বেখেয়ালি মনে পর্ব-২৮

0
561

#বেখেয়ালি_মনে
#লেখনীতে- Ifra Chowdhury
পর্ব-২৮
.
.
দু’দিনের জ্বরে ত্রয়ীর চোখ মুখ শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। আজ বিকেলে তনয়ারা বাসায় ফিরে এসেছে। সাথে ত্রয়ীর নানুকেও সঙ্গে নিয়ে এসেছেন। উনি এখন আগের থেকে অনেক টা সুস্থ। তবুও এক সপ্তাহ পর পর চেক আপ করাতে বলেছেন ডক্টর উনাকে। তাই তনয়া এক প্রকার জোর করেই উনাকে ঢাকায় নিয়ে আসেন। যাতে তনয়া নিজ দায়িত্বে মায়ের সেবা যত্ন করতে পারেন।

আর ঢাকায় বেশ বড় বড় ডক্টরের সাথে ত্রয়ীর বাবার বেশ সখ্যতা রয়েছে। এর সূত্র ধরেই মূলত ত্রয়ীর নানু ঢাকায় আসতে রাজি হয়েছেন।

সামনের সপ্তাহে তিশানের বিয়ের অনুষ্ঠান। সব ভাই বোনেরা সেসব আলোচনা করছে। তনয়া ত্রয়ীর এলোমেলো চুল গুলোতে তেল দিয়ে দিচ্ছেন। অনেক দিন পর মায়ের হাতের ছোঁয়া পেয়ে ত্রয়ীর অন্যরকম অনুভূতি হচ্ছে। বেশ আরাম লাগছে তার।

হঠাৎ করে চুলে টান লাগাতে চেঁচিয়ে উঠে ত্রয়ী,
– আহ! মা লাগছে তো।
তনয়া গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
– লাগুক। চুলের যত্ন না নিলে এমন-ই হবে।

ত্রয়ীকে তনয়া বকছে। এমন সময় ইনান এসে উপস্থিত হয় মা মেয়ের মাঝখানে। ইনান কে দেখে তনয়া বলল,
– আরে ইনান যে, কেমন আছো?

ইনান মুচকি হেসে বলে,
-জি, আন্টি আলহামদুলিল্লাহ ভালো। শুনলাম, নানু এসেছেন। তাই দেখা করতে চলে এসেছি।

তনয়া ত্রয়ীর চুলে বিনুনি গেঁথে দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। তারপর হেসে বলে,
– হ্যাঁ, মাকে জোর করেই নিয়ে এসেছি। আগামী সপ্তাহে তিশানের বিয়ে তাই এক্ষুনি নিয়ে আসলাম। তা ইনান তোমার কিন্তু অনেক কাজ এই বিয়েতে। বুঝোই তো বিয়েতে কতো কাজ। আর নিশান এতোটা একা সামলাতে পারবেনা। তাই তুমি একটু ওকে সাহায্য করো।

– আন্টি আপনি কোনো চিন্তা করবেন না। আমি আছি তো।

– হ্যাঁ, তুমি আছো দেখেই এতো ভরসা পাই। আচ্ছা তুমি বসো, আমি একটু আসছি।

ইনানের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে তনয়া নিজের রুমে যায়। ত্রয়ী এখনো ঠাই বসে আছে। পিছন দিক থেকে ইনান ত্রয়ীর বিনুনি ধরে টান দিয়ে বলে,
– শ্বাশুড়ি মাকে তো ইমপ্রেস করে ফেলছি। এখন বাকি শ্বশুর মশাইকে ইমপ্রেস করাটা। তারপরেই কেল্লাফতে।

– আমার বাবাকে ইমপ্রেস করা এতো সহজ না বুঝলেন?
ভেংচি কেটে কথাটা বলে ত্রয়ী।

ইনান ত্রয়ীর কথা শুনে একটু হেসে বলে,
– তোমার জামাইটাও যে এতো সহজে ছাড়ার পাত্র না। সে তার শ্বশুর মশাইকে ইমপ্রেস করেই ছাড়বে।

জামাই শব্দটা শুনে ত্রয়ী লজ্জা পেয়ে যায়। লজ্জামাখা কন্ঠে বলে,
– ধ্যাৎ! আপনিও না।
একথা বলেই সেখান থেকে হনহনিয়ে চলে যায় ত্রয়ী। ইনান পিছু ডাকলেও আর দাঁড়ায় না।

ইনান কে একা পেয়ে হিমা ইনানের কাছে এগিয়ে আসে। কিছুক্ষণ নীরব থেকে হিমা বলে,
– তোমার সাথে কিছু কথা ছিলো।

ইনান মোবাইল স্ক্রল করছিলো। হিমার কন্ঠ পেয়ে সে মোবাইল থেকে চোখ সরিয়ে হিমা দিকে তাকায়। তারপর বলে,
– হুম বলো কি বলবে?
– এখানে না। ছাদে আসবে একটু?
হিমার কথা শুনে ইনান ভ্রু কুঁচকে তাকায় ওর দিকে।

ইনানের চাহনি দেখে হিমা আকুতি করে বলে,
– প্লিজ চলো না?
ইনান আর কথা না বাড়িয়ে ছাদের দিকে পা বাড়ায়। হিমা তার পিছু পিছু যায়।

ছাদের রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে ইনান। হিমা তার পাশে। কেউ কোনো কথা বলছেনা।

মিনিয় পাঁচেক পরে ইনান খুক খুক করে কেশে বলে,
– কী বলবে এখন বলো?
হিমা গোপনে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,
– ত্রয়ীর সাথে তোমার কী সম্পর্ক?

হিমার কথাখানা শুনে ইনান চমকে উঠে। খুব অস্বস্তি এই মুহুর্তে তার। বিব্রতবোধ করছে। মনে মনে আওড়ায় সে,
– হিমা কী কোনো ভাবে জেনে গেলো আমাদের রিলেশনের কথা?

ইনান কে চুপ করে থাকতে দেখে হিমা আবার বলে,
– আচ্ছা, আমি-ই না হয় বলি তোমাদের কী সম্পর্ক? তোমরা রিলেশন করছো তাই তো?

ইনান এই মুহুর্তে থরথর করে কাঁপছে। বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে সে। কী বলবে বুঝতে পারছেনা। মনে মনে বলছে,
– হিমা তো সবটা জেনে গেছে। এখন ও যদি বাসায় সবাইকে বলে দেয় তাহলে? আমি তো এই মুহুর্তে আমাদের সম্পর্ক টা বাসায় জানাতে চাচ্ছিনা। আমার আরো কিছুটা সময় প্রয়োজন।

ইনানের এই অবস্থা দেখে হিমা হেসে ফেলে। হাসতে হাসতে বলে,
– আরে বাবা, ভয় নেই। আমি বাসায় কাউকে কিচ্ছু বলবোনা। তুমি এতো নার্ভাস হচ্ছো কেন?
– তুমি সত্যি বলছো? বাসায় কাউকে কিচ্ছু বলবে না তুমি?
– হ্যাঁ রে বাবা হ্যাঁ । কাউকে কিচ্ছু বলবো না। তুমি বন্ধু ভেবে আমাকে সবটা বলতে পারো।

হিমার কথায় ইনান খানিকটা সাহস পায়। অন্যদিকে ফিরে একটা নিঃশ্বাস ছাড়ে। তারপর হিমাকে সবটা খুলে বলে।

সব কথা শুনে হিমা গোপনে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে হাসিমুখে বলে,
– দোয়া করি, তোমাদের সম্পর্ক যেনো পূর্ণতা পায়। আমার বোনটাকে সবসময় খুশি রেখো।

হঠাৎ করে ইনানের কল আসায় হিমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে যায় সে। হিমা ইনানের যাওয়ার পানে তাকিয়ে থাকে। তারপর একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলে,
– একেই হয়তো বলে ভাগ্য। চেয়েছিলাম যাকে, সে ভালোবাসে আমারই বোন কে। সত্যি-ই ত্রয়ী তুই খুব ভাগ্যবতী ইনানের মতো একজন লাইফ পার্টনার পেয়েছিস। তোর ভালোবাসা পূর্ণতা পাক মন থেকে চাই।

__________________________________________________________
রাত বারোটার উপরে বাজে। ইনান রুমে পায়চারি করছে। ইনানের রুমে আলো জ্বলছে দেখে রাবেয়া হক আসেন ওর রুমে।

ছেলেকে এতো অস্থির দেখে রাবেয়া হক জিজ্ঞেস করেন,
– কি হয়েছে বাবুসোনা? এতো অস্থির দেখাচ্ছে কেন তোকে?

মায়ের কন্ঠ পেয়ে ইনান থমকে দাঁড়ায়। কিছু একটা ভেবে বলে,
– না,মা কিছু হয়নি তো। ঘুম আসছে না।
– ওমা! ঘুম আসছে না কেন? শরীর খারাপ হলো না-কি?

– ধুর, মা তুমি শুধু শুধু উত্তেজিত হচ্ছো। আমি ঠিক আছি। কিচ্ছু হয়নি আমার। তুমি গিয়ে ঘুমাও যাও।

ছেলের মুখের দিকে রাবেয়া হক কিছু বলতে গিয়েও থেমে যান। তারপর বলে,
– আচ্ছা ঠিক আছে। তুইও বেশি রাত করিস না। ঘুমানোর চেষ্টা কর।

রাবেয়া হক যাওয়ার জন্য এক কদম এগোলেই ইনান পিছু ডেকে বলে,
– মা!

রাবেয়া হক মাথা ঘুরিয়ে বলে,
– কি রে? কিছু বলবি?

ইনান আমতা আমতা করে বলল,
– আমার কাছে একটু বসবে? তোমার কোলে মাথা রাখতে খুব ইচ্ছে হচ্ছে।

ছেলের মুখে বাচ্চাদের মতো বায়না শুনে রাবেয়া হক হেসে ফেলেন। তারপর বেডের এক কোণে বসেন। ইনান বাধ্য ছেলের মতো রাবেয়া হকের কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে।

ছেলের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে রাবেয়া হক জিজ্ঞেস বলে,
– কী হয়েছে এবার আমাকে সত্যি করে বলতো?
– মা, কাউকে বিশ্বাস করে একান্ত নিজের গোপন কথা বলা কি ঠিক?

– সেটা তো তোর আর ওই মানুষ টার উপর নির্ভর করছে। তুই যদি মনে করে থাকিস, যাকে তুই তোর গোপন কথা বলেছিস সে তোর বিশ্বাসের যোগ্য; তাহলে, বলাটা ঠিক।

– আমার তো ঠিকই মনে হচ্ছে। কিন্তু তবুও অজানা একটা ভয় কাজ করছে।

– বাবুসোনা, কাউকে বিশ্বাস করতে হলে, সম্পুর্ন বিশ্বাস করতে হয়। এই যে, তোর একবার ঠিক মনে হচ্ছে। আরেকবার ভয় করছে এটা কিন্তু সম্পুর্ন বিশ্বাস না। মানে, তুই তাকে পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারিস নি এখনও। আর পুরোপুরি কাউকে বিশ্বাস না করে নিজের একান্ত গোপন কথা বলে দেওয়া ভুল কাজ।

– তাহলে কি আমি ভুল করে ফেললাম?
মনে মনে বলে ইনান কথাটা।

ছেলেকে চুপ করে থাকতে দেখে রাবেয়া হক জিজ্ঞেস করে,
– আচ্ছা এসব চিন্তা বাদ। যা বলে দিছিস সেটা তো আর চাইলেও ফিরিয়ে আনতে পারবি না। তাই অযথা, চিন্তা না করে ঘুমানোর চেষ্টা কর। আমি তোর মাথা হাত বুলিয়ে দিচ্ছি।
– ঠিক আছে।

হঠাৎ উৎকন্ঠা হয়ে রাবেয়া হক বলেন,
– বাবুসোনা, ত্রয়ীর বাসায় তোদের রিলেশনের ব্যাপার কবে জানাবি?

– আরো পরে। এখনও ত্রয়ী অনেক পিচ্চি। ওর বাবা অল্প বয়সের প্রেম ভেবে হয়তো সম্পর্কটা মেনে নিতে চাইবেন না। তাই আরো কিছুটা সময় যাক।

– এটা ভালো বললি। মেয়েটা এখনও পিচ্চি। আরেকটু সময় যাক। ও বুঝতে শিখুক বাস্তবতা। তারপর না হয় বেশি কিছু ভাবা যাবে।

রাবেয়া হকের কথা শুনে ইনান চিন্তায় ডুব দেয়। যদি হিমা এই মুহুর্তে বাসায় সবটা বলে দেয় তাহলে? হিমাকে বিশ্বাস করাটা কি ঠিক হলো?
নাহ! ত্রয়ীকে কাল সবটা জানাতে হবে। দেখি কি বলে।
_________________________________________________________
কাকভোরে ঘুম ভাঙে ত্রয়ীর। বিছানা হাতড়ে ফোন হাতে নিয়ে দেখে ইনান পঁচিশ বার কল করেছে। এতোবার কল করেছে অথচ ত্রয়ী টের পেলো না, এটা ভেবেই ত্রয়ী হকচকিয়ে উঠে। লাফ দিয়ে বিছানা থেকে নেমে ফ্রেশ হয়ে ফজরের নামাজ পড়ে নেয় সে। এতো সকালে ইনানকে কল ব্যাক করবে কি-না এটা নিয়ে দ্বিধায় পড়ে যায় ত্রয়ী।

আকাশ পাতাল কিছু একটা ভেবে ফোন রেখে ব্যালকনিতে চলে যায়। পাখির কিচিরমিচির শব্দ শুনতে থাকে সে। কিছুক্ষণ সেখানেই ঠাই দাঁড়িয়ে থাকে।

তারপর পা বাড়ায় সে কিচেন রুমে। নিজের জন্য এক কাপ কফি করে নিয়ে আবার ব্যালকনিতে ফিরে আসে। কফি মগে চুমুক দিয়ে চোখ বন্ধ করে ইনানের কথা ভাবে।

ত্রয়ীর জ্বরের সময় ইনান কফি করে এনেছিলো এক মগ। তা দেখে ত্রয়ী জিজ্ঞেস করছিলো,
– এক মগ কেন? আপনি খাবেন না?

ইনান হেসে বলেছিলো,
– খাবো তো। তোমার থেকে খাবো। আমি শুনেছি ভাগ করে খাবার খেলে না-কি ভালোবাসা বাড়ে।

ইনানের কথাটা শুনে ত্রয়ী ভীষণ লজ্জা পেয়েছিলো সেদিন। আজ সে কথাটা মনে হতে আবারও লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছে সে। বিড়বিড় করে বলে,
– আস্ত নির্লজ্জ একটা।

হঠাৎ করে ত্রয়ী ওর ঘাড়ে কারো একটা হাতের ছোঁয়া পেয়ে কেঁপে উঠে।

.
.
চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here