বেখেয়ালি মনে পর্ব-৩২

0
561

#বেখেয়ালি_মনে
#লেখনীতে- Ifra Chowdhury
পর্ব-৩২
.
.
নিশানের কথানুযায়ী ত্রয়ী তিশানের পুরো শরীরে হলুদ লেপ্টে দিয়েছে। এই নিয়ে সেখানে উপস্থিত সবার মাঝে হাসির রোল পড়ে গিয়েছে। অনেক আনন্দ, হৈচৈ এর মাধ্যমে হলুদের প্রোগ্রাম শেষ হয়।

ভোর রাতে সবাই শুয়ে পড়ে। দু’ঘন্টা ঘুমানোর পর আবার উঠে যায় ঘুম থেকে। এরপর থেকে শুরু হয় বিয়ের আয়োজন।

দুপুর বারোটা নাগাদ ত্রয়ী গোসল সেরে বের হয়। রেডি হওয়ার জন্য ড্রেসিং টেবিলের সামনে যেতেই একটা শপিং ব্যাগের দিকে চোখ যায় তার। শপিং ব্যাগ টা হাতে নিয়ে ভেতরে দেখে ত্রয়ী। মুহুর্তেই ওর চোখ চড়ক গাছ হয়ে যায়। কালো আর সোনালি রঙের একটা লেহেঙ্গা। সাথে একটা চিরকুট।

ত্রয়ী তাড়াতাড়ি করে চিরকুট দেখে।

“সবাই তো নীল রঙয়ের শাড়ী উপহার দেয় তার প্রিয়তমাকে, আমি না হয় কালো দিলাম আমার মহারাণীকে!”

চিরকুটটা পড়ে ত্রয়ী মুচকি হাসে। বিড়বিড় করে,
-পাগল একটা!

ত্রয়ী লেহেঙ্গাটা বের করে নিজের বুকের সাথে কিছুক্ষণ চেপে ধরে রাখে। এতে তার ইনানের হাতের ছোঁয়া আছ।

ত্র‍য়ী আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ভাবনায় মগ্ন। এমন সময় তনয়া আসে রুমে। ঝাঁঝালো কন্ঠে বলে,
– এভাবে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে না থেকে চটপট রেডি হ।

মায়ের কন্ঠ পেয়ে ত্রয়ীর ভাবনার অবসান ঘটে।
তাড়াতাড়ি করে হাতের চিরকুটটা লুকিয়ে ফেলে সে। তারপর নরম গলায় বলে,
– হচ্ছি মা।

তনয়া আর কিছু না বলে রুমের দরজার দিকে পা বাড়ায়। দু’পা এগোনোর পর আবার থমকে দাঁড়ায়।

মাথা ঘুড়িয়ে জিজ্ঞেস করে,
– এই লেহেঙ্গাটা আবার কখন নিলি?

ত্রয়ী মায়ের কথা শুনে ঢোক গিলে। আমতা আমতা করে বলে,
– এ-এ-এটা তো অনলাইনে অর্ডার করছিলাম। ভালো লেগেছিলো তাই। জেসিয়ার বাসার ঠিকানা দিয়েছিলাম। ও আসার সময় নিয়ে এসেছে। বিয়ের ঝামেলার জন্য তোমাকে বলতে ভুলে গেছিলাম।

ত্রয়ীর কথা শুনে তনয়া তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় ওর চোখের দিকে। যেনো কথাটা তার পছন্দ হয়নি। তিনি এমন কথায় সন্তুষ্ট নন। ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল সে,
– ওহ! আচ্ছা ঠিক আছে।

এই বলেই তিনি সেখান থেকে প্রস্থান করেন। মা চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ত্রয়ী ধপাস করে বেডে বসে পড়ে। খুব জোরে জোরে শ্বাস নেয়। মনে হচ্ছে, সে কোনো যুদ্ধ জয় করে এসেছে।

________________________________________________________

ইফতিহা সাদা রঙের একটা কুর্তির সাথে ব্ল্যাক জিন্স পড়েছে। মেয়েটাকে আজ যথেষ্ট সুন্দরী লাগছে। বহুদিন পর আজ সে যত্ন করে সেজেছে। কিন্তু কেন? এটার উত্তর তার জানা নেই।

তার মনে হচ্ছে, সে কারো জন্য খুব বেশি ছটফট করছে। তার ভেতরে সুপ্ত ভালোবাসার জন্ম হয়েছে। এবং সে ভালোবাসার টানেই সে আজ এমন সেজেছে।

ইফতিহা রেডি হয়ে ত্রয়ীর রুমে আসে। ত্রয়ীকে দেখে সে মুগ্ধ হয়। মিনিট দু’য়েক স্থির নয়নে তাকিয়ে থাকে তার দিকে। ফর্সা মেয়েদের কালো পড়তে নেই। এতে লোকের নজর লাগে।

কালো রঙ টা যেনো ত্রয়ীর সৌন্দর্য দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। না, না, দ্বিগুণ বললেও বোধহয় কম হয়ে যাবে। দ্বিগুনের চেয়েও আরো অনেক বেশি হবে পরিমাণটা!

ইফতিহা গটগট পায়ে ত্রয়ীর সামনে এসে ত্রয়ীর কানের পিছনে সামান্য কালি লাগিয়ে দিয়ে বলল,
– নজর না লাগে যেনো চান্দেরও গায়ে।

ইফতিহার কথাখানা শুনে ত্রয়ী লজ্জায় মিইয়ে যাচ্ছে। চোখে মুখে লজ্জার ছাপ স্পষ্ট। সে লজ্জামাখা কন্ঠে বলে,
– তোমার সব কিছুতেই একটু বাড়াবাড়ি।

ত্রয়ীর কথাতে ইফতিহা খিলখিল করে হেসে বলল,
– বাড়াবাড়ি না গো! সত্যি-ই বললাম। আর শুনো ভাইয়া তোমাকে তার রুমে ডেকেছে। একটু জলদি যাও।

ত্রয়ী আর কথা না বাড়িয়ে ইনানের রুমের উদ্দেশ্যে পা বাড়ায়।

ইফতিহাও এদিক ওদিক কাউকে খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। হঠাৎ করেই আবারও ধাক্কা খায় নিশানের সাথে। নাকে ব্যথা পেয়েছে মেয়েটা। নাক ডলতে ডলতে উপরের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে যায়। কথা গুলো গলায় এসে দলা পাকিয়ে গেছে তার। চোখের দৃষ্টি স্থির হয়ে গেছে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটার দিকে।

নিশান ইফতিহার কান্ডে অবাক হয়ে বলল,
– তোমার সাথে কি ধাক্কা খাওয়ার জন্যই আল্লাহ আমাকে দুনিয়াতে পাঠিয়েছে?

নিশানের কন্ঠ শুনে ইফতিহা কেঁপে উঠে। এতো সুন্দর কেন মানুষটার কন্ঠ?
বিড়বিড় করে বলে সে।

– এই যে মিস. কি বিড়বিড় করছো?

ইফতিহার কানে নিশানের কোনো কথাই পৌঁচ্ছেনা। সে এই মুহুর্তে মানুষটাকে দেখার ধ্যানে আছে। নিশান আর কিছু বলতে যাবে এমন সময় তিশান এসে ডেকে নিয়ে যায় তাকে।

ইফতিহা ঠাঁয় সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে। পাশ দিয়ে বাচ্চারা দৌড়াদৌড়ি করছে। তাদের মধ্যে একজনের সাথে ধাক্কা লেগে ইফতিহার ধ্যান ভাঙ্গে। সে চারপাশে তাকিয়ে দেখে নিশান নেই।

নিজের এমন কান্ডে নিজেই লজ্জা পেয়ে যায়। কপাল চাপড়ে বলে,
– তোর কি হয়েছে ইফতিহা? এমন লজ্জাহীন তো তুই ছিলি না। না-কি প্রথম প্রেম মানুষকে নির্লজ্জ বানিয়ে দেয়?
তারপর আবার নিজেই ঢোক গিলে বলে,
প্রেম? তবে, আমি কি সত্যি এই মানুষটার প্রেমে পড়ে গেলাম?

________________________________________________________

ত্রয়ী ইনানের রুমে যেতেই ইনান রুমের দরজা লক করে দেয়। ত্রয়ী চেঁচিয়ে উঠে বলল,
– এই এই, করছেন কি? দরজা লক করছেন কেন?

ত্রয়ী ভয় পাচ্ছে দেখে ইনান আরেকটু মজা নেয়। দুষ্টুমি মাখা কন্ঠে বলে,
– ইয়ে করবো, তাই দরজা লক করলাম।

ত্রয়ী ভয়ে অস্থির হয়ে উঠেছে। অনবরত ঘামছে সে। তা দেখে ইনান তার কাছে এগিয়ে আসে। ইনানকে এগোতে দেখে ত্রয়ী থরথর কাঁপতে থাকে। দম বন্ধ হয়ে আসছে তার।

তোতলানো গলায় বলে,
– আ-আ-আপনি কি করতে চাচ্ছেন? আমার কাছে আসবেন না একদম।

ত্রয়ী পিছতে পিছতে ড্রেসিং টেবিলের সাথে বাড়ি খায়। ব্যথা পেলেও সেটা হজম করে নেয়। ইনান দাঁড়িয়ে আছে ত্রয়ীর গা ঘেঁষে।

ত্রয়ীর অস্থির নিঃশ্বাস গুলো ইনানের মুখে পড়ছে। ইনান মুচকি হেসে ওর ঠোঁট যুগল ত্রয়ীর মুখের দিকে এগিয়ে নেয়। ত্রয়ী অস্থিরতায় চোখ বন্ধ করে ফেলে।

ইনান ওর ঠোঁট দু’টি ত্রয়ীর কপালে ঠেকায়। ত্রয়ী চোখ বড় বড় করে তাকায় তার দিকে। সর্বাঙ্গে কাপন ধরে যায় তার। হুট করেই ইনানের বুকে মুখ লুকিয়ে সে জাপটে জড়িয়ে ধরে।

ইনান ওপাশ থেকে শক্ত করে ধরে তাকে। ত্রয়ী জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে ইনান বুঝতে পারছে। তাই তাকে কিছুটা সময় দেয় শান্ত হওয়ার জন্য।

কিছুসময় পার হওয়ার পর ইনানের বুক থেকে ত্রয়ী মুখ তোলে। জড়িয়ে ধরার সময় তার কোনো রকম লজ্জা লাগেনি। কিন্তু এখন লজ্জার জন্য ইনানের চোখাচোখি হতে পারছে না সে। ইনান সানন্দে ত্রয়ীর এসব বাচ্চামো উপভোগ করছে।

ত্রয়ী ইনানকে ছেড়ে দিয়ে ছিটকে দূরে এসে দাঁড়ায়। সে হাপাচ্ছে, খুব হাপাচ্ছে!

ইনানের সামনে থেকে চলে যাওয়া উচিত তার এই মুহুর্তে। তাই পা বাড়ায় বের হওয়ার জন্য। ইনান পিছন দিক থেকে ত্রয়ীর হাত ধরে ফেলে।

ত্রয়ী আবারও চোখ বন্ধ করে শীতল গলায় বলে,
– ছাড়ুন। দেরি হয়ে যাচ্ছে। ওদিকে আমাকে খোঁজাখুঁজি শুরু হয়ে গেছে হয়তো।

ইনান কিছু বলেনা, হাত ছেড়ে দিয়ে ত্রয়ীর দিকে এগিয়ে এসে, কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে,

“আমি ভীষণ রকমের প্রেমে পড়েছি তোমার,
প্রেমে পড়েছি তোমার সবটার!
প্রেমে পড়েছি তোমার হেঁটে যাওয়া পেছনের দৃষ্টিতে,
প্রেমে পড়েছি তোমার ঝাঁকড়া চুলে পাঁচ আঙ্গুল বুলিয়ে দেওয়ার অপরূপ দৃশ্যে!
প্রেমে পড়েছি তোমার ঐ দু’টি চোখের, যখন লোডশেডিং এ মোমের মৃদু আলোয় দৃষ্টিহীন তাকিয়ে থাকতে অপলকে!
প্রেমে পড়েছি তোমার ছোট ফুলের বাগানে, অল্প ফোটা ফুলগুলোও যেনো তোমার কথা বলে!
প্রেমে পড়েছি ঐ সন্ধ্যাটার, চাঁদ দেখায় মিষ্টি জোৎস্নার উপভোগে ভাগিদার বসাতে যখন তুমি আমায়!
প্রেমে পড়েছি আমি তোমার,
প্রেমে পড়েছি তোমার সবটার!
শুনছো? আমি ভীষণ রকমের প্রেমে পড়েছি তোমার!
এমন প্রেমে বহুকাল পড়েনি আমি,
এমন করে কেউ আমায় অনেককাল মায়ায় বাঁধতে পারেনি।
এমন করে কেউ তার কথা রাত-দিন এক করে ভাবাতে পারেনি,
এমন করে কারো জন্য রাত জেগে আমি ছটফট করে মরিনি!
তুমি মেরেছো আমায়, মেরেছো প্রেমের বাণে!
আমি প্রেমে পড়েছি তোমার মায়াবী কথার,
প্রেমে পড়েছি তোমার সুরেলা কন্ঠের!
আমি তোমার কথার প্রেমে বন্দী হলাম,
নিজ থেকেই এ বন্দী জীবন মেনে নিলাম!
আমি প্রেমে পড়েছি তোমার,
প্রেমে পড়েছি তোমার সবটার!”

ত্রয়ীর চোখ ঝাপসা হয়ে উঠেছে। তার মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দিছে। সে এখন হিতাহিত জ্ঞান শূন্য একজন মানবী। তার শুধু-ই মনে হচ্ছে সেও মরেছে, ষোল বছর বয়েছে এসে সে প্রেমের জালে আটকে মরেছে। আর কেউ তাকে এ প্রেম ছাড়া বাঁচাতে পারবেনা।

.
.
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here