#বেলীফুল
পর্ব-৫
তুলনের ওপর দিয়ে টর্নেডো বয়ে গেল। মার কতগুলো খেয়েছে ঠিক হিসেব নেই। তবে সবচেয়ে বড় কষ্টের ব্যাপার হলো তার মোবাইলটা নিয়ে গেল মা। বাইরে যাওয়া বন্ধ পুরোপুরি। এখন থেকে ঘরে থাকতে হবে, ভাবিদের থেকে কাজ শিখতে হবে। খুব দ্রুত তার বিয়ে দেয়া হবে। বিয়ের পর বাপের বাড়ির লোককে যেন শুনতে না হয় মেয়েকে কাজ শেখানো হয়নি৷ লাফাঙ্গা ধরনের মেয়ের পড়াশুনা করে কাজ নেই।
পরদিন প্রায় সারাদিনই কাজ করল তুলন। সকালে রুটি বেলতে হলো। কোনোটা ছোট, কোনোটা বিশাল, কোনোটা ছেঁড়া তো কোনোটা পুড়ে ছাই! সেসব রুটি খেতে গিয়ে একেকজনের কঠিন সব বাণীও শুনতে হলো।
তার একটু পর ঘঁষতে হলো পাঙ্গাস মাছ। হাতটা ছিলে গেল তুলনের৷ বহু শখ করে রাখা নখ ভেঙে গেল দুটো।
দুপুরের রান্নাও ভাবিদের সাথে হাতে হাতে করতে হলো তার। সব মিলিয়ে একটু জিরিয়ে নেবার সময়টাও পেল না তুলন।
ভাবিদের মুখটা দেখার মতো ছিল আজ। একেবারে জ্বলজ্বল করছে, যেন ঈদ লেগেছে।
তুলন অবশ্য মেনে নিল সবকিছু। হিসেব পরে নেয়া যাবে। এখন বাড়াবাড়ি করলে ফল আখেরে তার জন্যই খারাপ হবে এটা বুঝে গেছে সে।
এতকিছুর পরও তার ওপর মায়া হলো না তেমন কারো। বড় ভাইয়া থাকলে হয়তো কিছু বলত, কিন্তু এখন ভাইয়েরা বাসায় নেই। আছে শুধু মা আর দুই ভাবি।
সব কাজ মুখ বুজে করতে পারল বলেই বিকেলে ইলার সাথে দেখা করার অনুমতি পেল সে।
***
“আচারটা অনেক মজা রে! কে বানিয়েছে?” খেতে খেতে বলল ইলা।
“ছোট ভাবি।”
“তোর এই ভাবিটা কাজের।”
“ভয়ানক কাজের! কালকের যত বিশ্রি কাহিনী হলো তার সব রসদ তিনিই জোগাড় করে দিয়েছেন। খালি আচার বানাতে পারলেই হয় না। মাথায় ঘিলু নাই কিছু না। গবেট কোথাকার!”
“আহা এমন করে বলিস কেন?”
“আর কী বলব? এত গাধা জানিস, বাবা মায়ের সামনে সেদিন বলছিল সে নাকি অনেকগুলা বাচ্চা নেবে।”
ইলা কয়েক মুহূর্ত চেয়ে থেকে খিলখিল করে হেসে গড়িয়ে পড়ল বিছানায়৷ ওকে দেখে তুলনও হাসল অনেকক্ষণ পর।
“ভাবি কি কনসিভ করেছে নাকি?”
“হাবভাবে তাই মনে হয়। বলেনি এখনো।”
“ওহ।”
“মানুষ বাড়ছে। আমাকে বিদায় করতে পারলে ওদের থাকার জায়গা একটু বাড়ত। এজন্যই আমার পেছনে লেগেছে। আমিও দেখে যাব শেষ পর্যন্ত।”
“আচ্ছা দেখিস৷ এখন একটু আচার খা।”
“তুই খা।”
ইলারও ভাগ দেয়ার ইচ্ছে ছিল না৷ সে আচারের পেয়ালা হাতে নিয়ে খেতে শুরু করল৷ কলিংবেল বাজল তখন। ইলার ফ্ল্যাটে সাধারণত তুলন ছাড়া কেউই আসে না। ছুটা বুয়া কাজ করে দিয়ে যায় সকালে। এখন তো বিকেল। ইলা গেল দরজা খুলতে। পিপহোলে চেয়ে তার হৃৎস্পন্দন হঠাৎ কমে যাবে মনে হলো। এক ছুটে সে চলে এলো তুলনের কাছে৷ বলল, “কানন এসেছে।”
“তো?”
“আমার কাছে এসেছে।”
তুলন বিরসমুখে বলল, “একদম ঢং করবি না৷ দুনিয়াতে সবার বয়ফ্রেন্ড আছে, তোর একার না। যা দরজা খোল।”
“ও এখনো আমার বয়ফ্রেন্ড হয় নাই।”
“তাতেই এই অবস্থা আর হলে কী হবে?”
আবারও বাজল বেল। ইলার বুক ধুকপুক করছে৷ সে আজ একটা কাজ করেছে। সকালবেলা মা বাবা বেরিয়ে যেতেই কাননের ফ্ল্যাটে গেছে সে। কানন তখন অফিস যাওয়ার জন্য প্রায় তৈরি৷ ইলা তার হাতে একটা চিঠি দিয়ে দৌড়ে ফিরে এসেছে৷ চিঠিটা লম্বা। সারমর্ম এই, “ইলাকে বিয়ে করে নিলেই কাননের জীবনের অবসাদ কেটে যাবে। ইলা অনেক সুন্দর করে গুছিয়ে সংসার করবে। আর দু’একটা বাচ্চাকাচ্চা হলেই দেখা যাবে কাননের আর মরতে ইচ্ছে করবে না।”
চুলটা আঁচড়ে নিয়ে এক দৌড়ে দরজা খুলে দিল৷ কাননের মুখে বিরক্তি খেলে যাচ্ছে।
“দরজা খু্তে এতক্ষণ?”
“কাজ করছিলাম। আসুন ভেতরে।”
“ভেতরে যাব না। এই নাও।”
কাননের হাতের প্যাকেটটা এতক্ষণে দেখল ইলা। “কী এতে?”
“খুলে দেখো।”
বলে দাঁড়াল না কানন। তার ফ্ল্যাট সামনেরটাই। ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। ইলা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আবার মনে মনে আনন্দও হচ্ছে। কানন তার জন্য কিছু এনেছে!
ইলার মনে পড়ে গেল প্রথম দিন কাননকে দেখার কথা। ও তখন মালপত্রের সাথে ট্রাকে করে প্রথমবার এই বাড়িতে এসেছে। নামতেই সামনে পড়ে গেল ছিপছিপে গড়নের ছেলেটার। সেদিন সে পরেছিল সাদা রঙেট একটা শার্ট। গলায় ধূসর মাফলার। খুব সাধারণ চেহারা, অথচ চোখদুটো গভীর৷ সেই গভীর চোখদুটো দিয়ে ছেলেটা তাকিয়ে ছিল বাড়ির সামনের শিমুল গাছটার দিকে। শীতের হাওয়ায় গাছ তখন পাতাশূন্য। শুধু ডালগুলো মেলে ধরে দাঁড়িয়ে থাকা নিঃসঙ্গ গাছটার মতো ছেলেটাকেও নিঃসঙ্গ লাগছিল। ইলা কোনোদিনই আগ বাড়িয়ে ছেলেদের সাথে কথা বলতে যায় না। কিন্তু এর মাঝে কী দেখেছিল সে নিজেও বুঝতে পারে না আজও। এখনো তাকে দেখলে ছটফট করতে থাকে ইলা। ইচ্ছে করে ছুটে গিয়ে তার কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে। মানুষটা আশেপাশে থাকলেও ভালো লাগা ছুঁয়ে দিয়ে যায় ইলাকে। স্বল্পভাষী মানুষটার একটু কথা তার মাথায় বার বার বাজতে থাকে সুর হয়ে। সেদিনের তীব্র কথা বলার তৃষ্ণায় সম্মোহিতের মতো এগিয়ে গিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করেছিল, “আপনি এই বাড়িতে থাকেন?”
ছেলেটা ফিরেও তাকায়নি। বোধহয় শুনতেই পায়নি, কিংবা শুনেও না শোনার ভান করে ছিল। ইলা খুব অপমানিত বোধ করেছিল। কয়েকদিন মন খারাপ করেও ছিল। কিন্তু সে জানত না এটা তার বেহায়া হওয়ার প্রথম ধাপ ছিল। সে ক্রমেই আরও বেশি বেহায়া হয়ে যাচ্ছে৷ যেচে পড়ে এই লোহার মতে শক্ত মানুষটাকে গলানোর চেষ্টা করছে। কানন তার ওপর স্পষ্টতই বিরক্ত, একদিন তো বেরও করে দিল। তবু ইলার শিক্ষা হয় না। যতই ফিরিয়ে দেক, পাগল মন তার কাছেই গিয়ে ভিড়ে।
“কিরে একা একা দাঁড়িয়ে আছিস কেন? তোর হনুমান চলে গেছে?”
“হ্যাঁ।”
“হাতে কী? গিফট?”
“জানি না, দিল।”
“চল দেখি।”
বেশ ভালোভাবে প্যাকেট করা ছিল চারকোণা জিনিসটা। কী হতে পারে ওরা বুঝতে পারছ না৷ তুলন বার বার বলছিল মনে হয় জুয়েলারি বক্স। কিন্তু একদম নিরেট মনে হচ্ছে।
খুলে দেখা গেল ভেতরে একটা বই। বইয়ের নাম, “ব্যক্তিত্ব উন্নয়নের সহজ একশো পদ্ধতি।”
ইলা হতবাক হয়ে চেয়ে রইল। তুলন এক ছুটে বাথরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। তার বেদম হাসি পাচ্ছে। ইলার সামনে হাসলে মার খেতে হতে পারে।
(চলবে)
সুমাইয়া আমান নিতু