ব্রোকেন হার্ট পর্ব-১০

0
1014

#ব্রোকেন_হার্ট
লেখাঃ মান্নাত মিম

|১০|
“সে তো তার রেস্ট হাউসে আছে। তাকে ওখানেই পাওয়া যাবে। প্রায়ই সেখানে থাকে।”

ভার্সিটিতে আসার উদ্দেশ্যই ছিল এন্ডারসনের সাথে দেখা করা, তার মোবাইল তাকে ফিরিয়ে দেওয়া৷ ক্লাস না করে এন্ডারসনকে খুঁজতে গিয়ে তার ক্লাসমেট আমাকে জানালো কথাটা। তার সাথে না কি কথা হয়েছিল সকালে। অথচ আমি কি না ক্লাস করলাম না এই ছেলেটার জন্য। না জানি আর কত ঝামেলা পোহাতে হবে তার জন্য আমাকে। এসব ঝামেলা থেকে মুক্তির জন্যই আজ শেষ দেখা।

রেস্ট হাউস, এন্ডারসনের মতো ধনী পরিবারের সন্তানদের জন্য আলাদা করে মনমস্তিষ্কের বিশ্রামাগার হিসেবে কাজ করে সেটা। সম্ভবত এটা এন্ডারসনের নিজের। সেখানের ঠিকানায় সাইকেল নিয়ে চলে এলাম। অতোটা গহীন বনজঙ্গল নয়, তবে কোলাহল মুক্ত স্থানে তৈরি এন্ডারসনের রেস্ট হাউস বেশ মনোমুগ্ধকর। ছোটো লোহার গেট খুলে বাড়িটার ভেতরে প্রবেশ করলাম। বাইরে থাকা কলিংবেল চাপতেই কিছুক্ষণ পরেই দরজার ওপাশে এন্ডারসনকে দেখা গেল, বেশ বিস্ময় নিয়ে সে দাঁড়িয়ে।

“তুমি! এখানে কীভাবে?”

“ভেতরে গিয়ে বলি নাহয়।”

দরজা থেকে সরে গিয়ে আমাকে ভেতরে প্রবেশের জায়গা করে দিলো। বাইরের থেকে বাড়ির ভেতরটা আরো সুন্দর, চোখ ধাঁধানো। প্যালেসের মতো। ডুপ্লেক্স বাড়ি। ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম। ড্রয়িংরুমের পাশ দিয়ে প্যাঁচানো সিঁড়ি ওপরের তলায় গিয়ে থেমেছে৷ সিঁড়ির কাছটাতে দাঁড়িয়ে আমি ঘুরঘুর করে দেখছিলাম তখন এন্ডারসন পিছন থেকে বলে উঠল,

“কফি চলবে?”

পিছন ফিরে তাকিয়ে সম্মতি জানালাম। সে চলে গেল সম্ভবত কিচেন রুমে। আমি তার পিছু পিছু গেলাম। ছোট্ট কিচেন রুম। তাও আবার স্পোর্টস জোনের পাশে উন্মুক্ত। দেখে বেশ অবাক হয়ে এন্ডারসনকে জিজ্ঞেস করলাম,

“এখানে স্পোর্টস রুমও রয়েছে? আবার পাশে দেখি কিচেন রুম!”

কফি মেকারে কফি তৈরি করে আমার হাতে এক কাপ ধরিয়ে দিয়ে নিজেও নিলো এক কাপ তুলে অতঃপর উত্তর দিলো,

“আমি এমনি করেই তৈরি করতে বলেছি। এই রেস্ট হাউস আমাকে আমার ড্যাড গিফট করেছে। আমাদের তিন ভাইয়েরই এমন হাউস আছে।”

“তাদেরটা-ও কি আপনার’টার মতো অদ্ভুত তৈরি?”

একটু উচ্চস্বরে হেসে উঠল এন্ডারসন। পরে থেমে বলল,

“নাহ, আমি আমারটাই এমন করে তৈরি করিয়েছি। সকলের আদর কি না তাই আবদার পূরণ করেছে। বাকিদেরটা একই।”

আমি আবারো চোখ ঘুরিয়ে দেখতে লাগলাম৷ এদিকে কফি শেষ করে এন্ডারসন পোলের টেবিলের কাছে এগিয়ে যায়। আমি-ও পিছু নিয়ে দেখি, ছড়ানো ছিটানো বল। বোধহয় কিছুক্ষণ আগে খেলছিল। আমি আসাতে খেলা বন্ধ করেছিল। এখন আবার খেলা শুরু করল। এন্ডারসন বলের দিকে স্টিক তাক করতে করতে বলল,

“তা কীসের জন্য এখানে আসা বললে না তো?”

হকচকিয়ে যাই আচমকা তার গুরুগম্ভীর বাক্য উচ্চারণে। এতক্ষণ পিনপতন নীরবতা ছিল বিধায় এমনটা হয়। পরক্ষণেই নিজেকে ধাতস্থ করে ইতস্তত গলায় বললাম,

“আসলে আপনার মোবাইলটা আমার কাছে রয়ে গিয়েছিল।”

বাকিটা সে বুঝল বোধহয় গোল করা ছিদ্রে বলটা স্টিকের সাহায্য খোঁচা দিয়ে বলল,

“দিতে এসেছ সেজন্য।”

তার খুব একটা কাছেও না আবার দূরত্বেও ছিলাম না। মাঝে অবস্থান করছিলাম। তবুও সে যখন আমার দিকে ঘুরলো, তখন তার কাঁধ পর্যন্ত বুকের সামনেই নিজের পাই। এভাবে হুট করে তার ঘুরে তাকানোতে আমি ভড়কে মাথা উঁচিয়ে তাকাতেই এন্ডারসনের অদ্ভুত, অন্যরকম দৃষ্টিভঙ্গি দেখা যায়। ঘোরতর নেশাক্ত লাল সেই চোখের দৃষ্টি মনে হলো আমার কাছে, এ দৃষ্টির সাথে আমি পরিচিত নই। কয়েক পা পিছিয়ে সরে যেতেই বাঁধাপ্রাপ্ত হই তার বলিষ্ঠ হাতের কাছে। কোমর পেঁচিয়ে পোলের টেবিলে বসিয়ে দেয়। হতভম্ব হওয়া আমার চোখে তাকিয়ে ঝুঁকে গিয়ে বলল,

“তোমার এই চোখজোড়া খুবই সুন্দর, অপূর্ব!”

সেটা অবশ্য আমি জানি। আমার সিন্ধু নীল ও সোনালি রঙের চুলের আভার সৌন্দর্যে সকলের মন কাড়তে সক্ষম। তবে কি সমুখের পছন্দের মানুষটার-ও মন কাড়তে সক্ষম? এক মন বলে হয়তো। ভাবনার মাঝেই গণ্ডদেশে স্পর্শ পেলাম উত্তপ্ত নিঃশ্বাসের সাথে। কাঁধ বরাবর সোনালি রঙের চুলের গুচ্ছ সরিয়ে তার ওষ্ঠের গাঢ় স্পর্শে মেতে সে। স্পর্শের মালিক আমার চিরচেনা, এই স্পর্শ বড্ড আকাঙ্ক্ষার। এই চেনা-জানার মাঝেই নিজের অনুভূতি নিয়ে এন্ডারসনের পিঠে আমার প্রশস্ত দুবাহু দিয়ে জড়িয়ে ধরলাম, আর দু’পা তার কোমর পেঁচিয়ে। আবেশিত আমি’তে ডুব দিতে তখন এন্ডারসন আমাকে উন্মুক্ত করতে ব্যস্ত। তার ওষ্ঠের স্পর্শ নিরাবরণ শরীরে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে সেভাবেই আমাকে কোলে তুলে নিয়ে সে এগিয়ে গেল ড্রয়িংরুমের সোফাতে শুইয়ে দিলো। আমার ওপর ঝুঁকে গিয়ে ফের গলা থেকে ঘাড় বেয়ে তার ওষ্ঠ দ্বারা কার্যসিদ্ধি শুরু করে দিলো। তখনই সোফায় রাখা আমার ব্যাগের ভেতর থেকে তার ফোন ‘বিপ বিপ’ শব্দে ভাইব্রেশন করতে লাগল। আর তাতেই ধ্যানচ্যুত হয়ে সে আমার কাছ থেকে সরে গেল। আমি হতভম্ব হয়ে ওঠে বসে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। তার এভাবে দূরে সরে যাওয়াটা আসলে আমার হজম হচ্ছে না। এন্ডারসন নিজের মুখ দু-হাত ম্যাসেজ করতে ব্যস্ত। বেশ কিছুক্ষণ সেভাবেই কেটে গেল। এরপরে সে স্পোর্টস রুমের দিকে চলে গেল ফিরে এসে আমার ওপরের টপস ছুঁড়ে মারল৷ টপস গায়ে জড়িয়ে নিলাম। থম ধরে বসে রইলাম তখনই কানে এলো এন্ডারসনের শব্দগুচ্ছ,

“এখন যাওয়া উচিত।”

সে কী ভাবে আমাকে? বেহায়া, বেশরম, বেলজ্জা? আর কত এভাবে সে আমার মন, অনুভূতি নিয়ে খেলা করবে? প্রতিবারই নিজ ইচ্ছায় কাছে টেনে নিবে আর মাঝ পথে এভাবে ছুঁড়ে ফেলবে। ভালোবাসি বলে এতোটাই খেলার জিনিস না কি?

নিচু হয়ে নতমস্তকের এন্ডারসনের অভিমুখে গিয়ে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে বললাম,

“ভালোবাসার অনুভূতি অনুভব করেও কেন এভাবে দূরে সরে যান?”

নিশ্চুপ, নিরুত্তর সে। তবুও আমি বলে গেলাম,

“ভালোবাসি বলে কি খেলার পাত্রী মনে করবেন? যখন-তখন আগলে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলতেও দ্বিধাবোধ করবেন না?”

এবারও সে নিরুত্তাপ উদাসীনতায় ঠায় দাঁড়িয়ে। তার এই উদাসীনতা আমাকে নিষ্ঠুরভাবে আঘাত করছে। যার ফলস্বরূপ দু-চোখ বেয়ে অশ্রু ধারা ঝরে পড়ছে। ব্যাগ থেকে তার মোবাইল বের করে সোফায় ছুঁড়ে মেরে চলে এলাম সেখান থেকে। আর না অনেক হয়েছে। এরপরেও তার কাছে যাওয়া মানে নিজের আত্মসম্মানে আঘাত হানা। সকলেই আমাকে সাবধান করেছিল, কিন্তু আমার বোকামিতেই আজ আমার কান্নার কারণ আমি নিজেই।

“অ্যা ব্রোকেন হার্ট
ইনটু ম্যানি পার্টস
ওয়ানা টেক অ্যা পার্ট
ফ্রম মাই ব্রোকেন হার্টস
ইয়েস, ক্রেজি নিডস, ক্রেজি নিডস
হোল দ্য হার্ট
বিটস সো ফাস্ট…”
_______

বিকেল ও সন্ধ্যার মাঝ বরাবর অবস্থান করা অদ্ভুত রঙে সাজানো আকাশ আমার খুব পছন্দের। কিন্তু আজ সেই আকাশের হালতও আমার মতো মনমরা, বিষণ্ণ। কেমন রাশি রাশি নিষ্প্রভ, নিস্তেজ সাদা মেঘের বেলা ওড়ে চলেছে! প্রভাহীন রূপে আমার-ও বিরূপভাব। টমাসকে দেখা যায় বল হাতে নিয়ে গেট দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করছে। পার্কে গিয়েছিল বোধহয় বন্ধুদের সাথে খেলাধুলা করার জন্য। কয়েকদিন হলো বন্ধুবান্ধব জুটিয়েছে ছেলেটা। মাম্মামের অসুস্থতার সময় তাকে বেশ নিষ্প্রাণ দেখা গিয়েছিল। অনুজ্জ্বল সেই মুখখানায় এখন একটু হাসির ছটা দেখা যায়। সময় দেওয়া হয় না ছেলেটাকে। অভিযোগও করে না। বুঝে খুব মা-বোনের দিন শেষে খাটুনি খেটে বাড়ি ফেরার হিসেব। তাই হয়তো এই বয়সেই অন্যসব বাচ্চাদের তুলনায় সে আকাঙ্ক্ষা কম করে। এখনো বাড়ির গ্রোসারি আইটেমগুলো আনা হয়নি। জানি না কখন, কী করে, কী হবে? মাম্মা পার্টটাইম একটা জব নিয়েছে নতুন করে। সম্ভবত বেয়ারার কাজ। পার্টি আয়োজনের টিমের মধ্যে বেয়ারা হিসেবে খাবার আইটেম সার্ভিস করার দায়িত্বে দশ-পনেরো জনের মাঝে তিনি-ও একজন। এখন যেখানে যেখানে পার্টি আয়োজন হবে সেখানে সেখানে গিয়ে সম্ভবত করতে হবে। এদেশের মানুষ আবার পার্টি পছন্দ করে থাকে। তাই প্রতিদিনই মাম্মার কাজ থাকে। হিসাবনিকাশ শেষে যা-ই দেওয়া হয় তাতেই সন্তুষ্ট চিত্তে বাড়ি ফিরতে হয়। তবুও অতোটাতে আমাদের হয়ে ওঠে না। সন্ধ্যা হয়ে অনেকটা সময় পেরিয়ে গেল। আমার-ও বেখেয়ালি মনের খেয়াল হলো আজ অন্তত কাজে যেতে হবে। এমন সময় মাম্মা এলো কাজ থেকে ফিরে। তাঁকে জানানো হয়নি কাজ ছেড়ে দেওয়ার কথা। উপরন্তু তিনি উলটো বলেছেন, মাস শেষের বেতন যেন অগ্রিম দেওয়া হয়। ক্লান্ত জন্মদাত্রীকে দেখে হৃদয়ে পরিস্ফুটিত ভালোবাসার অপমানে লবণ ছিটানোর মতো কাজ করল, আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো সঠিক অবস্থান। পরিবারের কথা চিন্তা করে ভালোবাসার দিকে অগ্রসর হওয়া বোকামি, যেখানে এন্ডারসন কেবল আমাতে মত্ত মোহের কারণে। তাছাড়া সে তো এনগেজড। তারপরেও আমার সাথে তার সাজে কীভাবে? নিজের বোকামি, নির্বুদ্ধিতা বেশ কটাক্ষ করে দেখতে পেলাম। সবকিছু মস্তিষ্ক থেকে ছেড়ে ফেলে সামনের দিকে অগ্রসর হলাম।

চলবে…

যারা পড়েন রেসপন্স করার অনুরোধ রইল 💝

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here