার বিছানার জায়গা টুকু তেমনই আছে শুধু মেঘ নিজে যেখানে ঘুমিয়ে ছিল সেখানের চাদর টুকু দলা হয়ে আছে।
—কেন ঘুমান নি??
—সেটা জেনে তোমার কি কাজ??যা করছো তাই করোনা আমার কোন বিষয়ে তোমাকে ইন্টারফেয়ার করতে হবে না।
কথাটা একটু উচ্চস্বরে বলে সৈকত।
মেঘ সৈকতের কথাটা শুনে মনে মনে কষ্ট পায় । ছোট থেকে কোনদিন এ পর্যন্ত তার বাড়ির মানুষ মেঘের সাথে এমন উচ্চস্বরে কথা বলেনি আর আজ বিয়ে হয়ে আসতে না আসতেই নিজের স্বামীর কাছে চোখ রাঙানী দেখতে হচ্ছে।
মেঘ আর কোন কথা না বাড়িয়ে শাড়িটা ঠিক করে পরে চুলগুলো আচড়ে নেই। তারপর চোখে কাজল দিয়ে আয়নার সামনে গিয়ে হালকা সেজে নেয় ।
হঠাৎ রুমের দরজায় টোকার শব্দ হয়
—ভাবি আসবো ??(সৈকতের ছোট বোন ঝিনুক)
—এসো।
—নাস্তা করবে চলো। সবাই তোমাদের জন্য নিচে অপেক্ষা করছে।
মেঘ আড়চোখে সৈকতের দিকে তাকিয়ে দেখে সৈকত রাতে রাখা সেই বোতলটা হাতে নিয়ে খোলার চেষ্টা করছে। বোতলটা রাতে যেমন ছিল তেমনই আছে। মেঘ ভাবে তার মানে রাতে ঐকথা বলার পরে সৈকত মদটা না খেয়ে ছিল !!
মেঘ ঝিনুকের দিকে তাকিয়ে বলে চলো।
ঝিনুক একটু এগিয়ে যেতেই মেঘ সৈকতের কাছাকাছি এসে ইচ্ছে করে হোচট খায় ।
ফলে সৈকতের হাত থাকা বোতলটা ততক্ষনে ফ্লোরে পড়ে ——
ঝিনুক কাচভাঙ্গা শব্দে পিছন ফিরে তাকাই।
সৈকত বসা থেকে উঠে দাড়িয়ে বলেঃ
—এই এটা তুমি কি করলে??
—সরি আসলে বুঝতে পারিনি শাড়িটা পায়ের নীচে পড়ে হোচট খেয়েছি।
—আমি কিছু বুঝিনা ভেবেছ!!
মেঘ সৈকতের কথা শুনে মনে মনে ভাবে ধরা খেয়ে গেলাম । পড়ে যাওয়ার আসল উদ্দেশ্য উনি বুঝে ফেলেছেন। এখন কি হবে!!?
—ভাইয়া তুই ভাবির উপর কেন রাগ করছিস?শাড়ি পরার অভ্যাস নেই তাই হয়তো
—এই তুই চুপ কর। আমি সব জানি গতকাল রাতে আসার পর থেকেই আমার পিছনে লেগেছে।
মেঘ মনে মনে হাফ ছাড়ে তবুও ভাল যে সৈকত তার এ্যাক্টিংটা বুঝতে পারেনি।মনে মনে নিজেকে বাহবা দিয়ে বলে চালিয়ে যা মেঘ ।
মনে আনা কথা গুলো চেপে রেখে তাড়াতাড়ি বলে সত্যিই আমি ইচ্ছা করে কিছু করিনি বলে নীচু হয়ে ফ্লোরে পড়ে থাকা কাচের টুকরো উঠাতে শুরু করে ।
সৈকত মুখ বাকিয়ে একটা বিদ্রুপ হাসি দিয়ে সরে বেলকনিতে গিয়ে দাড়ায়।
— ভাবি তুমি কেন এসব করছো?উঠো এ বাড়িতে অনেক লোক আছে এসব পরিষ্কার করার জন্য।
মেঘ উঠে দাড়ায় । ঝিনুক একটা কাজের মেয়েকে ডেকে সব পরিষ্কার করে দিতে বলে।
—ভাইয়া তুই যাবি না নাস্তা করতে।
—তোরা যা আমার খেতে ইচ্ছা করছে না বলে প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে টান দেয় সৈকত।
ঝিনুক আর কথা না বলে মেঘ কে সাথে নিয়ে নীচে ডাইনিং এ চলে আসে।
রোজী(বড় ভাবী)হেসে মেঘের কাছে এসে আস্তে করে বলে
—কি ?কেমন হলো ঘুম??
—জ্বী ,ভালো।
—সত্যিই ভালো!না—–
মেঘ প্রথমে বুঝতে না পারলেও এবার বুঝলো যে আসলে ভাবী তাকে কোন উদ্দেশ্য নিয়ে কথাটা বলেছে। কথাটা বুঝে মেঘ লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেললো।
ডলি(মেঝ ভাবি) দেখেছো ভাবি কেমন লজ্জা পেয়ে মুখটা লাল হয়ে গেছে।
সৈকতরা তিন ভাই এক বোন। ভাইয়েদের মধ্যে সৈকত ছোট আর ঝিনুক সৈকতের ও ছোট। তিন ভাইয়ের এক বোন খুব আদরের ।
রায়হান চৌধুরী একটা কাশি দিয়ে খাবার টেবিলের কাছে এগিয়ে এলেন। সঙ্গে সঙ্গে সবাই চুপকরে মাথা নিচু করে যার যার কাজ করতে শুরু করলো।
রায়হান চৌধুরী যতই ব্যস্ত সময় কাটান না কেন তার প্রতিদিনকার কাজ হচ্ছে সকালে সবার সাথে বসে নাস্তা করা। সবার ভালমন্দ জিঙ্গাসা করা। কারো কোন অসুবিধে হচ্ছে কিনা তা যাচাই করা। তার বড় দুই ছেলের ব্যবসা কেমন চলে তা খোজখবর নেওয়া। আর তার সবচেয়ে বড় যে কাজ সেটা হচ্ছে অনি (বড়ছেলের ছেলে)কে কোলে নিয়ে বসে খাইয়ে দিয়ে নিজে নাস্তা করা।
রায়হান চৌধুরী বলে সে কোথায় তাকে তো দেখছি না।
—ভাইয়া খাবেনা বলেছে।
—এ আর নতুন কি এই চৌদ্দ পনের বছর থেকে শুনে আসছি। তবুও আজকে ভেবে ছিলাম যে সে হয়তো আজ আসবে কিন্তু আসলো না বলে ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন চৌধুরী।
মেঘ তার শ্বশুরের কথা শুনে বুঝতে পারে যে এই মানুষটার বুকের মধ্যে কোথাও একটা কষ্ট আছে তার ছোট ছেলেকে নিয়ে। আর উনি যে তাকে বেশ ভালবাসে তাও বোঝা যাচ্ছে।
রোজি সবাইকে খাবার পরিবেশন করছে হঠাৎ মেঘ বসা থেকে উঠে রোজির কাছে গিয়ে বলে ভাবী আপনি বসুন আমি দিচ্ছি।
—আরে না তুমি বসো। খেয়ে নাও গতকাল কখন খেয়েছ তার কোন ঠিক নেই।
—না ভাবি আমার অসুবিধে হবে না ।
—আচ্ছা ঠিক আছে তাহলে দুজনে করি।
মেঘ খুশি হয়ে সায় দিল।
নাস্তা শেষ করে চৌধুরী বেরিয়ে গেলেন। তারপর তার ছেলেরা যার যার অফিসে চলে গেল আর ঝিনুক কলেজে ।
বাড়িটা এখন অনেকটা ফাকা।
রোজি মেঘের কাছে এসে চলো এবার কিছু খেয়ে নেবে।
আপনি খেয়ে নিন আমি পরে খাবো।
উুহ বুজেছি সৈকতের জন্য বসে আছো তাইনা!?
মেঘ কোন কথা না বলে চুপ করে থাকে।
—আচ্ছা বাবা ঠিক আছে ওতো লজ্জা পেতে হবে না।
তবে কিছু কথা বলি মন দিয়ে শোন।
—বলুন।
—আমি যখন থেকে এ বাড়িতে এসেছি তখন থেকে সৈকত কে দেখছি ও খুব রাগি আর একগুয়ে টাইপের । এই ভাল এই মন্দ। তবে ওর মনটা খুব ভাল। উপর থেকে দেখলে যতোটা শক্ত মনে হয় আসলে ওর ভিতরটা ততটাই নরম। আমার তো মাঝে মাঝে মনে হয় ও শ্বশুরের পতিচ্ছবি। আমাদের শ্বশুর ও কিন্তু এমনই। বাড়ির সবাই ওনাকে ভয় পায় সাথে সম্মান ও করে ।
আমি এত বছরেও বাবা আর সৈকতের মাঝের যে দেওয়ালটা আছে সেটা ভাঙ্গতে পারিনি আর কিসেরই দেওয়াল সেটাও জানিনা। তবে সৈকত মুখে কিছু না বললেও বাবাকে যে অনেক ভালবাসে তা বুঝতে পারি কিন্তু ও সেটা নিজে মুখে কখনও স্বীকার করে না।
ওর ব্যবহারে কোন রকম কষ্ট পাস না যেন।
মেঘ চুপচাপ শুনতে থাকে।
একটু পরই ডলি(মেজ ভাবী )এসে বড় ভাবীর কে বললো ভাবী আমি একটু বেরোচ্ছি।
—আজ আবার কোথায় যাচ্ছিস।
—আর এক বান্ধবীর সঙ্গে দেখা করার কথা । তারপর কিছু কেনাকাটা আছে।
—আচ্ছা আজ না গেলে হয় না?
—কেন??
—মেঘ এ বাড়িতে নতুন বউ হয়ে এসেছে আজ না হয় একে একটু সময় দে।
—কি যে বলোনা ভাবি । ওকি পালিয়ে যাচ্ছে নাকি ও তো থাকছেই ।
—আচ্ছা আর বলতে হবে না তুই যা।
ডলি চলে গেল।
ডলি বাড়ির মেঝ ছেলের বউ হলে কি হবে এমন ভাবে চলাফেরা করে মনে হয় সে এ বাড়িরই মেয়ে । একটু বেশী মর্ডান। যখন যা মন চায় তখন সেটা করে ।বন্ধু আর বান্ধবীদের নিয়ে বেশি সময় কাটাই । আজ এ পার্টি কাল ও পার্টি আজ এর জন্মদিন কাল ওর জন্মদিন এসব নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করে সে।
আর রোজি তার কোন তুলনা নেই। বড় বউ হিসাবে তার যা করার দরকার তার থেকে বেশি করে । সকালে ঘুম থেকে উঠে রাতে ঘুমাতে যাবার আগ পর্যন্ত সে এ বাড়ির সবকিছু দেখাশোনা করে । তার নিজের হাতে তেমন কাজ না করতে হলেও পুরোবাড়ির সব দায়িত্ব একরকম তার উপর । কাজের লোকদের সব বুঝিয়ে দেওয়া। কি করতে হবে কি না করতে হবে সে সবটা নিজে দেখিয়ে দেয় ।
যাকে এক কথায় বলা চলে আর্দশ বউ।
মেঘ বসে সৈকতের কথা ভাবতে থাকে।
হঠাৎ রোজির ডাকে তার ভাবনার ছেদ পড়ে এই নে দুজনের নাস্তা সাজিয়ে দিয়েছি নিয়ে দুজনে খেয়ে নে।
মেঘ নাস্তার ট্রে হাতে নিয়ে আচ্ছা বলে সেখান থেকে উপরে নিজের রুমে চলে আসে।
রুমে ঢুকে দেখে সৈকত কাত হয়ে ঘুমিয়ে আছে। ঘুমের মধ্যে মাথাটা বালিস থেকে পড়ে গেছে।
মেঘ দুরে দাড়িয়ে অনেকক্ষন সময় নিয়ে একদৃষ্টিতে সৈকতের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।
সৈকতের ফর্সা গায়ের রঙ ।
রাত জাগার জন্য চোখের নিচে একটু কালো হয়ে গেছে। ঠোট দুটো বাচ্চাদের মতো লাল । চুল গুলো এলোমেলো হয়ে আছে। মুখে কেমন যেন বিষণ্ণতার ভাব।
মেঘের মনে সৈকতের জন্য যে রাগ ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছিল বিয়ের দিন থেকে তা যেন একনিমিষে কোথায় উধাও হয়ে গেল। মেঘ আস্তে করে সৈকতের কাছে গিয়ে দুহাতে মাথাটা বালিসে তুলে দেয়। মেঘের ইচ্ছে করছে সৈকতের কপালে একটা আদর দিতে কিন্তু সৈকত যদি জেগে যায় তাহলে কি ভাববে!!এই ভয়ে চুপ করে সরে আসে।
হঠাৎ মেঘের ফোনটা বেজে ওঠে——–
(চলবে….)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here