বেখেয়ালি মনে পর্ব-৩৯

0
356

#বেখেয়ালি_মনে
#লেখনীতে- Ifra Chowdhury
পর্ব-৩৯
.
.
আচমকা ত্রয়ীর এমন কথা শুনে আলফাজ সাহেব পুরোপুরি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছেন। ত্রয়ী ইনানকে ভালোবাসে, এই কথা এখানে এই হসপিটালে সবার সম্মুখে আজ প্রকাশ হয়ে গেলো। কারোর মুখেই কোনো কথা নেই। রাবেয়া হক অবাক হয়ে অশ্রুসজল চোখে ত্রয়ী আর ওর বাবার দিকে তাকিয়ে আছেন। উনি জানতেন ঠিকই ওদের সম্পর্কের কথা, কিন্তু আজ এমন পরিস্থিতি এই কথাটা সবার সামনে ফাঁস হবে, তিনি কল্পনাও করতে পারেন নি। তিনি ভাবছেন, আলফাজ সাহেব ও মোস্তফা হকের কথা। দুজনেই মোটামুটি বেশ কঠোর ধরনের মানুষ। উনারা ইনান আর ত্রয়ীর সম্পর্ক মেনে নেবেন তো?

রাবেয়া হক এই দু’জন ব্যক্তির মুখের দিকেই তাকিয়ে আছেন। উনাদের কেউ একজনের কাছ থেকে কোনো উত্তর আশা করছেন, যা থেকে ওদের দুজনের সম্পর্কের পরিণতি আন্দাজ করা যাবে। কিন্তু আলফাজ সাহেব, কিংবা মোস্তফা হক – কেউই কোনো কথা বলছেন না। উনাদের হয়তো এই কথার কোনো জবাব এই মুহুর্তে জানা নেই। নাহয়, এই অবস্থায় কী বলে উঠবেন, তা ভেবে পাচ্ছেন না।

আলফাজ সাহেব মুখ খুলতে যাচ্ছেন। মেয়ের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা বলতে যাবেন, ঠিক তখনি ডাঃ রুহুল আমিনের প্রবেশ ঘটলো। তিনি কিছুটা চমকের সহিত বলে উঠলেন,
-একি! আপনারা এখনো এতজন ভীড় করে আছেন এখানে? দেখি আপনারা বাইরে অপেক্ষা করুন।
বলেই তিনি ‘নার্স, নার্স’ বলে ডাকতে লাগলেন। আর সেই সাথে মোস্তফা হকের দিকে তাকিয়ে এটাও বললেন,
-মিস্টার হক, আপনি একটু আমার সাথে আসুন। দুই মিনিট কিছু কথা আছে আপনার সাথে। আপনার ছেলেকে নিয়েই।

কিছুক্ষণের মধ্যেই দু’জন নার্স এসে বাকি সবাইকে বাইরে যাওয়ার জন্য তাড়া দিতে লাগলো।
ইনান কিছুটা পাগলের মতো করছিলো। ওর মায়ের হাত শক্ত করে ধরে আটকে রাখতে চাইছিলো। রাবেয়া হকও ছেলেকে ছেড়ে যেতে চাচ্ছিলেন না। অবশেষে, রাবেয়া হককে ইনানের ঘুমানোর আগ পর্যন্ত কিছুক্ষণ থাকার পারমিশন দিলেন রুহুল আমিন। আর বাদবাকি সবাই ভারাক্রান্ত হৃদয়ে ওখান থেকে বাইরে বেরিয়ে এলেন।

______________________________________________________

ইফতিহা আর নিশান বড়দের মাঝে না থেকে একটু আলাদা বসে আছে। মেডিকেল চত্বরে। ইফতিহা একটু পরপরই ইনানের কথা ভেবে কেদে উঠছে। নিশান কী বলবে বা কী করবে, বুঝে উঠতে পারছে না। একটু নিজের মানুষের মতো সান্ত্বনাও দিতে পারছে না।
অথচ ওর কেন জানি ইচ্ছে করছে, ইফতিহাকে ওর বুকে একটু ঠাই দিতে, ওকে নিজের সাথে জড়িয়ে নিয়ে ওর কান্নাটা মুছে দিতে। নিশান বুঝতে পারে, ও যে ইফতিহাকে ভালোবেসে ফেলেছে। ইফতিহাকে নিয়ে ওর মনের দুর্বলতাটা ধীরে ধীরে ভালোবাসায় রূপান্তরিত হয়েছে। কিন্তু ইফতিহার মনে কী আছে, সেটা নিশান বুঝতে পারে না।

ইফতিহা আর নিশান এতক্ষণ নিজেদের মধ্যে হালকা দূরত্ব বজায় হাটাহাটি করছিলো। দুজনেই চিন্তায় মগ্ন। একজন শুধু ইনানকে নিয়ে। আর একজন ইনানসহ তার মনের মানুষটিকে নিয়েও। কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে নিরবে পায়চারী করার পর নিশান ইফতিহাকে একটা বেঞ্চে কিছুক্ষণ বসার প্রস্তাব দিলো। ইফতিহা মুখে কিছু না বলে মাথাটা হালকা নাড়িয়ে ওর কথায় সম্মতি জানালো।

দুজনেই চুপচাপ বসে আছে। কেদে কেদে ইফতিহার চোখ, মুখ, নাক পুরো লাল হয়ে আছে। ওর দু’চোখ এখনো টলটল করছে। ইনানের দুর্ঘটনার কথাটা মনে পড়লেই আবারও হয়তো সেসব পানি অশ্রু হয়ে বেরিয়ে আসবে। নিশানেরও ভালো লাগছে না। একদিকে ইনানের এই অবস্থা, আর সেই সাথে ওর দু’জন খুব প্রিয় মানুষ – ত্রয়ী ও ইফতিহারও কেঁদে কেঁদে এমন অবস্থা! ওর মনে ছিটেফোটাও শান্তি বিরাজ করছে না।

ত্রয়ীর কথা মনে হতেই ওর তখনকার কথাটা মনে পড়ে যায়। ওদের বাবাকে যে ত্রয়ী ইনানকে ভালোবাসার কথা বলছিলো। তাহলে ত্রয়ী আর ইনানের মধ্যে রিলেশন ছিলো? আর এটা নিশান জানতো না? কেন? ত্রয়ী ওকে একটাবার শেয়ার করলে কী এমন ক্ষতি হয়ে যেতো? নাকি ভরসা করতে পারে নি ওর উপর? কে জানে! পাগলিটাই জানে, ওর মনে মনে কী চলছিলো।

নিশান ইফতিহার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,
-আচ্ছা তুমি কি ইনান ভাইয়াও কি ত্রয়ীকে ভালোবাসে? তুমি ওদের সম্পর্কের কথা জানতে?
ইফতিহা কিছুটা চমকে নিশানের দিকে তাকায়। খানিকক্ষণ নিরব থেকে নাকচোখটা একটু মুছে জবাব দেয়,
-জানতাম মানে, আন্দাজ করতাম শুধু। ভাইয়া বা আপু কখনো নিজ থেকে ওদের সম্পর্কের কথা বলে নি ঠিক, কিন্তু আমি বুঝতাম ওরা দুজন দুজনকে যে ভালোবাসে। আর আমি না বুঝে বেশ কয়েকদিন তো ওদের একা একা প্রেমালাপ করার সময় সেখানে উপস্থিতও হয়ে গেছিলাম।
কথাটা বলেই হালকা হাসে ইফতিহা। নিশানও ওর হাসিটা দেখে একটু হাসতে চেষ্টা করে।

ইফতিহা ঠোটের কোণে আরেকটু হাসি এনে বলে,
-ত্রয়ী আপু ভাইয়াকে খুব ভালোবাসে, জানেন?
নিশান ইফতিহার দিকে তাকায়,
-আর তুমি ভালোবাসো না কাউকে?
কথাটা শুনেই ইফতিহা একটু হকচকিয়ে যায়। হালকা নড়েচড়ে বসে। নিশান হাসে এমন অবস্থা দেখে। ও ইচ্ছে করেই ইফতিহাকে একটু খোচানোর জন্য বলে,
-কী হলো? অপ্রস্তুত হয়ে পড়লে নাকি? ভালোবাসো কোনো ছেলেকে? বলো বলো? আমি কাউকে বলবো না তো।
-আরে না এমন কিছু না। যা ইচ্ছে, তা-ই বলেন আপনি।
নিশান কোনো উত্তর না দিয়ে নিরবে হাসতে থাকে, অন্যদিকে তাকিয়ে।

_______________________________________________________

কেটে গেছে বেশ কয়েকদিন। ইনানকে এখনো ডিসচার্জ করা হয়নি হসপিটাল থেকে। ওর শারীরিক অবস্থা উন্নতির দিকেই আছে, কিন্তু ওর মানসিক অবস্থার কোনো পরিবর্তন নেই। মাঝখানের কয়েক বছরের ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো কোনোভাবেই সে মনে করতে পারে না। ও নিজেই খুব চেষ্টা করে মনে করার, কিন্তু এতে ওর ব্রেইনের উপর ক্রমশ চাপ পড়তে থাকে; যার প্রভাব ওর কার্যকলাপের উপর পড়তে শুরু করে।

সারাক্ষণ শুধু পুরনো কথা মনে করায় ব্যস্ত থাকতো ইনান। আর মনে না পড়লেই নিজের চুল টানতো, দাঁতে দাঁতে কিড়মিড় করতো, হাতে মুষ্টিবদ্ধ করে বসে থেকে নিজের ঊরুতেই ঘুষি মারতো। আরো কত্তো কি। কেউ তখন ওকে সামলাতে পারতো না। অগত্যা নার্স কিংবা ডক্টর এসে ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে শান্ত করতো।

আর ওদিকে ছেলের এই অবস্থায় রাবেয়া হক কাদতে কাদতে অস্থির। ত্রয়ীরও অবস্থাও তেমন। দিনরাত আল্লাহকে ডাকতে থাকে মেয়েটা। কেন ওর ইনানের সাথে এমন করলো? কেন ওর স্মৃতিশক্তি কেড়ে নিলো? ও না পারছিলো এসব সইতে, না পারছিলো কিছু করতে!

মোস্তফা হকেরও হাত পা বাধা। আল্লাহ যা করেন, উনার ইচ্ছাতেই তো সব করেন। নিজেকে খুব কষ্টে সামলানোর চেষ্টা করতেন উনি। কারণ উনি নিজেই যদি ভেঙে পড়েন, তাহলে তার কাধের ভরে থাকা স্ত্রী-সন্তানেরাও তো আরো ঝরে পড়বে।

আজ সকাল সকাল উনি কোর্টের দিকে বেরিয়েছেন। উনাদের সেই জায়গার কেইসটা নিয়ে। উনার ছেলেকে যে ঐ নেতার লোকেরাই মেরেছে, সেটা বুঝতেও উনার বেগ পেতে হয়নি। এমনিতেই তলে তলে অনেক হুমকি দিচ্ছিলো ওরা, আর ঐদিন তো ইনানকে ঐভাবে মারধরও করলো।

মোস্তফা হকও বুদ্ধিমান ব্যক্তি। বিপদেও মাথা ঠান্ডা রেখে সাথে সাথেই পরদিন আইনি সহায়তা নেন। তাদের হুমকির প্রত্যেকটা প্রমাণ মোস্তফা হক পুলিশদের হাতে তুলে দেন। উকিল সাহেবও সঙ্গে ছিলেন। তিনি এগুলোকে মামলার কাজেও কোর্টে সবার সামনে উপস্থাপন করবেন। এইবার তো নেতা সাহেব বেশ খারাপভাবেই ফেঁসেছেন। আর পার পাওয়ার কোনো উপায় নেই। জায়গাটাও এবার পুরোপুরি মোস্তফা হক সাহেবের দখলেই চলে আসবে।

কোর্টে যাওয়ার আগে একটাবার মোস্তফা হক উনার ছেলের কাছে এসে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। আজ ওদের জায়গার ঝামেলাটা নিয়ে কোর্টের শেষ শুনানি। ইনান খুব পরিশ্রম করেছে, ওর দাদার জায়গাটাকে না হারানোর জন্য। আর ঠিক এসব করতে গিয়েই এক পর্যায়ের দুর্ঘটনায় ইনান আজ এই অবস্থায়।

ইনান ঘুমোচ্ছে। একদম নিষ্পাপ বাচ্চাদের মতো একটা ছোট্ট বালিশে জড়িয়ে ধরে আছে। ছেলের ঘুমন্ত চেহারাটার দিকে তাকিয়ে মোস্তফা হকের চোখের কোণে হালকা পানি জমে যাচ্ছে। নিজেকে সামলে নিয়ে তখনি ওখান থেকে বেরিয়ে আসেন উনি। রওনা দেন কোর্টের উদ্দেশ্যে।

____________________________________________________

ত্রয়ী তখন থেকেই উশখুশ করছে ইনানের কাছে যাওয়ার জন্য। কিন্তু ইনান ঘুমোচ্ছিলো, তাই যেতে পারছিলো না। কিছুক্ষণ আগেই ইনানের ঘুম ভাঙলো। আর তখনি ত্রয়ী হন্তদন্ত হয়ে ইনানের বেডের দিকে ছুটলো।

ত্রয়ীকে নিজের কাছে আসতে দেখেই ইনান কিছুটা নড়েচড়ে উঠলো। কিছুটা বিরক্তিভাব নিয়ে বলতে লাগলো,
-এই মেয়ে, আপনি এখানে কেন? যান! যান এখান থেকে! সে আমার সাথে অন্য কোনো মেয়েকেই সহ্য করতে পারে না। আপনাকেও সহ্য করতে পারবে না। সরুন এখান থেকে। একদম কাছে আসবেন না আমার। আমি কিন্তু.. আমি কিন্তু চিৎকার করবো।

কথাটা বলেই ইনান আবার এদিক সেদিক তাকিয়ে কি যেন খুজতে থাকে। তারপর একটা ট্রে তে ওর একটা পানিভর্তি গ্লাস দেখে ওটাই নিজের হাতে নিয়ে নেয়। আর মুহুর্তেই ঐ গ্লাসের পুরোটা পানি ত্রয়ীর দিকে ছুড়ে মারে। ত্রয়ীর চোখ মুখে পানি ছিটকে পড়ছে। ও থমকে দাঁড়ায়।

ইনান গ্লাসটা ডান হাতে নিশানা করে ধরে ত্রয়ীকে উদ্দেশ্যে করে বলতে থাকে,
-আর এক পা এগোলেই আমি কিন্তু এ-এই গ্লাসটা ছুড়ে মারবো! তারপর একে একে এখানের সব ছুড়ে মারবো আপনার দিকে। যান বলছি!

ইনানের এমন রূপ দেখে আবারও চোখে পানি এসে যায় ত্রয়ীর। চিৎকার চেচামেচি শুনে রাবেয়া হক ও ইফতিহা-নিশানও ছুটে এসেছে। ওরা ইনানকে সামলাতে যায়। ত্রয়ী অনবরত কেদে চলেছে। ওর এসব মেনে নিতে খুব কষ্ট হচ্ছে! খুব। গোলমাল বুঝে কিছুক্ষণের মধ্যে আলফাজ সাহেবও সেখানে উপস্থিত হন।

ইনানকে এভাবে নিজের মেয়ের উপর চিৎকার চেচামেচি ও গ্লাস নিয়ে হুমকি দিতে দেখে উনি তাৎক্ষণিক ত্রয়ীকে টানতে টানতে কেবিন থেকে বেরিয়ে আসেন।

.
.
চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here