ভালোবাসি আমি যে তোমায় পর্ব: ১৬

0
2555

#ভালোবাসি_আমি_যে_তোমায়
#Sohani_Simu
পর্ব: ১৬

ভার্সিটিতে এসেছি ৩ঘন্টা হলো এখনও শৈবালের মুখোমুখি পড়তে হয়নি।ক্লাস শেষ করে ভার্সিটি থেকে বেড়িয়ে সোজা বাসায় চলে আসলাম।আমরা আসতেই ফুপ্পি বলল,

ফুপ্পি: আরাফ দেশে ফিরছে।

ফুপ্পির কথা শুনে আমি আর ইচ্ছে দুজনই কিছুক্ষণ চুপ থাকলাম। মনের মধ্যে পুরোনো ভয় গুলো নাড়া দিচ্ছে।আরাফ ভাইয়া কি আগের মতোই আছে?যদি আবার আগের মতো করে?আমার ভাবনার মাঝেই ইচ্ছে বলল,

ইচ্ছে: কেন আসছে তোমার ছেলে?(হালকা রেগে)

ফুপ্পি: আর কতদিন এভাবে চলবে বল?..এবার ও আসুক সব ঠিক হয়ে যাবে।ও ভাল হয়ে গেছে।ও সবার সাথে দেখা করতে চাই।সবাইকে নিজের করে বাঁচতে চাই।অনেক বলার পর তোর বাবা যেতে রাজি হয়েছে।চলনা আমরা যেয়ে দেখা করে আসি।(ইচ্ছের দিকে তাকিয়ে)

ইচ্ছে: কুকুরের লেজ কোনদিন সোজা হয়না, আম্মু (তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে)।তবে আমি এখন ঢাকায় যেয়ে দুদিনের বেশি থাকতে পারবোনা।

ফুপ্পি:হুম তোর থাকার দরকারও নেই।আরাফের সাথে দেখা করে চলে আসিস ছেলেটা খুশি হবে।
ইচ্ছে:অন্ত যাবে না?
ফুপ্পি: জারিফ ফোন দিয়েছিল।অন্তকে যেন রেখে যাই সেটাই বলল।

আমি: আমি একা কিভাবে থাকবো?

ফু্প্পি:২দিন এর জন্য চাঁদ দের বাসায় থাকবি দুদিন পর তোর মা, জারিফ আর ইচ্ছে চলে আসবে।

আমি: কিন্তু ওখানেও তো একই ব্যাপার, আঙ্কেল-অ্যান্টি সারাদিন বাসায় থাকেননা আর নির্ভীক ভাইয়া কখনও থাকেন কখনও থাকেন না।

ফুপ্পি: ওখানে তুই নিরাপদ থাকবি।কমলা,জাফর সবসময় বাসাতেই থাকে আর চাঁদ খুব ভাল ছেলে। তোর কোন ভয় নেই।জারিফ যে কিছুতেই রাজি হচ্ছেনা নাহলে তোকে রেখে যেতামি না।

আমি:তোমরা কখন যাবে?(মন খারাপ করে)

ফুপ্পি: আজ রাতেই।

ইচ্ছে:ধুর…

রাতে ইচ্ছে রেডি হচ্ছে আর আমাকে এক গাদা এডভাইস দিচ্ছে।এই দিকে যে আমার মন খারাপ সেটা কি ওর চোখে পরছেনা?

ইচ্ছে: আমি দুদিন পরই চলে আসবো।তোর একা ভার্সিটি যাওয়ার দরকার নেই।

আমি:ইটস্ ওকে। আমি যেতে পারবো।(মন খারাপ করে)

ইচ্ছে: কুলাঙ্গারটার সাথে দেখা করার কোন সখ নেই আমার। শুধু মাত্র আম্মুর জন্য যাচ্ছি। তুই তো জানিসই আম্মুর হার্টের সমস্যা টেনশন করলে আরও বেশি হয়..

আমি: হুম,তাড়াতাড়ি চলে আসিস তোকে ছাড়া আমার কিছু ভাল লাগবেনা।

ইচ্ছে: হুম। আম রেডি চল নিচে যাই।
আমি: চল।

নিচে এসে দেখি ভিসি আঙ্কেল আর নির্ভীক ভাইয়া এসেছেন,ফুপ্পা-ফুপ্পির সাথে গল্প করছেন।

ফুপ্পি:অন্তকে রেখে গেলাম ভাই।

আঙ্কেল: অন্ত তো আমারই মেয়ে,ওর কোন সমস্যা হবেনা।তোমরা চিন্তা মুক্ত থাকো।

ইচ্ছে: অ্যান্টি আসেনি?

নির্ভীক: আম্মুর আজ সার্জারি আছে ফিরতে অনেক রাত হবে।

ইচ্ছে : ঠিক আছে ভাইয়া,অন্তকে দেখে রাখবেন।ও খুব ভীতু।

নির্ভীক:ওকে।(মুচকি হেসে)

ফুপ্পা: ওকে ভাই আমরা তাহলে আসি।(ভিসি আঙ্কেলের সাথে হ্যান্ডশেক করে)

আঙ্কেল: ওকে আসুন।

বাসার বাহিরে এসে ফুপ্পি আমাকে বাসার চাবি দিল তারপর ফুপ্পা ফুপ্পি গিয়ে গাড়িতে উঠলো।ইচ্ছে আমার সাথে একটা টাইড হাগ করে গাড়িতে উঠলো।গাড়ি ছেড়ে দিল।

আঙ্কেল: অন্ত মা, যাও দরকারি জিনিস সব ব্যাগে নিয়ে নাও। তারপর দরজায় তালা দিয়ে আমাদের বাসায় চলে আসো।
আমি: ওকে আঙ্কেল।

আঙ্কেল:চাঁদ তুই অন্তকে নিয়ে আয় আমি বাসায় গেলাম।

নির্ভীক: ওকে। অন্ত চলো।

আমি: হুম চলুন।

বাসার ভেতরে আসলাম।নির্ভীক ভাইয়া আমাকে সোফায় বসিয়ে দিয়ে ছাদে চলে গেলেন। ছাদের দরজায় তালা দিয়ে নিচে আসলেন। সব রুমের জানালা বন্ধ করে দরজায় তালা লাগালেন।কিচেনে এসে জানালা বন্ধ করলেন গ্যাস সিলিন্ডার এর সুইচ অফ করলেন। তারপর আমার কাছে এসে বললেন,

নির্ভীক: তোমার রুমে চলো।দরকারি জিনিস সব ব্যাগে নাও।

রুমে এসে সব দরকারি জিনিস ব্যাগে নিলাম।তারপর নির্ভীক ভাইয়াকে বললাম চলুন। কিন্তু উনি আমাকে থামিয়ে দিয়ে বেলকুনির দরজা লাগিয়ে দিলেন।তারপর টেবিল থেকে আমার ডায়েরি আর ড্রইং খাতা হাতে তুলে নিলেন।
আমি: ওগুলো লাগবেনা। রেখে দিন।

নির্ভীক: উহুম লাগবে চলো।

বলেই আমার একহাত ধরে উনার কাছে টেনে নিয়ে রুমের লাইট অফ করে দরজা লাগিয়ে দিলেন।মেইন সুইচ অফ করে মেইন গেটে তালা লাগিয়ে দিয়ে একটা দম ছেড়ে বললেন,
নির্ভীক: সব ঠিক আছে চলো যাওয়া যাক ব্যাগটা আমাকে দাও।

বলেই ব্যাগ নিয়ে নিলেন।তারপর আমার ডানহাত ধরে উনাদের বাসায় হাঁটা দিলেন।

উনাদের বাসায় এসে আমাকে উপরে লাইব্রেরির পাশের রুমে থাকতে দিলেন।আমার আর নির্ভীক ভাইয়ার রুমের মাঝখানের রুমটায় লাইব্রেরি।আমি রুমে দাঁড়িয়ে আছি।

নির্ভীক: যেকোন সমস্যা হওয়ার সাথে সাথে আমাকে জানাবে।(বেডের উপর বসে)
আমি: ওকে।

নির্ভীক: ওকে,ফ্রেশ হয়ে নিচে আসো। একসাথে ডিনার করবো।
আমি: আমি খেয়েছি আর খাবোনা।

নির্ভীক: অনেক আগে খেয়েছো এখন আমার সাথে আবার খাবে।

আমি:আমার ক্ষুধা নেই।

নির্ভীক ভাইয়া আমার দিকে ভ্রু কুচকে তাকালেন তারপর বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে আমার হাত ধরে হাটা দিলেন।ডাইনিং টেবিলে এসে উনার পাশের চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে তবেই মুখ খুললেন।
নির্ভীক: বাবা?কমলা খালা?জাফর চাচা?(চিল্লিয়ে)

কমলা : জ্বে চাঁদ বাবা?

নির্ভীক: খেয়েছো সবাই?

কমলা:ভাইজান আর সাগরের আব্বা খাইছে।আমি ভাবি আইলে খামুনে।

নির্ভীক: আম্মুর আসতে অনেক রাত হবে তুমি খেয়ে ঘুমিয়ে পড়।আসো বসো এখানে।(সামনের চেয়ারে ইশারা করে)

কমলা: তোমরা আগে খাইয়া লও আমি খামনে,অন্ত মা কি খাইবা ভাত না রুটি?(আমার দিকে তাকিয়ে)

নির্ভীক: ভাত। আমাকেও ভাত দাও।
আমি: আমি রুটি খাবো।

নির্ভীক: ওকে। খালা ওকে ভাত দাও ভাত শেষ হলে রুটি দাও।
উনার কথা শুনে আমি থ।কমলা খালা মিটি মিটি হাসছে।আর উনি সব বাটির ঢাকনা খুলে দেখছেন কি কি রান্না হয়েছে।

আমি: ওকে খালা অল্প করে ভাতই দাও, রুটি খাবোনা।(নির্ভীক ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে)

খালা আমাদের ভাত দিলেন। আমি শুধু সবজি দিয়ে খেলাম। নির্ভীক ভাইয়া মাশআল্লাহ মাছ, মাংশ, সবজি, ডাল সবই খেলেন।খাওয়া শেষ করে আমরা সোফায় গিয়ে বসলাম।আঙ্কেল টিভিতে নিউস দেখছেন।আমি যেতেই রিমোট আমার হাতে দিয়ে বললেন, “দেখ কোথায় দেখবে।”

আমি:না,না আঙ্কেল আপনি দেখুন।

আঙ্কেল:আমি ঘুমোবো, তোমরা দেখ।

বলেই আঙ্কেল রুমে চলে গেলেন।নির্ভীক ভাইয়া আমার হাত থেকে রিমোট নিয়ে টিভি অফ করে দিলেন। তারপর সিরিয়াস অ্যাটিটিউড নিয়ে বললেন,

নির্ভীক: আরাফের ব্যাপারটা খুলে বলো।এ টু জেড শুনতে চাই।

উনার কথা শুনে আমি একটা শুকনো ঢোক গিললাম। একমুহূর্তেই নার্ভাস হয়ে গিয়েছি।আমি চাইনা পুরোনো কথা মনে করতে।কিন্তু এই অতীত কখনও আমার পিছু ছাড়বেনা

নির্ভীক: কি হল বলো?আমি জারিফ ভাইয়ার কাছে শুনেছি কিছুটা ও তোমাকে গোডাউন এ লুকিয়ে রেখেছিল তোমার মুখে সালফিউরিক এসিড মেরেছিল।(চোঁয়াল শক্ত করে)

আমি: ভাইয়া এসব কথা থাকনা। ভাল লাগছেনা এখন এসব বলতে।

নির্ভীক ভাইয়া উঠে এসে আমার পাশে বসে আমার দুগালে হাত রেখে বললেন,

নির্ভীক: একদম ভয় পাবেনা।আই সোয়্যার, তোমার সাথে যা করেছে ও সব ফেরত পাবে।

আমি: আরাফ ভাইয়া ভয়ঙ্কর।আপনি প্লিজ উনার থেকে দূরে থাকবেন।

নির্ভীক: ওকে বাদ দেও।তবে কাল কিন্তু আরাফের সব কথা শুনবো।আমার সবটা জানা দরকার।চলো ঘুমাবে।

আমাকে রুমে দিয়ে উনি নিজের রুমে চলে গেলেন।আমি রুমের লাইট অন রেখেই শুয়ে পরলাম একটু একটু ভয় পাচ্ছি। ঘুম নেই নতুন জায়গাই আসলে আমার ঘুম আসেনা।কিছুক্ষণ এপাশ ওপাশ করে উঠে বসলাম তারপর ব্যাগ থেকে ডায়েরী বের করলাম।নির্ভীক ভাইয়া ঠিকই বলেছিলেন এটা আমার দরকার লাগবে।আমি মুচকি হেসে ডায়েরী খুলে দেখতে লাগলাম।এই ডায়েরী একটু অন্যরকম। আমার সব উদ্ভট প্রশ্ন আর তার উত্তর এখানে আছে।প্রশ্ন গুলো আমার কিন্তু উত্তর গুলো বিভিন্ন জনের কাছ থেকে সংগ্রহ করেছি।কয়েক পাতা উল্টে পাল্টে দেখে একপাতায় চোখ স্থির হলো,তিনমাস আগে একটা প্রশ্ন লিখেছিলাম এখনও পারফেক্ট উত্তর মেলেনি।প্রশ্নটা হলো, হোয়াট ইজ লাভ?আমি প্রশ্নটা কাউকে জিজ্ঞেস ও করিনি উত্তরও পাইনি। ডায়েরিটা বন্ধ করে আবার শুলাম।ফোন হাতে নিয়ে অনলাইনে গেলাম।আপু অনলাইনে আছে তাই আপুকে ভিডিও কল দিলাম।কিছুক্ষণ কথা বলে রেখে দিলাম।তখনই নির্ভীক ভাইয়ার কল আসলো।ভিডিও কল।আমি একটু অসংকোচ এ পড়ে গেলাম উঠে বসে গায়ে ওড়না দিয়ে রিসিভ করলাম।

নির্ভীক: কি করো?এখনও ঘুমাওনি কেন?

উনি বিছানায় একপাশ হয়ে শুয়ে আছেন।বেড সাইড ল্যাম্পের আলোই উনাকে অমায়িক লাগছে।

আমি: এইতো ঘুমাবো এখন।(বসে থেকে)

নির্ভীক:একা ভয় করছে?

আমি: নাহ।

নির্ভীক: লাইট অফ করোনি? এত আলোতে ঘুমোলে মাথ্যা ব্যাথা করবে। বেড সাইড ল্যাম্প অন করে লাইট অফ করো।

আমি: থাক না এভাবে।আমার সমস্যা হচ্ছেনা।

নির্ভীক: আমি আছি এখানে। কোনো ভয় নেই লাইট অফ করো।

ধুর উনি এমন কেন।লাইট অফ করলে তো আমার ভয় লাগবে তাও অফ করতে বলছেন।খাটাশ একটা।এখন অফ করছি উনি কল কাটলে আবার অন করবো।(মনে মনে)

আমি: অফ করেছি।
নির্ভীক: হুম গুড গার্ল।এখন শুয়ে পড়।
আমি: ওকে বাই।

নির্ভীক: থাকো প্লিজ।

উনার এই প্লিজ কথাটা আমি কেন যেন ফেলতে পারিনা।এত সুন্দর করে কিভাবে প্লিজ বলেন উনি?
যাইহোক উনার কথা শুনে আমিও একপাশ হয়ে শুয়ে ফোন সামনে রাখলাম।কথা বলতে বলতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি জানিনা।রাস্তা দিয়ে এম্বুলেন্স যাচ্ছিলো শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল।ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখি নির্ভীক ভাইয়া এখনও আমার দিকে তাকিয়ে আছেন।আমি ঘুমজড়ানো কন্ঠে উনাকে বললাম,

আমি: সরি ভাইয়া, আমি ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম।

নির্ভীক: ইটস্ ওকে।ঘুমাও কিন্তু কল কেটো না।

আমি: চার্জ শেষ আর একটু আছে।(চোখ বন্ধ করে)

নির্ভীক: ড্রয়ারে পাওয়ার ব্যাংক আছে ঐটা লাগাও।

উনার কথা শুনে ড্রয়ার খুলে পাওয়ার ব্যাংক নিয়ে ফোন চার্জে লাগালাম। এত কিছু করতে আমার ঘুমই ভেঙ্গে গিয়েছে।প্রায় ৩০মিনিট কথা বলে আমি আবার ঘুমিয়ে গেলাম।সকালে ঘুম ভাঙ্গলো।কিছুক্ষণ পর ফোনের কথা মনে পড়তেই ফোনের দিকে তাকালাম। নির্ভীক ভাইয়া কল কাটেননি এখনও।তবে উনি ঘুমিয়ে আছেন।ফোনের সামনে উনার মুখ পড়ে আছে।ফোনে উনার লম্বা তরতরে নাক, গোলাপি ঠোঁট আর থুতনিতে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি দেখা যাচ্ছে।কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে কল কেটে দিলাম।

চলবে………

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here