ভালোবাসার চেয়েও বেশি 💞পর্ব-৫৭

0
6574

#ভালোবাসার_চেয়েও_বেশি💞💞
#লেখিকা- Mehruma Nurr
#পর্ব-৫৭

★….. নূর, নূর
আদিত্য নূরের নাম ধরে ডাকতে ডাকতে দৌড়ে নিচে নেমে এলো। নিচে এসে এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখলো নূর কোথাও নেই। আদিত্যের ভয় আরো বেড়ে গেল। নূর আমার ওপর রাগ করে কোথাও চলে গেলো নাতো? নাহ্ আদিত্য আর ভাবতে পারছে না। আমার প্রাণপাখী আমাকে ছেড়ে কোথাও যেতে পারে না। কোথাও না।

আদিত্য দরজার কাছে এসে দেখলো দরজা ভেতর থেকে আটকানো। তারমানে নূর বাইরে যাইনি। কথাটা ভেবে আদিত্য একটা নিঃশ্বাস ফেললো। আদিত্য এবার দৌড়ে সিড়ি বেয়ে ছাঁদে উঠে গেলো। ছাঁদে এসে পাগলের মতো এদিক ওদিক খুজতে লাগলো। কিন্তু কোথাও নূরকে দেখতে পেল না। আদিত্যর যেন পাগল প্রায় অবস্থা। আদিত্য দুই হাত দিয়ে নিজের চুল টেনে ধরে আহত কন্ঠে বললো।
….কোথায় তুমি প্রাণপাখী? প্লিজ কাম টু মি। আই প্রমিজ, আমি সব ঠিক করে দেব। শুধু একবার আমার কাছে এস প্লিজ।

আদিত্য হঠাৎ কোথাথেকে বিড়বিড় আওয়াজ শুনতে পেল। আদিত্য ভালো করে খেয়াল করলো আওয়াজ টা কোথা থেকে আসছে। আদিত্য শব্দটা অনূসরন করে এগিয়ে গিয়ে দেখলো, নূর সিড়ি ঘরের একেবারে কোণায় হাটুর ভেতর মুখ গুঁজে বসে আছে। বসে থেকে ঢুলছে আর কি কি যেন বিড়বিড় করছে।

নূরকে দেখে আদিত্যের দেহে যেন প্রাণ ফিরে পেল। আদিত্য দৌড়ে যেয়ে নূরকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো।
….এখানে কি করছ প্রাণপাখী? জানো আমি কতো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম? তুমি জানো না,তুমি আমার চোখের আড়াল হলে আমি পাগল হয়ে যাই?

আদিত্য খেয়াল করলো নূর ওকে জড়িয়ে না ধরে আগের মতোই বসে থেকে পাগলের মতো কি কি যেন বিড়বিড় করছে। আদিত্য নূরকে ছেড়ে নূরের সামনে বসে শোনার চেষ্টা করলো নূর কি বলছে।

নূর কেমন যেন অস্বাভাবিক ভাবে বিড়বিড় করে বলছে।
…. আদিত্য শুধু আমার, ওকে কেউ কেরে নিতে পারবে না, কেউ না, আদিত্য শুধু আমার রাজকুমার, শুধু আমার।

নূরের এমন অস্বাভাবিক আচরণ দেখে আদিত্যের ভয় লাগছে। ওর প্রানপাখি এমন করছে কেন? আদিত্য দুই হাত দিয়ে নূরের মুখটা আগলে ধরে উপরে তুলে বললো।
…হেই প্রাণপাখী, কি হয়েছে তোমার? দেখ আমি এখানেই আছি তোমার কাছে। প্লিজ প্রানপাখী যা দেখেছ ওগুলো সব ভুল। ওই নিরা কখন পেছন থেকে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরেছে আমি বুঝ,,,,

আদিত্যের কথা শেষ হওয়ার আগেই নূর আদিত্যের হাত টেনে ধরে ওর পাশে কোনার ভেতর দেয়ালের সাথে চেপে বসিয়ে দিল। তারপর আদিত্যের সামনে দিয়ে নিজের হাতটা আড়াআড়ি ভাবে দিয়ে, অস্বাভাবিক ভাবে বললো।
…..তু তুমি না এখানেই থাক। আমি তোমাকে এখানেই লুকিয়ে রাখবো। এ এখান থেকে তোমাকে কেউ কেড়ে নিতে পারবে না। কেউ না। আমি কাওকে নিয়ে যেতে দেব না তোমাকে।

নূরের এমন অস্বাভাবিক আচরণ দেখে আদিত্যের বুকটা ফেটে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে বুকের ভেতর কেউ ছুড়ি চালিয়ে দিয়েছে। ওর প্রাণপাখীটার এমন অবস্থা ওর কিছুতেই সহ্য হচ্ছে না। আদিত্য বুঝতে পারছে যে নূর তখন ওইসব দেখে ওর মন মস্তিষ্ক অনেক অশান্ত হয়ে আছে। তাই ও এমন অস্বাভাবিক আচরণ করছে।

আদিত্য দুই হাতে নূরের মুখটা আগলে ধরে আবেগি স্বরে বললো।
…..প্লিজ কলিজাটা, শান্ত হও একটু। দেখ আমি তোমার কাছেই আছি। কেউ আমাকে তোমার কাছ থেকে কেড়ে নিতে পারবে না। কেউ না।

নূর তবুও শান্ত হচ্ছে না। নূর এবার দুই হাত দিয়ে আদিত্যের মুখটা ধরে পাগলের মতো বলতে লাগলো।
…..প্লিজ আমাকে ছেড়ে যেওনা প্লিজ। তুমি যা বলবে আমি তাই করবো। আমি তোমার দাসী হয়ে থাকবো। তুমি যখনি আমাকে কাছে চাইবে, আমি তখনই ধরা দেব। কখনও মানা করবো না। তবুও আমাকে ছেড়ে যেওনা প্লিজ। অনেক কষ্টের পরে তোমাকে পেয়েছি। তোমাকে হারিয়ে ফেললে মরে যাবো আমি। সত্যিই মরে যাবো।

আর সহ্য করতে পারলো না আদিত্য। নূরকে শান্ত করার জন্য নূরের ঠোঁটে নিজের ঠোঁট চেপে ধরলো। অনেকক্ষণ ওভাবেই ঠোঁট চেপে ধরে রইল। নূর একটু শান্ত হয়ে আসলে, আদিত্য নূরের ঠোঁট ছেড়ে দিয়ে নূরের কপালের সাথে কপাল ঠেকিয়ে নূরের দুই গালে হাত বুলিয়ে আদুরে গলায় বললো।
……প্লিজ সোনাটা এমন করোনা। আমার কষ্ট হচ্ছে তো। তুমি ভাবলে কি করে যে আমি তোমাক ছেড়ে যাবো? সেটা বেঁচে থাকতে কখনোই সম্ভব না। তুমি তো আমার নিঃস্বাসের সাথে মিশে আছো। তুমি আছ বলেই আমার নিঃশ্বাস চলছে। তুমি না থাকলে আমার নিঃশ্বাসও বন্ধ হয়ে যাবে। আর তোমার সাহস কি করে হলো মরার কথা বলার হ্যাঁ? খবরদার যদি আর কখনও এই কথা বলেছ তো আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবে না।

নূর কেঁদে উঠে আদিত্যকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। আদিত্যও তার প্রাণপাখীকে শক্ত করে তার বুকের ভেতর আঁকড়ে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো।

একটু পরে নূর শান্ত হয়ে আসলে, আদিত্য নূরকে কোলে তুলে নিল। নূর আদিত্যের গলা জড়িয়ে ধরে বুকে মাথা রাখল। আদিত্য নূরকে কোলে নিয়ে সিড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলো। সিড়ি থেকে নেমে করিডরে আসতেই আদিত্য সামনে তাকিয়ে দেখলো নিরা সামনে দাঁড়িয়ে আছে।

নিরা এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওদের অপেক্ষায় করছিল। এটা দেখার জন্য যে ওর প্ল্যান সফল হলো কিনা। কিন্তু আদিত্য আর নূরকে এভাবে দেখে নিরার প্ল্যানে যেন এক বালতি পানি ঢেলে পড়লো। নিরা মনে মনে ভাবলো, ওদের তো এতক্ষণে আলাদা হয়ে যাওয়ার কথা। তাহলে ওরা একসাথে কি করছে?

নিরাকে এখানে দেখে আদিত্যের দমে থাকা রাগটা আবার জ্বলে উঠলো।এই মেয়েটার জন্য আমার প্রাণপাখীর আজ এই অবস্থা হয়েছিল। কথাটা ভেবে আদিত্যর রাগে ওর মাথা ফেটে যাচ্ছে। তবে এখন ও নূরের সামনে কিছু বলতে চায়না। কারণ এমনিতেই নিরার জন্য নূরের মনমানসিকতা ঠিক নেই। তাই এখন ওর সামনে কোনো সিনক্রিয়েট করতে চায় না।

আদিত্যর এভাবে দাঁড়িয়ে যাওয়া দেখে নূর মাথা তুলে একবার আদিত্যর দিকে তাকালো। তারপর আদিত্যের চোখ অনুসরণ করে সামনে তাকিয়ে দেখলো নিরা দাঁড়িয়ে আছে। নিরাকে দেখেই নূর আরো শক্ত করে আদিত্যের গলা জড়িয়ে ধরে, বাচ্চাদের মতো চোখ ঘুচি করে নিরার দিকে তাকালো। যেন নিরা এখনই ওর কাছ থেকে আদিত্যকে কেড়ে নিবে।

নিরা মুখ খুলে কিছু বলতে নিলেই আদিত্য ওকে থামিয়ে দিয়ে চোয়াল শক্ত করে বললো।
…..স্টপ, নট এ সিঙ্গেল ওয়ার্ড।
কথাটা বলেই আদিত্য নূরকে নিয়ে ওদের রুমে চলে গেলো।

আর নিরা নিজের প্ল্যান ফেল হওয়ার রাগে ফুঁসতে লাগলো।

আদিত্য নূরকে নিয়ে এসে বিছানায় শুইয়ে দিল। তারপর নিজেও ওর পাশে বালিশে কনুুই ঠেকিয়ে শুয়ে নূরের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। নূর আদিত্যের পেট জড়িয়ে ধরে বললো।
….তুমি ওই মেয়েটার কাছে একদম যাবে না। ও খুব পঁচা। তোমাকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিতে চায়। তুমি ওর একদম কথা বলবে না। একদম না।

আদিত্য মুচকি হেসে বললো।
…আমার প্রাণপাখি থাকতে আমি অন্য কারোর কাছে কেন যাবো? তুমি ছাড়া আমার আর কিছুই চাই না । এখন এসব কথা বাদ দিয়ে একটু ঘুমাও।নাহলে মাথা ব্যাথা করবে। আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি।

একটু পরে নূর আদিত্যকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পরলো। নূর ঘুমিয়ে পরলে আদিত্য নূরের কপালে চুমু দিয়ে নূরের গালে হাত বুলিয়ে মায়া ভরা চোখে নূরের দিকে তাকিয়ে রইলো। আমার প্রাণপাখীটা কখন আমাকে এতো পাগলের মতো ভালোবাসে ফেললো? কথাটা ভাবতেই আদিত্য একটা তৃপ্তির হাসি দিল।

আদিত্য নূরকে আস্তে করে নিজের থেকে ছাড়িয়ে ঠিক করে শুইয়ে দিয়ে, গায়ের ওপর চাদর টেনে দিল। তারপর আস্তে করে রুম থেকে বেড়িয়ে গেলো। এখন যে ওর আরেক জনের সাথে বোঝাপড়া আছে।

আদিত্য নিরার রুমের সামনে এসে দরজায় নক করলো। কিছুক্ষণ পরে নিরা এসে দরজা খুলে দিল। দরজা খুলে আদিত্যকে দেখে নিরা একটু অবাক হলো। আদিত্য কিছু না বলে ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল।

এটা দেখে নিরা খুশিতে যেন হাতে চাঁদ পেয়ে গেল। নিরা মনে মনে ভাবছে, আদিত্য ওর সাথে দেখা করতে এসেছে।তারমানে আদিত্যও ওকে পছন্দ করে। কথাটা ভেবে নিরা আবেদনীয় ভঙ্গিতে বলে উঠলো।
….আমি জানতাম তুমিও আমাকে পছন্দ কর। তাই তো এতরাতে আমি সাথে দেখা করতে এসেছ। আর হবেই না বা কেন, কোথায় আমার মতো স্মার্ট একটা মেয়ে। আর কোথায় তোমার ওই ক্ষ্যাত মার্কা ব,,,,

বাচ আর বলতে পারলো না নিরা। আদিত্য সজোরে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিল নিরার গালে। নিরা থাপ্পড় খেয়ে নিরা নিচে ফ্লোরে পড়ে গেল। আদিত্য নিরারা সামনে বসে নিরার চুলের মুঠি ধরে অগ্নি চোখে তাকিয়ে রাগী স্বরে বললো।
…কি বললি তুই? আমি আর তোকে পছন্দ করবো? আরে পছন্দ তো দূরের কথা তোর মতো থার্ড ক্লাস মেয়েকে তো আমি আমার বাসার কাজের লোকও রাখবো না। নূর যদি আমার জীবনে নাও আসতো তবুও আমি কখনো তোকে বিয়ে করতাম না। তুই কি ভেবেছিলি আমি তোর সম্পর্কে কিছু জানি না? তুই যে কতবড় ক্যারেক্টর লেস মেয়ে, তাকি আমি জানি না ভেবেছিস? তোকে শুধু সহ্য করি এই কারণে যে তুই বাবার বোনের মেয়ে। নাহলে তোকে আমি এবাড়িতে কখনো ঢুকতেই দিতাম না।

কিন্তু তোর আজকের এই নির্লজ্জকর কার্যকর্মে আমাকে সেই কথাও ভুলিয়ে দিতে বাধ্য করেছে। আমি কখনও কোনো মেয়ের গায়ে হাত তুলিনা। কিন্তু তুই আজকে আমাকে সেটাও করতে বাধ্য করেছিস।

আদিত্য নিরার চুলের মুঠি ধরে ঝাকিয়ে ঝাকিয়ে এসব কথা বলছে। আর নিরা ব্যাথায় ছটফট করে আদিত্যের কাছ থেকে ছাড়া পাওয়ার চেষ্টা করছে। আদিত্যর এমন ভয়ংকর রুপ ও এর আগে কখনো দেখিনি। নিরার ভয়ে অন্তর আত্মা কেঁপে উঠছে।

আদিত্য আবার বলে উঠল।
….তোর সাহস কি করে হলো আমাকে টাচ করার? আমার প্রাণপাখিকে কষ্ট দেওয়ার? তোর জন্য আমি আমার প্রাণপাখীকে এমন অবস্থায় দেখেছি, যে কথা মনে পরলে এখনো আমার বুক কাপছে। আজ তোর জন্য ও এতো কষ্ট পেয়েছে। তোকে তো আমি কিছুতেই ছাড়বো না।
কথাটা বলেই আদিত্য নিরার গলা চেপে ধরে বললো।
…তুই আমাকে ভালোবাসিস তাইনা? আজকে তোর সব ভালোবাসা আমি ঘুচিয়ে দেব।

নিরা যন্ত্রণায় ছটফট করছে। মুখ নীল হয়ে যাচ্ছে। নিরা কথা বলতে না পারায় দুই হাত জোর করে আদিত্যের কাছে অনুনয় করল ওকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য।

শেষমেশ আদিত্য ওঁকে ছেড়ে দিল। নিরা ছাড়া পেয়ে কাশতে লাগলো। আদিত্য রাগী স্বরে বলে উঠলো।
….এখন রাতের বেলা দেখে তোকে বের করে দিলাম না। তবে কাল সকালের সূর্য ওঠার আগেই তুই এখান থেকে বিদায় হবি। আমার প্রাণপাখী যেন সকালে উঠে তোর মুখ না দেখে। খবরদার আর কখনো তোর এই চেহারা আমাদের দেখাবি না। নাহলে কিন্তু দ্বিতীয় বার আর জানে বাচবি না।

কথাগুলো বলেই আদিত্য উঠে চলে যেতে নিল। দরজা পর্যন্ত যেয়ে আবার ফিরে এসে বললো।
….একটা কথা সবসময় মনে রাখবি। যে যে আমার প্রাণপাখীকে কষ্ট দিবে, আমি তাদের কাউকে ছাড়বো না।
কথাটা বলেই আদিত্য চলে গেলো।

নিরা বসে বসে কাশতে লাগলো। বেচারি জানে বেচে গেছে এটাই অনেক। আর দরকার নেই কিছু।

আদিত্য রুমে এসে নূরকে বুকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়লো।
——–

সকাল ৮-৩০
সবাই ডাইনিং টেবিলে ব্রেকফাস্ট করতে বসেছে। আদিত্যের বাবা বলে উঠলো।
….নিরা কোথায় দেখছি না যে? বাসায় চলে গেছে নাকি?

সানা বলে উঠলো।
….কিজানি বাবা সকাল থেকে তো দেখিনি। মনে হয় চলে গেছে।

আদিত্য খেতে বলে উঠলো।
….বাবা আমাদের এখন ওই বাসায় যাওয়া উচিৎ। বিয়ের জন্য নূরের ভার্সিটি আর আমার অফিসও অনেক দিন মিস হয়ে গেছে। তাই আমাদের যেতে হবে।

আদিত্যের বাবা বললো।
…..ঠিক আছে, তোরা যেটা ভালো মনে করিস। তা কখন বের হবি?

…এইতো বাবা একটু পরেই বের হবো।

নূর বলে উঠলো।
…বাবা আপনারাও চলুন না? আমার একা একা ভালো লাগবে না।

….নারে মা আমি এখানেই ভালো আছি। আর তোমার যখনই খারাপ লাগবে এখানে চলে আসবে।

ব্রেকফাস্ট শেষে একটু পরে আদিত্য আর নূর সবার কাছে বিদায় নিয়ে বেড়িয়ে পরলো ওদের বাসার উদ্দেশ্যে

—–

দেখতে দেখতে দুই সপ্তাহ পার হয়ে গেছে। এই দুই সপ্তাহে নূরের জীবন কোনো স্বর্গের চেয়ে কম কাটেনি। আদিত্যর ভালোবাসা আর কেয়ারে নূর যেন সুখের সপ্তম আকাশে ভাসছে। আদিত্যর ফাইনাল এক্সাম শেষ, তাই ও এখন শুধু অফিসেই যায়। আদিত্য রোজ অফিসে যাওয়ার সময় নূরকে ভার্সিটি নামিয়ে দিয়ে যায়। আবার আসার সময় নূরকে নিয়ে আসে। বাসায় যতক্ষণ থাকে ততক্ষণ আদিত্যের রোমাঞ্চের মিটার সবসময় চালুই থাকে।

শুধু আদিত্য আর নূর না, আবির -তানি,তাসির-সানা ওদের প্রেমও ভালোই চলছে। সায়েমও নিশির সাথে রিলেশনে চলে গেছে।

রাত ১০ টা
নূর বেলকনিতে গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আকাশের চাঁদ দেখছে। একটু পরেই দুটো হাত এসে ধীরে ধীরে নূরের কোমড় জড়িয়ে ধরলো। নূর জানে এই দুটো কার। এটা আর কেউ না ওর রাজকুমার। আদিত্য নূরের ঘাড়ে নাক ডুবিয়ে ঘ্রাণ টেনে নিয়ে নেশা ভরা কন্ঠে বললো।
….আমার প্রাণপাখীটা এখানে কি করছে?

নূর নিজের মাথাটা আদিত্যের বুকে এলিয়ে দিয়ে মুচকি হেসে বললো।
….চাঁদ দেখছে।

….আমাকে না নিয়ে একা একাই চাঁদ দেখছ?

…তুমিতো ফোনে কথা বলছিলে তাই ডিস্টার্ব করিনি।

ফোনের কথা শুনে আদিত্যর মুখের এক্সপ্রেশন পাল্টে গেল। আদিত্য একটু সিরিয়াস হয়ে বললো।
….একটা কথা বলার ছিল তোমাকে।

…হুম বলোনা।

….আসলে আজকে কোর্টের রায় এসেছে। জনির চৌদ্দ বছরের জেল হয়েছে, আর রুবিনা বেগমের ফাঁসির অর্ডার হয়েছে। কালকেই তাকে ফাঁসি দেওয়া হবে।

রুবিনা বেগমের ফাঁসির কথা শুনে নূর কিছুক্ষণের জন্য চুপ হয়ে গেলো। ওর ভেতর কেমন ফিলিংস হচ্ছে ও বুঝতে পারছে না। কেমন রিয়্যাকশন দেওয়া উচিৎ তাও বুঝতে পারছে না। ওই মহিলা যেমনই হোক, নূরতো তাকে নিজের মা ভেবেছিল। তাই হয়তো একটু খারাপ লাগছে ওর।

আদিত্য নূরের মনের অবস্থা বুঝতে পারছে। তাই নূরের মনকে ফ্রেশ করার জন্য বলে উঠলো।
…… প্রাণপাখী, আমার সাথে বাইক রাইডে যাবে?

…এখন? এই রাতের বেলায় বাইক রাইডিং?

…হুম, রাতের বেলায়ই বাইক রাইডিং এর আসল মজা পাওয়া যায়। তুমি একবার চল। দেখবে কত মজা হয়। এখন যাও রেডি হয়ে আস।

নূর মুচকি হেসে বললো।
….ঠিক আছে।

কিছুক্ষণ পরে নূর নীল রঙের লেগিস আর পিংক কালারের একটা কুর্তি পরে গলায় ওড়না স্কাপের মতো পেচিয়ে রেডি হয়ে বের হলো। আদিত্যও নীল জিন্স আর ব্লাক টিশার্টের উপর একটা মেরুন রঙের লেদার জ্যাকেট পরেছে।

একটু পরে দুজন বের হয়ে বাইকে উঠে বসলো। নূর আদিত্যের পেছনে বসে হাত দিয়ে আদিত্যের কোমড় জড়িয়ে ধরলো। আদিত্য মুচকি হেসে বাইক স্টার্ট দিল।

আধাঘন্টা ধরে বাইক চালিয়ে ওরা শহরের কোলাহল থেকে বেড়িয়ে এলো।রাতের আবছা আলো, আর চারপাশের শো শো বাতাস নূরের গায়ে লাগতে মনটা শিহরিত হয়ে গেলো। আদিত্য সত্যিই বলেছে, রাতের এই রাইডটা আসলেই অনেক ভালো লাগে।

বাইক চালাতে চালাতে ওরা অনেক দূর নির্জন নিরিবিলি নদীর কিনারার পাশ দিয়ে যাওয়া রাস্তায় চলেছে। একটু পরে আদিত্য হঠাৎ বাইক থামিয়ে দিল। বাইক থামিয়ে দেওয়ায় নূরের ঘোর কাটলো। নূর ভ্রু কুঁচকে বললো।
….কি হলো থামালে কেন? আমরা কি এখানে নামবো?

….না এখানে নামবো না।

…তাহলে?

…বলছি, আগে নেমে দাঁড়াও।

নূর আদিত্যের কথামতো নিচে নেমে দাড়ালো। আদিত্য একটু পেছন দিকে সরে গিয়ে বসে বললো।
….এখন সামনে এসে বস।

নূর কনফিউজড হয়ে বললো।
…মানে?

…মানে, তুমি এখন আমার সামনে বসবে।

…কিন্তু আমি সামনে বসবো কিভাবে? আর আমি সামনে বসলে তুমি বাইক কিভাবে চালাবে?

…উফফ,তুমি না অনেক প্রশ্ন করো। দাঁড়াও এখুনি দেখাচ্ছি।
কথাটা বলেই আদিত্য দুই হাত দিয়ে নূরের কোমড় ধরে উঁচু করে নূরকে সামনে নিজের দিকে মুখ করে বসালো। তারপর নূরের পা দুটো নিজের কোমড় পেচিয়ে পেছনে ক্রস করে দিয়ে আটকে দিল। আদিত্য নূরের কোমড় জড়িয়ে ধরে বললো।
….আমার অনেক শখ ছিল নিজের বউকে এভাবে সামনে বসিয়ে বাইক রাইড করবো। এতক্ষণ শহরের লোকজনের ভেতর ছিলাম, তাই সামনে আনিনি। তবে এদিকে কোনো লোকজন নেই তাই আর সমস্যা নেই। তোমার কোনো সমস্যা নেই তো এভাবে বসতে?

নূর লাজুক হেসে মাথা ঝাকালো। মানে কোনো সমস্যা নেই। আদিত্য তৃপ্তির হাসি দিয়ে আবার বাইক স্টার্ট দিল। নূর আদিত্যের গলা জড়িয়ে ধরে কাঁধে মাথা রেখে মুহূর্তেটা উপভোগ করছে। আর আদিত্য নূরের কাঁধের উপর দিয়ে সামনে তাকিয়ে অনেক স্লো গিয়ারে বাইক চালাচ্ছে। যাতে কোনো দূর্ঘটনা না হয়। নূরের মূহুর্তটা সত্যিই অনেক বেশি ভালো লাগছে। যা ভাষায় প্রকাশ করার নয়। আদিত্য ওঁকে রোজ নতুন নতুন সুখের খোঁজ দেয়। যে সুখের কথা ও কখনো কল্পনাও করেনি।

এসব ভাবতে ভাবতে নূর যেন এক ঘোরের ভেতর চলে গেলো। নূর হঠাৎ আদিত্যের গলা ছেড়ে দিয়ে ধীরে ধীরে চিৎ হয়ে বাইকের বনেটের উপর শুয়ে পরলো। দুই হাত দুই দিকে পাখির মতো ছড়িয়ে দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলো। ওর মনে হচ্ছে ও যেন হাওয়ায় ভাসছে। নিজেকে সত্যি সত্যিই পাখি মনে হচ্ছে।

নূরকে এভাবে এনজয় করতে দেখে আদিত্যের মনটাও খুশি হয়ে গেলো। আদিত্য দুষ্টু হেসে বললো।
….প্রাণপাখী, এভাবে আমাকে পাগল করলে তো এক্সিডেন্ট করে ফেলবো।

নূর ঘোরের মাঝেই বলে উঠলো।
….হলে হোক, তুমি পাশে থাকলে আমার কোনো কিছুর ভয় নেই।

নূরের কথায় আদিত্য একটা তৃপ্তির হাসি দিল। এভাবে আরো কিছুক্ষণ ঘুরে ওরা আবার বাসার দিকে ব্যাক করলো। নূর এখনো আদিত্যের সামনেই বসে আছে।
রাত অনেক হওয়ায় আর ঠান্ডা বাতাসের জন্য নূরের চোখ ভারী হয়ে আসছে। নূর আদিত্যকে জড়িয়ে ধরে আদিত্যের কাধে মাথা রেখেই ঘুমিয়ে গেল।

নূরের শরীর ঢিলা হয়ে আসায় আদিত্য বুঝতে পারলো নূর ঘুমিয়ে পরেছে। আদিত্য সাথে সাথে বাইক থামিয়ে দুই হাতে নূরের মাথাটা সামনে এনে দেখলো নূর সত্যি সত্যিই ঘুমিয়ে পরেছে। আদিত্য ঠোঁট কামড়ে হেসে মনে মনে বললো। হায়রে আমার ঘুম পাগলী বাইকের ওপরও ঘুমিয়ে পরেছে। আদিত্য নূরের কপালে চুমু দিয়ে ওর মাথাটা আবার নিজের কাঁধে রাখলো। তারপর নূরের গলার ওড়নাটা দিয়ে ভালো করে নূরকে নিজের সাথে পেচিয়ে বেধে নিল। যাতে নূর পড়ে না যায়। তারপর আবার বাইক স্টার্ট দিয়ে বাসায় চলে এলো। অনেক রাত হওয়ায় রাস্তায় তেমন লোকজন ছিল না। তাই আর অসুবিধা হয়নি। বাসায় এসে আদিত্য বাইক থামিয়ে আস্তে করে নূরকে কোলে নিয়ে ভেতরে ঢুকলো।

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here