ভালবাসা বাকি আছে পর্ব-১

1
1720

#ভালবাসা_বাকি_আছে -১
Hasin Rehana – হাসিন রেহেনা

লাগেজ নিয়ে টার্মিনালের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে একটা মেয়ে। পেছনে ফেলে যাচ্ছে তার সদ্য গোছানো সংসার। মেয়েটা যদি ফিরে তাকাতো, তাহলে দেখতে পেত, একজোড়া ভেজা চোখ অপলক চেয়ে আছে তার দিকে, ঘোরলাগা দৃষ্টিতে। যে দৃষ্টি সে দেখতে চেয়েছে বহুবার। কিন্তু হায়, আজ যখন মানুষটা সেই কাঙ্খিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে, তখন তাকে চলে যেতে হচ্ছে হাজার হাজার মাইল দূরে। চাইলেও ফিরে তাকাতে পারছে না। কারন, ফিরে তাকালেই ধরা পড়ে যাবে যে চোখের জলে ভেসে যাচ্ছে মেয়েটার দু’গাল। কথা দিয়েছিল বিদায়বেলায় কান্নাকাটি করবে না। কিন্তু সে কথা রাখা এত কঠিন হবে কে জানতো?

লাগেজ জমা দেওয়া হলে চেকইন করে ডিপার্চার লাউঞ্জে চলে গেল বুশরা। সিকিউরিটি চেকিং, ইমিগ্রেশন, ইত্যাদি যাবতীয় ফর্মালিটি শেষ করে বুশরা যখন লাউঞ্জে বসলো তখনই বেজে উঠলো ফোনটা। স্ক্রিনে ভেসে উঠলো এক মমতাময়ী নারীর মায়াময় চেহারা। চোখের কোলে জমে থাকা জল দুহাতে মুছে প্রকৃতিস্থ হওয়ার চেষ্টা করলো ও। যেন ফোনের ওপারের মানুষটা দেখে ফেলবে বুশরাকে।

“হ্যালো মা।”

“সব ঠিকঠাক আছে তো?”

“হ্যাঁ মা। সব ঠিক আছে। কোন ঝামেলা হয়নি। এনাউন্সমেন্ট হলে শুধু প্লেনে গিয়ে উঠবো। এত চিন্তা করো না তো।”

“মন খারাপ করিস না মা। পৌঁছে একটা ফোন করিস।”

“আচ্ছা মা। তুমি কান্নাকাটি করো না।”

“সাবধানে যাস।“

“আচ্ছা মা।“

ফোন কেটে যাওয়ার পরেও কিছুক্ষণ কানে চেপে রাখলো বুশরা। এই মমতাময়ী নারীর ভালবাসার দাম একজীবনে শোধ করা সম্ভব না ওর পক্ষে। কি ভাবছেন? তিনি বুশরার মা? নাহ। আমাদের গল্পের এই প্রধাণ নারী চরিত্রটি এতিম। মা, বাবা, পরিবার বলতে কিছু ছিল না তার। ছিল না বলছি কারন, এখন সবই আছে মেয়েটার। মমতাময়ী মা, স্নেহময় বাবা, অসাধারণ একজন জীবনসঙ্গী, আর একটা সাজানো গোছানো সুখী পরিবার। যাদের মায়া কাটিয়ে বিদেশ পাড়ি জমাতে কলিজাটা ফেটে যাচ্ছে মেয়েটার। তবু যেতে হচ্ছে।

ব্যাক্তিগত পিছুটান যেন তার ডাক্তারী ক্যারিয়ারে বাঁধা সৃষ্টি না করে এমনটাই চেয়েছে তার প্রিয়জন। তার পূর্ণ সমর্থনেই উচ্চশিক্ষা নামক সোনার হরিণের পেছনে ছুটছে সাধারণ মানুষের সেবায় নিবেদিতপ্রাণ বুশরা। হ্যাঁ, এয়ারপোর্টের অপরপ্রান্তে স্থানুর মত বসে থাকা মানুষটাই ওর প্রিয়জন, প্রথম প্রেম, যা এসেছিল উত্তরে হাওয়ার মত সন্তর্পণে। আর ভেসে নিয়ে গেছে মন প্রাণ সবকিছু। তাইতো পরিণয়ের পরপরই বিচ্ছেদটা বুকে বাঁধছে কাটার মত।

চলে যাওয়ার আগে আরেকটাবার কথা বলার জন্য মরিয়া হয়ে মানুষটাকে ফোন করলো বুশরা। ওপ্রান্তের মানুষটাও যেন তৈরি হয়েই ছিল ফোনকলটার জন্য। বিরক্তিকর ডায়াল টোন শুরু হওয়ার আগেই ফোনটা রিসিভ করে সে। হাজারও কথা বাকি থাকলেও দুপ্রান্তের নিরবতায় কেটে যায় কয়েক মুহুর্ত। কথামালারা যেন সব বাক্সবন্দি। নিরবতা ভেঙ্গে প্রথম কথাটা বলে রায়হান,

“বেশি খারাপ লাগছে?”

“কই না তো।”

“তাহলে চোখ মোছো।”

ধরা গলায় বুশরা বললো, “আমি মোটেও কাঁদছি না।”

তর্কে গেলো না রায়হান। বরং আলতো স্বরে বললো,
“জীবনে কোন পরিস্থিতিতে ভেঙ্গে পড়োনা। দূরে থাকলেও জেনো, আমি সবসময় তোমার পাশে আছি।”

ওদের কথা বলার মাঝেই এনাউন্সমেন্ট হলো। অতৃপ্তি নিয়ে ফোন রাখলো দুজনে। কত কথা বলা যে বাকি রয়ে গেল। একসাথে কাটানো টুকরো কিছু মুহুর্ত চিন্তা করতে করতে প্লেনে উঠলো বুশরা। বোর্ডিং পাসের সিট নাম্বার দেখে নির্ধারিত সিটে গিয়ে বসলো। সতর্কতামূলক কিছু এনাউন্সমেন্ট হচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই প্লেন টেকঅফ করবে। সিটবেল্ট বেঁধে চোখদুটো বন্ধ করলো বুশরা।

বিদায়বেলা রায়হানের শেষ কথা ছিল “বুশরা, চিঠি দিও।” তারপর থেকেই প্রিয়তমের শেষ মুহুর্তের অনুরোধ কানে বাজছিল প্রতি মুহুর্তে। তাইতো, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে প্লেন টেকঅফ করার কিছুক্ষণ পার হতেই জীবনে প্রথম চিঠি লিখতে অস্থির হয়ে ওঠে বুশরা। কিন্তু ব্যাকপ্যাকে নোটবুক, কাগজ, কলম কিচ্ছু নেই। অগত্যা, ইচ্ছেদের দমিয়ে রেখে চুপ করে বসে রইলো।

পাশের সিটে বসা ভদ্রলোকের সাথে ছোট্ট একটা বাচ্চা। কি চঞ্চল বাচ্চাটা। মনে হাজারো প্রশ্ন। আর বাবাটিও কি ধৈর্য ধরে বাচ্চাটার সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যাচ্ছে। সাধারণত এই বয়সের বাচ্চাদের মা ছাড়া ট্রাভেল করতে দেখা যায়না। কিন্তু তাদের দেখে বোঝাই যাচ্ছে যে বাবা মেয়ে একসাথে ঘুরেফিরে অভ্যস্ত। দীর্ঘ এই যাত্রাপথে বাচ্চাটার উপস্থিতি বেশ লাগছে বুশরার।

একটা সময় বাবাকে নানান প্রশ্ন করতে করতে নিজেই বিরক্ত হয়ে ট্যাব নিয়ে গেইম খেলতে শুরু করলো বাচ্চাটা। তখনই বুশরার মনে পড়ে ব্যাগে থাকা আইপ্যাডটার কথা। বিদায় উপহার হিসেবে দিয়েছিল রায়হান। লাগেজ গুছিয়ে ওজন করা হয়ে গেছে দেখে ব্যাকপ্যাকে নিয়েছিল জিনিসটা। মুহুর্তেই মুখে হাসি ফুটে উঠলো বুশরার। ডিজিটাল চিঠিই সই, ক্ষতি কি। বরং ফিরতি চিঠির জন্য দিনের পর দিন অপেক্ষা করতে হবে না। এ তো বরং শাপে বর।

মেঘের উপর
১৪ই মার্চ, ২০২২
প্রিয়তমেষু,
চিঠি তো লিখতে বললেন কিন্তু আমার কাছে যে নোটবুক, কলম কিচ্ছু নেই। ডিজিটাল যুগে ডিজিটাল চিঠি লিখতে বসেছি তাই। আপনি কি জানেন আপনি বড় পাষাণ? আচ্ছা একবার “যেওনা” বললে কি খুব বেশি ক্ষতি হতো? মেঘের ভেলায় ভেসে প্রতি মুহুর্তে কত যোজন যোজন দূরে চলে যাচ্ছি বলুন তো? আচ্ছা, আমাকে কি আপনার মনে পড়বে? আমি কি সত্যিই আপনার জীবনে বিশেষ কেউ হতে পেরেছি?
কয়েক ঘন্টা আগেও মনে হচ্ছিলো কত কথা বলা বাকি থেকে গেছে। অথচ দেখুন, কি লিখবো বুঝতে পারছি না। আসলে পরীক্ষা ছাড়া আগে কখনো চিঠি লিখিনি তো। অবশ্য প্রাপক থাকলে তবে তো। আচ্ছা শুনুন। সরি পড়ুন। এনাউন্সমেন্ট হচ্ছে, প্লেন দুবাই ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করবে কিছুক্ষণের মধ্যেই। বিদায় নিচ্ছি আপাতত।
খুব মনে পড়ছে সবাইকে। আপনাকে।
ভালো থাকবেন।

ইতি
আপনারই।

অনেকটা সময় ধরে এইটুকুন চিঠি লিখে ড্রাফট করে ডিভাইসটা আবার ব্যাকপ্যাকে রেখে দিলো। ততক্ষণে প্লেন ল্যান্ড করেছে দুবাইয়ের মাটিতে। অন্য যাত্রীদের সাথে গুটিগুটি পায়ে অপরিচিত একটা দেশের মাটিতে পা রাখলো বুশরা।

বেশ কয়েক ঘন্টার ট্রানজিট এখানে। এয়ারপোর্টের মধ্যেই একটা কফিশপে ওয়াই-ফাই জোন পেয়ে গেল বুশরা। হ্যান্ডব্যাগ থেকে আইপ্যাডটা বের করল। বেশ কাজে লাগলো আজ জিনিসটা। ফোনে টাইপ করে ইমেইল লিখলে ওই আবেগটা কাজ করতোনা হয়ত। আকাশপথে বসে লেখা চিঠিটা পাঠিয়ে দিল রায়হানের ঠিকানায়। তারপর অনির্দিষ্ট অপেক্ষা। সাথে এককাপ কফি, একলা জীবনের ক্ষণিকের সাথী। কফিতে শেষ চুমুক দিয়ে মেইলবক্স রিলোড দিল বুশরা। ফিরতি চিঠির দেখা পেয়ে হাসি ফুটে উঠলো দুচোখে। এত মায়া ঢেলে যে মানুষটা চিঠির উত্তর দিবে, কে জানতো?

ঢাকা, বাংলাদেশ
১৪ মার্চ, ২০২২
মায়াবতী,
এত অল্প সময়ে এ কি অদ্ভুত মায়ায় বেঁধে গেলে বলো তো? তোমাকে ছাড়া শেখ বাড়ি শূন্য লাগবে খুব। একটুও ফিরতে ইচ্ছা করছে না বাড়িতে। আগে বুঝিনি জানো তো? তাহলে যেতে দিতাম না। বিদায়বেলা একটু স্বার্থপর হতে ইচ্ছা করছিল। কিন্তু প্রিয় মানুষটার প্রিয় স্বপ্নপূরনে পিছুটান হতে চাই না কক্ষনো। সফল হয়ে তবেই ফিরে এসো।
অপেক্ষা করবো খুব।

ইতি,
রায়হান।

প্রায় ছয় ঘন্টার যাত্রা বিরতিতে অসংখ্যবার চিঠিটা পড়লো বুশরা। প্রতিবার মনে হচ্ছিলো এই বুঝি প্রথমবার। আসলে অল্প কয়দিনের বিবাহিত জীবনে এখনো রায়হান অতটা আবেগ প্রকাশ করেনি কখনো। যেটুকু ও বা অনুভূতি তৈরি হয়েছিল তা দানা বাধার আগেই আজ হাজার হাজার মাইল দূরে দুজনে। ঠিক এজন্যই এ সময়টাতে নব্য সংসারজীবন ফেলে আসতে চায়নি মেয়েটা। একটা ভয়, আতঙ্ক তাড়িয়ে বেড়িয়েছে ওকে। লোকে বলে “চোখের আড়াল, তো মনের আড়াল”। নিষ্ঠুর অতীতকে হৃদয়ের অতল গহীনে চাপা দিয়ে সামনে আগানো শুরু করা মানুষটাকে একলা ফেলে আসতে কিছুতেই মন সায় দিচ্ছিলো না বুশরার। রায়হানই বুঝিয়ে শুনিয়ে স্ত্রীকে রাজি করিয়েছে উচ্চশিক্ষার জন্য সাময়িক দুরত্বকে মেনে নিতে। সেই সাথে বুঝিয়েছে নিজের বাবা মা কে ও। জীবনসঙ্গী প্রেমময় হওয়ার চেয়ে বরং দায়িত্বশীল হওয়া বোধহয় অনেক বড় পাওয়া। তাই হয়ত রায়হানের প্রতি বুশরার ভাললাগা সময়ের সাথে সাথে ধাই ধাই করে উর্ধগামী হয়েছে।

আবার প্লেনে ওঠার ঘন্টাখানেক পরে ঘুম নেমে এসেছে মায়াবতীর ক্লান্ত দুচোখে। গত এক সপ্তাহ ধরে বিদেশযাত্রায় তোড়জোড় করতে শরীরটার উপর কম ধকল তো যায়নি। একদমই ঘুম হয়নি গত দুইতিনদি। বিরহ যাতনায় মনটাও কাতর। সব মিলিয়ে এখন ক্লান্তিরা আঁতকা হানা দিয়েছে সুযোগ পেয়েই। কতক্ষণ এভাবে কেটেছে বলা মুশকিল। তবে পরপর তিন চারটা সুতীব্র ঝাঁকুনিতে ঘুম উড়ে গেল বুশরার।

কোথায় আছে বুঝতে কিছুটা সময় লাগে। বিপদের গন্ধ পেয়ে শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে যায় মুহুর্তেই। ততক্ষণে এনাউন্সমেন্টে সতর্কবার্তা শুরু হয়ে গেছে। সুমিষ্ট কন্ঠের রমনীটি কি অবলীলায় বলে যাচ্ছে যান্ত্রিক গোলযোগের কথা, বিরূপ পরিস্থিতির কথা, আসন্ন বিপদের কথা, কি করতে হবে না হবে সেসব কথা। যাত্রীরা হইচই শুরু করেছে ইতোমধ্যেই। সবাই দিশেহারা।

বুশরার পৃথিবী যেন থমকে দাঁড়ায় মুহুর্তেই। নতুন জীবন শুরুর আগেই কি শেষ হয়ে যাবে? তাড়াতাড়ি ফেরার প্রতিজ্ঞা কি রাখা হবে না আর? প্রিয় মুখগুলো কি আর দেখা হবে না? আর ভাবতে পারে না বুশরা। কানের মধ্যে ভো ভো করছে। পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ার আগেই জ্ঞান হারায় মেয়েটা। যেন তলিয়া যায় অনন্ত কৃষ্ণগহব্বরে।

প্লেনের তীব্র ঝাকুনিতে আচমকা চোখ মেলে তাকালো বুশরা। বিরূপ আবহাওয়ার কারনে কিছুটা রাফ ল্যান্ডিং হয়েছে হিথ্রো ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে। তাতেই ঘুম ভেঙেছে ওর। একটু আগে যে আসলে স্বপ্ন দেখছিল তা বুঝতে পেরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো বুশরা।

চলবে…

(শুরুটা কেমন লাগলো জানাতে ভুলবেন না প্লিজ। কোন অবস্থাতেই গল্পের কোন অংশ কপি করবেন না। ভালো লাগলে শেয়ার করতে পারেন নির্দ্বিধায়)

#ডাক্তার_মিস – সিকুয়েল
#ভালবাসা_বাকি

পরের পর্বঃ https://www.facebook.com/107560794952483/posts/170328548675707/

1 COMMENT

  1. গল্পটা রিমুভ করার জন্য অনুরোধ রইলো। লেখক হিসেবে আমি চাইনা আমার গল্পটা আমার অনুমতিব্যাতীত কোথাও থাকুক।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here