#ভালোবাসার_চেয়েও_বেশি💞💞
#লেখিকা-Mehruma Nurr
#পর্ব-২৯
★ গানের শেষের দিকে এসে হঠাৎ প্রচুর ভীড় বেড়ে গেল। করতালি আর সিটি বাজানোর শব্দে চারিদিকে মুখরিত হয়ে গেলো। সবাই আদিত্যের নাম ধরে চিল্লাতে লাগলো।
অতিরিক্ত ভীড়ের কারণে নূরকে দেখতে পাচ্ছে না আদিত্য। মাথা উঁচিয়ে দেখার চেষ্টা করছে।কিন্তু কিছুতেই চোখে পরছে না। আদিত্যের একটু চিন্তা হতে লাগলো। কোনরকমে গান শেষ করে তাড়াতাড়ি করে স্টেজ থেকে দৌড়ে নেমে এলো। কিন্তু আসতেই আরেক ভেজালে পরলো।সবাই আদিত্যকে ঘিরে ধরলো সেলফি নেওয়ার জন্য। আদিত্যর প্রচুর বিরক্তি লাগছে এসব। এদের কারণে ও নূরের কাছে যেতেই পারছে না। আদিত্য কোনরকমে ভীড় ঠেলেঠুলে সরিয়ে বেড়িয়ে যায়।
আদিত্য দৌড়ে এসে দেখে নূর তখন যেখানে বসা ছিল সেখানে নেই। আদিত্যের চিন্তা আরো বেড়ে যায়। ও এদিক ওদিক তাকিয়ে নূরকে খোঁজার চেষ্টা করছে। কিন্তু অতিরিক্ত ভীড়ের কারণে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। আদিত্য মনে মনে ভাবে, হয়তো তানিদের কাছে গেছে। আদিত্য তানিরা যেখানে বসেছিল দৌড়ে ওইদিকে যায়।
তানিদের কাছে এসে দেখে নূর এখানেও নেই। আদিত্য ওদের দিকে তাকিয়ে বললো।
…..নূর কোথায়? নূরকে দেখেছো তোমরা?
আদিত্যর শুনে সবাই ভ্রু কুঁচকে আদিত্যের দিকে তাকালো। তাসির উঠে দাঁড়িয়ে চিন্তিত স্বরে বললো।
…নূর কোথায় মানে? নূর তো তোর সাথেই ছিল। তোদের দুজনকে তো একসাথেই আসতে দেখলাম।
আদিত্য বললো।
….হ্যাঁ আমার সাথেই ছিল। এখানে আসার সাথে সাথেই আমাকে স্টেজে চলে যেতে হয়। আমি ওকে বলেছিলাম তোদের কাছে এসে বসতে। কিন্তু নূর হয়তো তোদের কাছে আসতে পারেনি, তাই পেছনের দিকে বসেছিল। আমি এখন যেয়ে দেখছি ও ওখানে নেই। তাই ভাবলাম নিশ্চয় তোদের কাছে এসেছে তাইনা?
তানি অতি চিন্তিত স্বরে বললো।
….কিন্তু ভাইয়া নূরতো এখানে আসেনি।
আদিত্যের চিন্তা এবার ভয়ে পরিণত হচ্ছে। কেমন জানি অজানা ভয়ে বুকটা দুরুদুরু করছে। আদিত্য কম্পিত কণ্ঠে বললো।
….আ আসেনি মানে? এখানে না আসলে কোথায় যাবে?
আদিত্যের অবস্থা বুঝতে পেরে তাসির ওকে আস্বস্ত করার জন্য বললো।
…আরে চিন্তা করিস না তুই। হয়তো আশেপাশেই কোথাও আছে। নূরকে ফোন কর, তাহলেই জানা যাবে ও কোথায় আছে।
তাসিরের কথায় আদিত্য মাথা ঝাকিয়ে সায় জানালো।তাড়াতাড়ি ফোনটা বের করে নূরের নাম্বারে ফোন দিল। কল যাচ্ছে কিন্তু নূর ফোন রিসিভ করছে না। এভাবে একসময় কলটা কেটে গেল,কিন্তু নূরের ফোন রিসিভ হলো না।
আদিত্যের ভয় আরো বেড়ে গেল। গলা শুকিয়ে আসছে ওর। শুকনো গলায় ঢোক চিপে আবারও নূরের নাম্বারে ফোন দিল।এভাবে চার পাঁচবার দেওয়ার পরেও নূরের ফোন রিসিভ হলো না। আদিত্য অস্থির হয়ে এক হাত দিয়ে নিজের মাথার চুল শক্ত করে টেনে ধরে অন্য হাত দিয়ে নূরের নাম্বারে কল করছে আর বিরবির করে বলছে।
…পিক আপ,পিক আপ। পিক আপ দা ফোন ড্যাম ইট।
আদিত্য ভয়ার্ত দৃষ্টিতে সবার দিকে তাকিয়ে বললো।
…..ফ ফফোন রিসিভ করছে না।
আদিত্যের কথায় বাকি সবাইও চিন্তায় পড়ে গেল। তাসির আদিত্যের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো।
…..আরে এত আওয়াজে হয়তো নূর ফোনের রিংটোন শুনতে পাচ্ছে না। অথবা নূর ওয়াসরুমেও যেতে পারে। তুই অযথা চিন্তা করিস না। একটা কাজ করি আমরা সবাই আলাদা আলাদা হয়ে চারিদিকে নূরকে খুঁজি। নিশ্চয় কেউ না কেউ ওকে পেয়ে যাবো।
তারপর তানির দিকে তাকিয়ে আবার বলে উঠলো।
…তুমি যেয়ে লেডিস ওয়াশরুম গুলোতে খোঁজ।
তানি মাথা ঝাকিয়ে সায় দিল।
তাসিরের কথায় আদিত্য নিজের মনকে কোনরকমে বুঝ দেওয়ার চেষ্টা করছে।তাসির ঠিকই বলেছে। হয়তো আশেপাশেই কোথাও আছে নূর। এখুনি পেয়ে যাব হ্যাঁ। আদিত্য নিজের মনকে এসব সাতপাঁচ দিয়ে বুঝ দিলেও, নূরকে না দেখা পর্যন্ত কিছুতেই ও শান্তি পাচ্ছে না।
তাসিরের কথামতো সবাই চারিদিকে খোঁজা শুরু করে দিল নূরকে। তানি আর সানা ক্যাম্পাস ক্যাম্পাসের সব লেডিস ওয়াশরুম গুলাতে চেক করছে। তাসির আর আবির স্টেজের চারপাশে খুঁজছে। আর আদিত্য পাগলের মতো সব ক্লাসরুমে খুঁজছে। আর নূরের নাম্বারে বারবার ফোন দিয়ে যাচ্ছে। এই আশায় যে,নূর একসময় ফোন রিসিভ করে ওর মিষ্টি কন্ঠে হ্যালো বলে উঠবে।আর আদিত্য একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবে। কিন্তু না, এমন কিছুই হচ্ছে না।
প্রায় আধাঘন্টা পর সবাই আবার মাঠের ভেতর একত্রিত হলো। সবার চোখে মুখেই হতাশার ছাপ। কারণ ওরা কেওই নূরকে খুঁজে পায়নি। আদিত্য ওদের কাছে দৌড়ে এসে অস্থির হয়ে বললো।
….কিরে? তোরা নিশ্চয় নূরকে খুঁজে পেয়েছিস তাইনা? কোথায় ও বলনা?
তাসির হতাশা ভরা চেহারায় মাথা ঝাকিয়ে বললো।
….নারে আমরা কেউ নূরকে পায়নি।
নূরকে পায়নি, কথাটা যেন আদিত্যের কানে বারবার বাজতে লাগলো। ভয়ে ওর হাত পা অবশ হয়ে আসছে। বুকের ভেতর কেমন জ্বালা শুরু হয়ে গেলো। দম যেন বন্ধ হয়ে আসছে। আদিত্য দুই হাত দিয়ে নিজের চুল টেনে ধরে ধীরে ধীরে একপা একপা করে পেছাতে পেছাতে এদিক ওদিক তাকিয়ে অস্বাভাবিক ভাবে বলে উঠলো।
…..প প পায়নি মানে? কোথায় চলে গেলো নূর? এতো অল্প সময়ের মাঝে একটা মানুষ কিভাবে গায়েব হয়ে যেতে পারে? আসমান খেয়ে ফেললো, নাকি মাটি গিলে ফেললো?
তারপর পিছনে থাকা একটা চেয়ারে জোরে লাথি দিয়ে চিল্লিয়ে বললো।
…..হাউ ড্যাম ইট? হাউ?
তাসির এগিয়ে গিয়ে আদিত্যের ঘাড়ে হাত দিয়ে বললো।
….রিলাক্স আদি। এতো হাইপার হওয়ার দরকার নেই। এমনতো হতে পারে যে বাসায় চলে গেছে। আমাদেরকে বলার সময় পায় নি। তুই তো জানিসই ওর বাসার অবস্থা কেমন। হয়তো ওর সৎ মায়ের ভয়ে তাড়াতাড়ি করে আমাদের না বলেই চলে গেছে। আর কোনো কাজে ব্যাস্ততার জন্য হয়তো ফোনটাও ধরছে না।
তাসিরের কথায় আদিত্য একটা আশার আলো দেখতে পেল। আদিত্য তানির দিকে তাকিয়ে বললো।
…তুমিতো নূরের বাসা চেন। চলো আমরা এখুনি নূরের বাসায় যাবো।
তানি মাথা ঝাকিয়ে বললো।
….ঠিক আছে চলেন।
আদিত্য তাসিরের দিকে তাকিয়ে বললো।
….তোরা ক্যাম্পাসেই আবারও খুজতে থাক। আর হ্যাঁ স্টেজে উঠে মাইকেও একটা এনাউন্সমেন্ট করে দিস।আমি তানিকে নিয়ে নূরের বাসায় যাচ্ছি।
তাসির মাথা ঝাকিয়ে বললো।
….ঠিক আছে তুই যাহ।আমরা এদিকে দেখছি। তুই চিন্তা করিস না।
আবির বললো।
….ভাই আমিও তোদের সাথে যাচ্ছি।তোর এখন মন মানুষিকতা ঠিক নেই। গাড়ি আমি চালিয়ে নিয়ে যাবো।
আদিত্য মাথা ঝাকিয়ে সায় জানালো। তারপর ওরা তিনজন তাড়হুড়ো করে গাড়ি নিয়ে বেড়িয়ে পড়লো নূরের বাসার উদ্দেশ্যে।
গাড়িতে আদিত্য শুধু আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছে। নূরের বাসায় যেয়ে যেন নূরকে বাসায়ই দেখতে পায়। নূরের কিছু হয়ে গেলে যে ও নিজেও বাচবেনা। নূর ওর নিঃশ্বাসের সাথে মিশে গেছে। নূরকে ছাড়া আদিত্যের বেচে থাকা অসম্ভব।
কিছুক্ষণ পরে ওরা নূরের বাসার সামনে চলে আসে। গাড়ি থামতেই আদিত্য তাড়াহুড়ো করে নেমে পরে। তারপর তানির পিছুপিছু নূরের বাসার দিকে যেতে থাকে। বুকের ভেতর প্রচন্ড ধড়ফড় করছে আদিত্যের। মনে মনে বারবার শুধু আল্লাহর কাছে একটা জিনিসই চাচ্ছে। নূর যেন ওর বাসায়ই থাকে।
নূরের বাসার দরজায় আসতেই আদিত্যের সব আশা মাটিতে মিশে যায়। নূরের বাসার দরজায় তালা ঝুলানো দেখে আদিত্যের পায়ের নিচ থেকে মাটি স্বরে যায়। আদিত্য কাপা কাঁপা হাতে তালাটা ধরে। তারমানে নূর বাসায়ও আসেনি। তাহলে কোথায় গেল আমার নূরপাখি। কোথায় খুজে পাবো এখন ওকে? ও কি কোনো বিপদে পরেছে? কেও কিছু করেনিতো আমার নূরপাখির সাথে? এসব ভেবে আদিত্যের শরীর কেমন যেন অবশ হয়ে আসে। নিজের ব্যালেন্স রাখতে না পেরে আদিত্য পরে যেতে নিলেই আবির দৌড়ে এসে ওর কাঁধে হাত দিয়ে ধরে ফেলে। তারপর বলে ওঠে।
…ভাই নিজেকে সামলা। এতো ভেঙে পরলে চলবে না। আমাদের নূরকে খুঁজে বের করতে হবে। চল ক্যাম্পাসে যাই। নূর নিশ্চয় ক্যাম্পাসেই কোথাও আছে। আমরা পেয়ে যাব। তুই চিন্তা করিস না।
আদিত্য কোনো কথা না বলে দৌড়ে গাড়ির দিকে গেল। আবির আর তানিও ওর পিছে গেল। তিনজনই গাড়িতে উঠে তাড়াতাড়ি করে আবার ক্যাম্পাসে চলে আসে।
ক্যাম্পাসে এসে আদিত্য গাড়ি থেকে নেমে দৌড়ে ভেতরে যায়। তাসিরের কাছে যেয়ে জিজ্ঞেস করে নূরকে পেয়েছে কি না? তাসিরের জবাব শুনে আদিত্য আবারও নিরাশ হয়। কি করবে কিছুই মাথায় আসছে না।
আদিত্য নিজেকে একটু শুক্ত করে তাসিরের দিকে তাকিয়ে বললো।
….চল সিকিউরিটি রুমে যাই। সিসিটিভি ফুটেজ দেখলেই বোঝা যাবে নূর ক্যাম্পাসের বাইরে গিয়েছিল কি না।
তাসির মাথা ঝাকিয়ে বললো।
…হ্যাঁ এটা গুড আইডিয়া। চল দেখে আসি।
আদিত্য আবির আর তাসির গেল সিসিটিভি ফুটেজ দেখতে। সিসিটিভি ফুটেজে কোথাও নূরকে ক্যাম্পাসের বাইরে যেতে দেখা গেলোনা। তারমানে নূর ক্যাম্পাসের ভেতরেই কোথাও আছে।
আদিত্য ওর পরিচিত পুলিশের লোককে ফোন করে নূরের নাম্বার ট্রেস করে জানাতে বললো। কিছুক্ষণ পরে পুলিশ জানালো নূরের নাম্বার ক্যাম্পাসের ভেতরেই দেখাচ্ছে। আদিত্য সবার উদ্দেশ্যে বললো।
….নূর ক্যাম্পাসের ভেতরেই কোথাও আছে। আমরা ভালো করে খুজলেই পেয়ে যাব। আমি চাইলে এখুনি পুলিশ ফোর্স আনতে পারি। কিন্তু এতে করে নূরের পরে বদনাম হতে পারে। তাই আমাদেরই খুঁজে বের করতে হবে।
সবাই মাথা ঝাকিয়ে সায় জানালো। তারপর সবাই সারা ক্যাম্পাস তন্নতন্ন করে খুঁজতে লাগলো।
আদিত্য পাগলের মতো সব জায়গায় খুজতে লাগলো। নূরকে না পেয়ে ওর বুকের অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে। মনে হচ্ছে কিছু একটা কামড়ে ধরে আছে। হয়তো দমটাই বন্ধ হয়ে যাবে এখন।
—————————————
পিটপিট করে চোখ খোলার চেষ্টা করলো নূর। মাথাটা প্রচন্ড ভারী হয়ে আছে। নূর মাথায় হাত দিয়ে চোখ দুটো খুলে এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করলো ও এখন কোথায়। নূর চারপাশে তাকিয়ে দেখলো এটাতো কোনো নির্মাণাধীন বিল্ডিং মনে হচ্ছে।
নূর চোখ বড়ো বড়ো করে ঝট করে উঠে বসলো। ভয়ে ওর সারা শরীর থরথর করে কাপছে। মনে মনে ভাবছে, আমি এখানে কিভাবে এলাম? আমিতো স্টেজের সামনে উনার গান শুনছিলাম। তাহলে এখানে কখন কিভাবে আসলাম।
হঠাৎ নূরের মনে পরলো। যখন ও গান শুনছিল। আচমকা প্রচুর ভীড় বেড়ে যায়। আর ভীড়ের মাঝেই পেছন থেকে কে যেন ওর মুখের ওপর রুমাল চেপে ধরে। তারপর আর কিছু মনে নেই। এসব মনে করে নূরের হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। তারমানে ওকে কেও কিডন্যাপ করেছে? কথাটা ভাবতেই নূরের অন্তর আত্মা ভয়ে আৎকে উঠলো। কারা আমাকে নিয়ে এসেছে? আর কি চায় আমার কাছে?
হঠাৎ নূরের ওপর টর্চের লাইটের আলো এসে পড়লো। নূর ভয়ে গুটিশুটি হয়ে বসলো। নূর সামনে তাকিয়ে দেখলো তিনজন ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। ওর দিকে তাকিয়ে বিচ্ছিরি হাসি দিচ্ছে। ওদের ভেতর একজন বলে উঠলো।
….হেরোইনের তাহলে জ্ঞান ফিরেছে। এখন তো তাহলে ফিল্মটা শুরু করতে হয়। কি বলিস তোরা।কথাটা বলেই ওরা হাসা শুরু করে দিল।
নূর ভয়ে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলে উঠলো।
…..দে দেদেখুন এ একদম কাছে আসবেন না। কারা আপনারা? আর আমাকে এভাবে এখানে নিয়ে এসেছেন কেন?
আরেকটা ছেলে বলে উঠলো।
….কি বলো এসব জানেমান? কাছে না আসলে ফিল্ম কিভাবে বানাবো?
….মা মা মানে?
…..মানে হলো আমরা তোমার সাথে এখন ফিল্ম শুট করবো। হট ফিল্ম। যেখানে তুমি হবে নায়িকা আমরা হবো নায়ক। আর শুটিং শেষ হলে কয়েক মিনিটের ভেতরেই তুমি একদম ফেমাস হয়ে যাবে। কি সৌভাগ্য তোমার তাইনা?
ওদের কথা শুনে নূরের ভয়ে আত্মা শুকিয়ে আসছে। তাহলে কি আজ ওর সব শেষ হয়ে যাবে? নিজেকে কি এই হায়েনাদের হাত থেকে বাচাতে পারবে না?
—————————————
মাথার চুল দুই হাতে টেনে ধরে নিচের দিকে ঝুকে চেয়ারে চোখ বন্ধ করে স্তব্ধ হয়ে বসে আছে আদিত্য। দিন গড়িয়ে রাত হয়ে গেলো অথচ এখনো নূরকে পেলো না। নিজেকে আজ দুনিয়ার সবচেয়ে বেশি অসহায় ব্যাক্তি মনে হচ্ছে। নিজের এতো এতো ক্ষমতা থাকা সত্বেও নিজের প্রাণপাখি টাকেই খুঁজে বের করতে বের করতে পারছে না। নিজের ওপরেই চরম রাগ লাগছে আদিত্যর। আমার জন্যই সবকিছু হয়েছে। আমি যদি তখন নূরকে ওভাবে একা রেখে চলে না যেতাম, তাহলে এখন নূর আমার সাথেই থাকতো। সব দোষ আমার।
এসব ভেবে আদিত্যের রাগে সারা শরীর ফেটে যাচ্ছে। সারা শহরে আগুন জ্বালিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে।
আবির আর তাসির পাশেই দাঁড়িয়ে আছে।
তানি অনেক কান্নাকাটি করছিল।রাত হয়ে গেছে তাই আবির বুঝিয়ে শুনিয়ে তানি আর সানাকে বাসায় পাঠিয়ে দেয়। এখন ক্যাম্পাসে শুধু ওরা তিনজন ছাড়া আর কেওই নেই।
আদিত্যকে এভাবে গুম মেরে বসে থাকতে দেখে তাসিরের টেনশন হয়।তাসির আদিত্যের ঘাড়ে হাত দিয়ে বলে উঠলো।
….আদি রিলাক্স। আমরা পেয়ে যাব নূরকে। তুই চিন্তা করিস না।
আদিত্য ঝট করে দাঁড়িয়ে তাসিরের কলার চেপে ধরে রাগী স্বরে বলে উঠলো।
…..ওয়াট রিলাক্স ম্যান? ওয়াট রিলাক্স? ছয় ঘন্টা পার গেল নূরের নিখোঁজ হওয়ার। তুই বুঝতে পারছিস ব্যাপারাটা? ছয় ঘন্টা। এতো সময়ের ভেতরে নূরের সাথে কি কি হয়ে যেতে পারে, এটা ভাবতেই আমার রুহ্ কেঁপে উঠছে। আর তুই বলছিস রিলাক্স হতে?
তারপর তাসিরের কলার ছেড়ে দিয়ে ঠাস করে হাটু ভেঙে নিচে বসে পরে। ডান হাত দিয়ে বুকের বামপাশে পাঞ্জাবির অংশ খামচে ধরে কাতর গলায় বললো।
….বুকটা জ্বলে যাচ্ছে আমার তাসির। দম বন্ধ হয়ে আসছে। নূরের কিছু হয়ে গেলে আমি মরে যাবো তাসির সত্যিই মরে যাবো।
আদিত্যকে এভাবে দেখে তাসিরও হাটু ভেঙে বসে আদিত্যকে জড়িয়ে ধরে পিঠে হাত বুলিয়ে বলে উঠলো।
….কিছু হবে না নূরের। আমরা ওকে ঠিকই খুঁজে বের করবো। তুই নিজেকে সামলা। নাহলে কিভাবে হবে বল?
আবির এগিয়ে এসে বললো।
…ভাই আমাদের মনে হয় এখন পুলিশের সাহায্য নেওয়া উচিৎ। এখন নূরকে খুঁজে বের করাটাই বেশি জরুরি। পরেরটা পরে দেখা যাবে।
তাসির আদিত্যকে ছেড়ে দিয়ে বললো।
…হ্যাঁ আদি,আবির ঠিকই বলেছে। এখন আর মান সম্মানের চিন্তা করে লাভ নেই। আগে নূরকে খুঁজে বের করি। তারপর পরের টা পরে দেখা যাবে।
আদিত্য ওদের কথায় সায় জানালো। এখন নূরকে খুঁজে বের করাটাই বেশি জরুরি। আদিত্য নিজের ফোনটা বের করে পুলিশকে ফোন করতে যাবে হঠাৎ কিছু একটা মনে আসতেই আদিত্য বলে উঠলো।
….আচ্ছা আমরাতো ক্যাম্পাসের সবজায়গায় খুঁজেছি। কিন্তু ক্যাম্পাসের পিছনে যে একটা নতুন ভবনের কাজ চলছে, ওখানেতো দেখা হয়নি।
তাসির বলে উঠলো।
…কিন্তু ওখানেতো আপাতত কাজ বন্ধ আছে। আর কেউ কেন যাবে?
আদিত্য বললো।
….কেউ ইচ্ছা করে না গেলেও, অন্য কেউ কোনোভাবে নিয়েও যেতে পারে। আমাদের অবশ্যই একবার চেক করা উচিৎ।
তাসির আর আবির মাথা ঝাকিয়ে সায় জানালো। তারপর ওরা তিনজন দৌড়ে গেল ওখানে খুজতে।
——————————————
তিনজনের ভেতর একজন আরেকজনের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো।
….এই তুই মোবাইল বের করে ভিডিও করা শুরু কর। আমি এ্যাকশন করছি।
কথাটা বলেই ছেলেটা নূরের কাছে যেতে লাগলো
নূর ভয়ে কাঁদতে কাঁদতে কাকুতি মিনতি করতে করতে বললো।
…. আমকে ছেড়ে দিন প্লিজ। দয়া করে আমার এতবড় সর্বনাশ করবেন না।
ছেলেটা নূরের কথায় কোনো ভ্রুক্ষেপ না করে নূরের কাছে যেয়ে ওর হাতটা খপ করে ধরে বিচ্ছিন্ন হাসি দিয়ে বললো।
….আরে ডার্লিং এতো কান্নাকাটি করে কোনো লাভ হবে না। শুধু শুধু নিজের এনার্জি নষ্ট কোরোনা।তার চেয়ে বরং চুপচাপ আমার কথা মেনে নেও, তাতে করে তোমার আমার দুজনেরই সুবিধা হবে।
কথাগুলো বলেই ছেলেটা নূরের হাত চেপে ধরে নিজের মুখটা নূরের মুখের দিকে এগুতে লাগলো।
নূর নিজের সর্বশক্তি দিয়ে ছেলেটাকে একটা ধাক্কা মেরে ওখান থেকে স্বরে গেল। তারপর দৌড়ে ওখান থেকে পালানোর চেষ্টা করছে আর জোরে জোরে চেঁচিয়ে বলতে লাগলো।
…..বাঁচাও….. কেউ আছে? বাচাও…বাচাও…..
আদিত্যরা নির্মাণাধীন বিল্ডিংয়ে এসে সব জায়গায় তন্নতন্ন করে খুঁজছে। ওপরের দিকে আসতেই আদিত্যের হার্টবিট হঠাৎ অনেক জোরে জোরে চলতে লাগলো। আদিত্যের মনে হচ্ছে নূর আশেপাশেই কোথাও আছে।
হঠাৎ কারোর চিৎকার শুনে আদিত্যের বুকের ভেতর ধক্ করে উঠলো। এ এএটাতো নূরের আওয়াজ। তারমানে নূর এখানেই আছে। কথাটা ভাবতেই আদিত্য নূরের নাম ধরে ডাকতে যেয়েও আবার থেমে গেল। মনে মনে ভাবলো, নূরকে যদি এখানে কেউ নিয়ে এসে থাকে। তাহলে ওদের আওয়াজ শুনে পালিয়ে যেতে পারে। কথাটা ভেবেই আদিত্য আবির আর তাসিরের দিকে তাকিয়ে ঠোঁটের ওপর আঙুল রেখে চুপ থাকতে বললো। তারপর ওরা ধীর পায়ে উপরের দিকে গেল।
নূর বেশিদূর যেতে পারলো না। পেছন থেকে ছেলেটা এসে হিজাবের ওপর দিয়ে নূরের চুলের মুঠি ধরে নিজের দিকে ঘুরালো। তারপর ঠাস্ করে একটা চড় মেরে নিচে ফেলে দিল। তারপর রাগী স্বরে বললো।
….ভেবেছিলাম তোর সাথে ভালো ব্যবহার করে কাজ সারবো। কিন্তু তুই ভালো কথার মানুষ না।এখন দেখ আমি তোর সাথে কি করি?
কথাগুলো বলেই ছেলেটা নূরের কাছে যেতে লাগলো।
নূর পরে যেয়ে কপালে প্রচুর ব্যাথা পেয়েছে। আর চড় দেওয়ায় ঠোঁট ফেটে রক্তও পড়ছে। নূর সামনে তাকিয়ে দেখে ছেলেটা ওর কাছে আসছে। নূর শরীরের ব্যাথার কারণে উঠে যাওয়ার শক্তিও পাচ্ছে না। ছেলেটার কাছে আসা দেখে নূর কোনো রকমে নিজের দুই হাতে ভর দিয়ে ফ্লোরে ঘষে ঘষে পিছনে সরে যেতে থাকে। আর মাথা নেড়ে কাকুতি মিনতি করতে থাকে।
ছেলেটা বিচ্ছিরি হেসে নূরের শাড়ির আঁচলের দিকে হাত বাড়ায়।
ঠিক সেই মূহুর্তে আদিত্যরা ওখানে চলে আসে। চোখের সামনে নূরকে এভাবে দেখে আদিত্য স্তব্ধ হয়ে যায়। নিজের চোখ কেই বিশ্বাস করতে পারছে না আদিত্য। নূরকে এভাবে কখনো দেখতে হবে তা স্বপ্নেও ভাবিনি আদিত্য।
চলবে………