বেখেয়ালি মনে পর্ব-২৬

0
659

#বেখেয়ালি_মনে
#লেখনীতে- Ifra Chowdhury
পর্ব-২৬
.
.
তনয়া ছুটছেন নিজের বাবার বাড়ি। খুব ভোরেই খবর এসেছে তার মা খুব অসুস্থ। সেই থেকেই কান্নাকাটি শুরু হয়ে গেছে তার। বাসার সবাই যাচ্ছে শুধু ত্রয়ী ছাড়া। মাঝরাতে প্রচন্ড জ্বর উঠায় ওকে নিয়ে যাওয়ার সাহস পাচ্ছে না। তাই তনয়া ত্রয়ীকে রাবেয়া হকের দায়িত্বে বাসায় রেখে যাচ্ছেন। সারাদিন বাসায় থাকলেও রাতে যাতে ত্রয়ী ইফতিহার সাথে গিয়ে ঘুমায়, একথা পৈ পৈ করে বলে গেছেন তনয়া।

সকাল আটটা নাগাদ তারা বেরিয়ে পড়ে। ত্রয়ী জ্বরের ঘোরে বেঘোরে ঘুমোচ্ছে। বাসায় কেউ নেই তাই ইনান দ্রুত ত্রয়ীর কাছে আসার জন্য উঠে দাঁড়ায়। রাবেয়া হক আসতে চাইলে ইনান তাকে বাধা দিয়ে বলে,
– আমি পারবো ওকে সামলাতে তুমি অতো চিন্তা করো না। তুমি বরং কিছু নাস্তা পাঠিয়ে দিও ওর জন্য।

রাবেয়া হক মৃদু হেসে বলল,
– আচ্ছা ঠিক আছে। তবে, কোনো কিছুর প্রয়োজন হলে আমাকে ডাকিস।

মায়ের সম্মতি পেয়ে ইনান ব্যস্ত পায়ে ত্রয়ীর কাছে ছুটে আসে।
ত্রয়ীর ঘুমন্ত চেহারা দেখে ইনান থমকে যায়। একরাতের জ্বরে মুখ শুকিয়ে গেছে একদম। গোলাপি আভার ঠোঁটগুলো ফেটে ফেটে গেছে। ইনান আলতো হাতে ত্রয়ীর কপালে হাত রাখে। ত্রয়ী হালকা নড়ে উঠে আবার ঘুমিয়ে পড়েছে।

জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে মেয়েটার। ইনান দ্রুত থার্মোমিটার দিয়ে টেম্পারেচার চেক করে নেয়। চোখ যায় তার পাশে রাখা জলপট্টির দিকে। তাড়াতাড়ি করে জলপট্টি দিতে থাকে সে। হঠাৎ ত্রয়ী, ইনানের হাত খামচে ধরে। ইনান ব্যথা পেলেও চুপ করে তা সহ্য করে নেয়। হাতের বড় বড় নখ গুলো একদম দেবে গেছে হাতে। মিনিট দু’য়েক পর আবার হাত ছেড়ে দেয় ত্রয়ী।

সারা গায়ে কাঁপুনি দিয়ে উঠে। ইনান বেডের উপর থাকা কম্বল টেনে দেয় তার গায়ের উপর। কম্বলেও যেনো শীত কমছেনা। আশেপাশে তাকিয়ে আর কোনো কম্বল বা কাঁথা কিছুই দেখতে পায়না সে। তাই দ্রুত ত্রয়ীর মাথা উঠিয়ে ওর বুকের সাথে চেপে ধরে।

ইনানের বুকের উষ্ণতায় ত্রয়ী আরামবোধ করে। প্রায় আধঘন্টা ওভাবেই থাকে ত্রয়ী। জলপট্টি দেওয়ার কারণে টেম্পারেচার একটু কমে এসেছে। ইনান ধীরে ধীরে ওকে বেডে শুইয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। রাবেয়া হককে কল করে।

ছেলের কল পেয়ে রাবেয়া হক আৎকে উঠে। রিসিভ করে বলে,
– কিছু হয়েছে মেয়েটার?
ইনান মাকে আশ্বস্ত করে বলে,
– না মা, ও এখন ঠিক আছে। তুমি খাবার পাঠাও। কিছু খাওয়ানো দরকার ওকে।

রাবেয়া হক দ্রুত কল কেটে দিয়ে ওদের জন্য খাবার নিয়ে আসেন। এসেই ত্রয়ীর মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। মৃদু কন্ঠে ডাকেন,
– ত্রয়ী?

ত্রয়ীর সাড়া না পেয়ে ইনানের দিকে তাকান তিনি। ইনান চোখের ইশারায় বলে,
– তুমি যাও। আমি ওকে খাইয়ে দিবো।

রাবেয়া হক আর কিছু না বলে উঠে দাঁড়ান যাওয়ার জন্য। ইনান পিছু ডেকে বলে,
– মা! ও ঠিক হয়ে যাবে তো? আমার ওকে এভাবে দেখতে একটুও ভালো লাগছেনা। কত্তো প্রানবন্ত মেয়েটা এভাবে নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছে। আমার সহ্য হচ্ছে না।

ছেলের ব্যাকুলতা বুঝতে পেরে রাবেয়া হক বলে,
– একটা থাপ্পড় দিবো তোকে। সামান্য জ্বর হয়েছে মেয়েটার। আর তুই এভাবে ভেঙে পড়ছিস? বাবুসোনা, তুই তো এতো ভীতু ছিলি না। প্রেমে পড়ে তো দেখি এখন সেটাও হয়ে গেছিস।

ইনান চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। কী বলবে কিছুই বুঝতে পারছেনা। সত্যিই তো ইনান ভীতু না। তাহলে আজ হঠাৎ এমন কথা বলছে কেন?

রাবেয়া হক আবার বলল,
– তুই যা উপরে। আমি ত্রয়ীর কাছে বসছি। কোথায় মেয়েটাকে একটু যত্ন করবে তা না করে আজেবাজে সব চিন্তা করে বসে আছে।

মায়ের ধমক খেয়ে ইনান বলে,
– না, না, মা আমি-ই থাকবো। তুমি যাও। আমি আর এসব ভাববো না।

ছেলের এসব পাগলামি দেখে রাবেয়া হক মৃদু হাসেন। ভেতর থেকে তার দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। অনেক গুলো বছর পর ছেলেটা আবার আগের মতো চঞ্চল হয়ে উঠেছে। সব কিছু ভুলে নিজের ভালোবাসার মানুষকে খুঁজে পেয়েছে। তিনি একবার দু’জনের দিকে চোখ বুলিয়ে উপরে চলে যান।

ইনানের বুকের ভেতর টায় খুব অস্বস্তি হচ্ছে। ভালোবাসার মানুষের সামান্য কিছুতেই এমন অস্থিরতা শুরু হয় কেন? তা ইনানের অজানা।

__________________________________________________________

মিনিট দশেক পর ইনান ত্রয়ীর পাশে বসে শীতল গলায় তাকে ডাকে।
– ত্রয়ী? এই ত্রয়ী? উঠো।

ত্রয়ী হালকা চোখ খুলে আবার বন্ধ করে ফেলে। ইনান বুঝতে পারে এভাবে ত্রয়ী জাগবে না। তাই সে ত্রয়ীকে পাঁজা কোলে উঠিয়ে নেয়। শরীরের দূর্বলতার জন্য ত্রয়ী তাকাতে পারছে না। পুরো শরীরটা কেমন জানি অসাড় হয়ে আছে। ইনান ত্রয়ীকে নিয়ে ওয়াশরুমে যায়।

তারপর চোখে মুখে হালকা পানি ছিটিয়ে দিতেই ত্রয়ী ধীরে ধীরে চোখ খুলে।

আচমকা নিজেকে ইনানের কোলে আবিষ্কার করে ত্রয়ী হকচকিয়ে উঠে। কাচুমাচু হয়ে বলে,
– আ-আ-আপনি এখানে কেন? কেউ দেখে ফেললে কী ভাববে? নামান আমাকে।

এতোক্ষণ পর ত্রয়ীর কন্ঠ শুনতে পেয়ে ইনান গোপনে নিঃশ্বাস ছাড়ে। তারপর বলে,
– বাসায় কেউ নেই গো লজ্জাবতী। শুধু আমি আর তুমি।

কথাটা শুনা মাত্র-ই ত্রয়ীর চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়। তোতলানো কন্ঠে বলে,
– ক-কে-কেন সবাই কোথায়?

ইনান ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এসে ত্রয়ীকে বেডে বসিয়ে দেয়। তারপর বলে,
– তোমার নানু খুব অসুস্থ তাই সবাই উনাকে দেখতে গেছেন। তুমি সুস্থ হলে তোমায় নিয়ে যেতে বলেছে আমাকে।

কাঁদো কাঁদো গলায় বলে,
– নানুর কী হয়েছে? আমরা কবে চাঁদপুর যাবো?

ত্রয়ীর এমন কান্ডে ইনান হেসে ফেলে। হাসতে হাসতে বলে,
– জ্বরে দেখি তোমার মাথাটা একেবারে খারাপ হয়ে গেছে। তোমার নানুর বাসা চাঁদপুর না। কুমিল্লায়। পাগলী একটা। এখন, এতো কথা না বলে স্যুপ টা খেয়ে নাও। ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।

ত্রয়ী আড়চোখে স্যুপের দিকে তাকিয়ে ঢোক গিলে বলে,
– আমি খাবো না। আমার খিদে নেই।

– খাবো না বললে হবে না তো জান। খেতে হবে না হলে তাড়াতাড়ি সুস্থ হবে কীভাবে বলো? স্যুপ টা খেয়ে ঔষধ খেতে হবে তো।

– কেমন জানি তেতো লাগছে গলার ভেতর টায়। আমি খাবো না প্লিজ।

– ত্রয়ী মাইর দিবো কিন্তু। তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও। জ্বর হলে এমন হালকা তেতো লাগে।

ইনানের ধমক শুনে ত্রয়ী কাঁদো কাঁদো গলায় বলে,
– আপনি পঁচা। শুধু বকা দেন। একটুও ভালোবাসেন না আমায়।

– হ্যাঁ আমি পঁচা এখন স্যুপ টা না খেলে কিন্তু সত্যি মাইর দিবো। তাড়াতাড়ি খাও।

পরক্ষণেই একটু দম নিয়ে ইনান আবার বলে,
– আচ্ছা তোমায় খেতে হবে না। আমি-ই খাইয়ে দিচ্ছি।

ত্রয়ী খেতে না চাইলেও ইনান জোর করে ওকে স্যুপ টা খাইয়ে দেয়। হঠাৎ করে ত্রয়ীর চোখ আটকে যায় ইনানের হাতের দিকে। কেমন বিচ্ছিরি ভাবে কেউ খামচি দিয়েছে মনে হচ্ছে তার।

– আপনার হাতে এভাবে খামচি দিলো কে?
ত্রয়ীর কথা শুনে ইনান বিষম খায়। দুষ্ট কন্ঠে বলে,
– আমাদের বাসায় একটা বাচ্চা আছে না? ও দিয়েছে।

ভ্রু কুঞ্চন করে ত্রয়ী বলে,
– কে বাচ্চা? কখনো তো দেখলাম না তাকে।
ইনান ফিক করে হেসে দিয়ে বলে,
– তাকে তুমি চিনবেনা। সে বড় বাচ্চা, তবে ভীষণ দুষ্টু।
– বলুন না কে সে? নাম কী তার?
– উম! তার নাম হচ্ছে বোকাপাখি।

ইনানের মুখে নিজের নাম শুনে লজ্জা পেয়ে যায় ত্রয়ী। অন্যদিকে ফিরে জিভ কেটে বিড়বিড় করে বলে,
– আমি আবার এমন টা কখন করলাম?

পরক্ষণেই আলতো হাতে ইনানের হাত টা নিজের কাছে টেনে চোখ বন্ধ করে ঠোঁটের ছোঁয়া দিয়ে দেয় ত্রয়ী। হঠাৎ করে ত্রয়ীর স্পর্শ পেয়ে ইনানের হৃদপিন্ড দ্রুতগতিতে লাফাতে থাকে।

ত্রয়ীর কানের মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে,
– আরে বাহ! এমন মিষ্টি করে আদর দিলে তো আমি প্রতিবারই তোমার হাতের খামচি খেতে রাজি আছি!

ত্রয়ী ধাক্কা দিতে ইনানকে নিজের কাছ থেকে সরিয়ে দিয়ে বলে,
– ধ্যাৎ! আপনি আসলেই চরম নির্লজ্জ।

একথা বলে এক হাত দিয়েই দু’চোখ বন্ধ করে ঢেকে ফেলে সে। ইনান মুগ্ধ চোখে সে দৃশ্য উপভোগ করছে আর মিটমিট করে হাসছে।
.
.
চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here