ভরসার_দুহাত পর্ব_২১

0
278

#ভরসার_দুহাত
#শোভা_আক্তার(লাভলী)
#পর্ব_২১

উমায়ের হাত আড়াআড়িভাবে ভাজ করে বাহিরের দিকে তাকিয়ে আছে। আজ চাঁদটা কেমন লাল রং এর লাগছে। বিষয়টা উমায়ের এর জন্য ভয়ংকর। সে খুব ভয় পায় এমন পরিস্থিতি। কিন্তু এখন ভয় থেকে বেশী সে কষ্ট পাচ্ছে। বশির বুরাককে জড়িয়ে ধরে কান্না করছিল খুব৷ উমায়ের এর মন খারাপ হয়ে গিয়েছে। ভীষণ মনে পড়ছে তার পরিবারে কথা। বশির যেমন তার ভাইকে জড়িয়ে ধরেছিল উমায়ের এরও ইচ্ছে করছে তার ভাইদের জড়িয়ে ধরতে। হঠাৎ উমায়ের এর মনে হলো কেও তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। পাশ ফিরে দেখে বুরাক দাঁড়িয়ে আছে।
“মিস করছো পরিবারকে?”

“তুমি কী করে জানলে?”
“জানি না, আমার মন বলল।”
“তোমার মন কীভাবে জানলো আমি আমার পরিবারকে মিস করছি?”
“সব প্রশ্নের উত্তর থাকা কী সম্ভব?”
উমায়ের আর কিছু বলল না। চুপচাপ বাহিরের দিকে তাকিয়ে রইল। বুরাক তার পকেট থেকে মোবাইল বের করে ববিকে কল করলো। ববি শুয়ে ছিল। কল রিং শুনে ধীরে ধীরে উঠে বসলো। বুরাকের নাম স্ক্রিনে দেখে মুচকি হেসে রিসিভ করলো-
“হ্যাঁ বল”
“কিছুক্ষণ আগে কল দিয়েছিলাম কোথায় ছিলি?”
“ডাক্তার এসেছিল ড্রেসিং করতে।”
“কেমন আছিস?”
“আলহামদুলিল্লাহ, তোর কি খবর?”
“আলহামদুলিল্লাহ আমিও ভালো। তোকে বলেছিলাম ফিরোজ স্যারের নাম্বাররা মেসেজ করতে।”
“সরি দোস্ত ভুলে গিয়েছিলাম।”
“এখনই সেন্ড কর”
“হ্যাঁ দিচ্ছি একটু ওয়েট কর।”
“আচ্ছা, আল্লাহ হাফেজ।”
“আল্লাহ হাফেজ।”
বুরাক কান থেকে মোবাইল সরিয়ে উমায়ের এর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল-
“ববি নাম্বার সেন্ড করবে। কল করে কথা বলে নিও। আর হ্যাঁ আম্মু তোমাকে ডাকছে। তুমি আসো আমি যাই।”
উমায়ের বুরাকের হাত থেকে মোবাইল নিয়ে মাথা নাড়াল। বুরাক মুচকি হেসে চলে গেল। মেসেজ টন বাজতেই উমায়ের চেক করে সেই নাম্বারে কল করলো। ২ বার রিং বাজার পর রিসিভ হলো। অপরপাশ থেকে মায়ের কন্ঠ ভেসে আসলো। উমায়ের থমকে দাড়িয়ে আছে মায়ের কন্ঠ শুনে। মনে হচ্ছে অনেক বছর পর সে মায়ের কন্ঠ শুনলো। মা কলের ওপাড় থেকে কোন সাড়াশব্দ না পেয়ে কৌতুহল কন্ঠে বলল-
“উমায়ের?”
উমায়ের এর মুখে হাসি ফুটে উঠলো। কান্নাজড়িত কন্ঠে বলল-
“কী করে জানলে আমি?”
মা ধপ করে খাটে বসে মুখে হাত দিয়ে কেঁদে উঠলো। চোখের পানি মুছে বলল-
“জানি না, বলছিল তুমি-ই হবে। কেমন আছো তুমি আম্মু?”
“আমি ভালো আছি। তুমি কেমন আছো? আর আব্বু উসমান উজ্জ্বল?”
“আমরা সবাই ভালো আছি। কোথায় তুমি এখন?”
“বুরাক আমাকে তার বাসায় নিয়ে এসেছে।”
“তুমি সত্যি ঠিক আছো তো? আমার খুব ভয় করছে তোমাকে নিয়ে। আর বুরাক মানুষ হিসেবে কেমন? সে..সে তোমার ক্ষতি করার চেষ্টা করেনি তো?”
“একদম না আম্মু, বুরাকের সাথে আমি একদম সেফ আছি। তার পরিবারও খুব ভালো। আচ্ছা আব্বু কোথায়? আমি কথা বলবো।”
“তোমার আব্বু পুলিশ স্টেশন গিয়েছে। খালিদ খানের কিছু লোককে তারা ধরেছে। কিন্তু কেও বলছে না খালিদ খান কোথায়।”
“আব্বুকে বলো পুলিশদের বলতে যত দ্রুত সম্ভব খালিদ খানকে খুঁজে বের করতে। আমার খুব ভয় করছে বুরাককে নিয়ে। তার পরিবার খুব ভালো। খালিদ খান যদি সন্ধান পেয়ে যায় আমরা কোথায় তাহলে বুরাকের পরিবারের ক্ষতি হবে।”
“তুমি চিন্তা করো না। খালিদ খান এলাকাতেই আছে। তার অনেকগুলো আন্ডারগ্রাউন্ড আছে। কিন্তু কোথায় কোথায় এটা কেও জানে না তাই কেও তাকে পাচ্ছে না।”
“তোমরা ঠিক মতো থেকো আম্মু। তোমাদের কিছু হয়ে গেলে আমি বাঁচতে পারবো না।”
“তুমি টেনশন করো না। আর নিজের খেয়াল রেখো।”
“হুম, উসমান উজ্জ্বল কোথায়?”
“ঘুমাতে গিয়েছে। অনেক মিস করছে ওরা তোমাকে।”
“আমিও তাদের অনেক মিস করছি। খুব শীগগিরই ফিরবো আমি।”
“অপেক্ষা করছি আমরা।”
“এখন রাখছি আম্মু, বুরাকের মা আমাকে ডাকছে।”
“আচ্ছা যাও, আর সাবধানে থেকো।”
“জি, আল্লাহ হাফেজ।”
“আল্লাহ হাফেজ।”
উমায়ের কল কেটে এগিয়ে গেল। বুরাক তার মায়ের পায়ে মাথা রেখে শুয়ে আছে। বুরাকের বাবা আর ভাই হাসিমুখে কথা বলছে বুরাকের সাথে। দৃশ্যটা খুব ভালো লাগলো উমায়ের এর। মা উমায়েরকে দেখে ইশারায় ডাকলো। উমায়ের মায়ের সামনে গিয়ে বসে বুরাকের দিকে মোবাইল এগিয়ে দিলো। বুরাক মোবাইল নিয়ে উঠে বসলো। মা উমায়ের এর মাথায় হাত রেখে বলল-
“বুরাক আমাদের বল বলেছে। তোমাদের মাঝে কোন সম্পর্ক নেই তবুও তুমি আমার ছেলেকে বিশ্বাস করেছো এর জন্য ধন্যবাদ।”
উমায়ের জবাব দিলো না। মা মাথা থেকে হাত সরিয়ে উমায়ের এর হাত ধরে বলল-
“তোমাকে আমার বেশ পছন্দ হয়েছে। খাবার কিছু ভেবো না। আমি তোমাকে মেয়ের মতো দেখেছি।”
উমায়ের এর লজ্জা লাগলো খুব। মাথা নিচু করে বসে রইল। বুরাক মায়ের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলল-
“আপনি কি ভাবছেন সে বুঝেছে। এমন চিন্তাভাবনা মাথা থেকে মুছে ফেলুন।”
“তুই চুপ থাক।”
বশির ফিক করে হেসে দিলো। বুরাক বশিরের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলল-
“তুমি হাসছো কেন?”
“তোর ভাগ্য কতটা খারাপ তা দেখে হাসছি।”
“আমার ভাগ্য খারাপ না। আমি আমার পরিবার ফিরে পেয়েছি। আমার মতো ভাগ্যবান আর একটাও নেই দুনিয়ায়।”
তখনই শাফিয়া বলতে বলতে এগিয়ে আসলো-
“তুই এসেছিস শুনে কেও একজন খুশীতে চোখে আত্মহারা। এখনই আসতে চাচ্ছিল। আমি বলেছি আগামীকাল আসতে।”
“রেনুর কথা বললে?”
“তো আর কে? সে পাগল হয়ে গিয়েছে আসার জন্য।”
“সে তো পাগলই”
“আসলেও, তোর জন্য সে পুরোই পাগল।”
বুরাক আর শাফিয়া হাসতে লাগলো। এইদিকে উমায়ের অবাক হয়ে দুজনের কথা শুনছে। রেনুর কথা শুনে তার ভালো লাগছে না। আর বুরাক যেভাবে রেনুর গুন গাচ্ছে সেটা উমায়ের এর সহ্য হচ্ছে না।

পরেরদিন…..
ঘুম থেকে উঠে উমায়ের বাহিরে আসলো। চারপাশ কুয়াশায় ঢাকা। কিন্তু সকালটা বেশ সুন্দর। উমায়ের মুচকি হাসলো। রান্নাঘর থেকে শাফিয়া বেরিয়ে দেখে উমায়ের দাঁড়িয়ে আছে। শাফিয়া এগিয়ে গিয়ে উমায়ের এর সামনে দাঁড়াল। উমায়ের শাফিয়াকে দেখে হাসিমুখে সালাম দিলো। শাফিয়া সালামের উত্তর নিয়ে বলল-
“সকালে উঠে কফি খাওয়ার অভ্যেস আছে তোমার?”
“না ভাবী, মাঝেমধ্যে কফি খাই।”
“ঠিক আছে, খিচুড়ি পছন্দ?”
“হ্যাঁ খুব বেশী।”
“সকালের নাস্তা খিচুড়ি করেছি।”

মায়ের হেসে মাথা নাড়াল। তখনই বুরাক তার ঘর থেকে বের হলো আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে। উমায়ের বুরাককে দেখে সাথে সাথে চোখ সরিয়ে ফেলল। শীতকালে এই ছেলে খালি গায়ে ঘুরছে। শাফিয়া বলল-
“আমার তো বিয়ে হয়ে গিয়েছে। কাকে বডি দেখাচ্ছো শুনি।”
“তুমি ছাড়া আর কাকে দেখাবো সুন্দরী। তুমি ছাড়া আর কেও নেই আমার।”
তখনই কাশির শব্দ আসলো। বুরাক পেছনে তাকিয়ে দেখে বশির দাড়িয়ে আছে। বুরাক শাফিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল-
“বার বার আমাদের মাঝে এসে পড়ে।”
বশির এগিয়ে এসে বলল-
“দুই বাচ্চার মায়ের দিকে নজর দিতে লজ্জা করে না।”
“দুই বাচ্চার মা আগে আমার গার্লফ্রেন্ড ছিল। প্রথম ভালোবাসা ভুলা অসম্ভব।”
বশির হেসে বুরাকের ঘাড় চেপে ধরে পেটে আস্তে করে ঘুষা দিয়ে বলল-
“অনেক হয়েছে, বাহিরে চল তোর সাথে কথা আছে।”
“আসছি তুমি যাও।”
“আয় আমি বাগানে আছি।”
“আচ্ছা”
বুরাক তার ঘরে চলে গেল। বশির বাগানের দিকে হাঁটা ধরতেই মেইন গেইট ঠকঠক করার শব্দ আসলো। বশির গিয়ে দরজা খুলে হেসে শাফিয়ার দিকে তাকিয়ে উঁচু স্বরে বলল-
“শাফিয়া, কার্টুন এসে পড়েছে।”
শাফিয়া হেসে দিলো। রেনু তার হাতে থাকা ব্যাগ দিয়ে বশিরকে মারতে মারতে এগিয়ে আসলো। উমায়ের দূর থেকে রেনুকে দেখে দু’বার চোখের পলক ফেলল। শাফিয়া হাসতে হাসতে বলল-
“রেনু বশিরের জন্য বোন আগে শালীকা পরে। যদিও বর্ষার জায়গা কারো না। কিন্তু রেনু আর বর্ষাকে বশির কখনো আলাদা চোখে দেখেনি।”
“আর বুরাক?”
শাফিয়া উমায়ের এর দিকে তাকাল। উমায়ের আমতা আমতা করে বলল-
“না মানে বুরাকও বোনই মানে তাই না?”
“তা জানি না, তাদের বন্ধুত্ব খুব সুন্দর যতটুকু জানি। এত বছর বুরাকের সাথে কারো যোগাযোগ ছিল না। কিন্তু রেনুর সাথে কথা হয়েছিল।”
বশির আর রেনু এগিয়ে আসলো। রেনু শাফিয়া জড়িয়ে ধরে গালে চুমু দিলো।
“আই মিস ইউ।”
“কিছুদিন পর পর এসেও মিস?”
রেনু জবাবে হাসলো। শাফিয়া বলল-
“রেনু, ও হচ্ছে উমায়ের। ওর কথা বলেছিলাম না কলে?”
“ওহ হ্যাঁ আই সি”
রেনু উমায়েরকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে হাসিমুখে বলল-
“কেমন আছো?”
“জি আলহামদুলিল্লাহ ভালো, আপনি কেমন আছেন?”
“ভালো, কিন্তু প্লিজ আপনি করে বলো না। আমি এতোটাও বড়ো না।”
উমায়ের জোরপূর্বক হাসলো। তখনই বুরাক বের হলো। উমায়ের চোখ ঘুরিয়ে বুরাকের দিকে তাকাল। বুরাক শাফিয়াকে ইশারায় বলল রেনুকে না বলতে যে সে পেছনে আছে। বুরাক পা টিপে টিপে এসে রেনুর চোখ ধরলো। রেনু থমকে রইল কিছুক্ষণ। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল-
“বুরাক?”
বুরাক চোখ থেকে হাত সরালো। রেনু সাথে সাথে ঘুরে বুরাককে দেখে লাফ দিয়ে বুরাককে জড়িয়ে ধরলো। উমায়ের থমকে দাঁড়িয়ে আছে। তার মনে হলো কেও তার চোখে বিষ ঢেলে দিয়েছে। রেনু বুরাককে ছেড়ে ভ্রু কুঁচকে বলল-
“মোটু, তুই এত পাতলা হলি কি করে?”
“আমার কথা ছাড়, তুই যেমন ছিলি তেমনই আছিস। অবাক করার বিষয় তুই আর লম্বা হলি না।”
রেনু রাগে গাল ফুলিয়ে ফেলল। বুরাক হেসে রেনুর গাল ধরে টেনে বলল-
“হয়েছে আর ঢং করিস না। কেমন আছিস?”
“তোকে ছাড়া আমরা কেও ভালো ছিলাম না। জানিস কত মিস করেছি তোকে?”
“আমিও অনেক মিস করেছি।”
“আর ছেড়ে যাবি না তো?”
“যেতে হবে আমাকে। ফিরবো কিনা তা জানি না।”
“মানে? এই তুই কি বলতে চাস হ্যাঁ? তুই যদি এবার আমাদের ছেড়ে যাস ভালো হবে না বলে দিলাম।”
রেনুর কন্ঠে কান্না স্পষ্ট। বুরাক রেনুকে আবার জড়িয়ে ধরলো। উমায়ের বিরক্ত হয়ে হাত আড়াআড়ি ভাবে ভাজ করে অন্যদিকে তাকাল। বুরাক রেনুর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল-
“রাগ করিস না। আমি ফিরোজ আনোয়ার সাহেবকে উনার আমানত দিয়ে ফিরে আসবো।”
রেনু বুরাককে ছেড়ে চোখের পানি মুছে বলল-
“ফিরোজ আনোয়ার কে?”
“উমায়ের এর সাথে পরিচয় হয়েছিস?”
“হ্যাঁ”
“ওর বাবা”
“তুই ওকে দিয়ে সাথে সাথে ফিরে আসবি ওয়াদা কর।”
রেনু হাত বাড়িয়ে দিলো। বুরাক মুচকি হেসে রেনুর হাত ধরে বলল-
“ওয়াদা”
উমায়ের এর মনে হচ্ছে এটা তার দেখা সবচেয়ে জঘন্য সকাল। ঘুম থেকে উঠে এমন দৃশ্য দেখা মিলবে সে জানলে বাহিরেই বের হতো না। রেনু বুরাকের হাত ধরে টেনে ভেতরে নিয়ে গেল। উমায়ের এর রাগ বেড়েই চলেছে। কিন্তু আফসোস সে রাগ প্রকাশ করতে পারবে না এখন। শাফিয়া উমায়েরকে আসতে বলে চলে গেল। উমায়ের বাহিরের দিকে এক নজর দিয়ে লম্বা নিশ্বাস ফেলল।

রেনু আর বুরাককে একসাথে দেখে উমায়ের রাগে ফুসছে। বিষয়টা শাফিয়া ধরতে পেরেছে। তার মন বলছিল বুরাক যেমন উমায়েরকে পছন্দ করে উমায়েরও বুরাককে পছন্দ করে। হয় তো সে নিজেই এখনো বুঝতে পারেনি তাই বলেনি বুরাককে। রেনু কথায় কথায় বুরাকের গাল ধরে টানে। বিষয়টা উমায়ের এর রাগের আগুনে কেরাসিন ঢালার মতো। রেনু কথা বলতে বলতে উমায়ের এর দিকে তাকাল। উমায়ের এর চাহনিটা বেশ আজব। দেখে মনে হচ্ছে সে রাগে গজগজ করছে। রেনু থতমত খেয়ে গেল। এদিক সেদিক দেখে আবার উমায়ের এর দিকে তাকাল। উমায়ের এর চাহনিতে কোন পরিবর্তন নেই। সে পলকহীন দৃষ্টিতে রেনুর দিকে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ বুরাকের মোবাইল বেজে উঠলো। পকেট থেকে মোবাইল বের করে দেখে উমায়ের এর বাসার নাম্বার। বুরাক উমায়ের এর দিকে মোবাইল এগিয়ে দিলো। উমায়ের এক নজর বুরাককে দেখে মোবাইল নিয়ে উঠে বাহিরে চলে গেল। উমায়ের যেতেই রেনুর মনে হলো সে এখন বিপদমুক্ত। একটা লম্বা নিশ্বাস নিয়ে ছেড়ে বলল-
“বুরাক এই মেয়ে মানে উমায়ের এর সাথে তোর লাভেরিয়া নেই?”
“কি? লাভেরিয়া কেন থাকবে?”
“আমি এইটুকু বুঝতে পারলাম তোর মনে ওর প্রতি অনুভূতি আছে। ওর কি খবর?”
“জানি না, উমায়ের আমার উপর নির্ভর এখন। তার সাথে কথা বলে বা তাকে দেখে আমার কখনো এমন মনে হয়নি যে তার মনে আমার প্রতি অনুভূতি আছে।”
“ওকে, তুই ওকে নিয়ে ঢাকা কবে ফিরবি?”
“পরশু”
“ঠিক আছে, কালকের মধ্যে আমি ওর মনের কথা জেনে তোকে বলবো।”
“কি করবি শুনি”
“সেটা আমার উপর ছেড়ে দে। আমি যা যা বলল সেটা চুপচাপ করলেই হবে।”
বুরাক মাথা নাড়াল। রেনুর মাথায় নিশ্চয়ই কোন উল্টা পাল্টা কথা ঘুরপাক খাচ্ছে। কিন্তু মেয়েটার বুদ্ধি সবসময় কাজে আসে।

উমায়ের কথা বলে ফিরে এসে দেখে রেনু বুরাকের চুল ঠিক করে দিচ্ছে। বুরাকের চাহনি রেনুর দিকে। দুজনই হেসে হেসে কথা বলছে। উমায়ের ভাবছে কথায় কথায় একে অপরের সাথে চিপকানোর মানে কি। আর বুরাকও সায় দিচ্ছে। উমায়েরকে দেখে রেনু বলল-
“তুমি হারিয়ে আছো যে উমায়ের! আসো, বসো আমাদের সাথে।”
উমায়ের রেনুকে জবাব দিলো না। বুরাককে উদ্দেশ্য করে বলল-

বুরাক আমাকে যত দ্রুত সম্ভব বাসায় দিয়ে আসো।”
“আমরা পরশুদিন রওয়ানা দিবো।”
“না আমি আর অপেক্ষা করতে পারবো না। আমরা আগামীকালই যাবো।”
রেনু বলল-
“বুরাক ১ বছর পর বাসায় ফিরেছে। আর কয়টা দিন থাকলে হয় না?”
উমায়ের উঁচু স্বরে বলল-
“না হয় না, সে যেহেতু ফিরে এসেছে আর কোথাও যাবে না। আমাকে আমার পরিবারের কাছে দিয়ে সেও তার পরিবারের কাছে ফিরে এসে পরবে।”
উমায়ের এর কথা বলার ধরন বুরাকের পছন্দ হলো না। রেনুর দিকে তাকিয়ে দেখে রেনু মাথা নিচু করে রেখেছে। বুরাকের রাগ হলো উমায়ের এর উপর। উমায়ের এগিয়ে এসে বুরাকের সামনে মোবাইল রেখে ঘুরে চলে যেতে নিলো। কিন্তু বুরাকের ডাকে থেকে গেল। বুরাক দাঁড়িয়ে বলল-
“আমি জানি তুমি তোমার পরিবারকে মিস করছো। তোমার প্রত্যেক ফিলিংস এর শ্রদ্ধা করি আমি। কিন্তু তুমি আমার পরিবারের সাথে এভাবে কথা বলতে পারো না।”
উমায়ের বুরাকের দিকে ঘুরে দাঁড়াল। বুরাকের কথায় রাগ স্পষ্ট। উমায়ের হাত আড়াআড়ি ভাবে ভাজ করে বলল-
“আমি খারাপ ব্যবহার করি নি কারো সাথে। আমার কথা বলার ধরনটাই এমন।”
“না, উমায়ের অনেক শান্তশিষ্ট মেয়ে ছিল। যে দুষ্টুমি করতো তবুও তার কথা ও কান্ডে বাচ্চামি স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে।”
“বুরাক, তোমার কি মনে হয় না তুমি আমাকে এখনো চিনতে পারো নি?”
“হ্যাঁ, হয় তো আমি এখনো তোমাকে চিনতে পারি নি। কিন্তু আমি তোমাকে যতটুকু চিনি তুমি এমন না। কি হয়েছে বলো আমাকে।”
“কিছু হয়নি।”
“না বলে আমাকে কি হয়েছে। তুমি এখন তোমার বাবার সাথে কথা বললে। নিশ্চয়ই কিছু হয়েছে।”
“কিছু হয়নি বুরাক। তুমি বিজি ছিলে, ইউ ক্যারি অন। আমি ঘরে যাই হালকা ঘুম পাচ্ছে।”
বলেই উমায়ের ঘুরে হনহন করে চলে গেল। বুরাক রেনুর হাত ধরে বলল-
“রেনু, তুই আর বর্ষা আমার জন্য সেম। তোদের মন খারাপ হলে আমারও মন খারাপ হতো। প্লিজ মন খারাপ করিস না।”
“হয় তো উমায়ের রেগে আছে আমার উপর।”
“না, ও তোর উপর কেন রাগবে?”
“আমার মন বলছে। আর ওর চাহনি দেখে আমার মনে হচ্ছিল সে আমাকে ধরে এখনই পিটানো শুরু করবে।”
বুরাক ফিক করে হেসে দিলো। রেনু ভ্রু কুঁচকে বলল-
“তুই হাসা বন্ধ করে যা এখন।”
“কোথায় যাব?”
“তোর মেহমানকে মানাতে যা। যেভাবে ওর পেছরে ঘুরিস দেখে মনে হয় তুই ওর বডিগার্ড।”
“এমন কিছুই না, ওর খেয়াল রাখার দায়িত্ব নিয়েছি তাই যথেষ্ট চেষ্টা করি ও যাতে কষ্ট না পায়।”
“বাহ বাহ এটাকেই তো প্রেম, ভালোবাসা ও মোহাব্বত বলে।”
“চুপ থাক, আমি দেখে আসি ও কোথায়।”
রেনু হেসে মাথা নাড়াল। বুরাক এই ঘর থেকে বের হয়ে গেস্টরুমে গেল। উমায়ের একদিক থেকে আর এক দিকে হেটে যাচ্ছে আর কি যেন ভাবছে। বুরাক এমন পরিস্থিতি দেখে দু’বার কাশি দিয়ে ভেতরে গেল। উমায়ের বুরাককে দেখে খাটে বসলো। বুরাক হেটে এসে উমায়ের এর পাশে বসলো। উমায়ের তার ওড়না আঙুলে পেচাচ্ছে আবার খুলছে। বুরাক উমায়ের এর হাতের দিকে এক নজর দেখে উমায়ের এর দিকে তাকাল। উমায়ের নিচের ঠোঁট কামড় দিতে ধরে রেখেছে। আর ঘনঘন নিশ্বাস ফেলছে। বুরাক বুঝতে পারলো উমায়ের সত্যি-ই রেগে আছে। উমায়ের চোখ বন্ধ করে লম্বা নিশ্বাস নিয়ে ছেড়ে বুরাকের দিকে তাকাল। বুরাক উমায়ের এর চাহনি দেখে বলল-
“রেনুকে তোমার পছন্দ হয়নি?”
উমায়ের চোখ সরিয়ে ফেলল। উমায়ের এর ব্যবহার বুরাককে তার প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিলো। বুরাক আবার বলল-
“রেনু আর আমি ২ বছরের বড়ো ছোটো। আমাদের মাঝের বন্ধুত্ব খুব সুন্দর। কিন্তু আমি ওকে সবসময় বোনের নজরে দেখেছি।”
উমায়ের বুরাকের দিকে তাকিয়ে বলল-
“তুমি ওকে যেই নজরেই দেখো তাতে আমার কিছু আসে যায় না। আমি যত দ্রুত সম্ভব আমার বাসায় যেতে চাই।”
“সত্যি বলছো? তোমার এতে কিছুই আসে যায় না?”
উমায়ের দাঁড়িয়ে বুরাকের দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল-
“তুমি কি বলতে চাও বুরাক? তোমার কি মনে হচ্ছে তোমার প্রতি আমার মনে ফিলিংস আছে?”
বুরাক দাঁড়িয়ে গেল। উমায়ের চোখ সরিয়ে বলল-
“তুমি আমার পরিবারের সাহায্য করেছো। এর জন্য ধন্যবাদ। তোমার প্রতি আমার মনে খুব সম্মান আছে। এর বেশী কিছু এক্সপেক্ট করা বোকামি।”
“ঠিক বললে, কিন্তু আমি একজন মানুষ। আমার মনে কারো প্রতি শ্রদ্ধা, ভালোবাসা থাকতেই পারে।”
“হুম, কিন্তু কাওকে ভালোবাসার আগে তোমার ভাবতে হবে তুমি কে। তোমার কাজ কি। নিজের অস্তিত্ব ভুলে যেও না।”
বুরাকের মনে হলো কেও তার বুকে সজোরে ধাক্কা মেরেছে। উমায়ের কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। বুরাক ঠাই দাঁড়িয়ে আছে এখনো। উমায়ের এর সব কথা সত্য। অন্য কেও বললে হয় তো তার খারাপ লাগতো না। কিন্তু উমায়ের এর মুখে শুনে সে সহ্য করতে পারছে না। বুরাক খাটে বসলো। তার জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ে আপন মানুষকে হারানোই লিখা আছে হয় তো। বুরাকের চোখে পানি জমে গিয়েছে। দ্রুত চোখ মুছে লম্বা নিশ্বাস ফেলল। মোবাইল বের করে ববিকে কল করে কানে ধরলো। ববি রিসিভ করতেই বুরাক বলল-
“তুই এখন কোথায়?”
“আমি হসপিটালে, সন্ধ্যার পর ফিরোজ স্যার আমাকে উনার বাসায় নিয়ে যাবেন।”
“একটা কথা বলার আছে কাওকে বলবি না।”
“বল”
ববি হেলান দিয়ে বসে ছিল। বুরাকের কথা শুনে ধরফরিয়ে বসলো।
“কি বলছিস তুই?”
“যা শুনলি তাই। আর হ্যাঁ আমরা আজ রওয়ানা দিচ্ছি। উমায়েরকে যত দ্রুত সম্ভব তার বাবা মায়ের কাছে ফিরিয়ে দিবো।”
“তুই উমায়েরকে ভালোবাসিস বুরাক।”
“এক তরফা ভালোবেসে কি লাভ ববি?”
ববি চুপচাপ বসে রইলো। বুরাক একটা ঢোক গিলে কল কেটে দিলো। দু-হাত দিয়ে মুখ ঢেকে নিঃশব্দে চোখের জল ফেলছে। বুরাক টেরও পেলো না দরজার পাশে দাঁড়িয়ে কেও একজন তার প্রত্যেক কথ শুনে ফেলেছে।

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here