বেখেয়ালি মনে পর্ব-৪

0
913

#বেখেয়ালি_মনে
#লেখনীতে- Ifra Chowdhury
পর্ব-০৪
.
.

আজ শুক্রবার। নিরব খান বাড়িতে খুশির আমেজের ছড়াছড়ি। গতকাল রাতের ফ্লাইটে লন্ডন থেকে আলফাজ খানের বড় ভাই আকরাম খান এসেছেন যে বাংলাদেশে। ভোর ছয়টায় তিনি খান বাড়িতে প্রবেশ করেন। আকরাম খান সপরিবারে লন্ডন থাকেন। তাঁর পরিবাত বলতে, উনার স্ত্রী সুফিয়া খান,আর তাদের দুই কন্যা হিমা ও ঝুমা। হিমা ত্রয়ীর বছর দুয়েকের বড় আর ঝুমা ত্রয়ীর সমবয়সী।

হিমা, ঝুমাকে পেয়ে ত্রয়ীর খুশির সীমা নেই। শুক্রবার বিধায় আজ সবাই বাড়িতেই আছেন। তনয়া রান্নার কাজে ব্যস্ত। টুকি তাকে সাহায্য করছে।

সকাল ১০ টায় আলফাজ সাহেব আর আকরাম সাহেব বসে জমপেশ গল্প জুড়ে দিয়েছেন। প্রায় বছর তিনেক পর তাদের দেখা হয়েছে। তাদের দু’জনের গল্পের মূল টপিক হচ্ছে তাদের গ্রামের বাড়িতে গেট টুগেদারের আয়োজন করা নিয়ে।
তনয়া টুকিকে পাঠিয়ে আলফাজ সাহেবকে ডেকে নিয়ে গেলেন কিছু কথা বলার জন্য।

আলফাজ সাহেব তনয়ার কাছে যেতেই তনয়া বলেন,
– বলছিলাম কি, উপরের ফ্ল্যাটের ভাবি তো এখনো আসেন নি। উনার বড় ছেলে ইনান গতকাল আমায় জানিয়েছিলো, ভাবিদের আসতে আরো সপ্তাখানেক সময় লাগবে। আজ ওদের দুই ভাই বোনকে দাওয়াত দিলে কেমন হয়? একা একা ছেলে মেয়ে দুটো কী রাঁধছে, কী খাচ্ছে কিছুই তো জানি না।
-বেশ তো, আজ দুপুরে ওদেরকে আমাদের সাথে লাঞ্চ করতে বলো।

টুকিকে পাঠিয়ে দাও ওদের যাতে কথাটা বলে আসে।
-না, টুকি এখন কিচেন রুম ছেড়ে যেতে পারবেনা। তুমি বরং তিসান, না হয় নিশানকে পাঠাও।
আলফাজ সাহেব বিরক্তিকর স্বরে বলেন,
-তোমার বড় ছেলে বাসায় নেই। আর ছোটোটা এখনো ঘুমোচ্ছে। আজ পর্যন্ত কোনো কাজ তোমার দুই ছেলেকে দিয়ে হয়েছে বলো তো?
-আচ্ছা তুমি যাও ভাইজানের সাথে কথা বলো গিয়ে। আমি এদিকটা দেখছি।
তনয়ার কথানুযায়ী আলফাজ আবার নিজ গন্তব্যে ফিরে আসেন।

তনয়া টুকিকে উদ্দেশ্য করে বলে,
– টুকি, ত্রয়ীকে ইনানদের বাসায় যেতে বল। ইনান আর ওর ছোটো বোন যেনো লাঞ্চটা আমাদের সাথে করেন এটা বলে আসতে বলবি।
– আইচ্ছা খালাম্মা।
ত্রয়ী হিমা আর ঝুমার সাথে খোশগল্পে মেতে আছে। এর মধ্যে টুকি গিয়ে ত্রয়ীকে বলে,
– আপামণি, খালাম্মা আমনেরে কইছে ‘উপরের ভাড়াটিয়াগোরে দুপুরে আমনেগোর লগে খাইতে’ এই কথাখান গিয়া কইয়া আইতে।
ত্রয়ী টুকির কথা বুঝতে পারলেও হিমা, ঝুমা হা করে টুকির দিকে তাকিয়ে আছে।

টুকি কথাটা বলেই আবার কিচেন রুমে চলে গেছে। এদিকে ত্রয়ী ইনানকে আবার দেখতে পাবে এটা ভেবেই আবেগী হয়ে উঠছে। মনে মনে আকাশ পাতাল কত কথা ভাবা শুরু করেছে। ইনানের নামটা ত্রয়ীর মস্তিষ্কে আসতেই ত্রয়ীর ভেতরে কেমন অস্থিরতা শুরু হয়ে যায়। এর কারন ত্রয়ীর অজানা।

ষোলো বছরের একজন কিশোরীর মনে উথাল-পাতাল ঢেউ তোলার জন্য সাতাশ-আটাশ বছরের একজন যুবকের নাম মনে আসা-ই যথেষ্ট, তা ত্রয়ী এখন হারে হারে টের পাচ্ছে।
ত্রয়ী এক লাফে খাট থেকে নেমে দৌড় দেয় ইনানের কাছে যাওয়ার জন্য। ত্রয়ীর পিছন পিছন হিমা, ঝুমাও আসে।

বাসার কলিং বেল বাজাতেই দরজা খুলে দেয় ইফতিহা। ইফতিহাকে দেখে ত্রয়ী হাস্যোজ্জ্বল মুখটা ফাটা বেলুনের মত চুপসে যায়।
ইফতিহা কিছু বলার আগেই ত্রয়ী মুখ ফসকে বলে ফেলে,
– ইনান ভাইয়া নেই বাসায়?
ইফতিহা বলে,
– না ভাইয়া একটু বাজারে গিয়েছে। কেন?
ত্রয়ী খ্যাঁক করে নিয়ে পরিষ্কার গলায় বলে,
– না তেমন কিছুনা। আমাদের বাসায় তোমাকে আর ইনান ভাইয়াকে মা আজ দুপুরে খেতে বলেছেন। ইনান ভাইয়া আসলে কথাটা বলো।
আর দুপুরে চলে এসো কেমন?
ত্রয়ীর কথায় ইফতিহা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়।

_______________________________________________________

জুম্মার নামাজ পড়ে এসে সবাই ডাইনিং টেবিলে বসে। ইনান আর ইফতিহাও এসেছে। ত্রয়ী কেন জানি এই মুহুর্তে ইনানের দিকে সরাসরি তাকাতে পারছেনা। কোথা থেকে যেনো এক রাশ লজ্জা এসে ওকে ঘিরে ধরেছে। তাই বারবার আড়চোখে তাকাচ্ছে ইনানের দিকে।

সাতাশ-আটাশ বছরের চমৎকার যুবক ইনান। পেশায় একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। বাংলাদেশ প্রকৌশলী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে বের হয়েছে।

এতো বছর ও একাই ঢাকায় থাকতো। ওর পরিবার থাকতো সিলেট। ওদের শহরে। কিন্তু ইনান ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করার পর মা-বাবা আর ছোটো ভাই বোনকে নিজের কাছে নিয়ে এসেছে। ইনানের ছোটো ভাই ইয়াদ এবার এইচএসসি এক্সাম দিয়েছে। আর ছোটো বোন ইফতিহা এবার জেএসসি এক্সাম দিয়ে ধানমন্ডি গার্লস স্কুলে ভর্তি হয়েছে।

ইনান মাথা নিচু করে আছে। পুরুষ মানুষের এমন লজ্জা ত্রয়ী এর আগে কখনও দেখেনি। ইফতিহাও ভাইয়ের মতো লজ্জা পাচ্ছে। তা দেখে ত্রয়ী মুখ টিপে টিপে হাসছে। ইনান ইফতিহা কোনোমতে খাবারটা শেষ করে উঠে দাঁড়ায়। ঠিক তখনই তনয়া এসে বলে,
– এখনও শেষ পাতে মিষ্টিমুখ করা বাকি আছে। বসো দই-মিষ্টি খাবে তারপর উঠবে। মিষ্টির কথা শুনেই ইনানের গা গুলিয়ে আসছে। মিষ্টি একদম পছন্দ করে না ইনান। তবে ইফতিহা মিষ্টি পাগল।

ইনান বলে,
– আন্টি ক্ষমা করবেন, আমি মিষ্টি খেতে পারিনা।
ইনানের কথা শুনে ত্রয়ী টিপ্পনী কেটে বলে,
– ছেড়ে দাও মা, মনে হয় উনি ডায়াবেটিসের রোগী। জোর করে মিষ্ট খাওয়ালে হিতে বিপরীত হয়ে যাবে।

ত্রয়ীর কথা শুনে ইনান আরো লজ্জা পায় চুপচাপ বসে পড়ে চেয়ারে। ত্রয়ী আড়চোখে একবার ইনানের লজ্জা পাওয়া মুখটা দেখে মুচকি হাসতে থাকে।

আলফাজ সাহেব ইনানের উদ্দেশ্যে বলেন,
– শুনলাম, তোমার মা-বাবার ফিরতে আরো সপ্তাখানেক দেরি হবে। আর আমরাও আগামীকাল আমাদের গ্রামের বাড়িতে যাবো ভাবছি। কিন্তু তোমাদের দু’জনকে এই বিশাল বাড়িতে একা রেখে যেতে মন চাইছে না। কখন কী বিপদ আসে আমরা তো কেউ বলতে পারিনা।

তাই বলছিলাম, তোমরাও চলো আমাদের সাথে। গ্রামটাও দেখা হয়ে যাবে তোমাদের আর আমিও একটু নিশ্চিন্ত থাকতে পারবো।

আলফাজ সাহেবের কথা শুনে ত্রয়ী চোখ বড় বড় করে বাবার দিকে তাকায়। এ যেনো ত্রয়ীর কাছে মেঘ না চাইতে বৃষ্টি পাওয়ার মতো। গ্রামে যাবে এটা শুনার পর থেকে ওর মনটা আনচান করছিলো ইনানের জন্য। ইনানকে এক নজর না দেখলে যেনো ত্রয়ীর সারাদিন খুব অস্থিরতায় কাটে।

ইনানের গ্রামের প্রতি একটা দূর্বলতা আছে। তাই এই সুযোগটা পেয়ে হাতছাড়া করতে চাইলো না। বলল,
– আপনি যেটা চান সেটাই হবে আঙ্কেল। ইফতিহাও বাসায় একা একা বোর হচ্ছে। গ্রামে গেলে মন্দ হয় না ব্যাপারটা।
ইনানের মতামত শুনার পর আলফাজ সাহেব ডাইনিং ছেড়ে উঠেন।

__________________________________________________________

ঢাকা থেকে ত্রয়ীদের গ্রাম অর্থাৎ চাঁদপুর যেতে প্রায় দু ঘন্টার মতোন লাগে। যদি রাস্তায় জ্যাম না থাকে তাহলে। ভোরে ত্রয়ীরা রওনা দিয়েছে বিধায় রাস্তাঘাটে ফাঁকা ছিলো। দাউদকান্দি এসে কিছুটা জ্যামে পড়েছিলো তারা। তবে জ্যামটা বেশিক্ষন স্থায়ী হয়নি। সকালে নয়টার মধ্যেই ত্রয়ীরা গ্রামে পৌঁছে যায়।

চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ গ্রামে ত্রয়ীদের বাড়ি। সাত-আট কাঠা জমির উপর মস্ত খান বাড়ি। বাড়ির মাঝখানে বিশাল উঠোন। উঠোনের চারপাশ ঘিরে ঘর। বাড়িটার চারপাশে গাছ-গাছালি তে পরিপূর্ণ হয়ে আছে। বহুদিন পর ত্রয়ী টিনের ঘর দেখতে পেলো। বছর পাঁচেক ধরে ওদের গ্রামে আসা হয়না কোনো এক অজ্ঞাত কারনে।

আজ এতো বছর গ্রামে এসে ওর ফড়িংয়ের মতো উড়তে ইচ্ছে হচ্ছে মাঠে-ঘাটে। বাড়ির পিছনে ঘাট দেওয়া পুকুর। ত্রয়ী গাড়ি থেকে নেমে পুকুর পাড়ে চলে যায়। পুকুরের পাশে আছে হিজল গাছ আর শিমুল গাছ। ইনান আসে ত্রয়ীর পিছন পিছন। বাকিরা ঘরে যায়।

ত্রয়ী আনমনে পুকুরের পানি নিয়ে খেলতে থাকে। একদম বাচ্চাদের মতো। ইনান ত্রয়ীর পিছনে দাঁড়িয়ে আছে তা ত্রয়ী বিন্দুমাত্র টের পায়নি। ইনান হাসছে ত্রয়ীর এমন কান্ড দেখে। হাসিটা শব্দ ছাড়া। ত্রয়ী মিনিট দশেক পানি নিয়ে খেলে উঠে দাঁড়ায় ঘরে যাওয়ার জন্য। ঘাড় ঘুরিয়ে ইনানকে দেখে ত্রয়ী ভূত দেখার মতো চমকে উঠে।

পা স্লিপ খেয়ে পড়ে যেতে নেয় পানিতে। ইনান দ্রুত হাত ধরে ফেলে ত্রয়ীর। ত্রয়ীর শরীরের প্রায় অর্ধাংশই পানির উপরে। ইনান হাতটা ছেড়ে দিলেই ধপাস করে পানিতে পড়ে যাবে। ত্রয়ী চোখ বন্ধ করে আছে ভয়ে। ইনান হ্যাচকা টানে ত্রয়ীকে একদম ওর বুকের সাথে মিশিয়ে নেয়।

ইনানের বুকে যাওয়ার সাথে সাথেই ত্রয়ীর হৃদস্পন্দনের গতি ক্রমাগত বেড়ে যায়। পুরো শরীর শিহরন দিয়ে উঠে। বুকের ভেতর কিছু কথা সঙ্গোপনে বেসামাল উড়াউড়ি করছে,
মরবি রে তুই!
মরবি!
বেঘোরে মনটা হারাবি!
.
.
চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here