ভরসার_দুহাত পর্ব_২৭

0
338

#ভরসার_দুহাত
#শোভা_আক্তার(লাভলী)
#পর্ব_২৭

সন্ধ্যার সময় বুরাকের ঘুম ভাঙলো। উঠে দেখে সে একা ঘরে। ধীরে ধীরে বিছানা ছেড়ে নেমে বাথরুমে গেল। ফ্রেশ হয়ে ফিরে ঘরে আসলো। বাহির থেকে শব্দ আসছে। কন্ঠটা ববির বুঝতে পেরে দরজা খুলে বাহিরে গেল। মেইন দরজায় ববি আর ফিরোজ আনোয়ার দাঁড়িয়ে কার সাথে যেন কথা বলছে। বুরাক ধীরেপায়ে হেটে সামনে গেল। হেটে আসার শব্দ শুনে ববি পেছনে ফিরে দেখে বুরাককে। ববি চমকে উঠে চোখ বড়ো বড়ো বুরাককে ইশারায় বলল সামনে না আসতে। কিন্তু বুরাক ববির ইশারা বুঝতে পারলো না। সে দাঁড়িয়ে চোখের ইশারায় জিজ্ঞেস করলো কি হয়েছে। ববি আবার সামনের দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে উচ্চস্বরে বলল-
“ইন্সপেক্টর এখন আপনার উপর আমরা সব ছেড়ে দিলাম। খুঁজে দেখুন খালিদ খান এবং তার বাকি লোকদের।”
বুরাক থতমত খেয়ে গেল ববির কথা শুনে। দরজার ওপার থেকে একটা ভারী কন্ঠ ভেসে আসলো-
“খালিদ খানের লোক তো আপনিও ছিলেন। যেহেতু ফিরোজ আনোয়ার বলেছেন আপনার উপরের সব কেস বন্ধ করতে আমরা করেছি। এখন আপনার সেই বন্ধুর অপেক্ষায় আছি। সে আসলে তাকে সর্বপ্রথম ধরবো।”
ফিরোজ আনোয়ার বললেন-
“দেখুন আমরা আপনাকে বলেছি যা বলার। বুরাকের উপর যত কেস আছে আমি বন্ধ করাতে চাই। এখন সব আপনার উপর। বন্ধ করার বিনিময়ে যা চাইবেন আমি দিতে রাজি।”
“এমন ওয়াদা করবেন ফিরোজ সাহেব। আমরা যে কিছু চেয়ে বসতে পারি। এরচেয়ে ভালো সেই ক্রিমিনালকে আমাদের হাতে তুলে দিয়েন।”
ফিরোজ আনোয়ার জবাব দিলো না৷ পুলিশ বিদায় নিয়ে চলে গেল। পুলিশের গাড়ি যেতেই ববি তারাতাড়ি মেইন দরজা বন্ধ করে বুরাকের দিকে ঘুরে দাঁড়াল।
“তুই এখনো দাঁড়িয়ে আছিস? ভেতরে যা।”
ববির কথা শুনে ফিরোজ আনোয়ারও ঘুরে দাঁড়ালেন। বুরাক উনার দিকে তাকিয়ে বলল-
“কেন আমাকে আপনি নির্দোষ বানাতে চান বলুন তো? আমি কবুল করছি অনেক ক্রাইম করেছি জীবনে। কেসগুলো বন্ধ করা সম্ভব না ফিরোজ স্যার।”
“বুরাক, উমায়ের আমাকে সব বলেছে।”
“সেগুলো পুরানো কথা। আমি আপনাদেরও মারতে চেয়েছিলাম ভুলে গেলেন?”
“মারো তো নি, উল্টো আমাদের মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়েছো। আমার মেয়ের রক্ষা করেছো। আমি কিভাবে তোমার শাস্তি হতে দেই বলো?”
“এত ভালো হওয়া ভালো না ফিরোজ স্যার। আমি একজন ক্রিমিনাল, যে কোনো সময় পল্টি নিতে পারি।”
ফিরোজ আনোয়ার হেসে দিলেন। এগিয়ে এসে বুরাকের কাঁধে হাত রেখে মুচকি হাসি দিয়ে বললেন-
“আমি জানি তুমি এমনটা করবে না। এখন ঘরে গিয়ে বিশ্রাম করো। না হয় আমাদের ড্রইংরুমে আসো। তোমাদের ঘরে আমি খুব শীগগিরই টিভির ব্যবস্থা করে দিবো। তোমরা আসো আমি ভেতরে যাই।”
বলেই ফিরোজ আনোয়ার হাঁটা ধরলেন। ফিরোজ আনোয়ার কিছুটা দূর যেতেই ববি বলল-
“উনি যেহেতু সাহায্য করতে চাচ্ছেন তুই না করছিস কেন? বুরাক তুই ভালো একটি জীবন পাবি যদি তোর কেস গুলো বন্ধ হয়।”
বুরাক জবাব দিলো না। ববি এগিয়ে এসে বুরাকের হাত ধরে বলল-
“আমার ছোটোবেলার বন্ধু যদি আমার পাশে না থাকে আমি বাঁচতে পারবো না। তুই আমার জীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ অংশ।”
বুরাক এখনো চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। ববি হাসিমুখে বলল-
“চল এখন ড্রইংরুমে গিয়ে বসি। এই পরিবারের মানুষ গুলো এত ভালো কেন আমি বুঝতে পারিস না জানিস? চল এখন।”
ববি বুরাকের হাত ধরে বাসার ভেতরে নিয়ে গেল। ড্রইংরুমে সবাই বসে আছে। বুরাক আর ববিকে দেখে নুসাইফা বেগম হাসিমুকে বসতে বললেন। ববি বুরাককে উমায়ের এর পাশের সোফায় বসিয়ে নিজেও বসলো। উমায়ের বুরাককে এক নজর দেখে চায়ের কাপে চুমুক বসালো। তারপর আবার বুরাকের দিকে তাকিয়ে বলল-
“কত চামচ চিনি দিবো তোমার চায়ে?”
বুরাক উমায়ের এর দিকে তাকিয়ে বলল-
“আমি চা খাবো না।”
“তো কি বসে বসে দেখার ইচ্ছা? পরে আমাদের পেট ব্যাথা করলে তোমার খবর আছে।”
“আমি নজর দিচ্ছি না তোমার খাবারে।”
“সব কথা কী আর চোখ দেখে বুঝা যায়?”
ববি মিটিমিটি হাসছে তাদের শান্ত গলায় ঝগড়া দেখে। বুরাক জবাব দিতে পারছে না। মাঝে মধ্যে উমায়ের এর কথা তার মুখ বন্ধ করে দেয়৷ উমায়ের তার চায়ের কাপ রেখে ববি আর বুরাকের জন্য কাপে চা ঢেলে দিলো।
“তোমার চায়ে প্রায় ৪ থেকে ৫ চামচ চিনি দিতে হবে।”
উমায়ের এর কথা শুনে বুরাক ভ্রু কুঁচকে বলল-
“এত বেশী কেন?”
“তুমি যখন কথা বলো মনে হয় তেতো করলা কেও খাইয়ে দিয়েছে তোমাকে।”
ববি উসমান উজ্জ্বল শব্দ করে হেসে উঠলো। বুরাক বিরক্ত হয়ে মুখ ঘুরিয়ে ফেলল। উমায়ের চায়ে চিনি দেয়ার আগেই বুরাক চায়ের কাপ নিয়ে চুমুক বসিয়ে বলল-
“লাগবে না, এইভাবেই ঠিক আছে।”
উমায়ের হেসে উঠলো বুরাকের কথা শুনে। বুরাক আড়চোখে উমায়েরকে দেখে ভাবছে এখন আশে পাশে কেও না থাকলে উমায়ের এর ক্লাস নিতো।

পরেরদিন…..
উমায়ের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল বাঁধছে। আজ দেরি হয়ে গিয়েছে উঠতে। তারাতাড়ি তৈরী হয়ে ব্যাগ নিয়ে বাহিরে বের হলো। নাস্তা না করেই বাহিরে বের হয়ে ড্রাইভারকে বলল গাড়ি বের করতে৷ তখনই বুরাক দরজা খুলে বের হলো। বের হয়ে আড়মোড়া ভেঙে আকাশের দিকে চোখ ছোটো ছোটো করে তাকাল। রোদের কারণে তাকানো যাচ্ছে না। বুরাককে দেখে উমায়ের তাকে চা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখলো। হাফপ্যান্ট পড়ায় বুরাককে ক্লাস নাইন টেন পড়ুয়া ছেলেদের মতো লাগছে। বুরাক ধীরপায়ে হেটে গিয়ে বুরাকের সামনে দাঁড়াল। বুরাক উমায়েরকে দেখে বলল-
“সকাল সকাল এত সুন্দর করে তৈরী হয়ে কোথায় যাচ্ছো?”
“কোথায় আর যাবো? বয়ফ্রেন্ড কল করেছে ঘুরাবে আজ তার নিউ বাইক দিয়ে।”
উমায়ের এর মনে হলো তার কথা শুনে বুরাকের চেহারায় কালো মেঘ নেমে আসলো। উমায়ের হাত আড়াআড়ি ভাবে ভাজ করে অন্যদিকে তাকাল। বুরাক বিরক্ত হয়ে বলল-
“আমি কিছু জিজ্ঞেস করছি তোমাকে।”
উমায়ের থতমত খেয়ে বুরাকের দিকে তাকিয়ে বলল-
“কি জিজ্ঞেস করলে? কখন করলে?”
বুরাক রাগী কন্ঠে বলল-
“আমি জিজ্ঞেস করছি তোমার বয়ফ্রেন্ড আসলো কোথা থেকে?”
“মনে মনে জিজ্ঞেস করেছো? আমি বুঝবো কি করে বুরাক তুমি যদি মুখে না মনে মনে জিজ্ঞেস করো?”
“সে যাই হোক এখন উত্তর দাও।”
উমায়ের কিছু বলার আগেই ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে আসলো। উমায়ের গাড়ি দেখে বুরাকের দিকে তাকিয়ে বলল-
“আপাতত আমাকে পার্কের মোড়ে যেতে হবে। সে হয় তো ওখানেই অপেক্ষা করছে আমার। এখন আসি ফিরে আসার পর বলবো নি।”
বলেই উমায়ের গিয়ে গাড়িতে উঠে বসলো৷ বুরাক ঠাই দাঁড়িয়ে আছে। তার চেহারায় রাগ স্পষ্ট। উমায়ের এর মন চাচ্ছে চিৎকার করে হাসতে বুরাকের চেহারা দেখে। গাড়ি যেতেই বুরাক রাগে ঘনঘন নিশ্বাস ফেলছে। রাগের কারণে তার কান চোখ লাল হয়ে যাচ্ছে।

উমায়ের ভার্সিটি পৌঁছে দেখে রুম্মান মোবিনের বাইক থেকে নামছে। মোবিন রুম্মানকে টাটা দিয়ে বাইক স্টার্ট দিয়ে চলে গেল। রুম্মান উমায়ের এর গাড়ি দেখে দাঁড়াল। উমায়ের গাড়ি থেকে নেমে রুম্মানের দিকে এগিয়ে গিয়ে হাসিমুখে রুম্মানকে জড়িয়ে ধরলো।
“আই এম সরি রুম্মান।”
রুম্মান উমায়েরকে ছেড়ে অবাক হয়ে বলল-
“তুই মাফ চাচ্ছিস কেন হঠাৎ?”
“সেদিন মোবিন ভাইয়ার সাথে বেয়াদবি করেছি তাই। আমার তোর দিকটাও ভাবা উচিত ছিলো। তুই অনেক ভালোবাসিস উনাকে আমি বুঝতে পারছি।”
“চিল ইয়ার, আমি নিজেই তাকে বুড়ো ডাকি।”
উমায়ের হেসে দিলো। রুম্মানের মুখে থাকা হাসিটা সে হারাতে দিবে না। বুরাককে যেভাবেই হোক থামাতে হবে। দুজন মিলে ক্লাসের দিকে হাঁটা ধরলো।

বুরাক রাগী চেহারা বানিয়ে খাটে বসে আছে। তার নাস্তা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে পড়ে থাকতে থাকতে। ববি হাত ধুয়ে এসে বিরক্ত হয়ে বলল-
“তোর কি হলো বলবি? নাস্তা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে তো, খেয়ে নে।”
বুরাক চুপচাপ বসে রাগ কমানোর চেষ্টা করছে। ববি এগিয়ে এসে বুরাকের বরাবর বসে বলল-
“উমায়ের এর সাথে ঝগড়া হয়েছে আবার?”
বুরাক রাগী দৃষ্টিতে ববির দিকে তাকিয়ে বলল-
“ওর পাশে কোন ছেলেকে ভাবলে আমার মাথা কাজ করে না। আমি আর কিছু ভাবতে পারছি না। রাগে কি করতে ইচ্ছে করছে নিজেও বুঝতে পারছি না।”
“বিষয়টা কি? আমাকে বল কি হয়েছে?”
বুরাক উঠে দাঁড়াল। জানালা দিয়ে বাহিরের দিকে এক নজর দেখে বলল-
“আমি বাহিরে যেতে চাই ববি।”
ববি অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে বলল-
“পাগল হয়ে গিয়েছিস? বাহিরে পুলিশ অপেক্ষা করছে তোর। তোকে পেলে ধরে নিয়ে যাবে।”
“পারবে না, আমি এত কাঁচা খেলোয়াড় না যে আমাকে এত সহজে তারা ধরে ফেলবে।”
“তুই বাহিরে যেতে চাচ্ছিস কেন বল তো।”
“কাজ আছে”
“আমাকে বলবি না?”
বুরাক ববির দিকে তাকিয়ে না সূচক মাথা নাড়াল। ববি একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলে খাটে বসলো।

উমায়ের আর রুম্মান ক্যান্টিনে বসে আছে। তারা দুজন বসে বসে আশে পাশের প্রেমিক প্রেমিকাকে দেখছে আর ডিসকাশন করছে তাদের প্রেম কতদূর টিকবে। রুম্মান নাক মুখ কুঁচকে বলল-
“পাবলিক প্লেসে যদি আমার স্বামী এভাবে আমাকে খাইয়ে দিতে চায় আমি একটা ধমক দিয়ে বসবো।”
“কিন্তু কেন?”
“এত নির্লজ্জ হতে মন চায় না।”
“তুই এত আনরোমান্টিক আগে জানতাম না।”
“আমার মতে ভালোবাসা নিজেদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা ভালো।”
“হুমন লজিক, আচ্ছা আজও কি ভাইয়া আসবেন?”
“না, উনি শুধু আমাকে ভার্সিটি দিয়ে যান। নতুন কাজ শুরু করেছে তাই ব্যস্ত।”
“উনি কি কাজ করেন? আই মিন কিসের ব্যবসা উনার?”
“খেলনার, আগে চকলেট ফ্যাক্টরিতে কাজ করতেন এখন নিজের ব্যবসা দিয়েছে।”
“যাক ভালো, তুই বলেছিলি উনি তোকে কিছু বলতে চায় বলেছে?”
“না, আমি প্রায়ই জিজ্ঞেস করি। উনি সবসময় একটাই উত্তর দেন। আমি পার্মানেন্ট তাদের বাসায় যাব তারপরই বলবেন।”
উমায়ের ভাবনার গহিনে ডুবে গেল। মোবিন কি এমন বলতে চায় রুম্মানকে? সে একজন রেপিস্ট যদি এই কথা বলবে না তো? রুম্মান তখন কেমন রিয়্যাক্ট করবে কে জানে। রুম্মান বিরক্ত হয়ে বলল-
“তুই আবার ভাবতপ শুরু করলি? তোর কি হয়ে যায় রে কিছুক্ষণ পর পর?”
উমায়ের রুম্মানের দিকে তাকিয়ে না সূচক মাথা নাড়াল। ক্যান্টিন থেকে নাস্তা করে তারা ক্লাসরুমে ফিরে আসলো। রুম্মান একবার তার স্বামীর প্রশংসা শুরু করলে থাকতে চায় না। উমায়ের শুধু তার কথা শুনে এবং মাথা নাড়ায়। ক্লাস শেষে দুজন ভার্সিটি থেকে বের হলো। রুম্মান বলল তারা আজ কিছুক্ষণ ঘুরে তারপর বাসায় ফিরবে। উমায়ের ড্রাইভারকে বলে দিয়েছে বাসায় চলে যেতে সে যেতে পারবে পরে। উমায়ের আর রুম্মান মুড়িওয়ালা মামা থেকে মুড়ি কিনে নিয়ে ফুটপাত দিয়ে হাঁটা ধরলো। দুজন আবার গল্প শুরু করলো।
“বুরাককে নিজের মনের কথা কবে বলবি?”
“কখনো না”
“কিন্তু কেন?”
“আগে আমাকে ভাবতে হবে সে আমার ভাগ্যে লিখা আছে কিনা।”
“ভালোবাসা হারানোর কথা ভাবলে খুব কষ্ট হয় রে। তুই পারবি হারানোর বেদনা সহ্য করতে?”
“আমি জানি আমি তাকে পাবো না। তাই তাকে হারিয়ে ফেললেও সমস্যা নেই। আমার কষ্ট কম হবে।”
“এখন বলছিস কষ্ট কম হবে। যখন হারিয়ে ফেলবি তখন বুঝবি কষ্ট কত প্রকার ও কি কি। তোকে একটা এডভাইস দেই উমায়ের। তুই বুরাককে তার মনে কথা বলে দে। জানিস মনের ভাব প্রকাশ করলে কাছের মানুুষকে হারানোর চান্স কমে যায়?”
“আমি এমনটা কখনো শুনি নি।”
বলেই উমায়ের শব্দ করে হাসলো। রুম্মান বিরক্ত হলো উমায়ের এর হাসি দেখে। উমায়ের রুম্মানের দিকে তাকিয়ে বলল-
“জানিস ওর ফাঁসি হয়ে যেতে পারে?”
রুম্মান দাঁড়িয়ে গেল রুম্মানের কথা শুনে৷ উমায়েরও দাঁড়াল তার সাথে। রুম্মানের চেহারা দেখে মনে হচ্ছে সে খুব ভয় পেয়েছে উমায়ের এর কথা শুনে। উমায়ের হেসে রুম্মানের নাক ধরে টেনে বলল-
“তোর আবার কি হলো?”
“তুই কি বললি আবার বল তো।”
“বুরাককে যদি পুলিশরা ধরে ফেলে তাকে ফাঁসির আদেশ দেয়া হবে।”
“হোয়াট? আর ইউ সিরিয়াস উমায়ের?”
“হান্ড্রেড পারসেন্ট সিরিয়াস। বুরাকের উপর অনেক কেস আছে যেগুলো বন্ধ করতে পারছে না আব্বু। পুলিশ বলেছে বুরাককে এরেস্ট করে নিয়ে যাবে। গতকাল আমাদের বাসায় পুলিশ এসেছিলো। বুরাককে আব্বু স্টোররুমে রেখেছে তাই তারা টের পায়নি। আমি তাকে চাই না। সে বেঁচে থাকাই আমার জন্য সব।”
বলেই উমায়ের মাথা নিচু করে ফেলল। রুম্মান তাকিয়ে আছে উমায়ের এর দিকে।

ফিরোজ আনোয়ার জানেন না বুরাক বাসায় নেই। উনি দরজা ঠেলে হঠাৎ ভেতরে আসায় ববি চমকে উঠেছে। আশে পাশে বুরাককে না দেখে উনি জিজ্ঞেস করলেন বুরাক কোথায়। ববি বলল বুরাক বাথরুমে আছে। ফিরোজ আনোয়ার আর কিছু জিজ্ঞেস না করে ববির হাতে কিছু টাকা দিয়ে বলল বৃদ্ধ আশ্রমে দিয়ে আসতে। বৃদ্ধ আশ্রমের কথা শুনে ববি যেন আকাশে উড়ছে। সে সাথে সাথে এগিয়ে গিয়ে টাকা নিয়ে বলল এখনই যাবে সে। ফিরোজ আনোয়ার তার কান্ড দেখে হাসতে হাসতে চলে গেলেন। ববি জামা বদলে স্টাইল করে বাসা থেকে বের হলো। দোকান থেকে আকলিমার জন্য দুটো কিটক্যাট কিনে পকেটে রেখে দিলো। ১০ মিনিটের রাস্তাকে ববি ৫ মিনিট পাড় করলো। আশ্রমের বাহিরে দাঁড়িয়ে ঘনঘন নিশ্বাস ফেলছে। দৌড়ানোর কারণে ক্লান্ত লাগছে। আশ্রমের দারোয়ান মামাকে বলে দরজা খুলে ভেতরে গেল। আশ্রমের বাগানে অনেক বৃদ্ধরা আছে যারা বসে বসে গল্প করছেন। ববি সবাইকে এক নজর দেখে ভাবলো কিছু কিছু মা বাবা নিজের সন্তানকে অনাথ আশ্রমে রেখে আসে আবার কিছু কিছু সন্তানরা তার বাবা মাকে বৃদ্ধ আশ্রমে রেখে আসে। ববি জানে না তার বাবা মা কে। নিজের বাবা মায়ের কথা ভেবে কখনো মন খারাপও করে না। কিন্তু আজ এত এত বাবা মাকে দেখে তার মন খারাপ হয়ে গেল। হঠাৎ করেই কান্না আসছে। তখনই সামনে থেকে সেই অতি চেনা পরিচিত কন্ঠ ভেসে আসলো।
“আপনি এখানে?”
ববি সামনের দিকে তাকিয়ে দেখে আকলিমা দাঁড়িয়ে আছে হাতে আইসক্রিমের বক্স নিয়ে। আকলিমা হঠাৎ খেয়াল করলো ববির চোখের কোণায় একটুখানি পানি জমে আছে। ববি মুখে বড়ো হাসি ফুটিয়ে বলল-
“ফিরোজ স্যার পাঠিয়েছে ডোনেটের জন্য।”
“আপনি একটু অপেক্ষা করুন আমি বাবা মাদের আইসক্রিমটা দিয়ে আসি।”
ববি মাথা নাড়াল। আকলিমা সবাইকে আইসক্রিম দিয়ে একটা আইসক্রিম হাতে করে নিয়ে আসলো। এসে ববির দিকে এগিয়ে দিলো। ববি ইশারায় বলল খাবে না। আকলিমা এক ভ্রু উঁচু করে বলল-
“ভাব ওয়ালা লোক আমার একদম পছন্দ না।”
ববি সাথে সাথে আইসক্রিম নিয়ে বলল-
“ভাব নেই নি, আমার আইসক্রিম খুব পছন্দ। আসলে প্রথমবার জিজ্ঞেস করায় কিভাবে নিয়ে নিতাম বলুন? তাই একটু ড্রামা করতে হয়।”
আকলিমা শব্দ করে হেসে দিলো ববির কথা শুনে। ববিও মুচকি হাসলো তার হাসি দেখে। আকলিমা হাসতে হাসতেই ববিকে ইশারায় বলল তার পেছনে আসতে। ববি বাধ্য ছেলের মতো আকলিমার পেছনে গেল। ভেতরে গিয়ে ববি হা হয়ে চারপাশে চোখ বুলালো। খুব সুন্দর করে সাজানো আশ্রমটা। আকলিমা ববিকে বসতে বলে ভেতরে গেল। ববি সোফায় বসে আইসক্রিম খাচ্ছে আর অপেক্ষা করছে আকলিমার। আকলিমা খাতা আর কলম নিয়ে আসলো। ববির কাছ থেকে সব ডিটেইলস নিয়ে লিখে নিলো। টাকা গিয়ে লকআপে রেখে ফিরে আসলো। ববি মাথা তুলে দেখে আকলিমার হাতে ট্রে। ট্রে টি টেবিলের উপর রেখে আকলিমা বলল-
“ভালো সময়ে এসেছেন। মাত্রই নুডলস বানালাম।”
“আই লাভ নুডলস”
ববি দাঁত বের করে হেসে বলল কথাটা। ববির হাসি দেখলে আকলিমার মনে হয় সে জোকার দেখছে। অকারণে হাসে ছেলেটা। বাটিতে নুডলস বেড়ে আকলিমা এগিয়ে দিলো। সোফায় বসে গ্লাসে ঢেলে বলল-
“বুরাক ভাইয়া এখন কেমন আছে?”
“সে আগের থেকে অনেক ভালো আছে। আপনার আম্মুর কি অবস্থা? উনি সুস্থ আছেন?”
“জি, আজ উনার জন্মদিন।”
“বাহ, উনি কোথায়? আমি উনাকে উইশ করে তারপর যাব।”
“উনি উনার ঘরে বিশ্রাম করছেন।”
“আচ্ছা আজ উনার জন্মদিন আপনি কি করে জানলেন? মানে উনি বলেছেন?”
“না, গত ১ বছর আগে আজকের দিনে উনি এই আশ্রমে এসেছিলেন। নতুন করে আর একবার জন্ম হয়েছিলেন। পুরানো সব স্মৃতি মুছে নতুন জীবন শুরু করেছিলেন। তাই আজকের দিনে আমরা উনার জন্মদিন মানাবো। আমার প্রত্যেক বাবা মায়ের জন্মদিন এইভাবেই সেলেব্রেট করি আমরা।”
ববি মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে আছে। এই মেয়েটা আসলেও মানুষ নামক পরী। ববির চাহনি দেখে আকলিমা থমকে গেল। এই ছেলেটার চাহনিতে সে খারাপ কিছু দেখে না। চাহনিটা মুগ্ধকর খুব। চোখ দেখে এখন মনে হচ্ছে ছেলেটার জীবনে খুব কষ্ট। সবসময় মুখে হাসি রাখে বলে কেও বুঝতে পারে না। ববি হঠাৎ চোখ ফিরিয়ে নিলো। আকলিমাও থতমত খেয়ে গেল। দুজনেরই হঠাৎ অস্বস্তি হচ্ছে। আকলিমা “আসছি” বলে উঠে ভেতরে চলে গেল। ববি লম্বা নিশ্বাস ফেলে নিজেকে সামলালো। কিছুক্ষণের জন্য তার মনে হচ্ছিল এখনই তার হৃদয়ে বিস্ফোরণ ঘটবে।

অন্যদিকে…..
রুম্মানের কল এসেছে। তার ভাই তারাতাড়ি বাসায় ফিরতে বলেছে তারা কোথাও যাবে। উমায়ের রুম্মানকে বলল চলে যেতে সে হেটেও যেতে পারবে। মাত্র ১০ মিনিটের মতো রাস্তা রয়েছে বাসা পৌঁছাতে। রুম্মান তারাতাড়ি রওয়ানা হলো নিজের বাসার উদ্দেশ্যে। উমায়ের ধীরে ধীরে হাঁটছে। মাঝে মধ্যে একা থাকতে ভালো লাগে। উমায়ের হাটতে হাটতে হঠাৎ দেখলো সামনে পুলিশের গাড়ি এগিয়ে আসছে। পুলিশ দেখলে তার ভয় করে। মনে হয় এই বুঝি তারা বুরাককে ঘরে নিয়ে যাবে। উমায়ের দ্রুত হাঁটা ধরলো। হেটে অন্য রাস্তায় এসে লম্বা নিশ্বাস ফেলে নিশ্চিন্ত হলো। নিজেকেও এখন তার ক্রিমিনাল মনে হয়। হঠাৎ সামনে থেকে পরিচিত কন্ঠ ভেসে আসলো।
“বয়ফ্রেন্ড একা রেখে চলে গিয়েছে?”
উমায়ের মাথা তুলে দেখে একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। হুডি পড়া মুখে মাস্ক। উমায়ের এর চিনতে অসুবিধা হলো না ছেলেটা বুরাক। উমায়ের বলল-
“তুমি বিশ্রাম না নিয়ে এখানে কি করছো? বাবা বলেছে তোমাকে এলাকায় না বের হতে। জানো তো পুলিশরা ঘোরাঘুরি করছে?”
“জানি, আর আমি তাদের সামনে দিয়েই এসেছি। বুরাক শাহরিয়ার শাহকে ধরা সম্ভব না।”
“নিজেকে ডন মুভির শাহরুখ খান ভেবো না। বাসায় চলো এখনই।”
“তোমার বয়ফ্রেন্ড চলে গিয়েছে?”
“হ্যাঁ চলে গিয়েছে এখন তারাতাড়ি চলো প্লিজ।”
বলেই উমায়ের বুরাক হাত ধরে টেনে হাঁটা ধরলো। বুরাক আর উমায়ের পাশাপাশি হাত ধরে হাঁটছে। কিছুক্ষণ হাঁটার পর হঠাৎ তারা দেখলো সামনেই দুজন পুলিশ রয়েছে। বুরাক আর উমায়ের থমকে দাঁড়াল। তারা একটা ছবি সবাইকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করছে ছেলেটাকে দেখেছে কিনা। উমায়ের বুরাকের হাত ধরে ঘুরে আবার আগের রাস্তায় হাঁটা ধরলো। ভয়ে তার হাত পা জমে যাচ্ছে। হঠাৎ দেখলো সামনে রাস্তায় পুলিশের জিপ পার্ক করা। উমায়ের দাঁড়িয়ে গেল। বুরাক হঠাৎ হেসে বলল-
“ফেসে গেলাম আমরা।”
উমায়ের বুরাকের দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল-
“হাসছো তুমি? আর আমার এইদিকে জান বেরিয়ে যাচ্ছে ভয়ে।”
“কিন্তু কেন? তারা আমাকে ধরবে তোমাকে না।”
“তোমাকে ধরবে বলেই ভয় লাগছে।”
বলেই উমায়ের রাস্তার দুপাশ চেক করলো। বুরাক তাকিয়ে আছে উমায়ের এর দিকে। হঠাৎ উমায়ের দেখলো পুলিশ পেছনের রাস্তা থেকে একজন পুলিশ এগিয়ে আসছে। তার হাতেও একটা ছবি। যদিও উমায়ের আর বুরাক জানে না ছবিটা কার। কিন্তু তারা রিস্ক নিতে চায় না। যদি ছবিটা বুরাকের হয়ে থাকে এবং পুলিশ বলে মাস্ক খুলতে। কেও বাঁচাতে পারবে না বুরাককে। হঠাৎ উমায়ের এর হাত কাঁপতে লাগলো। উপর নিচে দেখছে সে। কি করা যায়। হঠাৎ তার মাথায় একটা বুদ্ধি আসলো। বুরাকের দিকে তাকিয়ে একটা ঢোক গিলল। বুরাক ভ্রু কুঁচকালো উমায়ের এর চাহনি দেখে। পুলিশ কিছুটা দূর থাকতেই উমায়ের হঠাৎ বুরাককে জড়িয়ে ধরলো। বুরাক থতমত খেয়ে গেল উমায়ের এর কান্ড দেখে। উমায়ের নিচু স্বরে বলল-
“জড়িয়ে ধরো আমাকে। বাকিটা আমি সামলে নিলো।”
বুরাক চোখ তুলে একবার পুলিশকে দেখে উমায়েরকে জড়িয়ে ধরে মুখ লুকিয়ে ফেলল।

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here