ভালোবাসার চেয়েও বেশি 💞পর্ব-৫১

0
6914

#ভালোবাসার_চেয়েও_বেশি💞💞
#লেখিকা-Mehruma Nurr
#পর্ব-৫১

★ জনি সয়তানি হেসে ধীরে ধীরে নূরের এসে বসে, নূরের দিকে লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে হাতটা উঠিয়ে নূরের দিকে বাড়াতে লাগলো।
নূরের ভয়ে অন্তর আত্মা শুকিয়ে আসছে। চোখ বন্ধ করে মনে মনে ভাবে, আদিত্য কি আসবেনা? আজ কি সত্যিই আমার সব শেষ হয়ে যাবে? আর কখনো কি আমার আদিত্যকে দেখতে পাবনা?
জনির হাত নূরের ওড়নার কাছে যেতেই, হঠাৎ দরজা ভাঙার বিকট একটা শব্দ হলো।

জনি আর নূর দুজনেই চমকে তাকালো দরজার দিকে। দরজার দিকে তাকাতেই দেখলো আদিত্য রিভলবার হাতে অগ্নিমূর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আদিত্যকে দেখে নূরের দেহে প্রাণ ফিরে পেল। নূর আদিত্যের দিকে তাকিয়ে অশ্রু চোখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। হ্যাঁ ওর বিশ্বাস জিতেছে। ওর আদিত্য এসেছে ওকে বাঁচাতে। এখন আর ওর কোনো ভয় নেই।

আদিত্যকে আজ কোনো হিংস্র বাঘের মতো লাগছে। যা দেখে জনির ভয়ে পরান পাখি উড়াল দেওয়ার উপক্রম।

আদিত্য এক মূহুর্তও দেরী না করে দ্রুত গতিতে ছুটে গিয়ে জনির বুক বরাবর সজোরে একটা লাথি মেরে দিল। সাথে সাথে জনি ছিটকে ফ্লোরে চিৎ হয়ে পরে গিয়ে কাতরাতে লাগলো। আদিত্য আবার জনির কাছে গিয়ে এলোপাতাড়ি ঘুষাতে লাগলো। জনিকে মার খেতে দেখে নূরের মনে মনে অনেক শান্তি লাগছে। এই সয়তানটার সাথে এমনই হওয়া উচিত।

আদিত্য এবার জনির মাথায় রিভলবার ঠেকিয়ে ক্রুদ্ধ কন্ঠে বললো।
….তোকে বলেছিলাম না নূরের থেকে দূরে থাকবি? তারপরও তোর সাহস কি করে হলো আমার প্রাণপাখীকে টাচ করার? ওকে কষ্ট দেওয়ার? তুই কি ভেবেছিলি, আমি তোকে খুঁজে পাবনা? আমারই ভুল হয়েছে। তোর মতো কিটকে সেদিনই মেরে ফেলা উচিৎ ছিল। তাহলে আর আজ এসব হতনা। তবে এবার আর আমি সেই ভুলটা করবোনা। এবার তোকে দুনিয়া থেকে বিদায় করেই ছাড়বো। তোর মতো জানোয়ারের বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই।
কথাটা বলেই আদিত্য রিভলবারের ট্রিগারে আঙুল রাখলো।

নূর এবার অবস্থা বেগতিক দেখে, চেচিয়ে বলে উঠলো।
…..আহহহ্,,, আদিত্য।

আদিত্য মাত্রই ট্রিগারে চাপ দিতে যাবে, হঠাৎ নূরের আহাজারিতে চমকে উঠে আদিত্য। জনিকে ছেড়ে দিয়ে একছুটে নূরের কাছে আসে। নূরের কাছে বসে ওর হাত পায়ের বাঁধন খুলে দিল। তারপর দুই হাতে নূরের মুখটা ধরে উত্তেজিত হয়ে বললো।
….. কি হয়েছে প্রাণপাখী? তুমি ঠিক আছো তো? কোথাও লেগেছে? ওই সয়তান টা কিছু করেনিতো?

নূর নিজের গালে রাখা আদিত্যর দুই হাতের ওপর নিজের দুই হাত দিয়ে আদিত্যের হাতদুটো চেপে ধরে মায়া ভরা কন্ঠে বললো।
…..আদিত্য থাকতে নূরের কি কিছু হতে পারে বলো?

আদিত্য একটা প্রাপ্তির হাসি দিয়ে নূরের সারামুখে পাগলের মতো চুমু দিতে লাগলো। তারপর নূরকে বুকের মাঝে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো।
….আমি কতো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম জানো? তোমাকে না পেয়ে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিল। তোমার কিছু হয়ে গেলে যে আমার নিঃস্বাস বন্ধ হয়ে যাবে প্রাণপাখী। আমি তোমাকে ছাড়া একমুহূর্তও বাঁচতে পারবো না। মনে রাখবে তুমি আছো তো আমি আছি। তুমি নেই তো আমিও নেই।

নূরও শক্ত করে আদিত্যকে জড়িয়ে ধরে নীরবে সুখের অশ্রু ফেললো।

কিছুক্ষণ পরেই আবির আর তাসির পুলিশ নিয়ে ওখানে চলে এলো। পুলিশ এসে জনিকে উঠিয়ে নিয়ে গেল। তাসির আর আবির নূরের কাছে এসে বললো।
….তুমি ঠিক আছো নূর?

নূর তাসিরের দিকে তাকিয়ে মাথা ঝাকিয়ে বললো।
….হ্যাঁ ভাইয়া। আমি ঠিক আছি।

আবির বলে উঠলো।
…ভাবি তুমিতো আমাদের ভয়ই পাইয়ে দিয়েছিলে।

ওদের কথার মাঝে দুজন কনস্টেবল রুবিনা বেগমকে ধরে এনে ইন্সপেক্টরকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো।
…..স্যার, এই মহিলাটা পালানোর চেষ্টা করছিলো। আমরা ধরে ফেলেছি।

পুলিশের কথায় সবাই সেদিকে তাকালো।রুবিনা বেগমকে এখানে দেখে আবির আর তাসির প্রচুর অবাক হলো। তাসির আদিত্যের দিকে তাকিয়ে বললো।
….এই মহিলা এখানে কি করছে?

রুবিনা বেগমকে দেখে নূর ঘৃণা আর রাগে ফেটে পরছে। নূর রুবিনা বেগমের দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আদিত্যকে ধরে আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল। তারপর আস্তে আস্তে হেঁটে রুবিনা বেগমের সামনে গিয়ে দাড়ালো। ঘৃণার চোখে তাকিয়ে নূর রুবিনা বেগমের গালে ঠাস করে একটা চড় মেরে দিল। তারপর রাগী কন্ঠে বলে উঠলো।
….তুই শুধু মা বা নারী না। তুই একটা মানুষ নামের কলঙ্ক। তোর দিকে তাকাতেও এখন আমার ঘৃণা হচ্ছে।
নূর ইন্সপেক্টর এর দিকে তাকিয়ে বললো।
….ইন্সপেক্টর, এই মহিলা আমার মা আর দাদিকে খুন করেছে। আর আজ আমাকেও খুন করতে চেয়েছিল। একে নিয়ে জান জেলে। আর ফাঁসির দড়িতে ছুলান এই মহিলাকে।

নূরের কথা শুনে আদিত্যরা যেন হতভম্ব হয়ে গেলো। তাসির আদিত্যের দিকে তাকিয়ে বললো।
..তারমানে এই মহিলাই নূরকে এখানে নিয়ে এসেছে?

আদিত্য মাথা ঝাকিয়ে হ্যাঁ বুঝালো। আদিত্য নূরের কাছে এসে রুবিনা বেগমের দিকে তাকিয়ে বললো।
…..আপনার ওপর আমার আগেই সন্দেহ ছিল। তাইতো আপনার আর জনির নাম্বার ট্রেস করে যখন একজায়গায় দেখতে পেলাম, তখনই আমি বুঝতে পেরেছি যে আপনারা দুজন মিলেই এসব করেছেন। আপনি কি ভেবেছিলেন, সেদিন আমার প্রাণপাখীর ওপর এতো অত্যাচার করার পরেও আমি আপনাকে এমনি এমনি ছেড়ে দিয়েছি? কখনোই না। আমিতো শুধু আপনার বিরুদ্ধে প্রমাণ খুজছিলাম। যাতে আপনার সত্যিটা সবার সামনে আনতে পারি। আর নূরের নিজের সম্পর্কে ওর ভুল ধারণাটা ভেঙে দিতে পারি। আর আমি সেই প্রমাণ পেয়েও গেছি। যে হসপিটালে নূরের জন্ম হয়েছিল। আমি সেই হসপিটালের সব সিসিটিভি ফুটেজ দেখেছি। আর সেখানে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে যে আপনি নূরের মাকে বালিশ চাপা দিয়ে খুন করেছেন। আমি ভেবেছিলাম আমাদের বিয়ের পরে আপনাকে পুলিশে ধরিয়ে দেব। কারণ আমি চাই নি বিয়ের আগে নূর এসব নিয়ে কষ্ট পাক।কিন্তু আপনি যে এসব করবেন, তা জানলে আপনাকে আগেই পুলিশের হাতে দিয়ে দিতাম। এখন আপনাকে ফাঁসি থেকে কেউ বাঁচাতে পারবেনা। একটা কথা মনে রাখবেন, আমার প্রাণপাখীকে যে যে কষ্ট দিবে আমি তাদের কাওকেই ছাড়বো না।
আদিত্য পুলিশের দিকে তাকিয়ে বললো।
…নিয়ে যান ওনাকে।

পুলিশ রুবিনা বেগমকে নিয়ে চলে গেলো।

পুলিশ চলে যাওয়ার পর আবির বলে উঠলো।
….চল ভাই এখন বাসায় যাওয়া যাক।

আদিত্য মাথা ঝাকিয়ে বললো।
…..তোরা তোদের গাড়ি নিয়ে চলে যা। আমি নূরকো নিয়ে আমার গাড়িতে আসছি।

আবির মাথা ঝাকিয়ে বললো।
….ঠিক আছে।

আবির আর তাসির চলে যেতেই আদিত্য নূরকে কোলে তুলে নিয়ে বাইরে গাড়ির দিকে গেল।
——————————–
রাত ৩-৩০
গাড়ি আপন গতিতে চলছে। নূর জানালার দিকে মুখ করে নীরবে কেঁদে যাচ্ছে,যাতে আদিত্য বুঝতে না পারে। নূর জানে ওর কান্না আদিত্যর সহ্য হয়না। নূর নিজেও কান্না করতে চাচ্ছে না। কেন কাঁদবে ওই স্বার্থপর মানুষগুলোর জন্য । কিন্তু জীবনের এতবড় সত্যিটা জানার পর নূর চেয়েও ওর চোখের পানি আটকাতে পারছে না। নিজের এতদিনের জীবনটা যেন ওর কাছে মিথ্যে মনে হচ্ছে।

নূর না দেখালেও আদিত্য ঠিকই বুঝতে পারছে যে নূর কাঁদছে। আজ আর আদিত্য নূরকে থামাচ্ছ না। একটু কাঁদলে হয়তো নূরের মনটা হালকা হয়ে যাবে এটা ভেবে।
একটা নদীর পাড়ে নিরিবিলি জায়গায় এসে গাড়ি ব্রেক করলো আদিত্য। তারপর নিজের সিটবেল্ট খুলে, নূরের দিকে ঝুকে নূরের সিটবেল্ট টাও খুলে দিয়ে দুই হাতে নূরকে তুলে নিয়ে নিজের কোলে বসালো আদিত্য। বুকের ভেতর জড়িয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো।

আদিত্যের আলিঙ্গনে নূর এবার আওয়াজ করে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো। কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠলো।
….আ আমার সাথেই কেন সবসময় এমন হয় বলোনা? ওই মহিলা আমার সাথে যেমনই ব্যবহার করুক না কেন, তবুও আমি তাকে আমার মা মানতাম। আর ওই মহিলাই কিনা আমার মা আর দাদিকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে। আর আমাকে দুনিয়ার সামনে অপয়া বানিয়ে দিয়েছে। নিজেকে আজ সবচেয়ে বড়ো বোকা মনে হচ্ছে। কেন সবাই আমার সাথে এমন করে? যাকে বিশ্বাস করে আপন ভাবি সেই আমাকে এতবড় ধোঁকা কেন দেয়? আমি কি এতটাই খারাপ?

নূরের কষ্টে আদিত্যেরও প্রচুর কষ্ট হচ্ছে। আদিত্য বলে উঠলো।
….হুঁশশ, একদম না। আমার প্রাণপাখীটা কখনও খারাপ হতে পারে না। সেতো সবার থেকে বেস্ট, সবার চেয়ে স্পেশাল। খারাপ তো তারা, যারা তোমার মূল্য বুঝতে পারেনি। তোমাকে কষ্ট দিয়েছে। কষ্ট হলেও এক হিসেবে ভালোই হয়েছে,যে তুমি সত্যিটা জেনে গেছ। এখন আর তুমি নিজেকে কখনও আনলাকি ভাববে না। তাই যা হবার তা হয়ে গেছে। এখন ওসব ভুলে যাওয়ার চেষ্টা কর।

নূর মাথা তুলে আদিত্যের চোখের দিকে তাকিয়ে বললো।
….হ্যাঁ ঠিকই বলেছো। আমি ভুলে যেতে চাই সবকিছু। আমি আমার অতীতের কিছুই মনে রাখতে চাই না। কিছুই না,কাওকে না। তুমি আমার অতীত ভুলিয়ে দিতে সাহায্য করবে প্লিজ? আমি শুধু তোমাকে মনে রাখতে চাই। তোমার হয়ে তোমার জন্য বাঁচতে চাই। তুমি ছাড়া আর কিছুই চাই না আমি।

আদিত্য দুই হাতে নূরের মুখটা ধরে বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে নূরের চোখের পানি মুছে দিয়ে মায়া ভরা কন্ঠে বললো।
…..বাচ্ অনেক কেঁদেছ, আর না। এখন কান্না বন্ধ করো প্লিজ। তুমি চিন্তা করোনা, আমি তোমার জীবন থেকে সব খারাপ স্মৃতি ভুলিয়ে দেব।আজকে আমাদের নতুন জীবনের শুরু হতে যাচ্ছে। যেখানে কোনো দুঃখ কষ্ট থাকবে না। থাকবে শুধু হাসি আনন্দ আর ভালোবাসা। সেখানে তোমার অতীতের কালো ছায়া তোমাকে ছুতেও পারবে না। আই প্রমিজ ইউ দ্যাট।

নূর আদিত্যের বুকে মাথা রেখে আবারও কাঁদতে লাগলো। আদিত্য বলে উঠলো।
….দেখ এখন যদি কান্না বন্ধ না করো, তাহলে কিন্তু আমি চলে যাবো এখান থেকে।

আদিত্যের কথা শুনে নূর আদিত্যের পিঠের টিশার্ট খামচে ধরে, আদিত্যকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে করুন সুরে বলে উঠলো।
…..না না, তুমি আমাকে ছেড়ে কোথাও যাবে না প্লিজ।
নূর মাথা তুলে আদিত্যের দিকে তাকিয়ে তড়িঘড়ি করে নিজের চোখের পানি মুছে বললো।
……এ এই দেখ আমি আর কান্না বন্ধ করে দিয়েছি। আমি আর কাদবোনা। সত্যিই বলছি। তবুও তুমি যেওনা প্লিজ।

আদিত্য নূরকে আবার বুকের মাঝে জড়িয়ে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বললো।
….আমিতো মজা করছিলাম পাগলি। তোমাকে ছেড়ে কোথায় যাবো আমি? আমার সব রাস্তা যে তোমার কাছে এসেই শেষ হয়। অনেক কেঁদেছ, এবার একটু শান্ত হও। নাহলে কিন্তু বিয়ের সাজে তোমাকে একদম পঁচা লাগবে দেখতে।

আদিত্যের কথায় নূর মুচকি হাসলো। আদিত্যও মুচকি হেসে নূরের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো।

এভাবে থাকতে থাকতে একসময় নূর আদিত্যের বুকেই ঘুমিয়ে পরে। আদিত্য নূরের দিকে তাকিয়ে দেখে নূর ঘুমিয়ে পরেছে। আদিত্য একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে মুচকি হেসে নূরের গালে হাত রেখে, বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে গালে আলতো করে স্লাইড করে মায়া ভরা চোখে নূরের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। ঘুমন্ত অবস্থায় নূরকে কতো মায়াবী লাগছে। এই নিস্পাপ মায়াবী মেয়েটাকে কেউ কিভাবে কষ্ট দিতে পারে? কথাটা ভেবে আদিত্যের খুব খারাপ লাগে। আদিত্য নূরের কপালে চুমু দিয়ে আবারও বুকের ভেতর জড়িয়ে নিলো। তারপর নূরকে কোলে রেখেই আস্তে করে গাড়ি চালাতে লাগলো। যাতে নূরের ঘুম না ভাঙে।

ফার্মহাউসে এসে আদিত্য নূরকে কোলে নিয়েই গাড়ি থেকে নেমে বাসার ভেতর যায়।
রাত অনেক হওয়ায় সবাই যার যার রুমে সুয়ে আছে। আবির আর তাসির এসে সবাইকে আগেই সবটা বলে দিয়েছে। তাই সবাই নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমিয়ে পরেছে।
আদিত্য নূরকে নিয়ে সোজা নূরের রুমে গিয়ে বেডের ওপর আস্তে করে শুইয়ে দিল। তারপর নূরের কপালে চুমু দিয়ে বিড়বিড় করে বললো।
……ঘুমাও প্রাণপাখী। ঘুম থেকে উঠে আমাদের জীবনের নতুন শুরু হবে। তুমি সারাজীবনের জন্য আমার হয়ে যাবে।
আদিত্য মুচকি হেসে রুম থেকে বেড়িয়ে গেলো।
—————————
সকাল ৭টা
আদিত্য তাড়াতাড়ি করে ফ্রেশ হয়ে রুম থেকে বেড়িয়ে আসে। রাতে নূরের নিখোঁজ হওয়ার জন্য এমনিতেই ঘুমাতে পারেনি। তারপরও যেটুকু সময় শুতে পেরেছে তখনও আদিত্যের কিছুতেই ঘুম আসেনি। শুধু এপাশ ওপাশ গড়াগড়ি করে ছটফট করেছে। ওর যেন সময়ই কাটছে না। কখন সেই মুহূর্ত আসবে, যখন নূর আর ও স্বামী স্ত্রী হবে।

আদিত্য বাইরে এসে দেখলো শুধু বড়রা ছাড়া তেমন কেউই নেই। অনেকে এখনো ঘুম থেকে ওঠেনি। আদিত্য আবিরের রুমে এসে দেখলো, আবির আর তাসির উপর হয়ে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে এখনো।

আদিত্য কয়েকবার ডাক দিলো ওদের। তবুও ওদের কোনো হেলদোল নেই। আদিত্য এবার বিরক্ত হয়ে আবিরের পাছায় একটা লাথি মেরে দিল। লাথি খেয়ে আবির উল্টে ফ্লোরে পরে গেলো। সাথে তাসিরও।

ফ্লোরে পরেই আবির ধড়ফড়িয়ে উঠে চেচিয়ে বললো।
….ওমাগোওওওও ভূমিকম্প শুরু হয়ে গেছে। মাগো কোথায় তুমি? বাঁচাও তোমার ছেলেকে। তোমাকে নাতী পুতী দেওয়ার আগেই তোমার ছেলে শহীদ হয়ে গেলো মা। তানি বেবি কোথায় তুমি? তোমার ভবিষ্যৎ বাচ্চাদের বাবা, বাসর করার আগেই মরে গেল।

আদিত্য চরম বিরক্ত হয়ে ধমক দিয়ে বললো।
….শাট আপ ইডিয়েট। এভাবে চিল্লাছিস কেন?

আবির এবার ভালো করে এদিক ওদিক তাকিয়ে আবার নিজের দিকে তাকিয়ে দেখলো না ও মরেনি এখনো বেঁচেই আছে। আবির আদিত্যর দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে বললো।
….এসব কি ভাই? সকাল সকাল এভাবে কেউ জাগায়?

…তো কি করবো? কখন থেকে ডেকে যাচ্ছি ওঠার নামই নেই তোদের। হাতির মতো পরে পরে ঘুমাচ্ছিস। বলি আজ যে আমার বিয়ে সেটা কি তোরা ভুলে গেছিস?

তাসির বলে উঠলো।
…আরে রাতে এতকিছুর জন্য শুতে শুতে অনেক রাত হয়ে গিয়েছিল। তাইতো একটু ঘুমচ্ছিলাম। আর তাছাড়া বিয়েতো সেই রাতে। এতো সকাল সকাল উঠে কি করবো?

আদিত্য একটু থতমত খেয়ে বললো।
….হ্যাঁ তো?রাতে বিয়েতো কি হয়েছে? বিয়ে বাড়ি কতো কাজ আছে সেগুলো কে করবে? আর রেডি হতেও তো সময় লাগবে তাইনা?

আবির বলে উঠলো।
….ভাই যে সময় আছে তাতে চার পাঁচবার রেডি হয়ে বিয়ে করে বাচ্চাও পয়দা করা যাবে। এতো ডেস্পারেট হওয়ার কি আছে? আসল কথা বলো যে, তোমার তড় সইছে না। শুধু শুধু আমাদের ঘুমটা ভেঙে দিলে।
কথাটা বলে আবির আর তাসির হাসতে লাগলো।

আদিত্য গলা খাঁকারি দিয়ে বললো।
….হইছে আর দাঁত কেলিয়ে হাসতে হবে না। তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে বাইরে আয়।
কথাটা বলেই আদিত্য বেড়িয়ে গেলো।
————————————-

বিয়ে বাড়ির তোড়জোড় ফুলদমে শুরু হয়ে গেছে। সবাই যার যার মতো রেডি হতে ব্যাস্ত। পার্লার থেকে মেয়েরা এসে নূরকে রেডি করছে । আর আবির তাসির আর সায়েম আদিত্যকে রেডি হতে সাহায্য করছে। ওরা নানারকম কথা বলে হাসাহাসি করছে। আদিত্য হঠাৎ দরজার দিকে তাকাতেই ওর হাসি বন্ধ হয়ে গেলো। কারণ দরজায় নূরের বাবা দাঁড়িয়ে আছে। নূরের বাবাকে এখানে দেখে আদিত্য অনেক অবাক হলো। নূর বাবার দিকে তাকিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বললো।
…..আপনি?

নূরের বাবা বিনয়ী সুরে বললো।
….হ্যাঁ আমি। তুমি যদি কিছু মনে না করো, তাহলে তোমার সাথে একটু কথা ছিল।

আদিত্য কিছুক্ষণ চুপ থেকে তারপর বাকিদের চোখের ইশারায় বাইরে যেতে বললো। সবাই বুঝতে পেরে রুম থেকে বেড়িয়ে গেলো। আদিত্য নূরের বাবার দিকে তাকিয়ে বললো।
….ভেতরে এসে বসুন।

নূরের বাবা ভেতরে এসে সোফায় বসলো। আদিত্য নূরের বাবার সামনাসামনি সোফায় বসে বললো।
…..বলুন কি বলতে চান? তবে একটা কথা আগেই বলে রাখি। আপনি যদি এখানে আপনার স্ত্রীকে ছাড়ানোর কথা বলতে এসে থাকেন। তাহলে বলবো আপনার চেষ্টা নিরর্থক। কারণ আমি ওই মহিলাকে কিছুতেই ছাড়বো না।

নূরের বাবা বললো।
….না না তুমি ভুল ভাবছ। আমি সেজন্য আসিনি। ওর মতো জঘন্য মহিলাকে আমি কেন ছাড়াতে বলবো, যে আমার স্ত্রী আর মাকে খুন করেছে?

….তাহলে কি বলতে এসেছেন?

….আমি নূরের ব্যাপারে কথা বলতে এসেছি।

আদিত্য ভ্রু কুঁচকে বললো।
….মানে?

….আসলে কিভাবে কোথাথেকে শুরু করবো বুঝতে পারছি না। আমি জানি আমি জীবনে অনেক অন্যায় করেছি। বিশেষ করে নূরের সাথে। নূরের মাকে আমি অনেক ভালোবাসতাম। নূরের জন্মের সময় যখন ওর মা মারা গেল, তখন আমি পুরোপুরি ভেঙে পড়েছিলাম। নিজেকে কিছুতেই সামলাতে পারছিলাম না। নূরকে যখন আমার সামনে নিয়ে আসলো। তখন ওকে দেখে আমার খুব রাগ হলো। মনে হলো নূরকে জন্ম দিতে গিয়েই আমার স্ত্রী মারা গেল। তানা হলে হয়তো আমার স্ত্রী বেচে থাকতো। এসব ভেবে প্রথম প্রথম নূরকে দেখলেই আমার রাগ হতো। তাই ওকে আমার সামনে আসতে মানা করতাম। যাতে আমি ওর সাথে কোনো খারাপ ব্যবহার না করে ফেলি। আমি জানতাম যে আমি যেটা করছি সেটা ঠিক না। কিন্তু তবুও আমার হাতে কিছু ছিল না। নূরকে দেখলেই আমার মৃত স্ত্রীর কথা মনে পরে যেতো। মায়ের চাপাচাপিতে রবির মাকে বিয়ে করলাম। ভাবলাম হয়তো আমি না পারি কিন্তু অন্য কেউ তো মেয়েটার খেয়াল রাখতে পারবে। কিন্তু ওই মহিলার মনে যে এসব ছিল সেটা আমি বুঝতেই পারিনি। প্রথম প্রথম রাগের জন্য নূরের সামনে না আসলেও পরবর্তীতে নূর বড়ো হওয়ার পর নিজের অপরাধ বোধের জন্য লজ্জায় ওর সামনে যেতাম না। তবে দূর থেকে আমি আমার দায়িত্ব পালন করার চেষ্টা করতাম। আমার ছোটভাই মানে নূরের চাচাকে সবসময় বলতাম নূরের দেখাশোনা করতে। নূরের পড়াশোনার জন্য যত টাকা লাগতো সব আমি ওকে দিতাম নূরকে ওর নাম করে দেওয়ার জন্য। রবির মায়ের কাছেও আমি নূরের হাত খরচের জন্য টাকা দিয়ে যেতাম। রুবিনা যে নূরের সাথে খারাপ ব্যবহার করে সেটা আমি কিছুটা জানতাম, তবে পুরোটা না। আমি রুবিনাকে অনেকবার বুঝিয়েছি নূরের সাথে খারাপ ব্যবহার না করে। রুবিনা তখন কেঁদেকেটে মেলোড্রামা শুরু করে দিত। আমি রুবিনাকে বেশি করে শাসন করতে পারি না।কারণ আমার ব্যাবসার কাজে বেশির ভাগই বাইরে থাকতে হয়। আমি যদি রুবিনাকে বেশি শাসন করি তাহলে সেই রাগও ও নূরের ওপর ঝাড়বে। আমি ভাবতাম রুবিনা হয়তো সৎ মা দেখে নূরের সাথে ভালো করে মিশতে পারে না। কিন্তু ওই মহিলা যে এতো জঘন্য তা জানলে কখনোই ওকে বিয়ে করতাম না।

এতক্ষণ নূরের বাবার কথাগুলো শুনে আদিত্য অনেক অবাক হলো। লোকটাকে যতটা খারাপ ভেবেছিল, লোকটা ততটাও খারাপ না। আদিত্য একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো।
…..তো এসব কথা এখন আমাকে কেন বলছেন? আমার কাছে কি চান আপনি?

নূরের বাবা অপরাধী সুরে বললো।
….আমি জানি আমি যতযাই বলিনা কেন, আমার অপরাধ কমে যাবে না। তুমি সেদিন ঠিকই বলেছিলে আমি একটা কু পিতা। যে তার ফুলের মতো মেয়েটার খেয়াল রাখতে পারিনি। তবে আমি অনেক খুশি যে তুমি ওর জীবনে এসেছ। তোমাকে সেদিন দেখেই আমি বুঝতে পেরেছি যে তুমিই ওকে সবচেয়ে ভালো রাখতে পারবে। তোমার চোখে নূরের জন্য ভালোবাসা দেখতে পেয়েছি । তাইতো তোমাকে সেদিন আমি আটকাইনি। আমি জানি নূর তোমার সাথে অনেক সুখে থাকবে। আমি জানি আমি বাবা হওয়ার যোগ্য না। তাইতো নূরের সামনে কখনো যাইনা। তবে আজ কেন জানি আমার মেয়েটাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। আজ ওর বিয়ে, ওঁকে বঁধু বেশে দেখার জন্য আমি নিজেকে আটকাতে পারিনি। তাই এখানে ছুটে চলে এসেছি।

নূরের বাবা আদিত্যের সামনে হাতজোড় করে বললো।
…. তুমি যদি অনুমতি দেও, তাহলে আমি ওকে একবার শুধু দেখতে চাই। আমি ওকে একবার দেখেই চলে যাবো। সত্যি বলছি।
কথাগুলো বলতে বলতে নূরের বাবার চোখে পানি চলে এলো।

আদিত্য নূরের বাবার হাত ধরে বললো।
….আরে আরে কি করছেন? আপনি আপনার মেয়ের সাথে দেখা করবেন, এতে আমার কাছে পারমিশন নেওয়ার কি আছে?

…..দরকার আছে।তুমিইতো ওর আসল গার্জিয়ান। আমি এত বছরেও যা করতে পারিনি। তুমি এই কয়দিনেই সেটা করে দেখিয়েছ। তাই তোমার অনুমতি ছাড়া কিভাবে দেখা করতে পারি।

আদিত্য মুচকি হেসে বললো।
…..ঠিক আছে আপনি দেখা করুন। আজকের দিনে আপনাকে দেখে নূরও অনেক খুশি হবে। আর হ্যাঁ আপনাকে চলে যেতে হবে না। বিয়ের অনুষ্ঠানে আপনি থাকলে নূর সবচেয়ে বেশি খুশি হবে। আর ওর খুশি আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

নূরের বাবা মাথা ঝাকিয়ে সায় জানিয়ে বললো।
…..আমার মেয়েটা সত্যিই অনেক ভাগ্যবতী, যে তোমার মতো জীবনসঙ্গী পেতে চলেছে।

আদিত্য মুচকি হেসে বললো।
….নূরের চেয়ে বেশি আমি নিজেকে লাকি মনে করে নূরকে পেয়ে।

আদিত্য সানাকে ডেকে পাঠালো। সানা আসলে আদিত্য নূরের বাবাকে দেখিয়ে সানাকে বললো।
….. সানা শোন, উনি নূরের বাবা। উনাকে নূরের কাছে নিয়ে যা। আর হ্যাঁ উনার সাথে নূরকে একা কথা বলার সুযোগ করে দিস।

সানা একবার অবাক হয়ে নূরের বাবার দিকে তাকালো। তারপর মাথা ঝাকিয়ে বললো।
….ঠিক আছে ভাইয়া।

আদিত্য নূরের বাবার দিকে তাকিয়ে বললো।
….ও আমার বোন। আপনি ওর সাথে যান। ও আপনাকে নূরের কাছে নিয়ে যাবে। আমার এখন ওখানে যাওয়া যাবে না। সবাই নানান রকম কথা বলবে। তাই আপনি ওর সাথেই যান।

নূরের বাবা মাথা ঝাকিয়ে বললো।
…..ঠিক আছে।

তারপর নূরের বাবা উঠে সানার সাথে নূরের রুমের দিকে গেল।

——

নূরকে আয়নার সামনে বসিয়ে পার্লারের মেয়েরা রেডি করছে। তানি আর নিশিও আছে। সানা রুমে এসে নূরকে বললো।
….ভাবি তোমার সাথে কেউ দেখা করতে এসেছে।

নূর ভ্রু কুঁচকে বললো।
….আমার সাথে আবার কে দেখা করতে আসলো?

….নিজেই দেখে নেও।
কথাটা বলে সানা দরজার সামনে থেকে সরে গেল। আর নূরের বাবা সামনে এগিয়ে এলো।

নূর ওর বাবাকে এখানে দেখে থমকে গেল। ওর বাবা এখানে আসবে এটা কখনো আশা করেনি নূর। সত্যি না স্বপ্ন দেখছে বুঝতে পারছে না নূর।
নূরের বাবাকে দেখে তানিও প্রচুর অবাক হলো। সানা পার্লারের মেয়েগুলোকে বাইরে যেতে বললো। তানিকে ইশারায় বাইরে যেতে বললো। তারপর সানা সহ সবাই বাইরে চলে গেলো।

নূরের বাবা ধীরে ধীরে নূরের সামনে এসে দাড়ালো। নূর যেন রিয়্যাকশন দেওয়া ভুলে গেছে।কি বলবে কিছুই বুঝতে পারছে না। আসলে কখনো ওর বাবার সাথে সেভাবে কথাই হয়নি। তাই মুখ দিয়ে কিছুই বের হচ্ছে না। শুধু চোখ দুটো দিয়ে অঝোরে পানি পরছে।
নূরের বাবার চোখেও পানি চলে এসেছে। নূরের দিকে তাকিয়ে অপরাধী সুরে বলে উঠলো।
….আমি জানি আমি তোমার সাথে অনেক অন্যায় করেছি। যার কোনো ক্ষমা নেই। আমি বাবা নামের কলঙ্ক। তবুও পারলে এই পঁচা বাবাটাকে ক্ষমা করে দিও।

নূর এবার ওর বাবাকে জড়িয়ে ধরে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো। কাঁদতে কাঁদতে বললো।
….কি বলছো বাবা? বাবা মা কখনো ছেলেমেয়েদের কাছে ক্ষমা চায় না। এতে যে আমার পাপ হবে। যা হবার তা হয়ে গেছে। ওসব বলে লাভ নেই। তুমি আজ এখানে এসেছ এতেই আমি খুশি।

কিছুক্ষণ পর নূরের বাবা নূরের চোখের পানি মুছে দিয়ে বললো।
….. কাদিস না মা, নাহলে আদিত্য আমার ওপর রেগে গিয়ে বলবে যে, আমি ওর নূরকে কাঁদিয়েছি। বিয়ের আগেই জামাই আর শশুরের ভেতর যুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে।

বাবার কথা শুনে নূর অশ্রু চোখে হেসে দিল। আজ যেন ওর খুশির ঠিকানা নেই। নিজেকে আজ পরিপূর্ণ মনে হচ্ছে। কোনো কিছুরই আর অভিযোগ নেই জীবন থেকে।

চলবে……….
(আপনার হয়তো জানেন না গল্প পড়ে আপনাদের দেওয়া অভিব্যক্তি গুলো লেখক লেখিকারদের কতটা উৎসাহ দেয়। সারাদিন এতো কষ্ট করে এতো বড়ো বড়ো পার্ট দেই। আর আপনারা কমেন্ট করতে এতো কিপ্টামি করেন। তাই এখন থেকে আমিও ছোট ছোট পর্ব দেব। 😤😤)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here