বেখেয়ালি মনে পর্ব-৩

0
1403

#বেখেয়ালি_মনে
লেখনীতে- Ifra Chowdhury
পর্ব-০৩
.
.
-আর আপনার ছেলে-মেয়েরা কোথায়?
নিরাশ কন্ঠে কথা খানা বলে ত্রয়ী। ত্রয়ীর মুখে ছেলে-মেয়ের কথা শুনে ছেলেটা বিস্ময়ের পঞ্চম আকাশ থেকে ধপাস করে পড়ে। একদম ধপাস করে।
– আমার ছেলে-মেয়ে কোথা থেকে আসবে? আজিব! আমি তো এখন পর্যন্ত বিয়ে-শাদিই করলাম না।
– তাহলে বললেন যে, আপনার বউ বাপের বাড়ি।
এবার সে ফিক করে হেসে ফেললো। বলল,
– বিয়ের আগে সব মেয়েরাই বাপের বাড়ি থাকে। সে সুবাদেই বললাম কথাটা।
সে বিয়ে করেনি কথাটা শুনে ত্রয়ীর নিজের অজান্তেই মনটা কিঞ্চিৎ নেচে উঠে। কিন্তু ত্রয়ী সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ না করে আবার প্রশ্ন করতে লাগলো,
– আপনি বিয়ে করেন নি। তাহলে বাবা যে আমাকে বলল, “এবার ফ্যামিলি ভাড়া দিয়েছে। হাজবেন্ড ওয়াইফ আর তাদের তিন ছেলে মেয়ে।”
এবার সে হো হো করে হেসে উঠলো। বলল,
– হাহাহা! এই কথা। আঙ্কেল ঠিকই বলেছেন। ফ্যামিলি ভাড়া দিয়েছেন। হাজবেন্ড ওয়াইফ আর তাদের তিন ছেলে মেয়ে।
কিন্তু এখন কথা হলো, কোন এঙ্গেল দিয়ে আপনার মনে হলো যে আমার তিন তিনটা ছেলেমেয়ে তাও আমার এই বয়সে?
ত্রয়ী যেনো ছেলেটার এই কথায় ভীষণ ভাবে লজ্জা পেলো। ও আমতা আমতা করে বলল,
– আ-আমি তো শুধু আপনাকেই দেখেছি এই বাসায়, তাই আরকি।
– হাহাহা! আপনি ভুল ভেবেছেন। আঙ্কেল আমার বাবা-মা কে হাজবেন্ড ওয়াইফ আর তাদের তিন ছেলে মেয়ে অর্থাৎ আমাদের তিন ভাই বোনের কথা বলেছেন।
ত্রয়ী ওর ডান হাত মাথার উপর দিয়ে কিছুক্ষন হা হয়ে তাকিয়ে রইলো ছেলেটার দিকে। নিজের বোকামির জন্য হাজার গাল দিচ্ছে নিজেকে। ত্রয়ীর কান্ড দেখে ছেলেটা মিটমিট করে হাসছে। সামনে প্রকাশ করছেনা। ত্রয়ী লজ্জা পাবে ভেবে।
ত্রয়ী বলল,
– আসলে বাবা এতো বড় ছেলেকে বাচ্চা বলাতে কনফিউজড হয়ে গেছিলাম।
– বাবা-মায়ের কাছে সবসময় তাদের ছেলে মেয়েকে বাচ্চাই মনে হয়। তাই হয়তো আঙ্কেল আমাদেরকে বাচ্চা বলেছিলেন।
ত্রয়ী আর একমুহূর্তও তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে পারবেনা। আসলেই যে সে বোকা তা বারবার প্রমাণিত হয়ে যাচ্ছে।
– সরি।
এটা বলেই ত্রয়ী ভো দৌড় দেয় সেখান থেকে। মেইন দরজার সামনে এসে সে আবার থেমে যায়।
ছেলেটা তা দেখে ওর কাছে এগিয়ে এসে বলে,
– আর কিছু বলবেন?
– ইয়ে মানে.. হ্যাঁ মানে.. ওই আর কি..
– কী?
– আঙ্কেল, আন্টি কি বাসায় নেই?
– না, উনারা গ্রামের বাড়িতে গেছেন। কাল চলে আসবেন।
– তাহলে বাসায় কি আপনি একা?
– ছোটো বোন আছে। এখনও মেবি ঘুমোচ্ছে। আপনি কি কথা বলবেন ওর সাথে? ডেকে দিবো?
– না, না, উনি ঘুমোচ্ছে ঘুমাক। অন্য একদিন এসে না হয় কথা বলা যাবে। এখন ডিস্টার্ব করবো না।
– আচ্ছা ঠিক আছে।
ত্রয়ী আবারও দু’কদম এগোয়। তারপর আবার দাঁড়িয়ে পড়ে। ঘুরে তাকায় ছেলেটার দিকে। বলে,
– এতো কথা হলো,অথচ আপনার নামটাই তো জানা হলো না। কি নাম আপনার?
– ইনান মুজনাবিন।
– ওহ আচ্ছা। আসি তাহলে এখন।
– আপনার নামটা তো বলে যান?
ত্রয়ী সিঁড়ির কাছে গিয়ে চিৎকার দিয়ে বলল,
– আমার নামটা না জানলেও চলবে আপনার।
ইনান হেসে বলল,
– আমি জানি আপনার নাম। আপনি হলেন, বোকাপাখি৷
ইনানের দেওয়া নামটা ত্রয়ীর মনে ধরলো। ও হাসতে হাসতে সিঁড়ি বেয়ে নেমে ইনানের চোখের আড়াল হয়ে যায়।
______________________________________________________

ত্রয়ী রুমে পায়চারি করছে। সামনে ওর ফার্স্ট সেমিস্টার পরীক্ষা। অথচ পড়ায় মন দিতে পারছেনা। মনে উসখুস করছে। এর সঠিক কারণ ওর জানা নেই। কেন এমন হচ্ছে? আপন মনে প্রশ্ন করে সে।
নিশান পানি নিতে আসে ডাইনিং রুমে। ত্রয়ীর রুমটা ডাইনিং রুমের অপজিটে। রাত ১ টার উপরে বাজে অথচ ত্রয়ীর রুমে লাইট জ্বলছে। তা দেখে নিশান ওয়াটার বোতল টা ডাইনিং টেবিলে রেখে ত্রয়ীর রুমের দরজায় করাঘাত করে।
এতো রাতে কে এলো রুমে? ত্রয়ী ঘাবড়ে যায়। তাড়াতাড়ি গিয়ে দরজাটা খুলে।
– ও ভাইয়া?
কন্ঠ বিচলিত।
– এতো রাত অবধি জেগে আছিস যে? শরীর খারাপ নাকি?
– না ভাইয়া, পড়ছিলাম, সামনে পরীক্ষা।
– রাত জেগে পড়তে হবেনা। বেশি রাত জাগলে শরীর খারাপ করবে। ১ টা অলরেডি বেজে গেছে। ঘুমিয়ে পড়্।
– আচ্ছা ঘুমাবো। তুমি গিয়ে শুইয়ে পড়ো।
– হুম যাচ্ছি। গুড নাইট।
নিশান যাওয়ার পরে ত্রয়ী রুমের দরজা লাগিয়ে দিয়ে শুয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলে। ঘুম আসছে না। বিছানার এপাশ থেকে ওপাশে গড়াগড়ি খাচ্ছে। এক অন্যরকম অনুভূতি বিরাজ করছে ত্রয়ীর সাড়া শরীর জুড়ে। চোখ বন্ধ করলেই ইনানের চেহারা ভেসে উঠছে। তবে কি ত্রয়ী ইনানের প্রেমে পড়েছে? নাকি অন্যকিছু? ইনানের কথা ভাবতে থাকে ত্রয়ী আপন মনে।
সারা রাত ঘুম হয়নি বললেই চলে। কাক ভোরে উঠে ত্রয়ী। সুবহে সকালে পাখিদের এই কলরব ত্রয়ীর খুব ভাল্লাগে। পাখিদের কিচিরমিচির শব্দের সাথে ত্রয়ী ছন্দ মিলিয়ে গুনগুন করে গান গাইতে থাকে। ও মুখে হালকা পানি ছিটিয়ে ব্রাশ হাতে নিয়ে ছাদে চলে যায়। ছাদে যাওয়ার পথে ইনানের ফ্লোরে চোখ পড়ে। খুব যেতে ইচ্ছে করছে ওর। কিন্তু এতো ভোরে কোনো কারন ছাড়া তো কারো দরজায় নক দেওয়া চরম বেয়াদবি। এটা ভেবেই ত্রয়ী আর এগোয় না সেদিকে।
ছাদে এসে ত্রয়ী ওর ফুলের গাছ গুলোতে হাত বুলিয়ে দেয়। হরেক রকমের ফুল আছে ছাদে। গোলাপ থেকে শুরু করে হরেক রঙের জবা, গাঁদা, পিটুনিয়া, প্যানজি, ডেন্টাস, গজানিয়া, ডালিয়া, সিলভিয়া, পপি, কসমস, জিনিয়া, জারবেরা, সূর্যমুখি, গন্ধরাজ, গ্লাডিওলাস, চন্দ্রমল্লিকাসহ বিভিন্ন রকমের ফুলের মেলা এখানে। এই ফুল গুলোর কারনে ছাদ টা আরো মনোমুগ্ধকর হয়ে উঠেছে। ছাদের প্রতিটা কোণে ফুলের সুবাস ছড়িয়ে পড়েছে।
“না, না কাল কোনোভাবেই ট্যুরে যাওয়া পসিবল না ইয়ার।”
হঠাৎ সেই পাগল করা কন্ঠস্বর পেয়ে ত্রয়ী পিছন ফিরে তাকায়। ইনানকে দেখে ত্রয়ী বিস্ফোরিত হয়ে যায়। মাথা ঘুরিয়ে নেয়। বড় বড় চোখ দুটো মার্বেলে মতো গোল হয়ে যায়। এক্ষুনি চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে আসবে এমন অবস্থা। ত্রয়ী আপন মনে বলে,
“যাকে এক পলক দেখার জন্য তার মন এতোক্ষন আনচান করছিলো, সে তার সামনে সত্যিই দাঁড়িয়ে নাকি এটা কল্পনা?”
নিজের হাতে নিজেই চিমটি কাটে।
“আউচ”
না ব্যথা পেলাম তো! তাহলে সে সত্যি সত্যি এসেছে।
ত্রয়ী আবার পিছন ঘুরে তাকায়। ছাদের দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে নিষ্পলকভাবে তাকিয়ে থাকে ইনানের দিকে। ইনান কারো সাথে ফোনে কথা বলছে আর সেই মিষ্টিভাবে হাসছে। এক হাত দিয়ে কপালে আসা চুল গুলো বারবার ঠিক করছে। এমন দৃশ্য ত্রয়ীকে খুব করে মুগ্ধ করছে। ত্রয়ীর ঠোঁটে ভালোবাসার হাসি। চোখের দৃষ্টিতে ইনানের জন্য অজস্র ভালোবাসা।
ফোনে কথা বলার ফাঁকে ইনানের চোখ যায় ত্রয়ীর দিকে।
“আচ্ছা! দোস্ত আমি তোকে কিছুক্ষন পরে ফোন করছি।”
ফোন টা রেখেই ইনান ত্রয়ীর দিকে এগিয়ে যায়। ত্রয়ী এতোক্ষণে ওর চোখজোড়া ইনানের দিক থেকে নামিয়ে নিয়েছে।
– বোকাপাখি! এতো সকালে আপনি ছাদে?
ত্রয়ী ভ্রু কুচকে বলে,
– সকালের কোমল বাতাসের সাথে স্নিগ্ধ পরিবেশটা উপভোগ করতে এসেছিলাম।
– ওহ আচ্ছা! তো উপভোগ করা হলো?
ত্রয়ী মিষ্টি হেসে বলল,
– হ্যাঁ খুব।
ত্রয়ীর হাসির প্রত্যুত্তরে ইনানও হেসে দেয়।
– একটা প্রশ্ন ছিলো বোকাপাখি।
ত্রয়ী জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই ইনান বলে,
– ছাদে আসার পর থেকেই একটা মিষ্টি স্মেল পাচ্ছি। কিন্তু কিসের স্মেল তা খুঁজে পাচ্ছিনা।
ইনানের কথা শুনে ত্রয়ী ওর বা’হাতের একটা আঙ্গুল উঠিয়ে পিছন দিকে ইশারা দেয়।
ইশারা মত ইনান পিছন ফিরে দেখে ছাদের একটা কর্ণারে যেনো ফুলের মেলা বসেছে। ইনান দ্রুত পায়ে সেদিকে এগিয়ে যায়। ত্রয়ী তার পিছন পিছন আসে।
ইনান বলে,
– ওয়াও! ওয়ান্ডারফুল। আমি জাস্ট অবাক এতো এতো ফুল গাছ দেখে। এগুলো সব তোমাদের?
ত্রয়ী মুচকি হেসে বলে,
– হ্যাঁ সব আমার। আসলে আমি ভীষণ ফুল ভালোবাসি। তাই বাবা আমাকে এগুলো এনে দিয়েছে।
ইনান উত্তেজিত হয়ে বলে,
– আমারও ফুল অনেক পছন্দ। আমার বাসায়ও একটা ফুলের বাগান আছে।
কথা বলতে বলতে বেলি ফুলের গাছটার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে,
‘এই ফুলটা আমার সবচেয়ে বেশি পছন্দের। এ ফুলের ঘ্রাণ আমি কল্পনাতেও পাই।”
ত্রয়ী কিছু বলছেনা। জাস্ট অপলক ভাবে ইনানকে দেখে যাচ্ছে।
______________________________________________________
স্কুলে এসেও ত্রয়ীর মন স্থির হচ্ছেনা। ছটফট করেই যাচ্ছে। ইনান এক পলক দেখার নেশা যেনো ত্রয়ীকে একেবারে গ্রাস করে নিয়েছে। ত্রয়ীকে এমন অস্থির দেখে ওর বান্ধবী জেসিয়া জিজ্ঞেস করে,
– কী হয়েছে রে তোর? এতো অস্থির কেন তুই?
– আচ্ছা জেসি, হুট করে কি কারো প্রেমে পড়া যায়?
– হ্যাঁ যায় তো! আমাদের পাড়ার একটা আপু আমার আপুনির কাছে ঐদিন বলছিলো, “সে নাকি হঠাৎ করে কার যেনো প্রেমে পড়েছে।” আর নাটক সিনেমাতেও তো কতোই দেখেছি। সত্যিই হয়তো হয় এমন। নাহলে কি আর এতো ঘটা করে এসব দেখাতো?
ত্রয়ী ছোটো করে বলে,
– ওহ আচ্ছা।
– কেন তুই কি কারো প্রেমে পড়েছিস?
ত্রয়ী চোখ মুখ খিচে জেসিয়ার দিকে তাকিয়ে বলে,
– আমি প্রেমে পড়েছি এটা তোকে কখন বললাম?
জেসিয়া চুপসে গিয়ে বলে,
– না হঠাৎ প্রশ্ন টা জিজ্ঞেস করলি তো তাই ভাবলাম।
ত্রয়ী মিটমিট করে হাসছে জেসিয়ার এমব অবস্থা দেখে। ত্রয়ী আবার জিজ্ঞেস করে,
– সত্যি দোস্ত বাস্তবেও এমন হয়? হুট করেই কারো প্রেমে পড়া যায়?
জেসিয়া এবার চিৎকার দিয়ে বলে,
– বুঝে গেছি দোস্ত। তুই সত্যিইইইইইইইইইই কারো প্রেমে পড়েছিস। আল্লাহ।
– একটা থাপ্পড় দিবো। এতো জোরে চেচাচ্ছিস কেন?
– বল না দোস্ত কে ছেলেটা?
ত্রয়ী আর জেসিয়ার জোর জবরদস্তিতে পেরে উঠে না। কথায় পাল্লা না দিতে পেরে এক পর্যায়ে বলেই ফেলে,
– আমাদের বাসার নতুন ভাড়াটিয়া।
জেসিয়া আরো আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করে,
– নাম কী তার?
– ইনান! ইনান মুজনাবীন।
ত্রয়ীর কথা শুনে জেসিয়া নেচে উঠে। ত্রয়ী জেসিয়ার একটা কান মলে দিয়ে বলে,
– তোকে বলাই ভুল হইছে। ফাজিল একটা!
জেসিয়া কানে হাত নিয়ে জিহবাতে কামড় দিয়ে ইশারায় সরি বলে। তা দেখে ত্রয়ী খিলখিল করে হেসে উঠে।
.
.
চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here