বেখেয়ালি মনে পর্ব-৩৮

0
485

#বেখেয়ালি_মনে
#লেখনীতে- Ifra Chowdhury
পর্ব-৩৮
.
.
ফয়সাল বেশ অনেকক্ষণ ধরে রাস্তার মোড়টায় অপেক্ষা করছে। ইনানের তো এখানেই দাঁড়িয়ে থাকার কথা ছিলো। তাহলে ও গেলো কোথায়? ফয়সাল ইনানের সন্ধানে এদিক ওদিক তাকায়। আর ভাবে- একটু আগেও তো যখন ফোন করেছিলো, বলেছিলো ও এখানেই দাঁড়িয়ে আছে। বেশি সময় তো পারও হয় নি। এরই মধ্যে ইনান আবার কোথায় উধাও হয়ে গেলো? কোনো দরকারি কাজ পড়ে গেলো নাকি?

ফয়সাল মিনিট দুয়েক অপেক্ষা করে ইনানের ফোনে একটা কল দেয়। রিং হচ্ছে তো। কিন্তু ইনান রিসিভ করছে না কেন? প্রথম স্বাভাবিকভাবে কলটা কাটলেও সেকেন্ড টাইম যখন ইনান কলটা রিসিভ করছিলো না, ফয়সালের ভ্রু কুচকে যায়। এই ইনান ব্যাটা করছেটা কী? কল রিসিভ না করুক, কেটে দিয়ে একটা মেসেজ তো করা যায়।

ফয়সাল তিন চারবার টানা কল করলো। কিন্তু ইনান রিসিভ করছে না। ফয়সাল এবার একটু চিন্তায় পড়ে গেলো। এই এত রাতে ও হঠাৎ হাওয়া হয়ে গেলো, আবার এখন কলও রিসিভ করছে না, কোনো বিপদে টিপদে পড়লো না তো আবার? ফয়সাল এটা ভেবে একটু উশখুশ করতে করতে আবার ইনানের ফোনে ট্রাই করে। হঠাৎ সে খেয়াল করে, আশেপাশেই কোথাও থেকে ফোনের রিংটোনের আওয়াজ আসছে। যদিও শব্দটা অতোটা স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে না। ও চারপাশে তাকায়। কিন্তু কাউকে দেখতে পায় না।

ও নিজেই কলটা কেটে দেয়। আশ্চর্যজনক ভাবে আগন্তুক ফোনের রিংটোনটাও বন্ধ হয়ে যায়। ফয়সাল কিছু একটা ভেবে আবারও ইনানের ফোনে কল দেয়। ফোনের রিংটোনটা আবারো শোনা যাচ্ছে! ফয়সাল অবাক হয়। ও চেক করার জন্য কলটা পুনরায় কেটে দেয়। রিংটোনটাও অফ হয়ে গেছে। তাহলে কি এটা ইনানেরই ফোন? ইনান আশেপাশেই আছে? তাহলে ও কল রিসিভ করছে না কেন? সামনেই-বা আসছে না কেন?

ফয়সাল কল দিয়ে এবার অস্পষ্ট রিংটোনটাকেই অনুসরণ করার চেষ্টা করে। ও প্রথমে বামদিকে যায়, কিন্তু ওদিকে এগুতে এগুতে রিংটোনের আওয়াজ আরো কমছে বলে মনে হয়, তাই ও ঘুরে কিছুটা ভালোভাবে খেয়াল করে উত্তর দিকে টার্ন নেয় এবং ঐদিকেই এগুতে থাকে। এতক্ষণে কলটা কেটে যায়। ফয়সাল আবার কল দেয়। আর রিংটোনের সাউন্ডটা ফলো করতে করতে অন্ধকার গলিটার দিকে এগিয়ে যায়। অন্ধকার দেখে ফয়সাল ওর মোবাইলের টর্চলাইটটা অন করে। আর চারপাশে এলোমেলোভাবে আলো ফেলতেই ইনানের পড়ে থাকা দেহটার উপর ফয়সালের নজর চলে যায়।

ও জলদি ইনানের কাছে ছুটে যায়। ওর চারদিকে প্রচুর রক্ত! নাক মুখও রক্তাক্ত হয়ে আছে। মাথাটা তো একদম রক্তে ভিজে আছে। মনে হচ্ছে এইমাত্রই ইনান রক্তের মধ্যে গোসল করেছে। ফয়সাল হাটুগেড়ে বসে ইনানের দুই গাল নেড়ে ওকে ডাকতে থাকে। কিন্তু ইনান অজ্ঞান হয়েই পড়ে আছে। ফয়সাল ওর শ্বাস ঠিকভাবে পড়ছে কি-না চেক করে। হ্যাঁ পড়ছে! ফয়সাল আর দেরি না করে দ্রুত ওর বাকি বন্ধুদের কল করে।

সিয়ামকে কল দেওয়ামাত্রই সে রিসিভ করে। ফয়সাল এপাশ থেকে অস্থির কন্ঠে বলে,
-দোস্ত! তোরা জলদি মাহিনের চাচার গাড়িটা ম্যানেজ করে তিন রাস্তার মোড়ের দিকে চলে আয়। ইনানের পুরো শরীর রক্তাক্ত অবস্থায় গড়াগড়ি খাচ্ছে। কী হয়েছে কিচ্ছু বুঝতে পারছি না৷ জলদি হসপিটালে নিয়ে যেতে হবে৷

কথাটা শুনেই সিয়াম দ্রুত অন্য বন্ধুরা ও মাহিনকে ওর চাচার কাছ থেকে গাড়ির চাবিটা নিয়ে ফয়সালের বলে দেওয়া লোকেশনে রওনা দেয়৷

______________________________________________________

ত্রয়ীর মনটা সন্ধ্যা থেকেই কেমন যেন কু গাইছিলো। ইনানের সাথে কথা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু তারপর যেন অস্থিরতাটা আরো বেড়ে গেছে মনে হচ্ছে। ত্রয়ী এর কারণ খুজে পাচ্ছে না। বাসায় কারোর কাছে বিষয়টা শেয়ার করে যে হালকা হবে, তারও উপায় নেই। ও নিজেই তো ব্যাপারটা বুঝে উঠতে পারছে না!

ইশ! এখন যদি হিমাপ্পা এখানে থাকতো, সে হয়তো ত্রয়ীকে দেখেই কিছু একটা বলে দিতে পারতো। অথবা ওর কাছে কোনো সাজেশান চাইলেও ত্রয়ীর মতো করে খুব ভালোভাবে সঙ্গ দিতো। কিন্তু তা তো হওয়ার নয়৷ ওরা তো গত সপ্তাহেই লন্ডন চলে গেছে। তাই ত্রয়ী এখন ইনানের কথাগুলোও মন খুলে কাউকে বলতে পারে না।

এসব ভেবেই ত্রয়ী মনে মনে আফসোস করতে থাকে। এক পর্যায়ে ওর মাথায় ইফতিহার চিন্তা আসে। একটু গিয়ে ইফতিহার সাথে গল্প করা যাক। তাহলে কথার ফাঁকে ফাঁকে ইনানের কথাও তোলা যাবে। আর গল্পগুজবের ফলে ত্রয়ীর মনটাও যদি একটু হালকা হয়..

যেমন ভাবা, তেমন কাজ। ত্রয়ী সিঁড়িতে পা বাড়িয়ে ইনানদের বাসায় রওনা হও। উদ্দেশ্য- ইফতিহার রুম। ত্রয়ী ওদের বাসায় যেতেই দেখে ইফতিহা ড্রয়িংরুমের সোফায় আরামে শুয়ে শুয়ে টিভি দেখছে। অন্যরা হয়তো তাদের কাজেই ব্যস্ত। যাই হউক, ত্রয়ী ইফতিহার দিকে এগিয়ে যায়। ত্রয়ীকে দেখেই ইফতিহা হাসিমুখে শোয়া থেকে উঠে বসে। আর ত্রয়ীকেও টেনে সোফাতে বসায়। তারপর দুজনেই টিভি দেখতে দেখতে নিজেদের মতো টুকটাক গল্পে মেতে উঠে।

হঠাৎ করেই রাবেয়া হকের চিৎকারে পুরো বাসা যেন থমকে যায়। ত্রয়ী ও ইফতিহা দু’জনেই চমকে উঠে। ত্রয়ীর বুকটা কেমন যেন ধক করে উঠে। ও বড়সড় একটা ঢোক গিলে। তারপর দুজনেই ইফতিহার মায়ের রুমের দিকে ছোটে। ইয়াদ আর মোস্তফা হকও উপস্থিত হয়ে গেছেন। এদিকে রাবেয়া হক ফোন ফেলে কান্নায় ভেঙে পড়েছেন। কাদতে কাদতেই কোনোভাবে বললেন,
-আমার.. আমার ই-ইনানের কী-কীভাবে যেন এ-এক্সিডেন্ট হয়েছে। ফ-ফয়সাল ফোন ক-করেছিলো। ওর ব-বন্ধুরা ওকে সদর হা-হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছে। আ-আমিও যাবো।
বলেই রাবেয়া হক আবার গিয়ে মোস্তফা হকের দু’হাত চেপে ধরেন,
-ওগো তুমি আমায় জ-জলদি আমার ছেলের কাছে নিয়ে চলো। ও ডাকছে আমায় ‘মা.. মা..’ করে। চলো তোমরা।

রাবেয়া হক কাদতে কাদতে অজ্ঞান হয়ে ফ্লোরে ঢলে পড়েন। ইয়াদ আর মোস্তফা হক দ্রুত সামলে ধরে উনাকে। ইফতিহা কাদতে কাদতে পানি আনতে ছুটে যায়।
এদিকে ত্রয়ীর পায়ের নিচ থেকে যেন মুহুর্তেই মাটি সরে গেলো বলে মনে হচ্ছে। ওর বুকের ধকধকানি শতগুণ বেড়ে গেছে। অস্থিরতাগুলো বাধ ভেঙে গেছে। ওর অজান্তেই চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। ত্রয়ীর মনে হচ্ছে, কেউ যেন ওর হৃৎপিন্ডটা টেনে বের করে নিতে চাচ্ছে। ওর ভেতরটাও একদম রক্তাক্ত হয়ে গেছে। কিন্তু সেটা অপ্রকাশ্যে! নিরবে!

ইনানদের বাসা থেকে শোরগোল শুনে নিশান, রিসা, তনয়া আর আলফাজ সাহেবও উপরে ছুটে আসেন। এসে দেখেন এই অবস্থা! মোস্তফা হক টাকা ম্যানেজ করে তৈরি হচ্ছেন, উনারা এখনি সিলেট রওনা দেবেন। ইফতিহা ত্রয়ীকে জড়িয়ে ধরে কাদছে। ত্রয়ীও কান্না থামাতে পারছে না। ইয়াদের চোখেও জল। আর রাবেয়া হকের অবস্থা তো আরো শোচনীয়। বাসায় পুরো কান্নার রোল পড়ে গেছে। অবশ্য পড়বেই-বা না কেন? ইনান যে সবার চোখের মণি ছিলো! আর আজ ওর এই অবস্থা! এসব দেখে আলফাজ সাহেবও তার ছোট ছেলে নিশানকে নিয়ে ওদের সাথে যেতে চান৷

তনয়াও এতে সম্মতি জানায়। অবশ্য উনারও হাই প্রেশার। এর মধ্যে তিশানও বাসায় নেই। নাহলে মিসেস তনয়াও হয়তো সাথে যেতো। এমন সমন ত্রয়ীও কান্না ও সাহস নিয়ে করুণ কন্ঠে আলফাজ সাহেবকে বলে ফেলে,
-বাবা আমিও যাবো।
ইফতিহাও সাথে সাথে ত্রয়ীকে আরো জড়িয়ে ধরে কাদতে কাদতে বলে,
-হ্যাঁ আপু তু-তুমিও চলো।

তনয়ার হয়তো মত ছিলো না মেয়েকে ওদের সাথে পাঠানোর। কিন্তু ইফতিহার চোখমুখ দেখে খুব মায়া হয় উনার। আর আলফাজ সাহেবও তনয়াকে চোখের ইশারা দেন, উনি নিয়ে যাবেন ত্রয়ীকে। তনয়া যাতে চিন্তা না করে। বাড়িতে তনয়া আর রিসা রয়ে গেছে। একটু পর তিশানও চলে আসবে। আলফাজ সাহেব তিশানকে সব বুঝিয়ে দিয়ে একটা ম্যাক্রো রিজার্ভ করে ইনানদের ফ্যামিলি ও নিজের দুই ছেলে মেয়ে – নিশান ও ত্রয়ীকে নিয়ে সিলেটের উদ্দেশ্যে বের হন।

_______________________________________________________

ঘন্টা খানেকের মধ্যেই ইনানকে হসপিটালে নিয়ে যেতেই ওকে ইমার্জেন্সীতে শিফট করা হয়। প্রচুর ব্লিডিং হয়েছে, যারা ফলে ডক্টররাও কিছু বলতে পারছেন না। তবে ইনশাআল্লাহ উনারা ওর বন্ধুদের আশ্বাস দিয়েছেন, গুরুতর কিছু হবে না। উনারা তাদের বেস্ট ট্রিটমেন্টটাই ইনানকে দেওয়ার চেষ্টা করবেন।

ইনানের বাড়ির লোকেরা হসপিটালে পৌছাতে পৌঁছাতে ভোরের আলো ফুটতে শুরু হয়ে যায়। সবাই মহান আল্লাহ তায়ালাকে ডাকতে ব্যস্ত। ইনানের অপারেশন চলছে। বাম পায়ে খুব চোট পেয়েছে। হাড়চ্যুত হয়েছে সম্ভবত। মাথার অবস্থা তো বলার বাহিরে। অনেকগুলো সেলাই লাগছে। রক্তশূন্যতাও দেখা দিয়েছিলো। ভাগ্যিস হসপিটালের ব্লাড ব্যাংকের প্রয়োজনীয় রক্ত বরাদ্দ ছিলো। নাহলে ইনানের জন্য যে আরো কী অপেক্ষা করছিলো, তা এক আল্লাহ ছাড়া কেউ জানেন না।

সবাই ডক্টর বের হওয়ার অপেক্ষা করছে। আলফাজ সাহেব আর মোস্তফা হক পায়চারি করছেন। দুজনের চোখেমুখেই অস্থিরতার ছাপ, বোঝা যাচ্ছে। ইনানের বন্ধুরাও রাত থেকে এখানে অবস্থান করছে। ত্রয়ী, ইফতিহা ও রাবেয়া হক এখনোও নিজেদের সামলে উঠতে পারছে না। অনবরত কেদে উঠছে। একটু পর নার্সদের সাথে ডঃ রুহুল আমিন বের হয়ে এলেন। উনি বেরিয়েই একটা স্বাভাবিক হাসি দিয়ে বললেন,
-পেশেন্ট এখন সুস্থ আছে, আলহামদুলিল্লাহ। তবে আপনারা সবাই একসাথে ভেতরে গিয়ে ভিড় করবেন না। একে একে দেখতে যাবেন।
রাবেয়া হক দ্রুত চোখ মুছে ছেলেকে দেখতে যান। সাথে ইয়াদ, ইফতিহা আর ত্রয়ী। মোস্তফা হক সহ বাকিরা এখনো দরজার পাশে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে। ইনান কতো সুন্দরভাবে বেডে শুয়ে আছে। কিন্তু ওর পুরো মাথায় ব্যান্ডেজ। বাম পায়েও প্লাস্টার করা। নাকে-মুখে নল লাগানো ছিলো, একজন নার্স এখন টিউবগুলো খুলে দিচ্ছে। রাবেয়া হক ছেলের অবস্থা দেখে আবারো মুখে কাপড় চেপে কেদে দেয়। ইনান ধীরে ধীরে চোখ খুলে। ওর মাকে দেখেই ঠোটে একটা ছোট্ট হাসির বাঁক ফুটতে থাকে। ইনান ধীরে ধীরে ডাকে,
-মা!
রাবেয়া হক ছুটে গিয়ে ছেলের চোখেমুখে চুমু খান। ইয়াদ, ইফতিহা আর ত্রয়ী ওদের কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। সবার চোখেই সুখ-দুঃখের অশ্রু। ইনান ওর মুখের ছোট্ট হাসিটা চারপাশে চোখ বুলিয়ে নেয়। ইয়াদকে দেখে। ইফতিহাকে দেখে। অতঃপর ত্রয়ীর দিকে চোখ পড়তেই ওর হাসিটা লুকিয়ে যায়। ও ওর মাকে জিজ্ঞেস করে,
-মা, এই মেয়েটা?
-বাবা, ত্রয়ী! ত্রয়ীও এসেছে আমাদের সাথে। তোকে দেখবে বলে। কতো কাদছে মেয়েটা কাল থেকেই।
-ত্রয়ী? ত্রয়ী কে মা? চিনতে পারছ না আমি। চিনতে পারছি না। আমার মাথা কাজ করছে না।
ইনানের কথাটা শুনেই উপস্থিত সবাই একদম স্তব্ধ হয়ে যায়। ত্রয়ী তো একদম নির্বাক হয়ে যায়। ওর ভেতর ভেতর যে কী চলছে, ও নিজেও ঠাওর করে উঠতে পারছে না। খুব দম বন্ধ, দম বন্ধ লাগছে! ইয়াদ আর ইফতিহা বাইরে ওদের বাবাকে খবর দিতে যায়। ইনান ত্রয়ীকে মনে করতে পারছে না। এটাকে কি খারাপ কিছুর লক্ষণ?

মোস্তফা হক আলফাজ সাহেব ও নিশানকে নিয়ে ভেতরে যায়। ত্রয়ী এখনো মূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে আছে। মোস্তফা হককে দেখেই ইনান হাসার চেষ্টা করে,
-বাবা।
মোস্তফা হক গিয়ে ইনানের ব্যান্ডেজ করা মাথাতেই ধীরে ধীরে হাত বুলিয়ে দেন। এদিকে আলফাজ সাহেব ইনানকে জিজ্ঞেস করে,
-বাবা, তুমি ঠিক আছো?
ইনান আস্তে আস্তে বলে,
-হ্যাঁ কিন্তু.. আপনি? আপনি কে?
ইনানের প্রশ্ন শুনেই সবাই আবার মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে থাকে। নিশান এগিয়ে জিজ্ঞেস করে,
-ভাইয়া, আমায় চিনতে পারছো? আমি নিশান। নিশান। আমার বড় ভাই তিশান, আমি নিশান, আর এই মেয়েটা ত্রয়ী। আমরা তিন ভাই-বোন। চিনেছো?

ইনান অসহায় ভাবে বলে,
-না ভাইয়া আমি.. আমি চিনতে পারছি না। আমি কিচ্ছু মনে করতে পারছি না। কিচ্ছু নাহ!
বলেই ইনান একটু পাগলের মতো আর্তনাদ করে উঠে।
মোস্তফা হক আর আলফাজ সাহেব আবার ডাক্তার ডাকতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। ইনানের এমন হচ্ছে কেন? ও ওদের মনে করতে পারছে না বলছে কেন?
ডক্টর সাহেব ইনানকে চেক করতে চলে এলেন। ইনানের বন্ধুরাও এবার ওকে দেখতে এসেছে। কিন্তু এবারও ওদের দেখে ইনানের একইরকম প্রতিক্রিয়া হলো। ও ওর পাঁচ বন্ধুর মধ্যে তিন বন্ধুকে চিনতে পারছে। ফয়সাল, সিয়াম আর নয়নকে। কিন্তু মাহিন আর সোহাগকে চিনতে পারছে না।
উপস্থিত সবাই আবার খুব চিন্তায় পড়ে গেছে। ইনানের কি স্মৃতিশক্তি হারিয়ে গেলো? কিন্তু তাহলে ওর মা-বাবা, ভাইবোন, কতিপয় বন্ধুদের কীভাবে চিনতে পারছে? ডক্টর সাহেব ওদের সবার কাছে পরিচিতির সময়কাল জানতে চায়। ফয়সাল, সিয়াম আর নয়নের সাথে ইনানের একদম ভার্সিটি লাইফ থেকে বন্ধুত্ব। তবে মাহিন আর সোহাগের সাথে বন্ধুত্বের বয়স আনুমানিক ৬/৭ মাস। এদিকে ত্রয়ীর ফ্যামিলির সাথে ইনানদের পরিচয় হয়েছে এক বছরের কম-বেশি হবে।

সব শুনে ডক্টর সাহেব বলেন,
-দেখুন, উনার হয়তো কয়েক বছরের স্মৃতিভ্রম হয়েছে। মাথায় জোরালো আঘাতের প্রভাবটা উনার ব্রেইনের উপর চাপ ফেলেছে। যার ফলেই উনি মধ্যিখানের কয়েক বছরের ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো মনে করতে পারছেন না। আর এজন্য এই সময়ে পরিচিত হওয়া মানুষগুলোকেও চিনতে পারছেন না।
কথার মাঝখানেই ডঃ রুহুল আমিনের একটা জরুরী কল আসে। যার কারণে তাদের উনি তাদের একটু অপেক্ষা করতে বলে পাশের কেবিনে চলে যান।

ঐ অবস্থায় ওসব শুনে হুট করেই ত্রয়ী ওর বাবাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেদে দেয়,
-বাবা ইনান আমায় মনে করতে পারছে না কেন? কেন বাবা? ও কি আর সুস্থ হবে না? কবে হবে বাবা? ডক্টরদের বলো না? উনাকে ঠিক করে দিতে। আমি উনাকে ছাড়া কীভাবে বাঁঁচবো?
ত্রয়ীর এমন কথাগুলো শুনে আলফাজ সাহেব কপাল কুচকে জিজ্ঞেস করেন,
-এই মা, এসব কী বলছিস তুই?
ত্রয়ী কাদতে কাদতে বলে দেয়,
-বাবা আমি ইনানকে খুব ভালোবাসি বাবা। খুব ভালোবাসি! উনাকে ছাড়া আমি এক মুহুর্তও থাকতে পারবো না!
আলফাজ সাহেব নিজের মেয়ের মুখে এসব শুনে একদম থমকে গেছেন। উপস্থিত বাকিরাও নির্বাক! আলফাজ সাহেবের দৃষ্টি স্থির হয়ে গেছেন। চোখদু’টো চড়কগাছ!

.
.
চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here