#বেখায়ালি_ভালোবাসা,
#পাট_৬
লেখিকা: #সাবেরা_সুলতানা_রসিদ
.
মেঘের সুস্থতার কথা শোনার পর সেদিন আর সৈকত মেঘকে দেখতে আসে নি। মেঘ যেন সুস্থ হয়েও আরো বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ছে। তবে সেটা ভিতরে ভিতরে । কাউকে কিছু বুঝতে দিচ্ছে না অথচ ভিতরে জলে পুড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে। কেন সৈকত তার সাথে এমন করছে কিছুই বুঝতে পারে না মেঘ। সেদিন ক্লিনিকে রাতে মেঘের পাশে ওর আম্মু ছিল। মেঘ সারা রাত না ঘুমিয়ে শুধু ছটফট করেছে আর ভাবছে কখন সকাল হবে ? কখন সৈকতের মুখ টা দেখতে পারবে? এ কদিনে সৈকতের উপর অনেক মায়া জমে গেছে। মেঘ যে সৈকতকে মনে মনে অনেকটাই ভালবাসতে শুরু করছে সেটা নিজে খুব ভালভাবে বুঝতে পারছে। যে মানুষটা তাকে এতটা এড়িয়ে চলে কথাই কথাই কষ্ট দেওয়ার চেষ্টা করে তাকে যে সে এতোটা ভালবাসবে মেঘ নিজেও বুঝতে পারেনি। মেঘ মনে মনে একটা সিদ্ধান্ত নেয় “সকালে বাসায় গিয়ে যে কর হোক সৈকতের মনের কথাটা তাকে আজ জানতেই হবে”। সকাল ১০টাই মেঘকে রিলিজ করা হল । চৌধুরী অফিসে যাওয়ার আগে মেঘের সাথে দেখা করে গেছে । রোজি আর ঝিনুক এলো মেঘকে বাসায় নিয়ে যাওয়ার জম্য ।মেঘ অনেক আশা করে ছিল হয়তো সৈকতও তাদের সাথে আসবে কিন্তু——- মেঘের আম্মু ক্লিনিক থেকে সোজা নিজেদের বাসায় চলে গেছে। মেঘ নিষেধ করেছিল যেতে ভেবে ছিল আম্মু তার সঙ্গে আসবে। কিন্তু আব্বু আর ভাইয়ার এ কদিনে একটু খাওয়ার কষ্ট হয়েছে । তাই মেঘ আর তার আম্মুকে জোর করেনি তার বাসায় যাওয়ার জন্য। গাড়ির মধ্যে বসে রোজি আর ঝিনুক একের পর এক কথা বলছে কিন্তু মেঘের সে দিকে কোন খেয়াল নেই। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে আর সৈকতের কথা ভাবছে। কেন মানুষটা এমন??কেন!?কেন?কেন? গাড়ি বাড়ির দরজায় পৌছাতে যে যেখানে ছিল সবাই ছুটে এল। অনি দৌড়ে এসে বললো কি মজা!ছোট আম্মু এসেছে !ছোট আম্মু এসেছে। বাসার কাজের মানুষ গুলো এসে ভাল মন্দ জিঙ্গাসা করছে। মেঘ অনি কে কোলে নিয়ে হল রুমের একটা সোফায় বসে । শরীরটা এখনো যে অনেকটা দুর্বল হয়ে আছে সেটা অনিকে কোলে নিয়ে বুঝতে পেরেছে। ঝিনুক মেঘের কাছে এসে বললো ভাবি জানো এ কদিন তোমাকে অনেক মিস করেছি । এ দুদিন বাড়িটা কেমন যেন ফাকা ফাকা লাগতো। সবছিল তারপর ও মনে হতো কি যেন নেই। রোজি বলে ঠিক বলেছিস। মেঘ দুদিনে যে আমাদের সবার মনে এতোটা জায়গা করে নিবে সেটা বুঝতেই পারিনি। রোজি মেঘের কাধে হাত রেখে বললো জানিস তুই ছাড়া এ বাড়িটা মনে হচ্ছিল অপূর্ণ । এখন তুই এসে পূর্ণতা পেল। মেঘ মিচকি হেসে বলেঃ — কি যে বলো না ভাবি!!? —হ্যা সত্যি। আচ্ছা শোন তুই তাড়াতাড়ি করে ফ্রেস হয়ে একটু রেস্ট কর । একটু পরেই আবার তোকে একটা কাজ করতে হবে। —কি কাজ? —তোদের বিয়েটা হুট করে হলো এ জন্য কোন অনুষ্ঠান করা হয়নি। তারপর বিয়ের দুদিনের মাথায় এমন অসুস্থ হয়ে পড়লি।তাই বাবা তোর সুস্থতা কামনা করে মানত করেছিল যে ,তুই সুস্থ হয়ে বাড়িতে আসলেই গরিব মিসকিনদের পেট ভরে খাওয়াবে আর তাদের কিছু নতুন কাপড় দান করবে। খুশিতে মেঘের চোখে পানি চলে আসে। এ বাড়ির সবাই তাকে এতটা ভালবাসে!!তার জন্য এতটা ভাবে!!? বাড়ির সবাই এখন খুব খুশি মেঘ কে পেয়ে। মেঘ বার বার দোতলার দিকে তাকাচ্ছে আর ভাবছে হল রুমে এত কথা হচ্ছে এত সরগোল হচ্ছে এটা শুনেই তো সৈকতের বোঝার কথা যে মেঘ বাসায় ফিরেছে। তারপর ও কেন সে নিচে আসছে না একটা বার দেখা করতে??সৈকত কি তাহলে এখনো ঘুমাচ্ছে?নাকি বাসায় নেই!? মেঘ রোজিকে বলে ভাবি আমার শরীরটা একটু খারাপ লাগছে আমি উপরে যাচ্ছি। —চল আমি তোকে নিয়ে যাচ্ছি। —না ভাবি তুমি অনিকে নাও আমি যেতে পারবো। —আচ্ছা। মেঘ আস্তে আস্তে সিড়িঁ বেয়ে উপরে উঠে সৈকতের রুমের দরজার কাছে আসতেই বুকের ভিতরটা কেমন যেন দুরুদুরু করতে থাকে। এটা ভয়ে না অন্য কারণে সেটা মেঘ বুঝতে পারেনা। আস্তে করে দরজায় হাত দিয়ে ধাক্কা দিতেই দরজা খুলে কিসের যেন তীব্র গন্ধ মেঘের নাকে এসে লাগলো। রুমের জানালা দরজা সব আটকানো তাই অন্ধকারে মেঘ ভালভাবে কিছু দেখতেও পাচ্ছে না।জানালা খোলার জন্য এগিয়ে যেতেই পায়ে একটা শক্ত কিছুর সাথে ধাক্কা খায় মেঘ। নিজেকো কোন রকম সামলে জানালার পর্দা সরিয়ে জানালা খুলতেই দেখে সৈকত ফ্লোরে পড়ে আছে । আর ফ্লোর এখানে ওখানে দু-তিনটা খালি বোতল গড়াগড়ি খাচ্ছে। রুমের ভিতরে কোন জিনিস ঠিক নেই সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। মনে হচ্ছে কেউ রাগ করে সব কিছু ছুড়ে ফেলেছে। মেঘ যেন এসব দেখে বিশ্বাস করতে পারছে না। কি হচ্ছে এসব?? এই মানুষটা আবার এসব খাওয়া শুরু করলো ??কিন্তু কেন?? মেঘ বুঝতে পারে যে গন্ধটা তাহলে এসবের। সৈকতের দিকে তাকিয়ে দেখে দু’হাত মেলে চিৎ হয়ে শুয়ে আছে। মাথাটা শক্ত ফ্লোরে দিয়ে। মুখটা আগের থেকে অনেকটা শুকিয়ে গেছে। চোখের নীচে একটু কালো ও হয়েগেছে। চুল গুলো উস্কোখুস্কো। পায়ের জুতা মোজাটা পর্যন্ত খোলা নেই। টমি ও শুইয়ে আছে সৈকতের পায়ের কাছে। মেঘ কে দেখে দু-একবার আস্তে করে ডেকে উঠলো কিন্তু মেঘ ভয় পেল না। মেঘ বিছানার উপর থেকে বালিস এনে সৈকতের মাথার নীচে দিয়ে দিল। তারপর পায়ের কাছে বসে পা থেকে জুতা খুলে টমির দিকে তাকিয়ে বললোঃ — কিরে তোর মালিকের এ অবস্থা কেন? আমি না হয় দুদিন অসুস্থতার জন্য বাসয় ছিলাম না কিন্তু তুইতো ছিলি। তুই খেয়াল করিস নি কেন?? টমি মেঘের দিকে তাকিয়ে শান্ত ভাবে ঘেউ ঘেউ করে উঠলো। মনে হচ্ছে কিছু বলছে। মেঘ টমি কে বললো কি বলছিস আমি বুঝতেছি না। আমি তো তোর ভাষা এখনও বুঝিনা কিন্তু তুই তো তোর মালিকের সঙ্গে থেকে থেকে মানুষের কথা কিছুটা হলেও বুঝতে শিখেছিস। পা থেকে মুজা টা খুলে রাখে আর বলে আচ্ছা এ মানুষটা এমন কেন বলতো!!? এতক্ষন টমি মাথা উচু করে কথা গুলো শুনলেও মেঘের এ কথা শুনে কেন জানি মাথাটা নিচু করে নিল। মেঘ বললো তার মানে তুই ও জানিস না !!?আচ্ছা আমি না হয় এ বাড়ীতে নতুন কিন্তু তুই তো অনেক বছর ধরে আছিস তাহলে বলতো কিসের এত কষ্ট তার?? হঠাৎ এ কথা শুনে টমি উঠে দৌড়ে একটা ড্রয়ারের কাছে গেল। আর মুখ দিয়ে সেটা খোলার চেষ্টা করছে। মেঘ অবাক হয়ে যায় টমির কাজে। আরে কি করছিস??বলে নিজে উঠে যায়। কিন্তু ড্রয়ার টা না খুলে টমিকে বলে আজ থেকে আমিও তোর বন্ধু হয়ে গেলাম । একটু সাহস নিয়ে টমির গলায় বাধা বেল্টে একটু হাত দেয় । আচ্ছা এখন কি করা যায় বলতো। সারা ঘরে কেমন গন্ধ বের হচ্ছে। আর উনি ও নীচে পড়ে আছে। ঘর টা যে কাউকে দিয়ে পরিষ্কার করাবো তার ও উপায় নেই। শরীরে আগের মত এত শক্তি ও নেই যে টেনে বিছানায় তুলবো। আচ্ছা তারপরও একটু চেষ্টা করে দেখি। মেঘ সৈকতের কাছে গিয়ে মাথাটা টেনে উঠিয় সোজা করে বসানোর চেষ্টা করতেই সৈকতের ঘুম ভেঙ্গে যায়। একটু চেয়ে থেকে ভাল করে চোখ মুছে বলে আরে তুমি!!? কখন এলে?? সৈকত কথা বলতেই ওর মুখ থেকে মদের গন্ধ সব মেঘের নাকে এসে লাগলো। উুহঃবলে মেঘ নাক চেপে অন্য দিকে মুখ ঘোরাল। —ও সরি। সরি মেঘ উঠে সরে গিয়ে বলেঃ —কিসের সরি?? —তোমার তো এ গন্ধটা পচ্ছন্দ না তাই। —আপনি এসব কেন করছেন? —সবসময় করি। —গত কয়েকদিন তো ঠিক ছিলেন তাহলে আবার কেন?? —এ কথার উত্তর আমি তোমাকে দিতে বাধ্য নই। মন চেয়েছে তাই। —আপনার যখন যেটা মন চাইবে আপনি তখন সেটাই করবেন!!? —হ্যা করবো। তাতে তোমার কি?? —আমার কিছু না। আসলে আমারই ভুল। —কি ? —কিছুনা । মেঘ রাগ করে ঘর থেকে বের হয়ে আসে। এদিকে সব আয়োজন শেষ । সবার খাওয়া শেষ। চৌধুরী সাহেব মেঘকে ডেকে সবাইকে কাপড় গুলো বিতরন করতে বলে। মেঘ দাড়িয়ে নিজের হাতে সবার হাতে কাপড় গুলো তুলে দেই। সবাই খুব খুশি হয়ে মেঘ কে মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া করে যায়। হঠাৎ মেঘ দেখে সৈকত কোথায় যেন যাচ্ছে। মেঘ কিছু না জিঙ্গাসা করে চুপ করে থাকে। এক এক করে সবাই চলে যায়। বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা হতে চললো কিন্তু সৈকতের আর দেখা নেই। সবাই খুব আনন্দ করছে কিন্তু মেঘের মনটা ভার হয়ে আছে । মেঘ রাতের খাবারটা কোনরকমে তাড়াতাড়ি শেষ করে। সৈকত আসার আগেই রুমে এসে একটা খয়েরী শাড়ী পরে সুন্দর করে সাজে। মাথায় রজনীগন্ধা ফুলের মালা জড়িয়ে রুমে হালকা আলো জ্বালিয়ে সৈকতের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। অপেক্ষার প্রহরটা সত্যিই খুব কষ্টের হয় । সেটা এতদিন মেঘ অন্যের মুখে শুনে এসেছে কিন্তু আজ নিজে সেটা উপলব্ধি করতে পারছে। এক একটা মিনিট যেন মেঘের কাছে এক বছরের সমান। মেঘ ঘড়ি দেখে বারোটা বেজে দশ মিনিট তবুও সৈকতের আসার কোন নাম নেই। এমনিতে মেঘের শরীরটা খারাপ তার উপর গতরাত র্নিঘুম কাটিয়ে এখন চোখটা কেমন যেন মাতালের মত ঢুলুঢুলু হয়ে আসছে হাজার চেষ্টা করেও আর চোখের পাতা খুলে রাখতে পারছেনা। হঠাৎ দরজাটা খুট শব্দে খুলে যায় । সৈকত আস্তে ধীর পায়ে এগিয়ে আসে মেঘের কাছে । সৈকত যতো মেঘের কাছে এগিয়ে আসছে মেঘের হার্টবিট ততো বেড়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে বুকের ভিতরে কেউ জোরে জোরে হাতুড়ি পেটাচ্ছে। সৈকত কাছে এসে মেঘের সামনে বসে হাত দিয়ে মেঘের মুখটা উচু করে কপালে একটা চুমু দেয়। মেঘ সৈকতের স্পর্শে লজ্জায় লাল হয়ে যায়। সৈকত মেঘের কানের কাছে মুখ নিয়ে অস্পষ্ট স্বরে বলে মেঘ আই লাভ ইউ। মেঘ ও সৈকতের গলা জড়িয়ে ধরে বলে———— (চলবে)