বেখেয়ালি মনে পর্ব-৮

0
844

#বেখেয়ালি_মনে
#লেখনীতে- Ifra Chowdhury
পর্ব-০৮
.
.
ওরা গ্রামে এসেছে আজ চারদিন। এ ক’দিন খুব ভালোই কেটেছে সবার। বিশেষ করে ইনান, ত্রয়ীর। ইনানের মনে ত্রয়ীর জন্য এক অদ্ভুত মোহ কাজ করছে। এমন যেন আজ অবধি অন্য কোনো মেয়ের ক্ষেত্রেই হয়নি। এটাকে কি শুধু মোহ বলে নাকি এর বেশি কিছু? জানা নেই ঠিক!

আজকের দিনটায় গ্রামে থেকে কাল সবার ঢাকায় ফেরার কথা। কিন্তু এই মুহুর্তে ইনানকে সিলেটের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিতে হবে। সকালেই খবর এসেছে ইনানের দাদা মারা গেছেন। তাই ইনান আর ইফতিহাকে এখনি সিলেট যেতে হবে। ইফতিহা খবরটা শোনার পর থেকেই কেঁদে চলেছে। ইনান ভেতরে ভেতরে ভেঙে পড়লেও সামনে তা প্রকাশ করছে না।

ত্রয়ীর মন বিষন্নতায় ঘিরে ফেলেছে। ইচ্ছে করছে ইনানের সাথে যেতে কিন্তু এটা তো সম্ভব না। বাবা-মা, জেঠু কেউই যেতে দিবে না।

ত্রয়ীকে মনমরা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ইফতিহা জিজ্ঞেস করে,
– আপু তুমিও চলো আমাদের সাথে?
ইফতিহার কথা শুনে ত্রয়ী ভ্যাবাচেকা খেয়ে বলে,
– এটা আদৌ সম্ভব না।
-কেন সম্ভব না?
– আমাকে একা তোমাদের সাথে যেতে দিবে না কেউ।
ইফতিহা ছোটো করে বলে,
– ওহ।

এমন সময় তনয়া এসে বলে,
– ত্রয়ী তুই বরং ইফতিহার সাথে যা। মেয়েটা কেঁদে কেঁদে অস্থির। ইনান হয়তো একা সামলাতে পারবে না। ও নিজেও তো শোকের মধ্যে আছে।

মায়ের কথা শুনে ত্রয়ীর বিস্ময়ের সপ্তম আকাশে ভ্রমণ করে। ওর মা ওকে যেতে বলছে তাও ইনান, ইফতিহার সাথে? এ যেনো কল্পনা!

ত্রয়ী হা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে দেখে তনয়া আবার বলে,
– এভাবে বোকার মত হা হয়ে দাঁড়িয়ে না থেকে জলদি তৈরি হয়ে নে।
– আমি একা যাবো মা?
– ওমা! একা কে বলল? ইনান, ইফতিহাও তো আছে।

ত্রয়ী ওর ডান হাত দিয়ে চোখ কচলে নিলো। স্বপ্ন দেখছে না তো ও? কিন্তু না সব তো ঠিকই আছে।
তনয়া ত্রয়ীকে তাড়া দিয়ে সেখান থেকে চলে যায়। ত্রয়ী আর বেশি ভাব নিতে যায় না। পরে যদি হিতে বিপরীত হয়ে যায় এই ভয়ে।

তনয়া ত্রয়ীর বাবা, জেঠুকে কোন যাদুবলে মানিয়ে ফেলে, তা ত্রয়ী জানেনা। জানতেও চায়না। কিছু জিনিস অজানা থাকাই ভালো।

ওরা সকাল দশটা নাগাদ বেরিয়ে পরে। ইনানের বাড়ি সিলেট সদরে। সিলেট যাওয়ার অনেক ইচ্ছে ত্রয়ীর ছোটো থেকেই কিন্তু কখনো যাওয়া হয়ে উঠেনি। আজ এভাবে নিজের ভালোবাসার মানুষের সাথে, তার নিজের বাড়ি সিলেট যাচ্ছে ত্রয়ী ভাবতেই পারছেনা। খুশির আমেজ যেনো ত্রয়ীর চারপাশ ঘিরে রেখেছে।

_________________________________________________________

ট্রেনে করে যাচ্ছে তারা। চাঁদপুর থেকে সিলেটের উদ্দেশ্যে ট্রেন ছাড়ে সকাল সাড়ে দশটায়। ইনান, ত্রয়ী মুখোমুখি হয়ে বসেছে। ত্রয়ীর পাশে ইফতিহা। ট্রেনের ঝকাঝক শব্দটা দারুণ লাগছে ত্রয়ীর কাছে। এই প্রথম সে ট্রেনে চড়েছে। জানালার ধারে বসে রাস্তার গাছপালা দেখছে। প্রকৃতি কী অপরূপ তা কেবল গ্রামে আসলেই বুঝা যায়। সব কিছুতেই সবুজের ছোঁয়া লেগে আছে।
কিন্তু ইনানের মন আজ কালো মেঘে ছেয়ে আছে। খুব দ্রুত সে সিলেট পৌঁছাতে চাচ্ছে। অন্যদিকে ত্রয়ী চাচ্ছে ট্রেনের যাত্রাটা যেনো খুব দীর্ঘ হয়।

ইনান সিটে হেলান চোখ বন্ধ করে আছে। ইফতিহা ঘুমিয়ে পড়েছে। ত্রয়ী ইনানের বন্ধ নয়নের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। এই মানুষটাকে ত্রয়ী সব উজাড় করে দিতে পারে। চোখ বন্ধ করেই! খুব যে ভালোবেসে ফেলেছে! হঠাৎ খেয়াল করে ইনানের চোখের কোণে জল জমেছে। ত্রয়ীর বুক ভারী হয়ে আসে। ওর চোখের কোণের বিন্দু পরিমাণ জলের ফোঁটাকে ত্রয়ী সহ্য করতে পারছেনা। ইচ্ছে করছে ওর কোমল হাতের ছোঁয়া দিয়ে ইনানের চোখ মুছে দিতে। কিন্তু সেই অধিকার এখনো হয়নি তার।

হঠাৎ করেই ত্রয়ীর চোখ যায় একজোড়া দম্পতির দিকে। একজন আরেকজনের বুকে মুখ গুজে ঘুমোচ্ছে। লোভ হয় ত্রয়ীর। ইনানকে কাছে পাওয়ার তীব্র নেশাটা আরো তীব্রতর হয়। জোঁকের মতো ইনানকে আঁকড়ে ধরতে মন চায়। ভাবনার অতলে তলিয়ে যায় ও।

এতোক্ষনে ইনানের নজরে পড়ে ত্রয়ী। ত্রয়ী চুলে সূর্যের কিরণ এসে পড়েছে। চকমক করছে চুলগুলো। কেমন এক অদ্ভুত ঝিলিক! হরিণের মতো ডাগর ডাগর আঁখির উপর শাইন করা চুলগুলো বার বার উড়ে এসে ভীষণভাবে বিরক্ত করছে।

ইনান আলতো হাতে চুলগুলো সরিয়ে দেয়। ত্রয়ীর পাকা ঘুমটা ভেঙে যায় কারো হাতের স্পর্শ পেয়ে। ইনান দ্রুত তার হাত গুটিয়ে নেয়। ত্রয়ী ইনানের দিকে তাকাতেই সে চোখ সরিয়ে নেয়। ত্রয়ী হাসে। সেই হাসিতে মিশে আছে লজ্জা।

– আর কতোক্ষণ লাগবে পৌঁছোতে?
স্থির কন্ঠে জিজ্ঞেস করে ত্রয়ী।
ইনান ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলে,
-আর এক ঘন্টা পর রেলস্টেশনে নামবো আমরা। সেখানে ইয়াদ গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করবে। স্টেশন থেকে বিশ মিনিটের মাথায় আমরা বাড়ি পৌঁছে যাবো।
সব মিলিয়ে ধরো, দেড় ঘন্টার মতন লাগবে আরো।

ইফতিহার ঘুম ভেঙে যায়। দাদাভাইয়ের কথা মনে পড়ে আবার কেঁদে উঠে। ত্রয়ী সান্ত্বনার বানী দেয়। কিন্তু ইফতিহার কান্না থামেনা। অনবরত কাঁদতে থাকে।

ত্রয়ীর মন খারাপ হয়ে আসে। চোখে জল জমে। কারো কান্না সে সহ্য করতে পারেনা। চোখ দিয়ে কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে। তিনজনই নীরব হয়ে যায়। রাতের আঁধারের মত সবার মুখে আধার নেমে আসে।

__________________________________________________________

রাত আটটার পর ইনান বাড়ি পৌঁছে। থমথমে হয়ে আছে বাড়ি। সবার মাথার উপরের ছায়া যখন সবার মাঝ থেকে চলে যায়, তখন বাড়ি থমথমে হয়ে যাওয়া স্বাভাবিক ব্যাপার।

ইনান এসে বাবাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ে। ইনান আসার অপেক্ষায় ছিলো সবাই। ও আসার পর সৈয়দ হককে কবর দেওয়া হয়। সবাই ক্লান্ত। কান্নার আওয়াজ থেমে এসেছে। ত্রয়ী কখনো এতোটা জার্নি করেনি। আজ হঠাৎ এতো পথ জার্নি করে এসে অসুস্থ হয়ে পড়ে।
ইনানের মা রাবেয়া হক ত্রয়ীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেই ত্রয়ী ঘুমের দেশে পাড়ি জমায়।

ইনান ব্যালকনিতে বসে আছে। লাল ডিম লাইটের মৃদু আলোতে ডায়েরি নিয়ে বসে। কিছু একটা লিখে । সেন্টার টেবিলের উপর মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ে।
রাবেয়া ইনানের ব্যালকনিতে এসে ছেলের পাশে বসে। হঠাৎ খোলা ডায়েরির পাতায় চোখ আটকে যায়।

“এই ব্যস্ততম শহরের ভীড়েও,
আজ আমি একা,
নিজেকে ভীষণ নিঃস্বঙ্গ মনে হয়!”

মুহুর্তেই ছেলের অতীত মনে করে রাবেয়ার বুক চিড়ে বেরিয়ে আসে হাহাকার মাখা এক গভীর দীর্ঘশ্বাস।
.
.
চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here