বেখেয়ালি মনে পর্ব-২৪

0
518

#বেখেয়ালি_মনে
#লেখনীতে- Ifra Chowdhury
পর্ব-২৪
.
.
– সিলেট গিয়ে মস্তবড় হক বাড়ি দেখে আসছো না? ওটা কিন্তু আমার বাড়ি না।
তাচ্ছিল্যের সুরে কথাটা বলে ইনান।
অবাক কন্ঠে ত্রয়ী জিজ্ঞেস করে,
– তাহলে ওটা কার বাড়ি?
– বলছি শুনো! মোস্তফা হককে দেখেছো না? উনি কিন্তু আমার নিজের বাবা না। ইনফ্যাক্ট হক বাড়ির কারো সাথে আমার রক্তের সম্পর্ক নেই।

ত্রয়ী যেনো ইনানের কথা গুলো শুনে অবাকের সর্বোচ্চ স্তরে চলে যাচ্ছে। সে নির্বাক ভঙ্গিতে সব শুনে যাচ্ছে।

ইনান কয়েক সেকেন্ড থেমে আবার বলল,
-আমার বয়স যখন আট বছর। তখন আমার বাবা মিলন শেখ হার্ট অ্যাটাকে মারা যান। তখন আমার মা খুব একা হয়ে যায়। দাদার বাড়ি থেকে তেমন সহয়তা পাইনি আমরা। মা চলে যায় নানুর বাড়ি। সেখানেও মাস কয়েক থাকার পর মামাদের বোঝা হয়ে যাই আমরা মা ছেলে।

নানা ভাই বেঁচে ছিলেন না। নানু ছিলেন অসুস্থ তাই প্রতিবাদ কর‍তে পারতেন না। আমি আর মা কত রাত না খেয়ে কাটিয়েছি, তা হিসেব ছাড়া। পড়া লেখা করার সুযোগ দেয়নি। তবুও আমি মামাতো ভাইয়ের বই থেকে চুরি করে একটু একটু পড়তাম। সেটাই মাথায় গেঁথে যেতো।

এভাবে আরো কয়েক মাস কেটে যায়। তারপর আমার এক মামা মায়ের দ্বিতীয় বিয়ের সম্বন্ধ নিয়ে আসেন। মা প্রথমে রাজি হয়নি। তারপর আমার ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে রাজি হতে বাধ্য হয়েছিলো।

দ্বিতীয় বিয়ের প্রস্তাব আসে হক বাড়ি থেকে। খুব সম্ভ্রান্ত পরিবার। এসব দেখে মা ঘাবড়ে যায়। যদি তারা আমাকে না মেনে নেয়! এই ভয়টা মায়ের আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে।

ইনান থামে। ত্রয়ী মনোযোগী শ্রোতা হয়ে সবটা শুনে যাচ্ছে।

ইনান দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আবার বলতে শুরু করে,
-তখন মা আবার এই সম্বন্ধ থেকে পিছিয়ে যায়। আর ঠিক সেই মুহুর্তে সৈয়দ হক মানে দাদাভাই মায়ের সাথে কথা বলেন। তিনি মাকে আশ্বস্ত করে বলেন, আমার দায়িত্ব যদি তার ছেলে মোস্তফা হক নিতে অস্বীকার করে, তাহলে তিনি নিজে আমার সম্পুর্ন দায়িত্ব নিবেন।
দাদাভাই যেটা বলেছিলো, হলোও সেটা। মোস্তফা হক অর্থাৎ বাবা আমাকে মেনে নেয়নি। তবে মা দাদাভাইয়ের কথার উপর ভরসা করে, আমার ভবিষ্যতের কথা ভেবে মোস্তফা হকের সাথে বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ হয়।

হঠাৎ করে ত্রয়ী খেয়াল করে ইনানের কন্ঠ ভেজা ভেজা লাগছে। হয়তো কাঁদছে। আবেগে ত্রয়ীর কান্না চলে আসে। সে নিজেও চোখ থেকে কয়েক ফোটা পানি বিসর্জন দেয়।
– তারপর?
ত্রয়ীর প্রশ্ন শুনে ইনান ওর দিকে তাকায়।

তারপর মৃদু কন্ঠে বলে,
– মোস্তফা হক আমাকে মেনে নেয় নি। মায়ের সাথে প্রায়ই এই নিয়ে ঝগড়া হতো। দাদাভাই আমার আর মায়ের পক্ষে ছিলেন সবসময় । দাদাভাইয়ের বদৌলতে আজকের এই আমি।

ত্রয়ী কাঁপা কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
– আঙ্কেল কি এখনো আপনাকে মেনে নেয় নি?

ইনান হাসে। শব্দ করে হাসে। ত্রয়ী চমকে যায় সেই হাসির তান্ডবে।

কিছুক্ষন নীরব থেকে ইনান বলে,
– মেনে নিয়েছে। আমার এসএসসি এক্সামের পর আমাকে মেনে নিয়েছে। আমার রেজাল্ট সর্বোচ্চ ছিলো, বিধায় পাড়ার লোকজন গুনগান গেয়েছিলো আমার। তারপর মোস্তফা হক আমাকে মেনে নিয়েছে।

তবে, এখন আমি বাবার চোখের তারা। আমাকে যেনো চোখে হারায় তিনি। আমিও আগের সব কিছু ভুলে উনাকে নিজের বাবার জায়গা দিয়েছি। তার একমাত্র কারণ হলো আমার মা। মায়ের চোখের পানি আমি সহ্য করতে পারিনা। অনেক কেঁদেছে মা। তাই আর নতুন করে আমি মায়ের কাঁদার কারণ হতে চাইনা।

– সব-ই বুঝলাম। কিন্তু প্রিয়া আপুর বাবা আপনাকে কেন মেনে নিলো না? আপনার তো এখন বাবা-মা দুজনেই আছে। তাহলে?
উদাস কন্ঠে কথাখানা বলে ত্রয়ী।

ইনান বলল,
– প্রিয়ার বাবা ভেবেছিলো, আমি যেহেতু হক বাড়ির কেউ না, তাহলে হয়তো আমি হক বাড়ির সম্পত্তির অংশীদার হবোনা। আর তিনি এতো সম্ভ্রান্ত একজন ব্যক্তি হয়ে নিজের একমাত্র মেয়েকে কোনো অনাথের হাতে তুলে দিতে পারবেন না। অথচ, ভদ্রলোক এটা বুঝেন নি হক বাড়ির অর্ধের সম্পত্তির মালিক আমি। দাদাভাই আমার নামে অর্ধেক সম্পত্তি লিখে দিয়েছেন।

– ছিঃ মানুষের মন মানসিকতা এতো নিচুও হয়? তিনি নিজেই তো এতো বড় ব্যবসায়ী। তাহলে মেয়ের স্বামী কত সম্পত্তির মালিক, এসব দিয়ে উনি কী করবেন?
তার তো সবার আগে তার মেয়ের সুখের কথা ভাবার কথা ছিলো।
বিরক্তিকর সুরে কথা গুলো বলল ত্রয়ী। প্রচন্ড রাগ হচ্ছে তার প্রিয়ার বাবার উপর।

– এই দুনিয়ায় সম্পত্তি আর টাকাই সব কিছু। তুমি তো পিচ্চি, তাই বুঝবেনা এসবের হিসেব। যাদের আছে, তাদের আরো চাই। হাহ!

ইনান ত্রয়ী দুজনেই নিশ্চুপ হয়ে আছে। আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে আছে। প্রকৃতি ও যেনো তাদের সঙ্গ দিচ্ছে। হঠাৎ করেই ইনান হাউমাউ করে কেঁদে উঠে। ত্রয়ী ঘাবড়ে যায়।

-হঠাৎ কী হলো মানুষটার?
আপন মনে আওড়ায় কথাগুলো সে। তারপর আবার ভাবে, কাঁদুক উনি। কাঁদলে বুকের ভেতর জমানো বোঝা গুলো একটু হলেও হালকা হবে।

ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়া শুরু হয়েছে। ইনানের চোখের পানি আর বৃষ্টির পানি মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। ত্রয়ী আর সহ্য কর‍তে পারছে না ইনানের কান্না।

তাই ইনান কে ঝাপটে জড়িয়ে ধরে বলে,
– প্লিজ আপনি এভাবে কাঁদবেন না। আমার সহ্য হচ্ছেনা। প্লিজ।

কান্নারুদ্ধ কন্ঠে ইনান বলে,
-আমাকে ছেড়ে সবাই চলে যায়। এই যে তুমি এখন আমার পাশে আছো, হঠাৎ একদিন তুমিও চলে যাবে।
ত্রয়ীও পাগলের মতো কাঁদতে শুরু করেছে। কন্ঠে তার কথা আসছে না। তবুও বলার চেষ্টা করছে।

– আমি কোনোদিন আপনাকে ছেড়ে যাবোনা। আজ এই মুহুর্তে থেকে আমার জীবনের শেষ নিঃশ্বাস অবধি আমি আপনার সাথে থাকবো। এই আপনাকে ছুঁয়ে কথা দিলাম।

খুব শক্ত করে ইনানের হাত দু’টো ধরে ত্রয়ী কথাটা বলে। অপরদিক থেকে ইনানও জোঁকের মতো আঁকড়ে ধরে।

শুরু হয় দু’জন মানুষের প্রণয় লীলা। চারপাশ অন্ধকারে নিমজ্জিত। হঠাৎ হঠাৎ আকাশ চমকাচ্ছে আর সেই আলোর সূত্র ধরে দু’জন দু’জনের চোখের দিকে স্থির নয়নে তাকিয়ে আছে। খুব জোরেশোরে বজ্রপাত পড়ার ফলে ত্র‍য়ী ইনানকে জড়িয়ে ধরে। ইনান তার সঙ্গ দিয়ে তার আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নেয় ত্রয়ীকে।
ইনানের বুকের ধুকপুকানির শব্দ স্পষ্ট ভাবে শুনতে পাচ্ছে ত্রয়ী। তার গরম নিঃশ্বাস গুলো ত্রয়ীর কপালে পড়ছে। এলোমেলো নিঃশ্বাস ফেলে ত্রয়ী। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে। তবুও একে অপরকে ছাড়ছেনা।

দু’জন দু’জনের প্রেমে মাতাল হয়ে যাচ্ছে। বেখেয়ালি মনের মাতাল করা প্রেমের শুরু হয় ঠিক সেই মুহুর্ত থেকে।
তীব্র থেকে তীব্রতর ভাবে একজন আরেকজনের নেশায় আসক্ত হয়ে যায়।

_________________________________________________________
সকালে কিচেন রুম থেকে আসা আওয়াজের চোটে ঘুম ভেঙে যায় ইনানের। ঘুম ঘুম চোখেই কিচেন রুমের দিকে এগিয়ে এসে হা হয়ে যায় সে।

চেঁচিয়ে বলে,
– আরে আরে বোকপাখি করছো কী? পড়ে যাবে তো। নেমে আসো এক্ষুনি।

ত্রয়ী ঘাড় ঘুরিয়ে ইনানকে একপলক দেখে আবার নিজের কাজে মন দেয়। চেয়ারে দাড়িয়ে কিচেন রুমের উপরের সেল থেকে আচারের কৌটো পাড়ছে সে।

আচারের প্রতি ভীষণ রকমের দূর্বলতা তার। তাই সে আসার সাথে সাথেই রাবেয়া হক ইয়াদকে ডাক দিয়েছিলো আচারের কৌটোটা পেড়ে দেওয়ার জন্য। কিন্তু ইয়াদ সেই ভোরেই বাসা থেকে বের হয়ে যাওয়ায় অগত্যা ত্রয়ীকেই কাজটা করতে হচ্ছে।

ইনান ধমক দিয়ে বলে,
– এই মেয়ে, নামতে বলছি না? তাড়াতাড়ি নামো, আমি পেড়ে দিচ্ছি।

ত্রয়ী ভেংচি কেটে বলে,
– কেন নামবো? আমি পিচ্চি হলেও বেশ লম্বা আছি আমি নিজেই পাড়তে পারবো।

কথাটা বলেই কৌটোটা হাতে নিয়ে পা ফসকে পড়ে যেতে নেয় ত্রয়ী।

ইনান সেটা লক্ষ্য করে দৌড়ে এসে দু’হাত বাড়াতেই ত্রয়ী ধপাস করে তার কোলে পড়ে যায়। ভয়ের চোটে চোখ বন্ধ করে ফেলে সে। হঠাৎ নিজেকে কারো কোলে আবিষ্কার করে চোখ খুলে তাকায় সে। তাকিয়ে দেখে ইনান মিটিমিটি হাসছে। লজ্জায় ত্রয়ীর ইচ্ছে করছে মাটিতে মিশে যেতে। এক হাতে তার আচারের কৌটো অন্যহাত দিয়ে ইনানের কলার খামচে ধরে আছে।

রাবেয়া হক মোস্তফা হককে পান বানিয়ে দিচ্ছেন বিধায় কিচেনে আসতে পারছেন না। তাই তিনি ইফতিহাকে পাঠায় ত্রয়ী আচারের কৌটাটা নিতে পেরেছে কি-না দেখার জন্য। ইফতিহা কিচেন রুমের দরজার সামনে এসে থমকে দাঁড়ায় এমন দৃশ্য দেখে। খুক খুক করে কেশে উঠে সে।

ইফতিহাকে দেখে তাড়াতাড়ি ত্রয়ীকে কোল থেকে নামিয়ে দেয় ইনান। ত্রয়ী লজ্জা পেয়ে দৌড়ে পালায় সেখান থেকে। ইনান মাথা চুলকাতে চুলকাতে কিচেন রুম থেকে বেড়িয়ে যায়। দু’জনের এমন কান্ডে ইফতিহা মুচকি হাসতে থাকে।

.
.
চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here