বেখায়ালি ভালোবাসা পর্ব-২১

0
1994

#বেখায়ালি_ভালোবাসা,
#পর্ব_২১
#লেখাঃসাবেরা_সুলতানা_রশিদ
.
মেঘ একা একা ছাদে এসে দাড়িয়ে রাতের ঘুমন্ত শহর দেখতে থাকে । হঠাৎ কাঁধে কারো হাতের স্পর্শে পিছন ফিরে দেখে ওর ভাইয়া দাঁড়িয়ে আছে।
—কিরে এত রাতে এই ঠান্ডায় একা ছাদে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?
—ঘুম আসছিল না তাই ভাবলাম একটু পায়চারি করলে যদি ঘুম আসে। তা তুমি এখানে কেন!?
—তোকে রুমে গিয়েছিলাম খুঁজতে দেখি রুমে নেই। তখন মনে হল তুই ছাদে আছিস তাই চলে এলাম। আচ্ছা বোন সেদিন কি যেন বলতে চেয়েছিলি কিন্তু বলিস নি।
—হ্যাঁ তোমাকে কিছু কথা বলার ছিল ভাইয়া,কিন্তু সেদিন হঠাৎ আম্মু চলে এসেছিল কথার মাঝে তাই আর বলা হয়ে ওঠেনি।
—তাহলে এখন বল।
মেঘ কি যেন ভেবে নিয়ে বলে ভাইয়া সুইটি ফিরে এসেছে।
—সুইটি!!!???
—হ্যাঁ সুইটি।
—কোথায় !!??
—ভাইয়া ও আগে তোমার জীবনটাকে নরক করে চলেগিয়েছিল এখন সে আবার আমার জীবনটা নরক করে দিতে ফিরে এসেছে।
—মানে!!??
মেঘ সব সংক্ষেপে বলে ওর ভাইয়াকে ।
—তুই কি জানিস সৈকতের সাথে ওর কিসের সম্পর্ক ??
—না ভাইয়া আমি জানি না। তবে এতটুকু জানি যে ও সৈকতের পি এ।
—সুইটি কি তোকে দেখেছে?
—না ও আমাকে দেখে নি। কিন্তু আমি ওকে দেখেছি । প্রথম দেখায় চিনতে পারিনি কারণ সেদিন খুব দূর থেকে দেখেছিলাম। কিন্তু সেদিন যখন সৈকত অফিসের কাজে বাইরে যাচ্ছিল সেদিন কাছ থেকেই দেখেছি । কিন্তু ও আমাকে দেখে নি।
—কেউ কি ওর আগের অতীতের কথা জানে তোর শ্বশুরবাড়ির লোকে?
—মনে হয় না। আর আমিও কাউকে কিছু জিঙ্গাসা করিনি।
—ঐ লোভী মেয়েটা আমার জীবনটা নিয়ে খেলা করেছে । আমি কিছুতেই ওকে তোর জীবন নিয়ে খেলা করতে দিব না। তারজন্য আমার যা করার আমি সব করবো।
—আমার খুব ভয় করছে ভাইয়া।
—কেন রে বোন এই ভাই থাকতে তোর এত ভয় কিসের?আমি আছিতো আমি সব সামলে নিব।
—কিন্তু ভাইয়া–
—কোন কিন্তু না। ভয় নেই তোর ভাইয়া এখন আর আগের মত নেই। এখন সে বাস্তবটাকে মেনে নিয়ে অনেক কিছু বুঝতে শিখেছে। জানিস তো মানুষের যখন দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যায় ,তখন সে রুখে দাঁড়াতে শেখে । কারণ সে তখন বুঝতে পারে তার পালাবার সব রাস্তা বন্ধ হয়ে গেছে। এখন প্রতিপক্ষের সঙ্গে মোকাবেলা তার করতেই হবে । হয় হারবে নয় জিতবে । কিন্তু সেই মুহূর্তে কেউ হেরে যাওয়ার জন্য লড়ে না। জিতে ফিরে আসার জন্য লড়ে । তার জন্য তাকে যা করার দরকার তা সে সব করতে প্রস্তুত হয়ে যায়।
মেঘ তাকিয়ে দেখে রাজুর চোখে মুখে দৃঢ়তার ছাপ ফুটে উঠেছে।
মেঘ আর কোন কথা বলে না ।
————**——**——**————
ও দিকে চৌধুরী সাহেব বাসায় ফিরে সৈকতের বাসায় ফেরার কথা শুনেই রোজির মাধ্যমে সৈকত কে দেখা করার জন্য তলব করে ।
সৈকত জানে কেন তাকে চৌধুরী সাহেব ডেকেছেন মেঘের কথা বলার জন্য নিশ্চয়।
কিন্তু এ মুহুর্তে আমি কি করতে পারবো কিছুই না। আমার এখানে করার কিছু নেই।
এরা দুজন মেলে আমার মায়ের নামে মিথ্যা অপবাদ দিয়েছে। আমার মনটাকে আমার মায়ের প্রতি বিষিয়ে দেওয়ার জন্য এতটা নীচে নেমেছে যে তা কল্পনা করাও অসম্ভব।
এইসব কথা মনের মধ্যে পুষে রেখে সৈকতের দুদিন কেটে যায় ।
এক দিকে সুইটির বিশ্বাসঘাতকতা আর একদিকে নিজের মনের সাথে যুদ্ধ এই দুই মিলিয়ে সৈকত মানসিক ভাবে কিছুটা ভেঙ্গে পড়ে । কিন্তু কাউকে কিছু বুঝতে দেয় না। দুটো দিন অফিসে না গিয়ে বাসায় নিজের রুমে শুইয়ে বসে সময় কাটাই।
না এভাবে আর সময় কাটালে চলবে না । নিজেকে কাজের মধ্য ব্যস্ত রাখতে হবে যাতে করে এসব চিন্তা গুলো আর মাথার মধ্যে দানা বাধতে না পারে ।
সৈকত সকালে তাড়াতাড়ি করে এলার্মের শব্দে ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে বের হয়ে অফিস যাওয়ার কাপড় খোঁজতেই মনে পড়ে মেঘ তো আর এ বাড়িতে নেই চলে গেছে ।
আগের মত কেউ আর আগে থেকে কাপড় গুলো গুছিয়ে দেবে না যে ,কোনটা পরে অফিস যেতে হবে ।
সৈকত আলমারি খুলে একটা একটা করে শার্ট বের করে আর বিছানার উপর ছুড়ে ফেলে কোনটা পরবে এটা না ওটা কিন্তু কোনটাই ঠিক করতে পারেনা। অবশেষে একটি শার্ট পরে কোর্ট পরে তৈরি হয়ে নেয় । আলমারির দরজা বন্ধ করতে গিয়ে নজরে পড়ে মেঘের দেওয়া সেই ঘড়িটার উপর ।
ঘড়িটা দেখে দরজা আটকে দিতে গিয়েও কি ভেবে সৈকত ঘড়িটা বের করে হাতে পরে নেয়।
তারপর নাস্তা করতে গিয়ে মুখোমুখি হয় চৌধুরী সাহেবের সঙ্গে।
মেঘ চলে যাওয়ার পর থেকে সবার মনের মধ্যে কেমন যেন সৈকত কে নিয়ে ক্ষোভ বিরাজ করছে।
সৈকত খেয়াল করে দেখেছে এ দুই দিন কেউ তার সঙ্গে কোন কথা বলে নি। সৈকত যদিও কথা বলার চেষ্টা করেছে তারা হ্যা ,হু ছাড়া তার বাইরে সৈকতের সঙ্গে আর কোন কথা বলে নি।
নাস্তার টেবিলে গিয়ে সৈকত গুড মর্নিং বলে নাস্তা করতে বসলেই পরিবারের অম্য সবাই কোন কথা না বলে মাথা নিচু করে যার যার মত নাস্তা খেয়ে উঠে চলে যায়।
কেউ সৈকতের প্লেটে নাস্তা তুলে দেয় না।
সৈকত নিজের টা নিজে তুলে নেয়।
হঠাৎ পাশ থেকে অনি বলেঃ
—চাচ্চু তুমি ছোট মাকে কবে আনবে ?
সৈকত কোন কথার উত্তর দেয় না।
অনি আবার বলেঃ
—বলোনা চাচ্চু তুমি ছোট মা কে কবে আনবে ?আমার ছোট মাকে দেখতে খুব ইচ্ছে করছে। প্লিজ চাচ্চু বলোনা।
—আমি জানিনা অনি । তুমি এক কাজ করো তুমি তোমার ছোট মাকে একটা ফোন করো বলো যে তুমি তাকে দেখতে চাও দেখ তোমার ছোট মা ঠিক তোমার সঙ্গে দেখা করতে চলে আসবে।
—না চাচ্চু ছোট মা আর আসবে না। আমি ফোন করেছিলাম । ছোট মা বলেছে তুমি না গেলে ছোট মা আর এ বাড়িতে আসবে না।
—তোমার ছোট মা যদি নিজের থেকে না আসে তাহলে আমি কি করতে পারি বলো?
—চাচ্চু
—হ্যা অনি বলো।
—চাচ্চু আমি তোমার কাছে একটা জিনিস চাইবো তুমি দিবে??
—বলো তুমি কি চাও। আমি দিব।
—প্রমিস?
— হুম প্রমিস।
—চাচ্চু আগামী সপ্তাহে যে আমার জন্মদিন সেটা কি তোমার মনে আছে?
সৈকত একটু হিসাব করে বলে হ্যা চাচ্চু মনে আছে।
—আমার জন্মদিনে তোমার কাছে একটা গিফট চাইবো দিবে ।
—হুম দিব বলো কি চাও?
—আমি ছোট মা কে চাই। আমার জন্মদিনে ছোট মা সবার আগে আমাকে উইশ করবে আমি তাই চাই ।
সৈকত অনির কথা শুনে আর কোন কথা বলে না।
—কি হল চাচ্চু বলো । তুমি কিন্তু আমাকে প্রমিস করছো আমি যা চাইবো তুমি তাই দিবে।
সৈকত বুঝতে পারেনা এখন অনিকে কি বলা উচিত।
হঠাৎ রোজি এগিয়ে এসে বলে
অনি চুপ করো । এটা তোমার চাচ্চু তোমাকে কখনো দিতে পারবে না মনে হয় তাই তোমার চাচ্চু কোন কথা বলছে না।
রোজির কথা শুনে অনি কান্না করতে শুরু করে ।
আমি ছোট মাকে ছাড়া কিছুতেই জন্মদিনের কেক কাটবো না।
রোজি বুঝিয়ে অনিকে ওখান থেকে সরিয়ে নিয়ে যায়।
সৈকত নাস্তার টেবিল ছেড়ে উঠে দাড়াতেই চৌধুরী সাহেব বললোঃ
—এতটুকু বাচ্চা পর্যন্ত বউমাকে ছাড়া এ বাড়িতে শূন্য শূন্য অনুভব করছে । আর তুমি!!?
নিজের মনের জিদ টাই তোমার কাছে বড় হয়ে গেছে আর এতগুলো মানুষের ভালবাসা স্নেহ মমতা কোনটাই তোমার চোখে পড়ছে না??
দেখছো না এ বাড়িটা বউমাকে ছাড়া কেমন খাঁ খাঁ করছে।
এ বাড়ির কাজের লোক থেকে শুরু এই ছোট্ট অনি পর্যন্ত এই শূন্যতা অনুভব করতে পারছে আর তুমি আমার উপর জিদ করে ঐ মেয়েটাকে দিনের পর দিন কষ্ট দিয়ে গেছ অপমান করেছ। মেয়েটা সব মুখ বুজে সহ্য করেছে শুধুমাত্র তোমাকে ভালবাসে বলে । এখনও সময় আছে তুমি বউমাকে ফিরিয়ে নিয়ে এসো। বউমা তোমার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে আছে।
চৌধুরী সাহেবের কথা শেষ হতেই
সৈকত বললোঃ
—আপনার কথা যদি শেষ হয়ে যায় তাহলে আমি আপনাকে কিছু কথা বলতে চাই।
—হ্যা বলো।
—আপনি জিদ বলুন আর রাগ বলুন না কেন আমি আপনাকে কখনই আপনার উদ্দেশ্য সফল হতে দেব না । আপনি কি ভেবেছেন মেঘ কে দিয়ে আপনার আমার ভিতরের যুদ্ধটা শেষ করবেন ??
ওকে আপনি আপনার মোক্ষম হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে আপনি আপনার উদ্দেশ্য হাসিল করবেন ?
মোটেও না। আমি সেটা কখনও হতে দিব না।
যুদ্ধটা আপনার আর আমার। এর মধ্যে তৃতীয় কেউ আসলে সে নিজেই শেষ হয়ে যাবে।
চৌধুরী সাহেব সৈকতের শেষ কথা শুন গর্জে ওঠে
— সৈকত!!!
—কি চৌধুরী সাহেব অবাক হচ্ছেন?? ভেবেছেন আমি আপনার প্লান বুঝি বুঝতে পারবো না। আপনি যে মেঘ কে দিয়ে আমার মায়ের নামে আমার কাছে যেসব খারাপ কথা বলিয়েছেন ভেবেছেন সেগুলো শুনে বোধহয় আমি আমার মাকে ঘৃনা করে আপনাকে বাবা বলে ডাকবো ??কিন্তু না সেটা কখনও সম্ভব না।
—কি বললে তুমি!!???
—কি হলো চমকে উঠলেন যে?? ও বুঝতে পেরেছি আমি যে আপনার প্লান টা বুঝে ফেলবো সেটা মনে হয় আপনি কখনোও আশা করেন নি? কিন্তু আপনার দুভাগ্য যে সেটা আমি ধরে ফেলেছি।
—তুমি একটু আগে কি বললে?আমি মেঘ কে দিয়ে কি করিয়েছি??
—আপনি এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেলেন!?
আপনি তো এত তাড়াতাড়ি ভুলে যাওয়ার মানুষ নন তাহলে??
নাকি ভুলে যাওয়ার অভিনয় করছেন??
—আমি এতকিছু শুনতে চাইনি। আগে বলো তুমি তোমার মায়ের কথা কি বললে?
— আপনি মেঘ কে দিয়ে আমাকে কেন বলিয়েছেন যে আমার মা মারা যায় নি!!?আমার মা বেঁচে আছে আর সে
অন্যে একজনের সঙ্গে—–
—স্টপ ইট সৈকত। জাস্ট স্টপ । আর কোন কথা বলো না তুমি। তুমি এখন যেতে পারো।
—কেন চৌধুরী সাহেব শুনতে এখন খারাপ লাগছে??নাকি খারাপ লাগার অভিনয় করছেন??আমি জানি আপনি খুব বড় মাপের একজন অভিনেতা। কিন্তু আপনার এই অভিনয়টা ঠিক আপনার সাথে যায় না। কেমন যেন লাগে। আচ্ছা আপনি আপনার এই নিচু মনের চিন্তাভাবনা নিয়ে কিভাবে রাজনীতি করেন বলেনতো?অবশ্য জনগণ এখনো বোকাই রয়ে গেল তাইতো আপনাদের মত মানুষদের তারা বিশ্বাস করে।
আচ্ছা এ দেশের জনগণ কবে সচেতন হবে বলুনতো??
যে নেতারা তাদের নিজেদের ছোট ছোট ঘর সামলাতে পারেনা তারা কিভাবে এই গোটা দেশ টাকে সামলাবে??
চৌধুরী সাহেব আর দাড়িয়ে থাকতে পারে না । হুপ করে চেয়ার টাতে বসে পড়ে।
সৈকত চৌধুরী সাহেবের অবস্থা বুঝতে পেরে আর কথা না বাড়িয়ে অফিসের উদ্দেশ্য বেরিয়ে যায়।
সৈকতের কথা শুনে চৌধুরী সাহেবের মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। তিনি এই ১৬বছর ধরে যে কথা গুলো নিজের বুকের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছেন কাউকে কোন কিছু বুঝতে দেন নি ,নিজের যন্ত্রণা শুধু নিজেই ভোগ করে চলেছেন আর আজ সে কথা গুলো ——–
কি করে সম্ভব!!?
আমিতো আমার ছেলেমেয়েদের এ কথা গুলো জানাতে চাইনি কখনো। তাহলে ??
আমি তো চাইনি তার মাকে তাদের সামনে ছোট করতে !!
জীবন আমাকে নিয়ে এতটা নিষ্ঠুর খেলায় কখনো মেতে উঠবে তা বুঝতে পারিনি।
আহ্ঃ বুকের বাম পাশে চিন চিন করে ব্যথা শুরু হচ্ছে । কেউ যেন নিশ্বাস টাকে আটকে ধরতে চাইছে !
জিহ্বাটা শুকিয়ে গেছে ।
কাউকে ডেকে যে বলবে একটু পানি দিতে সে শক্তি টুকু ও শরীরে আর অবশিষ্ট নেই। জিহ্বা টা যেন কিছুতেই নড়তে চাইছেনা। কন্ঠনালী অবরুদ্ধ হয়ে গেছে।
ব্যথাটা বেড়েই চলেছে মনে হচ্ছে কেউ যেন বুকের উপর একটা পাহাড় উঠিয়ে চাপা দিচ্ছে।
কিছুক্ষনের মধ্যে সবটা অন্ধকার——-
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here