ব্যবধান ( অষ্টম পর্ব )

ব্যবধান ( অষ্টম পর্ব )
শ্রাবন্তী ভট্টাচার্য্য

সারাদিন ধরে নাতিকে প্রাণভরে আদর করে, স্নান করিয়ে, ভাত মেখে কোলে বসিয়ে খাইয়ে, মনের সাধ মিটিয়ে নাতিসেবা করে, তবে সুলেখাদেবী রণকে ছাড়লেন। রণকে গাড়িতে বসিয়ে কৌস্তভ বেরিয়ে গেল, তার মায়ের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য। কলিংবেলের শব্দে দরজা খুলল শিখা। রণকে শিখার কোলে দিয়েই, বেরিয়ে আসছিল কৌস্তভ। পেছন থেকে ডাকলো শিখা—-” কৌস্তভ চলে যেওনা। একটু ঘরে এস।“

কৌস্তভ অনিচ্ছা সত্বেও, আপত্তি করলোনা। আপত্তি জানালেই আবার শুরু হবে সেই মান-অভিমানের পালা। ধীরে ধীরে ঘরে প্রবেশ করলো সসংকোচে। সেদিনের পর থেকে শিখার ঘরে ঢুকে, আগের সেই স্বাচ্ছন্দ্য আর বোধ করেনা কৌস্তভ। একটা অস্বস্তি সর্বক্ষণ মনের ভেতর। একটা চেয়ার দখল করে কিছুটা আড়ষ্ট হয়ে বসে রইল সে।
শিখার কোল থেকে রণকে নিয়ে টুলুমাসি ওকে ঘুম পাড়াতে ঘরে নিয়ে গেলে, শিখা ঢুকলো রান্নাঘরে। আজ পোস্তর বড়া বানিয়েছে শিখা। কৌস্তভের ভীষণ পছন্দের আইটেম। একটা প্লেটে বেশ কয়েকটা পোস্তর বড়া সাজিয়ে, ঘরে ঢুকতে গিয়ে চোখ পড়ল কৌস্তভের উপর। বাইরের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর হয়ে বসে আছে। এই কৌস্তভ আর আগের সেই কৌস্তভের মধ্যে যেন আকাশ পাতাল পার্থক্য। সত্যিই অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে ওর স্বভাবে। আগের সেই প্রগলভতা আর নেই ওর মধ্যে। তাহলে আজ সত্যিই কী কৌস্তভ ওদের ফিরে পেতে চায়? শুরু করতে চায় নতুন এক জীবন? তবুও কেন জানিনা, শিখার ভয় হয় বিশ্বাস করতে। ভয় হয় ভরসা করে নতুন করে আঘাত পেতে।

——-” আজ ঘরে পোস্তর বড়া বানিয়েছিলাম। তোমার তো ভীষণ পছন্দের? তাই ভাবলাম এসেছ যখন তোমায় দিই।“—– প্লেটটা এগিয়ে দিতে দিতে হাসিমুখে বলল শিখা।
——” আমার পছন্দগুলো তাহলে এখনও ভোলনি দেখছি। এখনও এত মূল্য রাখি তোমার কাছে?
কৌস্তভের কথার অন্তর্নিহিত ক্ষোভ বুঝতে পেরে, চুপ করে রইল শিখা। বেশ কিছুক্ষণ দুপক্ষই নীরব। খানিক বাদে শিখাই কথা বলল আবার।
——-” তোমার শরীর এখন কেমন আছে কৌস্তভ? পায়ের ব্যথাটা কমেছে?”
—-” হ্যাঁ, কমেছে। এখন ভালো আছি।“–‘ সংক্ষেপে উত্তর দিল কৌস্তভ।
কৌস্তভের এই সর্বক্ষণের ঔদাসীন্যই, শিখার ক্ষোভ ও অভিমানেকে আরও উস্কে দেয়। কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই কৌস্তভ উঠে পড়ল—–” এখন আসি শিখা। পোস্তর বড়াটা খুব ভালো বানিয়েছো। খাওয়ানোর জন্য ধন্যবাদ।“
শিখা মুখ ঘুরিয়ে বলল—-” তুমি ভুল করছো। বড়াটা আমি বানাইনি। টুলুমাসি বানিয়েছে। ধন্যবাদটা তাকেই দেবে যাও।“
শিখার অভিমানের বহর দেখে, হাসি পেলো কৌস্তভের। তবুও পূর্বের গাম্ভীর্য বজায় রেখে বলল—-” তুমি যেমন আমার পছন্দগুলো ভোলনি, আমিও তেমনি তোমার হাতের রান্নার স্বাদও ভুলিনি শিখা। তাই ধন্যবাদটা তোমারই প্রাপ্য। আর আরেকটা ব্যাপারেও তোমায় ধন্যবাদ দেওয়ার ছিল।“
——-” কী ব্যাপারে?”
——–” আজ রণকে পাঠিয়ে মাকে যে আনন্দ তুমি দিয়েছো, তার জন্য ধন্যবাদ। যদিও আমার উপর রাগ দেখাতেই তুমি রণকে ওই বাড়ি পাঠিয়েছো, তবু ব্যাপারটা বেশ ভালোই হল। নাতিকে কাছে পেয়ে অনেকদিন বাদে একটু প্রাণখুলে হাসলো মা।“

রণর জন্মদিন ক্রমশ এগিয়ে আসছে। এবছর রণ তিন বছরে পা দেবে। হাতে গোনা আর দুটো দিন বাকি। খুব ব্যস্ত শিখা। প্রতিবছর ছেলের জন্মদিনটা ও বেশ ধুমধাম করে পালন করে। স্কুলের কলিগ থেকে শুরু করে পাড়া-প্রতিবেশী রণর জন্মদিনের নিমন্ত্রণ পেতে কেউ আর বাকি থাকেনা। সারা বছর এই দিনটার জন্য অধীর আগ্রহে বসে থাকে শিখা। ছেলের জন্মের দিনটা ওর কাছে ভীষণ আনন্দের। সব আনন্দই তো একে একে ওর জীবন থেকে বিদায় নিয়েছে। তাই ছেলের এই জন্মদিনটাই আনন্দ করে, ছোটখাট মহোৎসব করে কাটায় শিখা।

স্কুলে সবাইকে রণর জন্মদিনের নিমন্ত্রণ জানিয়ে, কমন রুমে তনিমার পাশে এসে বসল শিখা। তনিমা নিচুস্বরে জিজ্ঞেস করল—-” হ্যাঁরে শিখা, কৌস্তভকে ডেকেছিস?” শিখা দুপাশে মাথা নেড়ে বলল—” না। আমি আর নতুন করে কোন ঝামেলা চাইনা তনিমা। সবাই জানে ওর সাথে আমার ডিভোর্স হয়ে গেছে। তারপর ঐ দিন কৌস্তভ যদি আমার বাড়িতে উপস্থিত থাকে, লোকে বলবে কী? আরতিদেবীকেও ডেকেছি। চিনিসই তো কেমন জাহাবাজ মহিলা উনি। সবার সামনে যাতা বলে দিতে, ওঁনার মুখে একটুও বাধবেনা।“
——-” তাই বলে, ছেলের জন্মদিনে তার বাবাকেই ডাকবিনা?”
——–” আগের বছরও তো আমি ছেলের জন্মদিন পালন করেছিলাম। কই আগের বছর তো ওর মনে পড়েনি, ছেলের জন্মদিনে আসবার কথা? মদ আর বন্ধুবান্ধব নিয়েই তো মেতে ছিল। তাহলে এই বছর ছেলের জন্য এত দরদ কীসের? নাইবা আসলো, এতে অসুবিধাটা কোথায়?“
——” কী জানি বাবা! তোকে ঠিক বুঝতে পারিনা এখন। তোর মনটা ধীরে ধীরে পাষাণ হয়ে যাচ্ছে শিখা।“
——-” বাহ! এখন আমায় পাষাণ মনে হয় তোর? আমি পাষাণ কিনা জানিনা, সত্যিই বলতে কী, আমি কৌস্তভের সব বিপদেই নির্দিধায় ওর পাশে দাঁড়াতে পারবো। কিন্তু ও যদি আমার দিকে ভালোবাসার হাত বাড়িয়ে দেয়, তাহলে এত সহজে আমি ধরা দিতে পারবোনা তনিমা। আর তুই তো বলেছিলি, কৌস্তভের মত মানুষেরা কখনও শোধরায় না। ও সবসময় আমার ভালোবাসার সুযোগ নেবে। এখন নিজেই দল পরিবর্তন করছিস?“
——-” দল পরিবর্ত করিনি রে। আমি বরাবরই তোর ভালো চাই। এখন আমি বুঝতে পারছি, কৌস্তভের সম্পর্কে আমার ধারণা ভুল ছিল। কৌস্তুভকে এখন দেখবার পর আমার মনে হচ্ছে, ও সত্যিই বদলে গেছে। ও এখন তোদের আবার ফিরে পেতে চায়। সারাটাজীবন তোদের সাথেই কাটাতে চায়। এরমধ্যে কোন প্রতারণা আছে বলে আমার মনে হয়না। আর যে মানুষ অন্তর থেকে নিজের ভুল শুধরে, নতুন করে জীবনটা শুরু করবার, নতুন করে বাঁচবার স্বপ্ন দেখে, আমার মনে হয় তাকে একবার সুযোগ দেওয়া উচিত।“

সুলেখাদেবী সকাল সকাল তৈরি হয়ে নিয়েছেন নাতির কাছে যাওয়ার জন্য। আজ জন্মদিন রণর। সকাল থেকে অজস্র বার শিখার ফোন এসে গেছে। সুলেখাদেবীকে আজ সারাদিন নাতির কাছে থাকতে হবে। শিখার এটা প্রতিবারের আব্দার। ঠাম্মি না আসলে নাতির জন্মদিনের কোন অনুষ্ঠানই শুরু করেনা শিখা। সুলেখাদেবীর আজ যেমন আনন্দ, তেমন একটা কষ্টও মনের ভেতর। শিখা এতবার তাকে যেতে বলেছে, কিন্তু কৌস্তভকে একবারের জন্যও ডাকেনি। ছেলের মুখটা দেখেই বুঝতে পারছেন, ওর মনের ভেতরের যণ্ত্রণাটা। নিজের ছেলের জন্মদিন, অথচ ওর যাওয়ার অনুমতি নেই। কৌস্তভকে যাওয়ার কথা বললে, ওর একটাই কথা, অতজন বাইরের লোকের সামনে শিখার বাড়ি ওর যাওয়াটা ঠিক হবেনা। ভীষণই দৃষ্টিকটু হবে ব্যাপারটা। সকলে ভালো চোখে দেখবেনা। এতে শিখার আর ওর দুজনেরই অসম্মান।

সুলেখাদেবীকে গাড়িতে বসিয়ে ঠিক সময় কৌস্তভ ছেড়ে দিয়ে এল শিখার বাড়ি। রাতে আবার ঠিক সময়মত এসে নিয়ে যাবে বলে, সেইমুহূর্তেই বেরিয়ে গেল কৌস্তভ।
সকালে রয়েছে শুধু কিছু ঘরোয়া অনুষ্ঠান। এই অনুষ্ঠানে সুলেখাদেবী ছাড়া আর কাউকেই ডাকেনা শিখা। নিমন্ত্রিতরা আসবে সন্ধ্যেবেলা। সুলেখাদেবী রণর সব অনুষ্ঠানই করছেন হাসি মুখে। তবুও মাঝেমধ্যেই ছেলেটার জন্য উদাস হয়ে যাচ্ছে মনটা। আর না জানি কত কষ্টই ভোগ করতে হবে তাঁর ছেলেকে। শিখাকে কিছু এব্যাপারে বলবেন না ভেবেও, শেষে বলেই ফেললেন একসময়।
——–” শিখা, আজ তুমি রণর জন্মদিনে কৌস্তভকে একবার ডাকতে পারতে মা। একা একা ছেলেটা আমার পড়ে রয়েছে ঘরে ।“
শিখা একটু ইতস্তত করে বলল——–” আমি কৌস্তভকে ডাকিনি ঠিকই। কিন্তু মা, ওকে আসতেও তো বারণ করিনি? আর তাছাড়া ও রণর বাবা। ছেলের জন্মদিনে, ওকে আলাদাভাবে নিমন্ত্রণ করবার তো কোন প্রয়োজন নেই। ছেলের বাবা হিসেবে ওর তো নিজেই আসা উচিত।“
——” এখন তোমাদের ব্যাপারটা একটু আলাদা শিখা। তোমাদের মধ্যে তো আর স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক নেই। কাজেই এখন তোমার বাড়িতে তুমি না ডাকলে কৌস্তভ আসবে কেন?”
——-” তুমি যদি বল, তাহলে ওকে আসতে এখুনি আমি ফোন করছি মা।“
——-” নাহ! ছেড়ে দাও। এখন আর ফোন করতে হবেনা। এখন ফোন করলে ভাববে, আমি হয়তো তোমায় ফোন করতে বাধ্য করেছি। ও আর আসবেনা।“

সারাদিন অসম্ভব ব্যস্ততার মধ্যে কেটে গেল শিখার। অতিথি অভ্যাগতদের আপ্যায়ণ, কেক কাটা, বাচ্চাদের নানান খেলনা বিতরণ, হৈহুল্লোর, গল্প গুজব, খাওয়া-দাওয়ার মধ্যে গোটা একটা দিন চোখের পলকে পার হয়ে গেল। রাতও বেশ হয়েছে। নিমন্ত্রিতরা একে একে চলে গিয়ে, ঘর কিছুটা ফাঁকা। সুলেখাদেবী খেতে বসেছেন। তনিমা শিখার হাতে হাতে সাহায্য করছে। সারাদিনের অনিয়মের ক্লান্তিতে ঘুম পেয়ে গেছে রণর। ঘুমে ছেলেটা কান্না জুড়েছে বলে, টুলুমাসি ওকে বাইরে খোলা হাওয়ায় নিয়ে এসে চেষ্টা করছে কান্না থামানোর। দেখতে পেল গেটের কাছে কৌস্তভের গাড়ি এসে থামলো।
এগিয়ে এসে রণকে কোলে নিতে নিতে কৌস্তভ বলল——” টুলুমাসি মাকে একটু ডেকে দাও না। বল আমি নিতে এসেছি।“
——-” হ্যাঁ দাদাবাবু, আমি এখনি ডাকছি। মা এইমাত্র খেতে বসলেন। আপনি একটু অপেক্ষা করুন, আমি ডেকে আনছি।“

রণকে নিয়ে একটু অন্ধকার দেখে, বাইরে রাখা একটা বেঞ্চে এসে বসল কৌস্তভ। আশ্চর্য রকমভাবে বাবার কোলে এসেই রণর কান্না থেমে গেছে। বাবার কাঁধে মাথা রেখে, চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। ছেলের গালে পরম স্নেহে একটা চুম্বন দিয়ে, সজল চোখে একদৃষ্টে তাকিয়ে রয়েছে কৌস্তভ। ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে, শার্টের পকেট থেকে ছেলের জন্য পছন্দ করে কেনা সোনার চেনটা বার করে, সযত্নে পরিয়ে দিল ছেলের গলায়। ( ক্রমশ )

https://www.facebook.com/107986137690507/posts/299096971912755/
সপ্তম পর্বের লিঙ্ক

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here