বেখেয়ালি মনে পর্ব-২৭

0
512

#বেখেয়ালি_মনে
#লেখনীতে- Ifra Chowdhury
পর্ব-২৭
.
.
ইনান হাসিটা হালকা থামিয়ে একটু দুষ্টুমির নজরে ধীরে ধীরে ত্রয়ীর দুচোখ ঢেকে রাখা হাত দু’টো নিজের হাতে সরাতে থাকে। ত্রয়ী বাচ্চাদের মতো চোখ বন্ধ করে আছে। অনবরত কাঁপছে দু’চোখের পাতা। বুকটাও ঢিপঢিপ করছে।
ও চোখ বন্ধ রেখেই ইনানকে ধাক্কা দিয়ে বেডে ফেলে দেয়। তারপর উঠে যেতে চায় ওখান থেকে। ইনান হাসছিলো খুব। ত্রয়ীকে উঠে যেতে দেখে ওর হাসি থামে। ত্রয়ীর হাত টেনে ধরে আটকে জিজ্ঞেস করে,
-এই, জ্বর নিয়ে কোথায় যাচ্ছো?
ত্রয়ী মুখ ভেংচি কাটে,
-হুহ্! জানি না। তবে যেখানেই যাই, আপনার কাছে থাকবো না এটা নিশ্চিত!
ইনান চোখ বড় বড় করে ভারী কন্ঠে বলে,
-ওলেবাবা! তাই নাকি?
-জি ইয়েস।
-কেন কেন?
-আপনার যে লাজ-লজ্জা বলতে কিচ্ছু নাই, সেজন্য।

ইনান হাসে,
-আরে বোকাপাখি আমার, লজ্জা তো নারীর ভূষণ। অযথা ছেলেরা এসব দিয়ে কী করবে বলো দেখি?

ত্রয়ী আড়চোখে তাকায় ইনানের দিকে। ও ইনানের দৃষ্টি দেখে বেশ বুঝতে পারছে ইনান যে রীতিমতো দুষ্টুমি শুরু করেছে।

ত্রয়ী মুখ ঘুরিয়ে কোনো উত্তর দিতে যাবে, তখনি দরজাটা কেউ খট করে খুলে দাঁড়ায়। দুজনেই ঘাড় ফিরিয়ে দরজার দিকে চমকে তাকায়। ইফতিহা এসেছে।

ওকে দেখে ইনান আর ত্রয়ী উভয়েই অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। ইনান চটজলদি ত্রয়ীর হাতটা ছেড়ে একটা ছোটখাটো ঢোক গিলে। ত্রয়ীও ওদিকে লজ্জায় চোখ টিপে ঘুরে দাঁড়ায়। ধ্যত সেদিনও ইফতিহা ওদের দুজনকে ওভাবে রান্নাঘরে দেখে ফেলেছিলো!
ইফতিহা নিজেও এবার বিব্রতবোধ করছে। সে বেকুবের মতো দরজার সাথে ঘেষে ঘেষে আস্তে আস্তে ওর গলাটা বের করে বত্রিশ পাটি দাঁত দেখিয়ে একটা হাসি দেয়,
-হ্যালো লাভ বার্ডস!

লাভ বার্ডস শুনে ইনান আর ত্রয়ী দুজনেই পরস্পরের দিকে অবাক চাহনিতে তাকায়। ত্রয়ীর দু’চোখ তো পুরো রসগোল্লার মতো হয়ে গেছে। ইফতিহা কি তাহলে কিছু ঠাওর করতে পেরে গেলো নাকি ওদের সম্পর্কের ব্যাপারে?
ইনান তো শুধু ওর মায়ের কাছে প্রকাশ করেছিলো ত্রয়ীকে যে ভালোবাসে। অন্য কাউকেই তো বলে নি। তাহলে ইফতিহা কীভাবে জানলো? নিশ্চিত সন্দেহ করেছে তাহলে! অবশ্য করারই কথা। যেসব অবস্থায় ওদের একসাথে পাকড়াও করছে।
ইনান আপন মনে এসব ভেবে একটু এদিক সেদিক পলক ফেলে।
তারপর ইফতিহার উদ্দেশ্যে বলে,
-তু-তুই কী করছিস এখানে?

ইফতিহা মুখ বেকিয়ে জবাব দেয়,
-এমনভাবে বলছিস যেন আসতে নিষেধ আছে এখানে! হুহ দরকারেই এসেছি।
-কী দরকার?
মুহুর্তেই আবার ত্রয়ী ইফতিহার কাছে গিয়ে ওকে টেনে এনে বলে,
-আরে ইফতিহা ভেতরে আসো না? বসো এসে।
-না আপু বসবো না। আমার এক ফ্রেন্ড এসেছে। ওর সাথেই আড্ডা দিচ্ছিলাম। তারপর মা এসে বললো তোমার খাওয়া হয়েছে কি-না দেখে যেতে।

ওদিক থেকে ইনান জবাব দেয়,
-হ্যাঁ হয়ে গেছে। নে বাটি চামচ নিয়ে যা।
ইফতিহা ওর দিকে সরু দৃষ্টিতে তাকায়,
-বাবা গো! তুমি যেমন আমাকে তাড়িয়ে দিতে চাচ্ছো?
ইনান তোতলায়,
-ক-কই? আমি তো বললাম শুধু।

ইফতিহা গোপনে মুখ ভেংচায় ইনানকে। তারপর কোনো জবাব না দিয়ে স্যুপের বাটিসহ ট্রে টা হাতে নিয়ে ত্রয়ীকে বলে,
-আমি এখন যাই আপু। পরে আসবো আবার। তুমি মেডিসিন নিয়ে নিও কিন্তু।
ত্রয়ী হেসে মাথা নাড়ায়,
-আচ্ছা।
_________________________________________________________
দুপুরবেলা বেশ একটা লম্বা ঘুম দিয়েছে ত্রয়ী। বিকেল হতে না হতেই তার ঘুম ভেঙে যায়। ঘুম ঘুম চোখ মেলে তাকায় সে। রুমে ও একাই আছে।
ধুর একা একা কি ভালো লাগে? ইনান ওকে রুমে একা রেখে গেলো কেন? পঁচা লোক একটা! আজ আসুক। খুব রাগ করবো আজ। হুম! খুব রাগ করবো।

ত্রয়ী ঘুমের মধ্যেই এসব ভাবছে আর মনে মনে বিলাপ করছে। তখনি ওর দরজায় কিছু একটার হালকা শব্দ হয়। ও ফিরে তাকায় সেদিকে। তাকাতেই দেখে ইনান ঢুকছে।
ইনান ত্রয়ীকে জাগ্রত অবস্থায় দেখে একটা হাসি দেয়,
-আরে বোকাপাখি, উঠে পড়েছো তুমি?
ত্রয়ী কোনো জবাব দেয় না। একটু আগেই ওর মনে একটা অভিমান বাসা বেধেছে। আর সেটাই এখন ভেতর ভেতর খোঁচা দিচ্ছে এখন।

ত্রয়ী মুখ ফুলিয়ে আবার অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে শুয়ে থাকে। ইনান কিছুটা অবাক হয়ে ধীরে ধীরে ত্রয়ীর ওদিকে যায়। ত্রয়ী তাকিয়েই আছে। কিন্তু ওর দৃষ্টিটা কেমন যেন হয়ে আছে। কত্ত কি যেন খেলা করছে এই চোখ দুটোতে!
ইনান ফের জিজ্ঞেস করে,
-কী হয়েছে বোকাপাখি? শরীর ঠিক আছে তো?

বলতে বলতেই ইনান ওর হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে ত্রয়ীর কপালে স্পর্শ করে। জ্বর কমেছে কি না দেখার জন্য। হাতটা ওর কপালে ঠেকতেই ইনান একটু স্বস্তিবোধ করে। গায়ের তাপমাত্রাটা একটু কম কমই লাগছে। জ্বরটা নেমেছে তাহলে।

কিন্তু অতো ভালোভাবে দেখার আগেই ত্রয়ী ইনানের হাতটা ছিটকে সরিয়ে দেয়। ইনান হতভম্ব হয়ে পড়ে।
আরে! কী হলো মেয়েটার? এমন করছে কেন?
সে ধীরে ধীরে ত্রয়ীর পাশে বসে ওর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে জিজ্ঞেস করে,
-এই কী হয়েছে তোমার? এমন করছো কেন? কিছু করেছি আমি?

ত্রয়ী এবার মুখ খুলে। ভ্রু কুচকে ইনানের দিকে তাকিয়ে বলতে থাকে,
-আপনি আমাকে একা রেখে চলে গেলেন কেন? ঘুমিয়ে পড়েছি বলে কি আপনি আমায় রুমে রেখে চলে যাবেন?
-ওহ এই ব্যাপার!
ত্রয়ীকে মুখ ভেংচিয়ে কাঁথা দিয়ে সম্পূর্ণ মুখটা ঢেকে নেয়,
-হুহ্!

ইনান ত্রয়ীর কান্ড দেখে হাসিতে ফেটে পড়ে। বুঝতে পারে ত্রয়ী অভিমান করে কথাগুলো বলছে। কিন্তু সে যে ভুলও বুঝে বসে আছে। না জেনেই অভিমান করেছে পাগলিটা।

ইনান বলতে থাকে,
-আরে! আমি তো রুমেই ছিলাম বোকাপাখি। তুমি যখন ঘুমিয়ে পড়েছিলে, তখন আমি ইয়াদকে ডেকে নিচ থেকে একটা ম্যাগাজিন আনিয়ে তোমার রুমেই তো পড়তে থাকি। ঐ দেখো ম্যাগাজিনটা ওখানেই পড়ে আছে। আমি ওখানে বসেই পড়ছিলাম। বিশ্বাস না হলে ওটার পাতা উল্টিয়ে দেখো ৭১ নং পেইজের কোণায় ছোট্ট একটা ভাঁজ আছে। মানে আমি ততোটুক কমপ্লিট করেছি। আর তারপরই একটা ফোন কল আসে আমার। এখানে কথা বললে তোমার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটতে পারে ভেবে আমি বাইরে গিয়ে কথা বলে আসি। ৫ মিনিটই হলো মাত্র। তুমি চাইলে আমার ফোনও চেক করে দেখতে পারো।

ইনানের কথা শুনে ত্রয়ী লুকিয়ে নিজের জিভে কামড় দেয়। ধ্যত! অযথাই ভুল বুঝলাম। ইশশ আর উনি যেভাবে বলছেন, তাতে তো মনে হচ্ছে উনি ভাবছেন আমি উনাকে বিশ্বাসও করি না। কিন্তু এমনটা তো একদমই না।
ত্রয়ী কিছু বলার আগেই ইনান আবার বলে,
-তুমি ঘুমাচ্ছিলে, আর আমি এখানেই তো আমার মতো ম্যাগাজিন পড়ছিলাম, আর সেই সাথে তোমার দিকে খেয়ালও রাখছিলাম। বুঝলে পিচ্চি?

ত্রয়ী মুখের উপর থেকে কাঁথা সরিয়ে তাকায়,
-এই আমি পিচ্চি না। আর তারপর আমি আপনাকে অনেক বিশ্বাসও করি, বুঝলেন? এতো প্রমাণ টমাণ লাগবে না। এখন আমি ফ্রেশ হবো, দেখি ওয়াশরুমে যাই।

ইনান আর কিছু বলে না। ও হেসে ত্রয়ীর কথায় সম্মতি জানায়।
_________________________________________________________
ইনান আর ত্রয়ী দুজনেই ছাদে দাঁড়িয়ে আছে। দুজনেই গল্পগুজবে মেতে আছে। তারই এক পর্যায়ে ত্রয়ী খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে চোখ বন্ধ করে একটা লম্বা নিঃশ্বাস নেয়,
-উফ! ছাদে আসলে যে মনটা কত্ত ফুরফুরে লাগে, বলার বাহিরে! আর সেই সাথে এতো বাতাস, বেশ আরামও লাগে।

আসলেই ছাদটা ওদের দুজনেরই খুব প্রিয় জায়গা। ত্রয়ীর উড়নাটা হাওয়ায় উড়ছে। ইনান হাসে। মুগ্ধতায় তাকিয়ে থাকে ওর দিকে।

ত্রয়ী এগিয়ে ছাদের রেলিং ঘেঁষে দাঁড়ায়। তারপর ওর মিষ্টি কন্ঠে গান ধরে,
“আজকে হাওয়া ছন্নছাড়া,
আজকে হাওয়া বিবাগী,
আজকে সময় খোশমেজাজে,
আজকে সময় সোহাগী..”

ইনান ওর এক প্যান্টের পকেটে হাত রেখে ত্রয়ীর দিকে এগিয়ে যায়। রেলিংয়ে রাখা ত্রয়ীর হাতের উপর আলতো করে ওর হাত রাখে আর নিজেও গেয়ে উঠে,

“মাঝে মাঝে তোর কাছে
জেনে শুনে হেরে যাই,
কিছু কথা বলে ফেলি,
কিছু কথা ছেড়ে যাই..

অচেনা সকাল হোক,
উদাসী বিকেল হোক,
বারে বারে মনে হয়,
তোর হাতে মরে যাই..”

ত্রয়ী ইনানের হাতের স্পর্শে কেঁপে উঠে। ও চমকে তাকায়। ইনানের কন্ঠে গানের বাকি লাইনগুলো শুনে লজ্জাও পায়। বুকের ভেতরটা কেমন করে উঠে ওর।
.
.
চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here