ভালোবাসি আমি যে তোমায় ২*পর্ব:১২

0
1959

#ভালোবাসি_আমি_যে_তোমায়_২
#Sohani_Simu

১০.

সূর্য অস্ত গিয়েছে এক ঘন্টা আগে।অন্ধকার ছাপিয়ে চারিদিকে কৃত্রিম আলো জ্বলে উঠেছে।মানুষজনের চলাচলে কোলাহল পূর্ণ হসপিটালের পরিবেশ।তিনতলার করিডোরের চেয়ারে নিষ্প্রাণ বসে আছে জারিফ।অত্যন্ত ধৈর্যশীল এই ছেলেটা বার বার ধৈর্যহারা হয়ে পরছে।চিন্তায় আর ভয়ে পাগল প্রায় অবস্থা।কি থেকে কি হয়েছে সে এখনও জানেনা শুধু জানে তার কলিজার টুকরো ছোটপাখি তার ছোট বোন সামনের ওই আইসিইউতে ঘুমোচ্ছে।জারিফ মাথা নিচু করে বসে ছিল হঠাৎ কাঁধে কোমল হাতের স্পর্শ পেয়ে হাতের দিকে তাকালো।হাত ভর্তি লাল টুকটুকে মেহেদী দেখে বুঝতে একটুও বাকি রইলোনা সামনে দাঁড়ানো মেয়েটি কে।জারিফ মাথা তুলে তাকালোনা।কুহেলী ধীরে ধীরে জারিফের পাশের চেয়ারে বসে শান্ত কন্ঠে বলল,
“ছোটপাখি ঠিক হয়ে যাবে,একটু সময় দাও ওকে।এত অধৈর্য হলে কি করে হবে বলো?তুমি যদি এভাবে ভেঙে পর বাবা-মার কি হবে ভেবে দেখেছো?”

জারিফ চেয়ারে হেলান দিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ধরা গলায় বলল,
“আমি ঠিক আছি।কার সাথে এসেছো?বাবা-মা কি করছে?আফ্রা কোথায়?”

কুহেলী জারিফের একবাহু ধরে আগের মতোই বলল,
“মাকে ডক্টর ঘুমের ঔষধ দিয়েছে,ঘুমোচ্ছে।আফ্রা আর বাবা, মার কাছেই আছে।আমি একা এসেছি।একটু খাবার নিয়ে এসেছি,সারাদিন কিছু খাওনি।এখন একটু খাবে চলো।”

জারিফ উঠে দাঁড়ালো।মিনিমাম দুঘণ্টা একইভাবে বসে আছে সে।একবারের জন্যও উঠে দাঁড়ায়নি।পা দুটো অবশ হয়ে গিয়েছে।ধীরে ধীরে আইসিইউ এর দরজার সামনে হেঁটে গিয়ে কাচ লাগানো অংশে চোখ রাখলো।ভেতরের দৃশ্য করুন।কুহেলী জারিফের পেছনে দাঁড়িয়ে বলল,
“ওকে নিয়ে আসো।”

জারিফ মনে মনে একটু শক্ত হল।নিজেকে একটু স্বাভাবিক করে নিয়ে আস্তে করে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো।নিঃশব্দে হেঁটে গিয়ে নির্ভীকের কাঁধে হাত রাখলো।নির্ভীক অন্তর হাত ধরে বেডের পাশে বসে ছিল জারিফকে দেখেই ধরা গলায় বলল,
“ঘুমোনোর এত জায়গা থাকতে পিচ্চিটা এখানে কেন ঘুমোচ্ছে বলোতো?মাথায় একটু লেগেছে বলে কি ছত্রিশ ঘন্টা ধরে ঘুমোতে হবে?”

জারিফ নির্ভীকের দিকে ঝুকে নরম কন্ঠে বলল,
“বাহিরে চল,কথা আছে।”

নির্ভীক অন্তর দিকে তাকিয়ে বলল,
“ওকে এখানে একা রেখে বাহিরে যাব?ঘুম ভাঙলে এসব দেখে ভয় পাবে তো।”

জারিফ অসহায় মুখ করে বলল,
“জাস্ট টু মিনিট।”

-“টু সেকেন্ডও নয়।”নির্ভীকের কাটা উত্তর।

জারিফ নির্ভীকের হাত থেকে অন্তর হাত ছাড়িয়ে নিয়ে জোড় করে নির্ভীককে টেনে বাহিরে নিয়ে আসলো।একটু দূরেই প্রান্ত আর ইচ্ছেমতি দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল।নির্ভীককে বাহিরে দেখেই ওরা দৌঁড়ে কাছে আসলো।প্রান্ত নির্ভীকের এক বাহু চেপে ধরে বলল,
“চল আমার সাথে।”

নির্ভীক প্রান্তকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল।আবার দরজা খুলতেই জারিফ ওকে ধরলো।নির্ভীক রেগে চেঁচিয়ে বলল,
“কি সমস্যাটা কি তোমাদের?আটকাচ্ছ কেন?”

জারিফ শান্ত গলায় বলল,
“সমস্যাটায় জানতে চাইছি,কি হয়েছিল রাজশাহীতে?এখনই সবটা বলবি।”

নির্ভীকের চোয়াল শক্ত হয়ে গেল।দরজার পাশে সেট করা স্টিলের চেয়ারে লাথি দিল।ইচ্ছেমতি ভীত কন্ঠে বলল,
“আমি বলি?নির্ভীক ভাইয়া হয়তো সবটা জানেননা।”

জারিফ ইচ্ছেমতির সামনে এসে ওর দুই বাহু শক্ত করে ধরে বলল,
“কি জানিস?কি করে হলো এসব?বল?”

নির্ভীক চোখমুখ শক্ত করে দরজা ঠেলে অন্তর কাছে চলে গেল।ইচ্ছেমতি শুকনো ঢোক গিলে বলা শুরু করলো,

“কাল সকাল আটটায় ঘুম থেকে উঠে দেখি ও ঘুমোচ্ছে।দশটায় ঢাকায় রওণা দেওয়ার কথা ছিল সেজন্য আমি তাড়াহুড়ো করে ফ্রেশ হয়ে ওকে ডেকে দিলাম।ঘুম থেকে উঠে এক বারে রেডি হয়ে নিচে গেল সেখান থেকে তাড়াহুড়ো করে ছাদে গেল।একটু পরই ছাদের দরজায় অনেক জোড়ে শব্দ হচ্ছিল জন্য আমি রুম থেকে বেড়িয়ে দেখি আরাফ ভাইয়া অন্তর হাত ধরে টানতে টানতে সিঁড়ি দিয়ে নামছে আর ছাদের দরজা এপাশ থেকে লাগানো অন্যপাশে নির্ভীক ভাইয়া দরজায় বারি দিচ্ছেন।ভাইয়া অন্তকে নিয়ে বাসা থেকে বেড়িয়ে আসলো।অ্যাঙ্কেল-অ্যান্টি,প্রান্ত ভাইয়া কারও কথা শুনলোনা।জোড় করে অন্তকে আর আমাকে গাড়িতে তুলে গাড়ি নিয়ে বেড়িয়ে আসলো।গাড়িতে আমি অনেকবার জানার চেষ্টা করেছি ভাইয়া কিছু বলেনি।অন্ত পুরো রাস্তা কেঁদেছে একটা কথাও বলেনি।ভাইয়া সোহেল নামের কাউকে ফোন করে বলল আমরা এখনই ঢাকায় যাচ্ছি কাজি অফিসে যেয়ে যেন বিয়ের ব্যবস্থা করে।ভাইয়া নিজের আর অন্তর বিয়ের কথা বলছিল।তখনি নির্ভীক ভাইয়া বাইক নিয়ে আমাদের গাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালেন।ভাইয়া গাড়ি থামাতেই অন্ত গাড়ি থেকে নেমে গেল।রাস্তায় অনেক গাড়ি চলছিল অন্ত গাড়ি থেকে নামতেই পেছন থেকে একটা গাড়ি ওকে ধাক্কা দেয়।প্রায় কুড়ি মিনিট পর একবার জ্ঞান ফিরেছিল শুধু তিনচার বার নির্ভীক ভাইয়াকে ডেকেছিল।তারপর দুঘন্টা পর একবার জ্ঞান ফিরেছিল ডক্টরকে নির্ভীক ভাইয়ার কথায় বলেছে। ”

জারিফ পাশের চেয়ারে ধপ করে বসলো।ইচ্ছেমতি জারিফের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে জারিফের হাত ধরে কান্না করতে করতে বলল,
“সব ওই কুকুরটার জন্য হয়েছে।কুকুরটা এটা কি করে করতে পারলো?কুকুরটা কি করে ওকে বিয়ে করতে চাইতে পারে?আই হেট হিম।তুমি ওকে পুলিশে দাও।”

জারিফ এক হাত দিয়ে কপাল ধরলো।কি করবে বুঝতে পারছেনা।আরাফ এমনটা করেছে দুনিয়া উল্টে গেলেও তার বিশ্বাস হবেনা।দুজন ডক্টর এসে হন হন করে রুমের মধ্যে ঢুকে গেলেন।একটু পর একজন মাঝ বয়সি ডক্টর বেড়িয়ে এসে রাগী কন্ঠে বললেন,
“আপনারা ছেলেটাকে আটকাচ্ছেন না কেন?এভাবে ট্রিটমেন্টে বাধা দিলে পেশেন্টকে বাঁচানো যাবেনা।নিয়ে যান উনাকে।”

প্রান্ত ভেতরে ঢুকে নির্ভীককে জোড় করে বাহিরে নিয়ে আসলো।ডক্টররা ভাল করে চেকআপ করে রুম থেকে বেড়িয়ে এসে একজনকে ডক্টরের চেম্বারে ডাকলেন।জারিফ আর নির্ভীক ডক্টরেরর সাথে কথা বলতে আসলো।মাঝ বয়সি ডক্টর গম্ভীর মুখ করে বললেন,

“পেশেন্টের কন্ডিশন আগের তুলনায় ভাল।আশা করছি রাতের মধ্যেই জ্ঞান ফিরবে।”

নির্ভীকের শুকনো মুখটা একটু সতেজ হলো।জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলল,
“অন্ত ভাল হয়ে যাবে তো ডক্টর?আউট অফ ডেনজার না?”

ডক্টর ডেস্কের উপর থেকে অন্তর সিটিস্ক্যান রিপোর্টটা নির্ভীকের দিকে দিয়ে বললেন,
“জ্ঞান না ফেরা পর্যন্ত পেশেন্ট আশঙ্কামুক্ত নয়।মস্তিষ্কের সেরেব্রামে রক্তক্ষরণ হয়েছে।এমনটা হলে পেশেন্টের বাকশক্তি,স্মৃতিশক্তি,আবেগ,ইচ্ছা,বুদ্ধি-বৃত্তি,সৃজনশীলতা,কর্মপ্রবণতা সব নষ্ট হয়ে যায়।এমনকি হাতের একটা আঙুলও নড়াতে পারেনা।”

নির্ভীকের মাথা ঘুরছে।হাত-পা মৃদু কাঁপছে।গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছে।পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাচ্ছে।জারিফ আটকা আটকা কন্ঠে বলল,
“ওর কি এমন কিছু…”

ডক্টর জারিফকে পুরোটা বলতে না দিয়ে মাথা নাড়িয়ে বললেন,
“নো নো ডোন্ট ওরি।পেশেন্টের কন্ডিশন ভাল আছে।রেসপন্স করছে।হাত-পায়ে জোর আছে।চোখেও কোন প্রবলেম নেই কিন্তু মাথায় ক্লট আছে।ক্লট সারাতে মেডিসিনে কাজ না হলে অপারেশন করতে হবে।অপারেশনে লাইফ রিস্ক আছে।আর ক্লট থাকাকালীন পেশেন্ট হয়তো বাকশক্তি হারিয়ে ফেলবে,কথা বলতে পারবেনা।স্মৃতি হারাতে পারে এছাড়াও অস্বাভাবিক আচরণ করতে পারে।”

ডক্টরের কথা শুনে নির্ভীকের শরীর খারাপ লাগছে।দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।ডক্টর কিছু একটা বুঝতে পেরেই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে নির্ভীকের কাছে এসে ওর বুকে হাত দিয়ে বলছেন,
“জোড়ে জোড়ে শ্বাস নিন।নিজের নামের উল্টো বলার চেষ্টা করুন।ভয় পাবেন না,মেয়েটা সুস্থ হয়ে যাবে। ”

জারিফ আতংকিত হয়ে নির্ভীকের কাঁধ ঝাকিয়ে বলল,
“এই কি হচ্ছে তোর?ডক্টর?ও এমন করছে কেন?”

ডক্টর ডেস্কের উপর একটা বেল চাপতেই একটা নার্স ভেতরে ঢুকে।ডক্টর উনাকে অক্সিজেন মাস্ক রেডি করতে বলেন।নির্ভীক চেয়ারে বসেই জোড়ে জোড়ে শ্বাস নেয়ার চেষ্টা করছে,জোড়ে শ্বাস নেওয়ায় ওর চওড়া বুক দ্রুত ওঠা নামা করছে।হাত পা নিস্তেজ হয়ে আসছে।ডক্টর আর জারিফ ওকে ধরে ডক্টরের চেম্বারের ভেতরই বেডে শুয়ে দিয়ে অক্সিজেন মাস্ক পরিয়ে দেই।কিছুক্ষণ পর একটু আরাম পেলে ডক্টর ওকে ঘুমের ইন্জেকশন পুশ করে দেন।ডক্টর পুনরায় ডেস্কে গিয়ে বসে বললেন,

“অতিরিক্ত টেনশন আর ভয় থেকে এমনটা হয়েছে,ডোন্ট ওরি।”

জারিফ চিন্তিত হয়ে বলল,
“ডক্টর আমার বোন?”

ডক্টর ডেস্কে হাত রেখে নম্র কন্ঠে বললেন,
“দেখুন আপনার বোনের যা হয়েছে সেটা হলো ট্রোম্যাটিক ব্রেইন ইনজুরি।বাহিরে থেকে ব্রেনে আঘাত লেগেছে।স্ক্যান করে দেখা গিয়েছে ভেতরে অগ্রমস্তিষ্কের সেরেব্রামে রক্তক্ষরণ হয়েছে,যা ক্লটের সৃষ্টি করেছে।এছাড়াও এক জায়গায় ফোলা আছে। ।আঘাত লাগার এক ঘন্টা পরও যদি জ্ঞান না ফেরে তাহলে পেশেন্ট টিবিআই এর থার্ড পর্যায়ে চলে যায়।আপনার বোনের হিস্ট্রিটা অন্যরকম।দুতিনবার জ্ঞান ফেরার পর একই নাম বার বার রিপিট করেছে।আমাদের ধারণা তার খুব একটা প্রবলেম হবে না।ব্রেনে ক্লট সৃষ্টি হলে মেমোরি সেলে কোনো মেমোরি থাকেনা আর কোন মেমোরি না থাকলে কোনো কথা বলারও প্রয়োজন পরেনা।আপনার বোন কিন্তু টিবিআই এর থার্ড পর্যায়ে আছে।চেকআপে যা বুঝলাম ফিজিক্যাল প্রবলেম নেই মেন্টাল প্রবলেম থাকবে কিন্তু অস্থায়ী।ট্রিটমেন্ট নিতে থাকলে সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা আছে।ক্লট নিয়ে যত চিন্তা,অনেকসময় ট্রিটমেন্ট করার টাইমই পাওয়া যায়না।ব্রেনে একটা বালুর কণা থাকলেও লাইফ রিস্ক সেখানে আপনার বোনের ব্রেনে ক্লট আছে আপনি নিশ্চয় বুঝতে পারছেন আমি কি বলতে চাইছি।”

ডক্টরের কথা শুনে জারিফের মনে হলো ওর কানে কেউ গরম সিসা ঢালছে।ডক্টরের কেবিন থেকে বেড়িয়ে সে প্রান্তকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কান্না করতে লাগলো।প্রান্ত,কুহেলী আর ইচ্ছেমতি উদগ্রীব হয়ে ডক্টরেরর কথা শোনার জন্য কেবিনের বাইরে অপেক্ষা করছিল।আরাফ এতক্ষণ রাযীনের সাথে বাহিরে ছিল,সে অন্তকে দেশের বাহিরে নিয়ে ট্রিটমেন্ট করার ব্যবস্থা করতে গিয়েছিল।আরাফ হন্ত দন্ত হয়ে জারিফের কাছে আসতেই জারিফ ওকে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে করতে বলল,
“তুই এটা কিভাবে করতে পারিস?আমি বিশ্বাস করতে পারছিনা।আগে কেন আমাকে জানাসনি।ছোটপাখির বিয়ে শুধুৃমাত্র চাঁদের সাথে হবে।আজকেই ওদের বিয়ে হওয়ার কথা ছিল।কি করলি এসব?”

আরাফ অনুভূতি শূন্য হয়ে স্ট্রেট দাঁড়িয়ে আছে।কয়েকবছর ধরে সে অন্তকে ভালোবাসে।কাউকে কিছু জানায়নি এমনকি জারিফকেও এব্যাপারে কিছু বলেনি।ভেবেছিল একবারে প্রতিষ্ঠিত হয়ে সবাইকে জানাবে,তখন কেউ না করতে পারবেনা আর ততদিনে অন্তও বড় হবে কিন্তু কাল সকালে সে ছাদে গিয়ে নির্ভীকের সাথে অন্তকে দেখে ওর মাথায় রক্ত উঠে যায়।জোড় করে অন্তকে ঢাকায় নিয়ে এসে বিয়ে করার ডিসিশন নেই।সে কল্পনাও করতে পারেনি তার জানপাখির সাথে এতবড় দূূর্ঘটনা ঘটে যাবে।

রাত দুটো।হসপিটালে জনসমাগম একদমই নেই।চারপাশে পিনপতন নীরবতা বিরাজ করছে।তিনতলার বারান্দায় এসে রাত্রির আকাশ দেখছে আরাফ।হসপিটালের সামনের রোডে এত রাতেও নৈশব্দ পদদলিত করে ছোট বড় যানবাহন চলাচল করছে।

-“ভাইয়া?”
ইচ্ছেমতি কাছে এসে দাঁড়ায়।

ঘুরে দাঁড়ায় আরাফ।নীল রঙের পাতলা টিশার্ট ওর পরনে।একহাত দিয়ে চোখ আর কপাল কচলে ইচ্ছেমতির দিকে তাকায়।কাল থেকে দুই ভাই-বোনের মধ্যে কোনো কথা নেই।

-“তোমার সাথে একটু কথা আছে।”শুকনো মুখ করে বলে ইচ্ছেমতি।

-“হ্যাঁ -বল।”

-“এখানে নয়,বাসায় চলো।আমার এখানে ভাল লাগছেনা বাসায় যাবো।”

-“কুহেলীর সাথে গেলিনা কেন?আচ্ছা চল তোকে রেখে আসি।”শান্ত কন্ঠে বলল আরাফ।

ইচ্ছেমতি ভেবেছিল আরাফ যেতে রাজী হবেনা কিন্তু খুব সহজেই রাজী হয়ে গেল।সে তার ভাইকে চিনতে পারছেনা।সবাই যখন টেনশনে অস্থির,জারিফের মতো শক্ত ছেলে ভেঙ্গে দূর্বল হয়ে গিয়েছে সেখানে আরাফের মতো নরম মনের ছেলে কি করে এত স্বাভাবিক আছে বুঝতে পারছেনা সে।তবে কি তার ভাইকে এতদিনেও চিনেনি।হ্যা চিনেনি,একটুও চিনতে পারেনি।আরাফ ইচ্ছেমতিকে নিয়ে হাঁটা দিল।

আইসিইউ রুমের ভেতরে অন্তর পাশে বসে ফিসফিস করে একা একা কথা বলছে নির্ভীক।তার কথা গুলো এমন,
-“তুমি বলছিলে না প্রিয়তা কে?তুমি আমার প্রিয়তা।তোমার সবকিছু আমার কাছে এত বেশি প্রিয় যে তোমাকে বোঝানোর ক্ষমতা নেই আমার।তুমি চকলেট খেয়ে খোসাটা ফেলে দাও না?ওই খোসাটাও আমার প্রিয়।তুমি রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে সেই রাস্তাটাও আমার ভাল লাগে।তোমার আশেপাশের সবকিছু আমার ভাল লাগে বাট এই রুমটা আমার একটুও ভাল লাগছে না।কখন উঠবা?এত কেন ঘুমোচ্ছ?তাড়াতাডি উঠো প্লিজ।আমার ভয় করছে এখানে।এত মেশিন দেখে তুমি ভয় পাবা না তো?”(মন খারাপ করে)

“তোমার হোয়াইট কালার পছন্দ না?তোমার জন্য হোয়াইট কালার কতগুলো ড্রেস কিনেছি জানো তুমি?আমি নিজেও জানিনা তুমি কি করে জানবা!।এই তো সেদিন তোমাকে নিয়ে ঘুরতে গিয়ে তোমার জন্য একটা মেঘ শাড়ি কিনেছি তুমি দেখতে পাওনি না?কিভাবে দেখবা আমি তো লুকিয়ে কিনেছি।ওই শাড়িটা তোমাকে শরতে দিব।তুমি ওটা পরবা তারপর আমরা কাশবনে যাবো।”(মুচকি হেসে)

“তোমার ভাইদের ছাগল কেন বলি প্রুফ পেলা তো এবার?তোমাকে নাহয় একটু জড়িয়েই ধরেছিলাম,আরাফ ভাইয়া ছাগলদের মতো এত রিয়েক্ট করলো কেন বলো তো।আজকের জন্য কত প্ল্যান ছিল জানো?সব প্ল্যান ফ্লপ হয়ে গেল,জারিফ ভাইয়াও বিয়ে করতে পারলোনা।আমি কিন্তু ভাইয়ার বিয়ে ভাঙিনি,তুমি আবার আমাকে বকাবকি করো না।ওই ছাগলটার জন্য তোমাকে এত কষ্ট পেতে হচ্ছে।ছাগলটা কি জানতোনা আমি তোমাকে ভালোবাসি!সবাই জানে আর ছাগলটা জানেনা?”(রাগী কন্ঠে)

“জানো ভার্সিটিতে তোমাকে দেখেই আমি তোমার প্রেমে পরে গিয়েছিলাম।তোমার শশকের মতো ভীত চাহনিতে আমি আহত হয়েছিলাম।তোমাকে ভিজিয়ে দিয়েছিলাম কেন জানো?শুনলে তুমি হাসবা,রাগও করতে পারো কিংবা মুখ ফুলিয়ে আমাকে দুচারটে মাইরও দিতে পারো।আমি তো তোমাকে ছোটবেলা থেকেই ভালোবাসি।সেদিন ইগো ছিল ঠিকই কিন্তু তার থেকে বড় কথা তরুণী তোমাকে দেখে আমি শিশু তোমাকে ভুলে গিয়েছিলাম।তোমার উপর রাগ হয়েছিল আবার নিজের উপরও রাগ হয়েছিল,আমি কি করে পারলাম আমার পিচ্চিকে ভুলে তোমার উপর ক্রাশ খেতে!পরে জানলাম পিচ্চিটার নাম আর তোমার নাম সেম।তোমার ছাগল ভাইটাকে ফোন দিলে বলেছিল তার ছোটপাখি ভার্সিটিতে পড়েনা,ঢাকাতেই আছে।কত্ত বড় মিথ্যে কথা ভাবতে পারছো,ছাগলটা নাকি আমাকে সারপ্রাইজ দিতে মিথ্যে বলেছিল।আমি সারপ্রাইজড হয়েছিলাম মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম ছাগলটাকেও একটা উচিত সারপ্রাইজ দিব।ছাগলটার বিয়ের দিনে তার বিয়ে ভেঙ্গে নিজে বিয়ে করে নিব ছাগলটা তখন বুঝতে পারবে ভালোবাসা নিয়ে খেলা করলে কতটা ফাঁটে।বাই দ্যা ওয়ে তুমি রাগ করোনি তো?আমি কিন্তু তোমাকে ছাড়া আর কাউকে ভালোবাসিনি।সেদিন ওটা তুমি ছিলে তাই তোমাকে ভালোবেসেছি।তোমার জায়গায় অন্যকোন মেয়ে থাকলে আমি তাকাতামই না তার দিকে।ট্রাস্ট মি।”(নরম কন্ঠে)

হঠাৎই নির্ভীকের হাতের মধ্যে অন্তর হাত কেঁপে উঠলো।নির্ভীক কথা থামিয়ে অন্তর দিকে ঝুকে ওর গালে হাত রেখে বলল,
“অন্ত?”

খুশিতে নির্ভীক কি করবে বুঝতে পারছেনা।কয়েকসেকেন্ড থতমত করে দৌঁড়ে রুম থেকে বেড়িয়ে আসলো।দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে বলল,
“ভাইয়া,প্রান্ত – অন্ত জেগে যাচ্ছে।তাড়াতাড়ি ডক্টরকে আসতে বলো।”

জারিফ,রাযীন আর প্রান্ত চেয়ারে বসে ঝুমোচ্ছিল নির্ভীকের কথা শুনে ওরা ছুটোছুটি শুরু করে দিল।রাযীন ডক্টর হওয়ায় সে দৌঁড়ে আইসিইউতে ঢুকে গেল।জারিফ আর প্রান্ত ডক্টর ডাকতে গেল।

অন্ত চোখ খুলেছে।ভীত চোখে আশেপাশে তাকাচ্ছে।তিনজন ডক্টর তাকে চেকআপ করছে।নির্ভীক পাশেই দাঁড়িয়ে আছে।কেউ তাকে রুম থেকে বের করতে পারেনি।কম বয়সি ডক্টর আবু তালহা বার বার রাগী চোখে নির্ভীকের দিকে তাকাচ্ছেন কারন একটু আগে উনি নির্ভীক কে রুম থেকে ঠেলে বের করে দিচ্ছিলেন।নির্ভীক রেগে ডক্টরের চোয়াল বরাবর একটা পান্চ মেরে রুমে নিজের জায়গা করে নিয়েছে।

বয়স্ক ডক্টর অন্তর মেমোরি টেস্ট করার জন্য অন্তর সামনে ঝুকে দাঁড়ালেন।অন্তকে নিজের নাম জিজ্ঞেস করলেন।অন্ত কিছু না বলে ভীত চোখে হাতের দিকে তাকাচ্ছে কারন তার হাতে ক্যানুলা করা আছে।ডক্টর নেক্সট কোয়েশ্চেন করলেন,
-“বলো তো মামুনি আমি কে?”

অন্ত ভ্রু কুচকে ডক্টরের দিকে তাকালো।ডক্টরের মাথায় একটাও চুল নেই,টাক মাথা চকচক করছে।এছাড়াও লোকটার চোখের ভ্রু সাদা।অন্তর কাছে লোকটাকে অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে।অন্ত কিছু বলছেনা দেখে ডক্টর নরম কন্ঠে বলল,

-“চলো আমি তোমাকে হেল্প করি।আমি একজন ডক্টর।এই যে আমার সাথে যাদের দেখছো উনারাও ডক্টর।ওই ছেলেটাকে দেখো,চিনতে পারছো ওকে?”

অন্ত নির্ভীকের দিকে তাকালো।নির্ভীকের মনে আশা-নিরাশার দোলা।টেনশনে স্থির হয়ে দাঁড়াতে পারছেনা।অন্ত কি বলবে সেটা শোনার জন্য উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করছে।অন্ত নির্ভীকের কুচকুচে কালো চোখের দিকে তাকিয়ে দূর্বল হেসে মাথা নাড়ালো।এতেই যেন নির্ভীক প্রাণ ফিরে পেল।বুকে হাত দিয়ে স্বস্তির শ্বাস ফেলল।

চলবে………

(যারা গল্পে কি হচ্ছে কিছু বুঝতে পারছেন না তাদের জন্য কিছু টিপস-

★এতদিন অন্তর মাধ্যমে গল্পের কাহিনী তুলে ধরা হয়েছে এখন লেখিকা অর্থাৎ আমি গল্পটাকে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করবো।

★নয় নম্বর পার্টের ট্রিপল স্টারের নিচের অংশ মন দিয়ে পড়ুন না বুঝার কিছু নেই।

★আমাকে সবটা বুঝিয়ে বলার টাইম দিন।আজকের পার্টে অনেক কিছু বুঝতে পারবেন।আজকেও যদি না বুঝেন নেক্সট পার্টগুলোতে বুঝে যাবেন ইনশাআল্লাহ্।

★কোন রহস্য নেই,রহস্য মনে করলেই রহস্য।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here