বেখায়ালি ভালোবাসা পর্ব-৭

0
2421

#বেখায়ালি_ভালোবাসা,
#পাট_৭
লেখিকা: #সাবেরা_সুলতানা_রসিদ
..
হঠাৎ মেঘের মনে হয় কে যেন তাকে শরীরে ঝাঁকুনি দিয়ে ডাকছে।
মেঘ চোখ মেলে দেখে ঝিনুক দাড়িয়ে আছে
—ভাবি উঠো তাড়াতাড়ি নিচে চলো দেখ কি হচ্ছে।
মেঘ ধড়ফড় করে উঠে এদিক ওদিক তাকিয়ে সৈকত কে খুজতে থাকে।
একটু আগেই তো সৈকত ওর কাছে ছিল । কপালে চুমু দিল আর কানের কাছে মুখ নিয়ে কি যেন বলেছিল। মুহূর্তের মধ্যে সৈকত কোথায় চলে গেল। ও মানুষ না অন্যে কিছু!!
মেঘ একটু সামলে বললো তোমার ভাইয়া ছিল না এখানে কোথায় গেল??
—ভাইয়া!!??ভাইয়া এখানে কোথা থেকে আসবে ভাইয়া তো নীচে হল রুমে । সেই যে দুপুরে বেরিয়ে ছিল আর কেবল ফিরলো। ফিরেই দেখ কি শুরু করেছে।
—মানে!!?
মেঘ মনে মনে ভাবে তাহলে আমি এতক্ষন যা দেখলাম সবটা স্বপ্ন!!??
সৈকত আসে নি কিন্তু আমার এই কপালে দেওয়া চুমু বলেই নিজের অজান্তে কপালে হাত দেয় মেঘ।
—কি হলো ভাবি কি ভাবছো??তাড়াতাড়ি চলো বাসার অন্যে সবাই জেগে যাওয়ার আগে।
—কি হয়েছে সেটা তো বলবে।
—আগে চলো তারপর নিজের চোখে দেখবে। আমার খুব ভয় করছে ভাবি।
—কেন??
—বাবা যদি ভাইয়াকে এ অবস্থায় দেখে তাহলে লঙ্কাকান্ড হয়ে যাবে।
মেঘ ছুটে দরজা খুলে বের হতেই সৈকতের কন্ঠস্বর শুনতে পেল।সৈকত জোরে জোরে চিৎকার করছে। কিন্তু কি এমন হলো ওর যে এমন জোরে জোরে চিৎকার করছে।
মেঘ সিড়িঁ দিয়ে নেমে নীচে হল রুমে পা দিতেই চোখ পড়লো জিনিসপত্র এলোমেলো এখানে ওখানে ছড়ানো ছিটানো। হল রুমটা সুন্দর করে সাজানো গোছানো ছিল দামি দামি দেশী বিদেশী সোপিচ দিয়ে সেসব ভেঙ্গে চুরে একাকার ।
সৈকত চিল্লাচ্ছে চৌধুরী সাহেব কোথায় আপনি বেরিয়ে আসুন। আজ আপনাকে আমার সব প্রশ্নের জবাব দিতেই হবে।
মেঘ দৌড়ে সৈকতের কাছে গিয়ে বললোঃ
— কি হয়েছে আপনার এভাবে চিৎকার করছেন কেন??
—এই চুপ ,একদম চুম । কথা বলবে না।
—আচ্ছা বলবো না। চলুন রুমে চলুন।
—না আমি কোথাও যাবো না। আমার সব
প্রশ্নের উত্তর চাই ।
—কি প্রশ্ন কিসের উত্তর ?
—যার কাছে প্রশ্ন করবো সেই তো মুখ লুকিয়ে আছে তোমার শ্রদ্ধেয় শ্বশুর।
হঠাৎ ঘড়িতে ঢংঢং করে চারবার ঘন্টা বাজার শব্দ হলো। মেঘ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে চারটা বাজে। তারমানে সৈকত মধ্যে রাতে মদ খেয়ে ফিরে এখন এখানে দাড়িয়ে মাতলামি শুরু করেছে।
মেঘের রাগটা চরমে পৌছে গেল।
—এই আপনার সমস্যা কি??এই মধ্যে রাতে মদ খেয়ে বাসাই ফিরে গলা ছেড়ে চিল্লাচিল্লি করছেন। সারাদিন পরিশ্রম করে সবাই একটু ঘুমাচ্ছে আর আপনি!!??বাবা যদি এখন আপনাকে এ অবস্থায় দেখে তাহলে বুঝতে পারছেন তার মনে কেমন প্রভাব পড়বে?
—এই তুমি কত টাকার মাইনে নেওয়ার চুক্তি করেছ হ্যা। তুমি কার হয়ে এত কথা বলতে এসেছো এখানে?
—মানে কি বলছেন আপনি!!?
—আমি কিছু বুঝিনা ভেবেছো । একটা মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে তুমি। তা জানা সত্বেও চৌধুরী সাহেব তার নিজের স্ট্যাটাস তার সামাজিক সম্মান ভুলে তোমাকে এ বাড়িতে আমার বউ করে এনেছে। নিশ্চয় তার পেছনে বড় কোন কারণ আছে। না এ বিয়েতে তোমার মতামত নিয়েছিল ,না আমার!!
বুঝলাম তুমি এত বড় বাড়ি, গাড়ি,শাড়ি ,গহনা পেয়ে সব ভুলে নিজেকে মানিয়ে নিছ। কিন্তু আমি!!??
সৈকত মেঘ কে এভাবে অপমান করবে মেঘ ভাবতেও পারছে না। মেঘ মনে মনে সৈকত একটু একটু করে ভালবাসতে শুরু করেছিল তা কি সৈকত একটুও বুঝতে পারে নি!!??
আর সৈকত সে সব বুঝবার চেষ্টা না করেই মেঘের ভালবাসা কে পণ্যের দামে বেচে দিল!!??
মেঘের ভালবাসা নাকি বাড়ি ,গাড়ি,শাড়ি আর গহনার জন্যে!!!
মেঘের মনে মনে হাসি পাচ্ছে । খুব হাসি পাচ্ছে। তবে সে হাসিটা জীবনের সবচেয়ে পরাজয়ের হাসি।
তার বাবা তাকে এমন একটা মানুষের সঙ্গে বিয়ে দিল যে তাকে এ কদিনে একটা বারের জন্যে ও বুঝবার চেষ্টা না করে প্রতিনিয়ত উঠতে বসতে অপমান করে চলছে। নিজের ইচ্ছা মত কথা সাজিয়ে কি র্নিদ্বিধায় বলে ফেলছে। একটা বারের জন্য ভাবছে না যে তার এই কথা গুলো অন্যে মানুষটার বুকের মধ্যে এফোড় ওফোড় করে দিচ্ছে।
মেঘ না চাইতেও ওর চোখ দিয়ে দরদর করে পানি ঝরতে লাগলো।
হঠাৎ মেঘ নিজের কাধে কারো স্পর্শে পিছন ফিরে তাকায় ।
—বাবা আপনি? বলে মেঘ নিজেকে সামলে নিয়ে চোখের পানি মুছে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে।
—হ্যা আমি। আমি সব শুনেছি ।
—আপনি কেন শুধু শুধু এই মাঝরাতে উঠে আসতে গেলেন।
চৌধুরী সাহেব আস্তে করে সৈকতের সামনে গিয়ে দাড়ালেন। তারপর সৈকতের পা থেকে মাথা পর্যন্ত ভাল করে নিরিখ করে দেখে বললেনঃ
—এতদিন আমি তোমার এই কাজ গুলো তোমার আচারন গুলোকে শুধু ছেলে মানুষী ভেবে পাত্তা দেয়নি। ভেবেছি সময়ের সাথে সাথে তুমি পাল্টে যাবে। নিজেকে শুধরিয়ে নেবে ।
কিন্তু ,না।
আমার সে ধারনা ভুল।
মানুষ শুধুমাত্র স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়লেই তার মন মানসিকতা উন্নত হয় না । সেটা তুমি নিজে প্রমান করলে।
আমার সঙ্গে তোমার মনের ভিতরে যে সব জিনিস নিয়ে দ্বন্দ্ব ,সে সব প্রশ্নের জবাব তুমি ঠিক একদিন পেয়ে যাবে। আর তখন তুমি এই দিনটার জন্য আফসোস করবে। এই ভেবে যে তুমি নিজের মনগড়া কল্পকাহিনী নিয়ে এতদিন পড়েছিলে। কখনও অন্যের মন দিয়ে ভাবার অন্যের চোখ দিয়ে দেখার চেষ্টা করো নি।
আচ্ছা সেসব বাদ দিলাম এখন বলো
এই মেয়েটার কি দোষ??
কেন শুধু শুধু তাকে কষ্ট দিচ্ছ? কেন কথায় কথায় ছোট করছো?
শুধুমাত্র এ জন্যেই যে আমি নিজে পচ্ছন্দ করে তাকে এ বাড়িতে বউ করে এনেছি??
সৈকত আর কোন কথা বলতে পারে না। মনে হচ্ছে যেন জোকের মুখে লবণের ছিটে পড়েছে। এতক্ষন যে চিল্লাচিল্লি করে সারা বাড়ি মাথায় তুলছিল আর সে এখন চুপ করে মাথা নিচু করে দাড়িয়ে আছে।
চৌধুরী সাহেব ঝিনুকের দিকে তাকিয়ে বললো যা ওকে ঘরে পৌছে দে।
ঝিনুক মাথা নাড়িয়ে হ্যা বলে সৈকতের কাছে এগিয়ে বললো চল ভাইয়া ঘরে চল।
সৈকত ঝিনুকের হাত সরিয়ে দিয়ে বললো আমার কাউকে লাগবে না। আমি একাই চলে যেতে পারবো।
চৌধুরী সাহেব মেঘের কাছে এসে বললোঃ
—কাঁদিস না মা,দেখবি একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। যে আজ তোর ভালবাসার কোন দাম দিচ্ছে না একদিন সেই সর্বোচ্চ মূল্য দিয়ে তোর ভালবাসা কিনতে চাইবে।
তোর ভালবাসা পাবার জন্য পাগল হয়ে যাবে ।
মেঘ কোন কথা বলতে পারে না। চুপ করে দাড়িয়ে থাকে।
————**——**——**————
মেঘ আর সৈকতের সামনে যায় না।
ঝিনুকে দিয়ে রুম থেকে কাপড় আনিয়ে ঝিনুকে বলেঃ
—আমি যদি তোমার রুম ব্যবহার করি তাহলে কি তোমার সমস্যা হবে?
—কি যে বলো না ভাবি। আমার কেন সমস্যা হবে??
—অনেক ধন্যবাদ ।
—ভাবি এটা ঠিক না। তুমি আমাকে ধন্যবাদ দিচ্ছ।
আচ্ছা শোন আমি কলেজে যাচ্ছি ফিরে এসে কথা হবে।
মেঘ মাথা নাড়িয়ে সায় দেয়।
ঝিনুক বুঝতে পারে মেঘের মনটা খারাপ । ভাইয়া যে তখন কেন এমন সব কথা বললো কে জানে!!?ঝিনুক ছোট বেলা থেকে খেয়াল করছে সৈকত তার অন্যে দু ভাইয়ের থেকে অনেক আলাদা। সৈকত ঝিনুককে অনেক ভালবাসে । ঝিনুক ও তার দু ভাইয়ের থেকে সৈকত কে অনেক বেশী ভালবাসে । কিন্তু সৈকত যে কেন এমন তা ঝিনুক ও বুঝতে পারেনা।
ঝিনুক চলে যাওয়ার পর মেঘ বাথরুমে ঢুকে শাওয়ার টা ছেড়ে মন খুলে কাঁদে । এ দিনে সৈকতের দেওয়া ছোট ছোট আঘাত মেঘ ভুলতে বসেছিল কিন্তু আজকের বলা কথা গুলো মেঘের কানের মধ্যে বেজেই যাচ্ছে। এতচেষ্টা করছে মেঘ কথা গুলো ভুলে যাওয়ার জন্য কিন্তু পারছে না।
সারাদিন মেঘ আর রুম থেকে বের হয়না।
শুইয়ে বসে কাটিয়ে দেয় । তার মার ক্লিনিকে বলা কথা গুলো মনে করে খুব কান্না পায় । আর মনে মনে হ্যা আম্মু তুমি ঠিকই বলেছিলে আমি কপাল গুনে এমন একটা স্বামী পেয়েছি তা না হলে কি!!??
মেঘ ওর বাড়ির সবাই কে খুব মিস করতে থাকে। সবার মুখটা মেঘের চোখের সামনে ভেসে ওঠে।
মেঘের মন চাই একছুটে বাড়ি গিয়ে ওর আম্মুর গলা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে।
রোজি এসে অনেক বার জানতে চেয়েছে কি হয়েছে কিন্তু মেঘ কিছুই বলেনি। শুধু বলেছে ওর শরীরটা ভাল লাগছে না।
রোজি অনেক জোরাজুরি করে মেঘের মুখে দু-তিন বার খাবার তুলে দিয়েছে ওতটুকুই। নিজ থেকে আর খায়নি।
মেঘ মনে মনে ঠিক করে ওর শ্বশুর রাতে বাসায় ফিরলে অনুমতি চাইবে বাড়ি যাওয়ার জন্য।
মেঘ একটা বারের জন্যেও সৈকতের খোজ নেয় নি। ওর রুমে ও যায় নি।
সৈকত ও মেঘের কোন খোজ নেয়নি। মেঘ বাসায় আছে না রাগ করে চলে গেছে তা সৈকত জানেনা।
————**——**——**————
চৌধুরী সাহেব বাসায় ফিরে আগে মেঘের খোজ করে ।
মেঘ নিজে শ্বশুরের রুমে যায়।
—বাবা আসবো?
—আয় মা ,আয়। বাবার রুমে আসতে কি মেয়ের কোন অনুমতি লাগেরে মা।
—আপনি কোন কাজ করছিলেন কিনা!!?
—জানিস মা এই বাজে অভ্যাস টা আমার কোন দিনও ছিল না,এখন ও নেই। আমি অফিসের কাজ অফিসে করতে ভালবাসি । বাসাকে কখনও অফিস ভাবিনা।
—মেঘ মুখে একটু হাসি টেনে বলে এটা তো খুবই ভালকথা।
—তোর মুখটা এত শুকনা দেখাচ্ছে কেন?সারা দিন না খেয়ে আছিস মনে হয়।
—না বাবা ,আসলে—-
হঠাৎ রোজি চায়ের কাপ টেবিলে রেখে বলে। সত্যি বলেছেন বাবা ও আজ সারাদিন ও কিছুই খায়নি। কি হয়েছে তাও কিছু বলছে না। মন খারাপ করে সারাদিন ঘরে বসে ছিল। ওদিকে সৈকতের ও একই অবস্থা।
চৌধুরী সাহেব রোজিকে বললেনঃ
—বড় বৌমা তুমি একটা কাজ করো।
—কি বাবা?
—তুমি চা টা নিয়ে যাও। আমি এখন চা খাব না। তুমি বরং কাউকে দিয়ে আমার আর মেঘ মায়ের খাবারটা রুমে পাঠিয়ে দাও।
রোজি খুশি হয়ে বলে ঠিক আছে বাবা আমি এখনি যাচ্ছি।
রোজি খাবারটা রুমে দিয়ে যায়।চৌধুরী সাহেব খাবার নিয়ে নিজ হাতে মেঘের মুখে তুলে খাইয়ে দেয়। মেঘ ছোট্ট বাচ্চাদের মতো চুপচাপ খাবার খেতে শুরু করে।আর চোখ বেয়ে পানি পড়ে।
চৌধুরী সাহেব বলেঃ
—জানি রাতে সৈকতের ঐ কথা গুলো শুনে তুই অনেক কষ্ট পেয়েছিস। ওর কথায় মন খারাপ করিস না । ও মন থেকে এসব বলেনি। দেখেছিস তো বাইরে থেকে কিসব গিলে এসে ঐভাবে কথা বলছিল।
ওর মনটা না এখনো বাচ্চাদের মতোই রয়ে গেছে। ও যে মন থেকে কি চায় সেটাই ও আজ পর্যন্ত ঠিক করতে পারে না। এখন এটা ভাবে তো আরেকটু পর ওটা।
আমি যেদিন তোকে দেখে ছিলাম সেদিই বুঝেছিলাম তুই ছাড়া আর কেউ ওকে ভাল করতে পারবে না। আমার সৈকতের জন্য যে শুধু তোকে দরকার । তুই ওকে ছেড়ে কোথাও যাস না মা।
—কিন্তু বাবা!!
—কি মা বল।
—আমি কিছুদিনের জন্য বাড়ি যেতে চাই।
—জানি তোর খুব বাড়ির জন্য মন খারাপ লাগছে। কিন্তু মা তুই যদি এসময় বাড়ি যাস তাহলে সবাই অন্য কিছু মনে করতে পারে। তুই এখনও ভাল করে সুস্থ হোসনি এক্ষনি বাড়ি গেলে তোর আব্বু আম্মু কি মনে করবে।
মেঘ ভাবে সত্যিই তো এখন যদি আমি বাড়ি যায় তাহলে সবার মনে অনেক প্রশ্ন জাগতে পারে।
(চলবে….]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here