বেখায়ালি ভালোবাসা পর্ব-২৪

0
1998

#বেখায়ালি_ভালোবাসা, #পর্ব_২৪ #লেখাঃসাবেরা_সুলতানা_রশিদ
. সৈকত বাড়ি ফিরে মেঘের বলা কথা গুলো মন দিয়ে ভাবতে
থাকে । সব সত্যি আমার ঘরেই আছে আমাকেই সেটা
জানতে হবে !!?? কোথায় কি আছে আমার ঘরে ?? সৈকত
এদিক ওদিক তাকিয়ে প্রতিটা জিনিসপত্র খুব ভাল ভাবে দেখতে
থাকে কিন্তু কিছুইতো কোথাও তেমন দেখা যাচ্ছে না!!
তাহলে!!?? সৈকত আলমারির দিকে এগিয়ে যায় একটা একটা
করে ওর সব কাপড় সরিয়ে ফেলে অবশেষে একটা
ডায়েরি আর মেঘের দেওয়া সেই মোবাইলটা পায়। সৈকত
তাড়াতাড়ি করে ডায়েরি টা খুলে পৃষ্টা উল্টাতে থাকে কিন্তু না
এটাতে তো কিছুই নেই সব পৃষ্টা ফাঁকা। এটাতো একটা নতুন
ডায়েরি । ধুর এতো ভাবতে আর ভাল লাগছে না। সৈকত হাতে
থাকা ডায়েরিটা দুরে ছুড়ে ফেলে দেয়। বিয়ের আগের
জীবনটাই খুব ভাল ছিল। ঐ মেয়েটা এ বাড়িতে বউ হয়ে
আসার পর থেকেই যতসব গন্ডোগোল শুরু হয়েছে।
একটার পর একটা ঝামেলা লেগেই আছে । হঠাৎ সৈকতের
নজর পড়ে ফ্লোরে ছুড়ে ফেলা ডায়েরিটার দিকে।
ডায়েরিটা মেলে আছে একটা পৃষ্টায় ছোট একটু জায়গা
নিয়ে কি যেন লেখা?? সৈকত এগিয়ে গিয়ে ডায়েরিটা তুলে
দেখে একটা ঠিকানা লেখা। এটা কার ঠিকানা হতে পারে!!? আর
কোথাও কিছু লেখা নেই শুধুমাত্র এই ঠিকানাটা ছাড়া!!!?? কি
আছে এই ঠিকানায় সেটা আমাকে জানতেই হবে । সৈকত
হাতে থাকা ঘড়ির দিকে তাকায় ঘড়িতে রাত দশটা বেজে
পনেরো মিনিট । ঢাকা শহরে দশটা মানে সবে সন্ধ্যা ।তবে
এখন শীতকাল তাই একটু —- সৈকত একটু ভেবে নিয়ে
ঠিকানাটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ে । সৈকত নীচে নামতে
রোজি জিঙ্গাসা করে —কিরে কোথায় যাচ্ছিস এখন? —
বাইরে যাচ্ছি । কেন কিছু বলবে?@ —হ্যাঁ বলার তো অনেক
কিছু ছিল কিন্তু এখন বেশী কিছু বলছি না । শুধু একটা কথা
বলতে চাই —হ্যা ভাবি বলো কি বলবে?? —দেখ সৈকত আমি এ
বাড়িতে এসেছি তা অনেক গুলো বছর কেটে গেল। তুই
আমার ছোট ভাইয়ের মতো। আমার নিজের ভাইকে
যেমন ভালবাসি ঠিক তেমন আমি তোকেও ভালবাসি স্নেহ
করি। —হুম এসব জানি। এগুলো আবার নতুন করে বলার কি
আছে? —আমি তোর থেকে বয়সে অনেকটাই বড় তাই
তোর থেকে বলতে পারিস সব কিছুতেই আমার অভিজ্ঞতা
টাও বেশি। মেঘ যে তোকে ভালবাসে সেটা তুই
ভালকরেই জানিস। আর মন থেকে মানিস ও। তাহলে তোর
প্রবলেমটা কোথায়!!?মেঘ খুব ভাল একটা মেয়ে তুই
কেন শুধু শুধু ওকে এভাবে কষ্ট দিচ্ছিস!!? ঐ মেয়েটা
তোকে ভালবাসে তোর পরিবারটাকে ভালবাসে এই
পরিবারের প্রত্যেকটি সদস্য কে সে ভালবাসে
শ্রদ্ধাকরে । আজকের কথায় ধর তোরা তিন ভাই তো বাবার
সন্তান। বাবা অসুস্থ হয়ে ক্লিনিকে আছে আর তোরা সবাই
যার যার মতো বাড়ি চলে এসেছিস। একটা বারের জন্যেও
ওখানে কেউ থাকবার প্রয়োজন মনে করিস নি!! —ওখানে
থাকার কি আছে !!?ক্লিনিকে উপর মহল থেকে আদেশ
আছে তারা যেন চব্বিশ ঘন্টা চৌধুরী সাহেব কে দেখে
রাখে । তার কেয়ার করে । ভাল সেবা প্রদান করে। —আমি
জানতাম তুই এমনটাই বলবি। তারপর ও কারোনা কারো থাকা লাগে
। আচ্ছা বাদ দে,তারপরও দেখ ঐ মেয়েটাই কিন্তু একা
ক্লিনিকে রাত কাটাচ্ছে। বাসা থেকে খাবার পাঠিয়েছিলাম। যদি
পারিস একটু দেখে আসিস খাবারটা ও খেয়েছে কিনা? —
আচ্ছা ঠিক আছে দেখে আসবো। —আর শোন! —হ্যা
বলো। —কেউ কাউকে এতটা ভাল না বাসলে তার জন্য এত
কিছু মন থেকে করা যায় না। তোকে মন থেকে ভালবাসে
বলেই তোর সঙ্গে জড়িত সব কিছুকে ও এত ভালবাসে ।
—ভাবি আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে । এখন আসি —যা। সৈকত
নিজের বাইক টা নিয়ে বেরিয়ে পড়ে । ডায়েরি তে যে
ঠিকানাটা দেওয়া ছিল সেটা সৈকতের খুজে পেতে অনেকটা
সময় লেগে যায় । বাসাটার সামনে যেতেই গেটের
দারওয়ান জিঙ্গাসা করে কাকে চাই? সৈকত ঠিকানায় লেখায় নামটা
বলে দেয়। —এতো রাতে আপনি মালিকের সঙ্গে দেখা
করতে এসেছেন ??দেখি আমি একটা ফোন করে নিই যদি
উনি রাজি হন তাহলে আমি আপনাকে ভিতরে যেতে দিতে
পারবো। —ঠিক আছে একটা ফোন করুন তবে বলবেন
যে আমার ওনার সঙ্গে দেখা করাটা খুব জরুরী । দারওয়ান
একটা ফোন করে । সৈকত দাড়িয়ে অপেক্ষা করতে থাকে
। একটু পরই দারোয়ানটা হাসিমুখে বলে ঠিক আছে ভিতরে
যান তবে বেশি সময় নষ্ট করবেন না। সৈকত ওকে বলে
ভিতরে যায় । একটা কাজের লোক এসে সৈকত কে বসে
অপেক্ষা করতে বলে । বাড়িটা মোটামুটি আলিশান ভাবেই তৈরি
করা হয়েছে । ঘরের সাজানো আসবাবপত্রের দিকে
তাকালে বোঝা যায় বেশ আভিজাত্য ছোয়া রয়েছে।
দেওয়ালে বেশ কিছু ছবি ঝুলছে মনে হয় তার
ছেলেমেয়ের ছবি। একটু বাদেই একজন মধ্যবয়স্ক
লোক এসে দাড়াল সৈকতের সামনে। সৈকত তাকে
দেখেই চমকে বসা থেকে উঠে দাড়ায় । লোকটা
সৈকতের কাছে এগিয়ে এসে বলেঃ —হ্যালো ইয়াংম্যান।
সৈকত খুব ক্ষীণ কন্ঠে বলে আপনি–!! আমি ডাঃসুমন বলে
লোকটা হাত বাড়িয়ে দেয় । সৈকত নিজের চোখ কান
কোনটাকেই যেন বিশ্বাস করতে পারছে না। —বসো।
সৈকত আস্তে করে বসে পড়ে । সৈকতের সব কিছু
কেমন যেন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। কি কথা
বলবে কিছুই বুঝতে পারছেনা। —তুমি কি কোন কারণে
চিন্তিত ?? সৈকত বলে আমি একটু পানি খাব। লোকটা হাসিমুখে
বলে ঠিক আছে বসো আমি কাউকে বলছি। লোকটা
উঠে যেতেই সৈকত ভাবে তাহলে কি মেঘের বলা কথা
গুলোই সত্যি!!? তা না হলে ডায়েরিতে কেন এই বাড়ির ঠিকানা
দেওয়া থাকবে ?? কিছুক্ষণ পরে লোকটি ফিরে আসতেই
সৈকত বলে আপনার পুরো নাম টা কি শামসুজ্জামান সুমন??
লোকটি বলে হ্যা। কেন বলতো ?? —আসলে যার কাছ
থেকে আপনার সম্পর্কে শুনেছি সে আমাকে
শামসুজ্জামান বলেছিল । ও আচ্ছা। একটু পরে সেই কাজের
মেয়েটা পানি সাথে হালকা নাস্তা এনে হাজির হয় । সৈকত শুধু পানি
টুকু খেয়ে নেই। —আচ্ছা এবার বলো কি দরকার আমার
সাথে??দারোয়ান বললো খুব জরুরী । —হ্যা আসলে—
বলে সৈকত মনে মনে ভাবে কি বলবো ??কিছুইতো মাথায়
আসছে না। —হ্যাঁ বলো ?? —আসলে আমি আপনার সঙ্গে
আমার বন্ধুর ব্যপারে কথা বলতে এসেছি। —কি প্রবলেম??
—আসলে ও কিছুদিন থেকে বলতেই লোকটার ফোনটা
বেজে উঠলো । সুমন সাহেব ফোনটা হাতে নিয়ে
বলে এক্সকিউজমি আমি একটু কথা বলি লোকটা সৈকতের
সামনে দাড়িয়ে কথা বলছে । কথা শুনে মনে হচ্ছে তার
মেয়ে কথা বলছে । কথার মধ্য ডাঃ মায়া বলে ডেকে
ওঠে। মায়া নামটা শুনেই সৈকতের বুকের মধ্যে কেমন
কেঁপে ওঠে । এদিক থেকে কন্ঠ ভেসে আসে
“আসছি ”। পরিচিত সেই কন্ঠস্বর টা শুনে সৈকতের বুকের
ভিতরে কেমন শীতলতা বয়ে যায়। এ কন্ঠস্বর যে তার খুব
পরিচিত ।এতবছরেও এ কন্ঠ যে সৈকত কখনো ভোলেনি
একটা মুহূর্তের জন্য ভোলেনি এই মধুর কন্ঠস্বর । সৈকত
এখনো রোজ রাতে ঘুমানোর আগে যে এই কন্ঠস্বর
শুনতে পায় “সৈকত আমার লক্ষি ছেলে এবার ঘুমাও আমি
তোমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি”। আর আজ এতো বছর পর
সৈকত সেই কাঙ্ক্ষিত কন্ঠ শুনতে পাবে !??এটা দুঃস্বপ্ন
নয়তো!?? —কি হয়েছে এভাবে ডাকছো কেন?? —
তোমার মেয়ে ফোন করেছে কথা বলবে। সৈকত
এতো বছর পর তার প্রিয় মানুষটার মুখ এভাবে দেখবে !!??
সৈকত কখনো কল্পনাও করেনি। ফোনটা হাতে নিয়ে কি
হাসিখুশি ভাবে কথা বলতে বলতে চলে গেলেন। সুমন
সাহেব বললো আসলে আমার মেয়ে দেশের বাইরে
থাকে । তাই প্রতিদিন আমাদের ঘুমানোর আগে কথা বলে ।
সৈকত উঠে দাড়িয়ে বলে আজ আমি আসি । —কেন!!?
তোমার সঙ্গে তো কথাই বলা হলো না। —ইটস ওকে
বলে সৈকত বেরিয়ে হনহন করে হেটে চলে আসে।
সৈকতের শরীরে মনে হচ্ছে আর এতটুকুও শক্তি
অবশিষ্ট নেই। শরীরটা কেমন যেন মনে হচ্ছে বাতাসে
ভেসে বেড়াচ্ছে। সুমন সাহেব পিছন থেকে সৈকতকে
দুবার ডাকদেয় । কিন্তু সেই শব্দটা আর সৈকতের কর্ণে
এসে পৌছায় না। সৈকতের মাথাটা কেমন যেন শূন্য শূন্য অনুভব
হচ্ছে। কোন কিছুই যেন আর ঠিকমত কাজ করছে না। সৈকত
বেরিয়ে কোনরকমে বাইক স্টার্ট দেয়। সৈকতের মনে
হচ্ছে আজ চারপাশের প্রকৃতি বুঝি তাকে নিয়ে তামাশায়
মেতে উঠেছে। সব কিছু তার দিকে তাকিয়ে কেমন
বিদ্রুপ ভাবে হাসছে। ঐ রাতের তারা সেটাও আজ আর মিটিমিটি
জ্বলছে আর সৈকত কে বলছে তুই এতদিন মিথ্যার জ্বালে
জড়িয়ে ছিলি। তোর সমস্ত কিছু আজ মিথ্যা প্রমানিত হলো।
তোর রোজ রাতের কান্না ,তোর রোজকার নালিশ সব
সবটাই মিথ্যা ছিল। মিথ্যার দেশে বসবাস করেছিস তুই। মিথ্যামায়ায়
জড়িয়ে এত দিন তুই সত্য থেকে দূরে সরে ছিলি। সৈকত
আর বাইক চালাতে পারছেনা। বুকের ভিতরের এতদিনের
জমিয়ে রাখা চাপা কষ্টটা আজ বুক ফেড়ে বেরিয়ে আসতে
চাইছে। সৈকত আর পারছেনা সেটাকে নিজের ভিতর দমিয়ে
রাখতে । সৈকত কোনরকমে বাইক টা রাস্তার পাশে দাড়
করিয়ে শরীরের সব শক্তি দিয়ে চিৎকার করে কাঁদতে শুরু
করে —– (চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here