ব্যবধান ( নবম পর্ব )
শ্রাবন্তী ভট্টাচার্য্য
———” একটু বসতে পারি?”
এক অপরিচিতা মহিলার কন্ঠস্বর শুনে, চমকে পেছন ফিরে তাকালো কৌস্তভ।
বেঞ্চের এক পাশে নিজের জায়গা করে নিতে নিতে হেসে বলল তনিমা—” আপনি আমায় চিনবেন না কৌস্তভবাবু। আমি দীপশিখার কলিগ ও বান্ধবী তনিমা।“
——” আপনার সাথে সাক্ষাতে আলাপ নেই ঠিকই। কিন্তু শিখার কাছে আপনার নাম অনেকবার শুনেছি। আপনি যেভাবে বিপদের দিনে সাহায্য করেছেন শিখাকে, তা আমার জানা আছে। আর তার জন্য শিখার সাথে আমিও আপনার কাছে আন্তরিকভাবে কৃতজ্ঞ।“
———” ওসব অতীতের কথা ছাড়ুন কৌস্তভবাবু। বর্তমানে ফিরে আসুন। আজ যে প্রশ্ন নিয়ে আপনার কাছে এলাম, সেটাই বলি। আপনাদের দুজনের এই মান-অভিমানের পর্ব আর কতদিন দীর্ঘায়িত হবে, বলুন তো?”
কৌস্তভ একটু ম্লান হেসে বলল——” আমি আর কী বলবো? সেটা আপনার বান্ধবীকেই জিজ্ঞেস করুন।”
——-” বান্ধবীকে জিজ্ঞেস করেছি। ওর সাথে কথা বলে যতটুকু বুঝেছি, এক আকাশচুম্বী অভিমান ও ক্ষোভের বশবর্তী হয়ে নিজের বুদ্ধি, বিবেচনা, চিন্তাশক্তি সব বিসর্জন দিয়ে বসে আছে। তা আপনারও কী সেই একই অবস্থা? এইভাবে চলতে থাকলে, আপনাদের সম্পর্ক তো কোনদিনই তার মোহনাই খুঁজে পাবেনা।“
——–” আমি চেষ্টা অনেক করেছি। কিন্তু শিখা বোধহয় আমার প্রতি বিশ্বাস, ভরসা, ভালোবাসা সবকিছুই হারিয়ে ফেলেছে। ওর পক্ষে অবশ্য এটাই স্বাভাবিক। আমি যা করেছি, এরপরে আর কোন অধিকারে ওর ভালোবাসা দাবি করি বলুন? আর এখন তো পরপুরুষ বলে, আমায় একেবারেই দূরে ঠেলে দিয়েছে শিখা। সত্যিই নিজেকে বড় অসহায় লাগছে। কী করবো জানিনা।“
——–” কী করবেন মানে? এইভাবে হাল ছেড়ে দিলে চলবে নাকি? নিজের ন্যায্য অধিকার এবার আদায় করুন। ভুল মানুষ মাত্রেই হয় কৌস্তভবাবু। আবার মানুষই তা সংশোধন করে। আর সেই মানুষকে ক্ষমা করে দিতে, আরেকজন সহৃদয় মানুষই এগিয়ে আসে। দীপশিখা যদি এই সহনশীলতা হারিয়ে ফেলে ভুল সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে সেটাকে দৃঢ় হাতে সঠিক পথে চালনা করা এবার আপনার দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে কৌস্তভবাবু। রণর কথা চিন্তা করেই এবার আপনাকে একটু কঠিন হতে হবে। এবার সময় হয়েছে, নিজের অধিকার আদায় করবার।“
——–” আপনি কোন পথের ইঙ্গিত করছেন, আমি বুঝতে পারছি তনিমাদেবী। কিন্তু নিজের এতদিনের অভিজ্ঞতা দিয়ে, এটাও বুঝেছি, অধিকার আদায় করা যায়, কিন্তু ভালোবাসা আদায় করা যায়না কখনও। তা অর্জন করতে হয়। বলপূর্বক শরীর আদায় করা যায়। কিন্তু মন পাওয়া যায়না। তাও অর্জন করতে হয়। তাই আমি আদায় নয়, অর্জনেই বিশ্বাসী তনিমাদেবী।“
শিখার সাথে গল্প করতে করতে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন সুলেখাদেবী। মাকে দেখেই উঠে দাঁড়াল কৌস্তভ। রণ ততক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছে কৌস্তভের কোলে। টুলুমাসি এসে রণকে কোলে নিয়ে চলে গেল ঘরে।
কৌস্তভের মুখোমুখি হয়ে যাওয়ায়, একটু অপ্রস্তুতে পড়ে গেল শিখা। স্বীকার না করলেও, একটা অপরাধবোধ ওর মনের ভেতর ক্রমাগত দংশন করছে। একটু ইতস্তত করে বলল—–” রাতে এখান থেকে খেয়ে যাও কৌস্তভ।“
সৌজন্যমূলক একটু হেসে কৌস্তভ বলল—-” না শিখা, প্রয়োজন নেই। আমি খেয়ে এসেছি।“
তারপর সুলেখাদেবীর দিকে ফিরে বলল—–” মা চল এবার। দেরি হয়ে যাচ্ছে।“
——-” হ্যাঁ, বাবা চল। “——- বলে ছেলের পিছু পিছু পা বাড়ালেন সুলেখাদেবী।
মাকে সযত্নে গাড়িতে বসিয়ে, চলে গেল কৌস্তভ। তাদের যাওয়ার পথের দিকে চেয়ে, বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল শিখা। কিন্তু একবারের জন্যও শিখার দিকে ফিরেও তাকালোনা কৌস্তভ।
———” কেমন তেজ দেখেছিস তনিমা। খেতে বললাম, মুখের উপরই না বলে দিয়ে, রাগ দেখিয়ে চলে গেল।“
——-” যেকোন মেরুদন্ড যুক্ত ভদ্র মানুষই, ঠিক এটাই করবে শিখা। তুই নিজেও ভালো করে জানিস, আজ কৌস্তভের সাথে যে ব্যবহারটা করেছিস, তা মোটেও ঠিক নয়। কৌস্তভের পক্ষে যথেষ্ট অপমান জনক। তুই যখন যা বলবি, সেটাই কৌস্তভ মানতে বাধ্য নয় শিখা। নিজের আত্মসম্মান রক্ষা করবার অধিকার প্রত্যেক মানুষেরই আছে।“
আজ তিনদিন হতে চলল, কৌস্তভ রোজই অফিস ফেরত বিকেলবেলা পার্কে গিয়ে হতাশ হয়ে ফিরে আসে। রণ এইকটাদিন খেলতে আসেনি টুলুমাসির সাথে। প্রথমে এই নিয়ে চিন্তা না হলেও, ক্রমশ কেমন এক অজানা দুশ্চিন্তা দানা বাঁধছে মনে। কারো কিছু হয়নিতো? ছেলেটা সুস্থ আছে তো? ঘরে এসে জামাকাপড় না ছেড়েই, কৌস্তভ একটা ফোন করলো শিখাকে। ফোনে পুরোটাই রিং হয়ে গেল, কেউ ধরলো না। দ্বিতীয়বারও বেজে গেল ফোনটা। কৌস্তভ ক্রমশ অস্থির হয়ে উঠছে। আরও একবার ফোন করলো। এইবার ফোনটা রিসিভ হলো।
——-” হ্যালো শিখা, এতবার কল করছি, ধরছোনা কেন?”
ফোনের ওপ্রান্তের মানুষটা হাউমাউ করে কেঁদে উঠল—–” দাদাবাবু আমি শিখা নই। আমি টুলুমাসি। দাদাবাবু আজ তিনদিন ধরে রণর জ্বর সাথে পায়খানা আর বমি। ছেলেটা একেবারে এলিয়ে পড়েছে। কাঁদবারও ক্ষমতা নেই। দিদিভাই ডাক্তার দেখিয়েছে, কিন্তু ওষুধে কোনই কাজ হচ্ছেনা। কত করে দিদিভাইকে বলছি, আপনাকে একটা খবর দিতে। কিছুতেই দিদিভাই আপনাকে খবর দিতে দিচ্ছেনা। জেদ ধরে বসে আছে। আপনি এখুনি আসুন দাদাবাবু। ছেলেটাকে বাঁচান।“
টুলুমাসির কথা শুনে রাগে, ক্ষোভে সারাশরীর কাঁপছে কৌস্তভের। দিকবিদিক জ্ঞান শূন্য হয়ে, সেইমুহূর্তেই বেরিয়ে গেল গাড়ি নিয়ে।
শিখার ঘরে ঢুকে দেখে, খাটের উপর নিস্তেজ হয়ে পড়ে রয়েছে তিনবছরের শিশু। গলা দিয়ে ক্ষীণ একটা কান্নার শব্দ বেরোচ্ছে। শিখা ওকে ওষুধ খাওয়ানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু সেই ওষুধ পুরোটাই প্রায় মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসছে। একদৃষ্টে ফ্যালফ্যাল করে মায়ের দিকে চেয়ে রয়েছে রণ। সেই সজল করুণ দৃষ্টিতে রয়েছে, ওষুধ না খাওয়ানোর জন্য মায়ের প্রতি শিশুর কাতর আকুতি।
এই দৃশ্য দেখে কৌস্তভের মনের ভেতরটা যেন দগ্ধ হয়ে যাচ্ছে। মনের সমস্ত যণ্ত্রণা ক্রমশ পরিবর্তিত হচ্ছে অসীম ক্রোধে। তবুও নিজেকে আপ্রাণ চেষ্টায় সংযত রেখে, জিজ্ঞেস করলো——” আজ তিনদিন ধরে, ছেলেটার এই অবস্থা। আমায় একটা খবর দাওনি কেন শিখা?”
কৌস্তভের দিকে না তাকিয়েই, গম্ভীর হয়ে তাচ্ছিল্যের সাথে উত্তর দিল শিখা—-” প্রয়োজন মনে করিনি। এতদিন ছেলের অসুখ-বিসুখের দেখাশোনা, দায়িত্ব একা হাতে আমিই সামলেছি। আর আমিই সামলাব। তোমার তো ছেলের দিকে এর আগে কোনদিনও ফিরে তাকাবার প্রয়োজন মনে হয়নি। তাহলে আজ কিসের চিন্তা তোমার? আজও তোমায় এই নিয়ে মাথা না ঘামালেও চলবে। রণ খুব ভালো করেই জানে, ওর চিন্তা করবার জন্য ওর মা সর্বক্ষণ ওর পাশে রয়েছে। তুমি বরাবরই আমাদের ব্যাপারে উদাসিন। তাই তোমার মত দায়িত্বজ্ঞানহীন মানুষকে জানাবার কোন প্রয়োজন আছে বলে, একবারও মনে হয়নি আমার।“
শিখার এই শ্লেষাত্মক কথাগুলো, আজ ভীষণ অসহ্য লাগছে কৌস্তভের। নিজের সমস্ত সংযম হারিয়ে, রাগে চিৎকার করে উঠল কৌস্তভ—–” কী চাও তুমি শিখা? আমি জানতে চাইছিতো, আমার কী শাস্তি হলে তুমি খুশি হও? বলোনা, নিজেকে শেষ করে দেবো আমি? তাহলেই তুমি শান্তি পাবে? আজ আমাদের অশান্তির জেরে ছেলেটাকে কষ্ট দিচ্ছো কেন এভাবে? এই শিশুও কী তোমার ক্ষোভের উষ্মা থেকে রেহাই পাবেনা? আমার উপর রাগ জাহির করতে, রণর শারীরিক অবনতিও কী চোখে পড়ছেনা তোমার? রণর অবস্থা দেখে তুমি বুঝতে পারছোনা, ওর ভালো চিকিৎসার প্রয়োজন?”
——–” রণর শরীরে ব্যাপারটা তোমার চেয়ে আমি অনেক বেশি ভালো বুঝি কৌস্তভ? ছেলেটা ছোট থেকে আমার তত্বাবধানেই মানুষ। তাই ওর কী প্রয়োজন না প্রয়োজন, তোমার চেয়ে ঢের ভালো জানি। ভালো ডাক্তারের কাছেই ওর চিকিৎসা করছি। উনিই বরাবর রণর চিকিৎসা করে এসেছেন। রণকে সুস্থও করেছেন। ওঁনার ওষুধেই রণ এবারেও ঠিক সুস্থ হয়ে উঠবে। আমাদের ব্যাপারে তোমার কোন ইন্টারফেয়ারেন্স আমি চাইনা কৌস্তভ। তুমি চলে যাও। ফিরে যাও তোমার ওই রঙীন জীবনে। ওখানেই তোমায় মানায় ভালো। আমার আর রণর জীবনে, তোমার আর কোন প্রয়োজন নেই।“
শিখার কথাগুলো শুনে, স্তব্ধ হয়ে, কয়েকমুহূর্ত স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে রইল কৌস্তভ। এইসময়তেও এই শ্লেষা মিশ্রিত বিদ্রুপাত্মক শ্রুতিকটু অবাঞ্ছিত কথাগুলো, কী করে বলছে শিখা? ঘৃণায় ভরে গেল বিস্মিত কৌস্তভের মন। অসুস্থ ছেলের থেকে, শিখার অভিমানটাই বড় হলো? পারিপার্শ্বিক অবস্থার গুরুত্ব বিচারের ক্ষমতা কী একেবারেই হারিয়ে ফেলেছে শিখা? ক্রোধের আগুন যেন ঠিকরে বেরোচ্ছে দুচোখ দিয়ে। ছেলের অবস্থা দেখে বেশ বুঝতে পারছে, এখন সময় নষ্ট করলে চলবেনা। অসম্ভব বিতৃষ্ণায় শিখার সাথে আরেকটাও কথা না বলে, এগিয়ে এসে বিছানা থেকে ছেলেকে জোর করে কোলে তুলে নিল কৌস্তভ। নিজের জেদে অটল শিখা, বাধা দিতে এলে, রাগে হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে কৌস্তভ, সপাটে একখানা চড় কষাল শিখার গাল লক্ষ করে। মৃদু আর্তনাদ করে, শিখা ছিটকে পড়ল খাটে। রাগের মাথায় এভাবে শিখার গায়ে হাত তুলে, অনুতপ্ত কৌস্তভ মনের অনুশোচনারভাব গোপন রেখে, খাটে শুয়ে ক্রন্দনরত শিখার দিকে, কঠিন শীতল দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল—-” তুমি রাগ আর অভিমানে বশে নিজের চিন্তাশক্তি হারিয়েছে শিখা। অবস্থার গুরুত্ব বোঝবার বোধটুকুও এখন তোমার নেই। তাই তোমার সাথে কথা বলবার কোন মানেই হয়না। এতদিন তোমার সব অপমান আমি সহ্য করেছি বলে, ভেবে নিওনা ছেলের ব্যাপারেও তোমার এই অন্যায় ছেলেমানুষি আমি মেনে নেবো। এইমুহূর্তেই ছেলেকে আমি নার্সিংহোমে অ্যাডমিট করব। রণকে নিয়ে আমি গাড়িতে অপেক্ষা করছি। তুমি তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে চলে এস।“
কৌস্তভের এই ভীষণ রুদ্র রূপ আগে কখনও দেখেনি শিখা। ভয়ে বিস্ময়ে কথা বলবার সাহসটাই হারিয়ে ফেলেছে। আর দ্বিতীয় কোন প্রতিবাদ না করে, ছেলের ও নিজের কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস পত্র গোছাতে, চলে গেল নিজের রুমে।
কৌস্তভের কাছে মার খেয়ে যেমন রাগ হচ্ছে, তেমনি মনের কোথাও যেন একটা ভালো লাগার অনুভূতিও কাজ করছে শিখার। এতটা দায়িত্বশীল হতে আগে কখনও দেখেনি কৌস্তভকে। আশাও রাখেনি ওদের বিপদে এইভাবে পাশে এসে দাঁড়াবে কৌস্তভ। খুব ইচ্ছে করছে নিজের ও ছেলের সমস্ত দায়িত্ব কৌস্তভের কাঁধে চাপিয়ে নিশ্চিন্ত হতে। কৌস্তভের এই ভরসাযোগ্য কাঁধে মাথা রেখে একটু শান্তিতে ঘুমোতে। কিন্তু পরক্ষণেই আবার সেই ভয়টা বিক্ষিপ্ত করে তুলছে মনকে। সারাটাজীবন এইভাবে ওদের দায়িত্ব নেবেতো কৌস্তভ? মাঝপথে হাত ছেড়ে দিয়ে, আবার দেবেনাতো একাকীত্বের যণ্ত্রণা? ( ক্রমশ )
https://www.facebook.com/107986137690507/posts/299807138508405/
অষ্টম পর্বের লিঙ্ক