ভালোবাসি আমি যে তোমায় ২পর্ব:৩১

0
1326

#ভালোবাসি_আমি_যে_তোমায়_২
#Sohani_Simu

২৬.

এখন দুপুর।সূর্যের কড়া রোদে চারপাশ ঝিম ধরে আছে।দুপুরের এইসময়টাতে হাতে চিনচিনে ব্যথা অনুভূত হওয়ায় ঘুম ভেঙ্গে গেল অন্তর।চোখ খুলে দেখে নিজের ঘরেই শুয়ে আছে।সবাই তাকে ঘিরে ধরে আছে।অন্তকে চোখ খুলতে দেখেই সবার মুখে হাসি ফুটে উঠলো।ডান হাতের কনুইয়ে ভর দিয়ে উঠার চেষ্টা করতেই জারিফ অন্তকে ধরে বিছানার সাথে হেলান দিয়ে বসিয়ে দিল।অন্ত বাম হাতের দিকে তাকিয়ে দেখলো ব্যান্ডেজ করা আছে।মলিন মুখে জারিফের দিকে তাকালো।জারিফ অন্তর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,

‘ঠিক হয়ে যাবে।’

অন্ত জারিফকে জড়িয়ে ধরে হুহু করে কেঁদে উঠলো।জারিফ অন্তর মাথায় আর পিঠে হাত রেখে বলল,

‘কুহেলী? একটু খাবার নিয়ে আসো যাও আর তোরা সবাই যা এখন।’

সবাই ঘর থেকে বেড়িয়ে গেল।অন্ত এখনও ফোঁপাচ্ছে।জারিফ শান্ত কন্ঠে আরাফকে বলল,

‘তুইও যা।’

আরাফ শুকনো মুখ করে সোফায় বসে ছিল।জারিফের কথা শুনে উঠে দাঁড়িয়ে অন্তর কাছে আসতে আসতে বলল,

‘কথা বলব একটু ওর সাথে।’

আরাফের কথা শুনে অন্ত চোখ খিচে বন্ধ করে জারিফের বুকে মুখ গুজে কান্নার গতি বাড়িয়ে দিল।আরাফের মুখ দেখতে চায় না।জারিফ রাগী কন্ঠে বলল,

‘কিছু বলতে হবে না,তুই যা।’

আরাফ গেল না।বিছানায় অন্তর পায়ের কাছে বসে দুই হাত অন্তর পায়ে রাখলো।অন্ত চমকে পা গুটিয়ে নিল।আরাফ মলিন স্বরে বলল,

‘প্লিজ ফরগিভ মি।ভুল করেছি আমি।আর কোনদিনও এমন ভুল করবো না।ওসব কথা আর কখনও বলব না।আবার আগের মতো হয়ে গেছি ওকে?জারিফও ভাইয়া আমিও ভাইয়া,দুটো ভাইয়া তোমার।ক্ষমা করেছো?’

অন্ত কিছু বলল না।জারিফ আরাফের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘পায়ে ধরে ক্ষমা চা।আর একশোবার কান ধরে উঠবস কর তাহলেই ক্ষমা পাবি।’

আরাফ সত্যি সত্যি অন্তর দুইপা চেপে ধরলো।অন্ত এবার জোরে জোরে শব্দ করে কেঁদে দিল।আরাফ পা ছেড়ে অন্তর অন্যপাশে বসে বলল,

‘ক্ষমা করেছো?না করলে কিন্তু আবার পা ধরে বসে থাকবো।’

জারিফ মুচকি হেসে বলল,

‘আগে একশোবার কান ধরে উঠবস কর তারপর ক্ষমা পাবি।যা শুরু কর।’

আরাফ মেঝেতে দাঁড়িয়ে দুই হাতে কান ধরে উঠবস শুরু করে দিল।দশবার খুব দ্রুত উঠবস করলেও তারপর ক্লান্ত হয়ে গেল ধীরে ধীরে উঠবস করছে আর বলছে,

‘একটা সেঞ্চুরীই তো করতে হবে,এ আর এমনকি।কোনো ব্যাপারই না।’

অন্ত জারিফের বুকে মাথা রেখে আড় চোখে আরাফকে দেখছে।এমনটা বহু বার হয়েছে।আরাফ একটু জোরে কথা বললেই অন্ত মুখ ফুলিয়ে বসে থাকতো।রাগ ভাঙ্গানোর জন্য আরাফকে সবার আগে কানটায় ধরতে হতো।কিছুক্ষণ পর আরাফের কান ধরা দেখে অন্ত কান্না ভুলে ফিক করে হেসে দিল।অন্তকে হাসতে দেখেই আরাফ কান ছেড়ে দিয়ে অন্তর পাশে বসে বলল,

‘এই তো হেসেছে তারমানে ক্ষমা করে দিয়েছে।উফ বাঁচলাম!’

জারিফ অন্তকে সোজা করে বসিয়ে দিয়ে বলল,

‘ক্ষমা করে দিলি?এত সহজে?’

অন্ত নাক টেনে আরাফের দিকে তাকিয়ে বলল,

‘সত্যি আর ওইরকম কথা বলবা না তো?’

‘হুম সত্যি,তিন সত্যি।’

অন্ত হাসলো কিন্তু পরক্ষণেই ডানহাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ মুছে আবার কান্না করতে করতে বলল,

‘এ্যা এ্যা আমার হাত।এখন আপুর বিয়ে খাব কি করে?’

আরাফ অন্তকে একপাশ থেকে জড়িয়ে ধরে বলল,

‘আমি খাইয়ে দিব।ডোন্ট ক্রাই।’

কুহেলী আর আফ্রা খাবার নিয়ে ঘরে ঢুকলো।আফ্রা ধপ করে বিছানায় বসে অন্তর দিকে তাকিয়ে মুখ ভেংচি দিয়ে বলল,

‘হুহ ঢং দেখে বাঁচিনা।ভাইয়া একটু বকলো আর ওমনি মরার জন্য হাতপাত কেঁটে ড্রামা শুরু করলো।ড্রামাবাজ মেয়ে কোথাকার!’

অন্ত নাক মুখ ফুলিয়ে আরাফের দিকে তাকালো।আরাফ তো তাকে বকেনি।আরাফ তাকে অপমান করেছে।বাসার সবাই জানে আরাফ অন্তকে একটু বকেছে তাই অন্ত এমন করেছে।নির্ভীক নিজে সবাইকে এমনটা বুঝিয়েছে।আরাফ ভয় পাচ্ছে অন্ত যদি সবাইকে বলে দেয় বাসা ভর্তি লোকের সামনে আরাফের সম্মান ধুলোই মিশে যাবে।সবাই আরাফকে খারাপ নজরে দেখবে।নির্দিষ্ট কয়েকজন ছাড়া আরাফ আর অন্তর ব্যাপারটা কেউ জানে না।আরাফ এমন একজনকে ভালোবেসেছে যাকে ভালোবাসার অধিকার আরাফের নেই।আরাফ কিছু বলার আগেই কুহেলী বলল,

‘ড্রামাবাজ নয় ভাই সোহাগী মেয়ে এটা।বাপরে এইটুকু পিচ্চির এত রাগ!’

আফ্রা বিছানার উপর পা তুলে বসে বলল,
‘ভাইয়েরা একটু বকতেই পারে তাই বলে হাত কেঁটে মরতে হবে??কাল সন্ধ্যায় আরাফ ভাইয়া তোকে কত করে ডাকলো তুই গেলি না তাহলে বোকবেনা তো কি করবে?দিন দিন তুই বেয়াদবের চূড়ান্ত হচ্ছিস।বাবা আজকে আসুক তারপর দেখ বাবাকে দিয়ে কিভাবে তোকে বকা খাইয়ে নিই।’

অন্ত মন খারাপ করে শুনছে আর ভাবছে আরাফ যখন ক্ষমা চেয়েছে অন্তর বিশ্বাস আরাফ আর এরকম কিছু করবেনা।অন্তর মন খারাপ দেখে জারিফ এক ধমকে পরিবেশ ঠান্ডা করে ফেলল।খাবারের প্লেট হাতে নিয়ে অন্তকে তুলে খাওয়াতেই আফ্রা বলল,

‘ভাইয়া ওর বাম হাত কেটেছে ডান হাত তো ভালই আছে তাও কেন তুলে খাওয়াতে হবে?ওকে দাও ও একা খাবে।’

অন্ত রাগী চোখে আফ্রার দিকে তাকালো।আফ্রা মুখ ফুলিয়ে বলল,

‘আমাকে আর ইচ্ছেকে তোমরা কেউ ভালোইবাসোনা,তোমারদের কি একটায় বোন?’

জারিফ মুচকি হেসে বলল,

‘না তোরাও বোন।তোদেরও ভালোবাসি তবে ছোটপাখিকে সবচেয়ে বেশি।ডোন্ট মাইন্ড।’

আফ্রা থমথমে মুখ করে বলল,

‘ওকে করলাম না মাইন্ড।তোমাদের কোন দোষ নেই সব দোষ ওর।ফইন্নিটা যাদু করে সবার কাছ থেকে ভালোবাসা নিতে পারে।নির্ভীক ঠিকই বলে ও একটা যাদুমণি।’

অন্তর এতক্ষণে নির্ভীকের কথা মনে পরলো।খাওয়া থামিয়ে কৌতুহলী হয়ে বলল,

‘নির্ভীক ভাইয়া আসেনি?’

কুহেলী চিন্তিত হয়ে বলল,

‘হ্যাঁ নির্ভীক সেই সকালে গেল আর আসলো নাতো?’

জারিফ অন্তর মুখে খাবার তুলে দিয়ে বলল,

‘ওর ভার্সিটিতে কাজ আছে একটু।’

অন্ত মন খারাপ করে খেতে লাগলো।আরাফ একটু পর ঘর থেকে বেড়িয়ে আসলো।কলিজা ফেটে যাচ্ছে তার।অন্তর এমন পাগলামিতে ভয় পেয়ে আরাফ অন্তর কাছে নিজের সব ভালোবাসা লুকিয়ে ফেলল।ভেবেছিল জোর করে হলেও ভালোবাসা আদায় করবে কিন্তু অন্ত সেসব সহ্য করবেনা।শেষ করে দিবে নিজেকে।আরাফ একটা জিনিস খুব ভাল করে বুঝেছে অন্ত তাকে ভাই হিসেবে খুব ভালোবাসে।আরাফ সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তকে সময় দিবে।এখনই তাড়াহুরো করবে না।

সারাটাদিন কেঁটে রাতের অর্ধেক হয়ে গেল অন্ত নির্ভীকের দেখা পেল না।নির্ভীকদের বাসার সবাই অন্তকে দেখে গিয়েছে শুধু নির্ভীক বাদে।অন্ত ঘরে একা বসে আছে।নিচ থেকে গানবাজনার আওয়াজ আসছে।কাল আফ্রার গায়ে হলুদ তাই সবাই খুব এক্সাইটেড হয়ে আছে।অন্তর মন খারাপ কারন সারাদিন নির্ভীকের দেখা পায়নি আর হাত কেটেছে জন্য বাবা-মা রাগ করেছে,ঠিক করে কথা বলছেনা।ঘড়িতে এখন রাত এগারোটা বাজে।নির্ভীকের সাথে কথা বলার জন্য অন্তর মন উসখোস করছে।তাই কিছু না ভেবেই নির্ভীককে ফোন দিল কিন্তু নির্ভীক কল রিসিভ করছেনা।কয়েকবার ফোন দিল কিন্তু কোন রেসপন্স পেল না।মেসেঞ্জারে যেয়ে দেখলো নির্ভীক ঠিকই অনলাইনে আছে তাহলে কল কেন তুলছেনা?অন্ত মন খারাপ করে মেসেজ লিখে পাঠালো,

‘কল ধরছেন না কেন?’

কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর দেখল নির্ভীক মেসেজ না দেখে অফলাইনে চলে গিয়েছে।অন্ত হতাশ হয়ে ফোন রেখে আরাফের ঘরে আসলো।আরাফ ঘরে নেই কিন্তু নিপা আছে।নিপার জন্যই অন্ত এখানে এসেছে।আরাফ ঘর ছেড়ে কোথায় গিয়েছে কে জানে।আরাফের মা এবার সত্যি অসুস্থ তাই ডিভোর্সের কথা কাউকে বলতে পারছেনা।আরাফের ঘরেই নিপার থাকার জায়গা হয়েছে।অন্ত এসে দেখে নিপা মেঝেতে বিছানা করে শুয়ে আছে।অন্ত যেয়ে নিপার পাশে নিপার বালিশেই মাথা রেখে শুয়ে বলল,

‘নিচে শুয়েছো কেন?’

নিপা গভীর চিন্তায় মগ্ন ছিল অন্তর কথা শুনে হকচকিয়ে গিয়ে বলল,

‘অহ তুই?কখন আসলি?’

অন্ত বাম হাতটা সাবধানে পেটের উপর রেখে বলল,

‘এই তো এখনই।তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করব?’

নিপা মিষ্টি হেসে বলল,
‘যতগুলো ইচ্ছে করতে পারিস।’
অন্ত নিপার দিকে পাশ ফিরে শুয়ে বলল,
‘তোমাদের কি ডিভোর্স হয়ে গিয়েছে?’

নিপা মুচকি হেসে বলল,
‘না।পাঁচবছরের আগে কোন ডিভোর্স নেই।চুক্তি করে নিয়েছি।’

অন্ত ভ্রু কুচকে বলল,
‘ভাইয়া যে বলছিল তোমাকে ডিভোর্স দিয়েছে।’

নিপা অন্তর গায়ের উপর একহাত তুলে দিয়ে বলল,

‘তোর ভাইয়া একটা গবেট।কিসের কাগজে সাইন করলো ভাল করে দেখলোও না।নির্ভীক ভাইয়া যেমনটা বলেছিলেন তেমনটায় হয়েছে।’

নির্ভীকের কথা শুনে অন্ত কৌতুহলী হয়ে সবটা শুনতে চাইলো।নির্ভীকের কথা শুনতে অন্তর সবসময়ই খুব ভাল লাগে।আর এখন ঘরে ডিম লাইট জ্বলছে, এসির টেম্পারেচার কমিয়ে দেওয়া আছে জন্য ঘর ঠান্ডা হয়ে আছে।অন্তর মনে হচ্ছে সে কোন রুপকথার রাজকুমারেরর গল্প শুনছে।পরিবেশটা এমন সুন্দর!নিপা অন্তকে ফিসফিস করে বলছে,

‘নির্ভীক ভাইয়াকে আমি আগে কখনও চিনতাম না।তোর এক্সিডেন্টের পর ঢাকায় প্রথম উনাকে দেখেছিলাম।ইচ্ছের কাছে অনেক গল্প শুনেছি উনার ব্যাপারে।এই তো কিছুদিন আগে উনি ফোন করে আমার সাথে পরিচিত হলেন।কোন ভণিতা না করে ডিরেক্ট বললেন দেখুন ভাবি আমি জানি আরাফ ভাইয়া আপনাকে ডিভোর্স দেওয়ার চেষ্টা করছে আমি লয়্যার দিয়ে কিছু পেপারস ঠিক করে আপনার এড্রেসে পাঠিয়ে দিয়েছি আপনি আরাফ ভাইয়ার থেকে কৌশলে সিগনেচার করে নিবেন।আমি চিন্তিত হয়ে বললাম এতকিছু কিভাবে জানলেন?আর কিসের পেপারস?উনি আমাকে বললেন একটা ডিল আছে ওখানে।পাঁচবছরের আগে আরাফ ভাইয়া আপনাকে ডিভোর্স করতে পারবেনা।জারিফ ভাইয়া পরে আপনাকে সব জানাবে।কিছুদিন পর আরাফ হুট করে দেশে চলে আসলেন আর আমাকে ডিভোর্স দিতে চাইলেন।রেগে ছিলেন আমার উপর আমিও রেগে ওই পেপারস গুলো এগিয়ে দিয়েছি,উনি না দেখেই সাইন করে দিলেন।উনি ভাবছেন আমাদের ডিভোর্স হয়ে গেছে কিন্তু হয়নি,আবারও বাঁধা পরলেন আমার সাথে।আরাফের সাথে আমার বিয়েটা নাকি নির্ভীক ভাইয়ায় দিয়েছেন আর আমাকে প্রমিস করেছেন আমাদের বিয়ে টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব উনার।আমরা নিজের ভাইও কখনও আমার জন্য এত কিছু করতো না।’

নিপা সিলিং এর দিকে তাকিয়ে নিজের ভাইয়ের কথা ভাবছে।তার ভাই কি করে আপন থেকে পর হয়ে গেল সেসব ভেবে একটা দীঘশ্বাস ফেলে আবার বলল,

আরাফ আমাকে আগেই বলেছে জোর করে ভালোবাসা পাওয়া যায়না।আমি তো জোর করিনি আর করবও না কখনও।তুই বল,আমাকে একটুও ভালোবাসা যায় না?একবার আমার হাতে হাত রেখে এগিয়ে যাওয়া যায় না?’

নিপার চোখ ভিজে এসেছে।ওড়নার কোনা দিয়ে চোখ মুছে অন্তকে ডাকতেই খেয়াল করলো অন্ত ঘুমিয়ে গিয়েছে।নিপাও অন্তর পেটের উপর হাত রেখে চোখ বন্ধ করে থাকলো।প্রায় আধঘন্টা পর নিপার চোখ লেগে আসতেই দরজা খোলার শব্দ পেয়ে নিপা তাকালো।আরাফ এসেছে।আরাফকে দেখেই চোখ বন্ধ করলো।আরাফ মেঝের দিকে একবার তাকিয়ে বুঝতে পারলো নিপা মেঝেতে শুয়েছে।তাই মাথা না ঘামিয়ে আলমিরা সামনে দাঁড়িয়ে শার্ট খুলে টিশার্ট গায়ে দিল।বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করতেই মনে হল নিচে দুজন শুয়ে আছে।আরাফ উঠে বসে নিচে তাকাতেই অন্তকে দেখে ভ্রু কুচকালো।বিছানা থেকে নেমে অন্তর পাশে হাঁটু গেরে বসলো।নিপা অন্তর ব্যান্ডেজের কাছে হাত রেখেছে দেখে আরাফ রেগে গেল।ঘুমের মধ্যে অন্ত যদি হাতে ব্যথা পায় সেই ভয়েই নিপার হাত ধরলো।নিপা চমকে তাকালো।এটা তার প্রথম ছোঁয়া।পুরো শরীর শিউরে উঠলো।নিপাকে তাকাতে দেখেই আরাফ অপ্রস্তুত হয়ে নিপার হাত ছেড়ে দিল,রাগী কন্ঠে বিরবির করে বলল,

‘ওর উপর হাত দিয়েছিস কেন?ওর হাতে লেগে গেলে কি হতো!!আর ওকে নিয়ে ফ্লোরে শুয়েছিস কেন?উঠ এখান থেকে।’

নিপা চট করে উঠে বসলো।আরাফের স্পর্শ পেয়ে তার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে।আরাফ যেই হাত ধরেছিল সেটা বুকে চেপে ধরে সোফার সাথে হেলান দিয়ে আরাফের দিকে তাকিয়ে আছে।আরাফ অন্তর দিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে নিপাকে উদ্দেশ্য করে ফিসফিস করে বলল,

‘লাইটটা অন কর।বিছানাটা ঠিক করে দে।’

নিপা আরাফের কথা বুঝতে পারেনি।আরাফ বিরক্ত হয়ে উঠে গিয়ে লাইট জ্বালিয়ে দিল।চোখে আলো লাগায় অন্ত একটু নড়েচড়ে আবার গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল।আরাফ বিছানায় বালিশ ঠিক করে খুব সাবধানে অন্তকে মেঝে থেকে তুলে বিছানায় শুয়ে দিল।অন্তর শরীরে পাতলা কম্বল টেনে দিয়ে কাঁটা হাতটা ঠিক করে রেখে দিল।অন্তর দিকে ঝুকে দাঁড়িয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে অন্তর কপালে চুমু দিয়ে নিপার দিকে তাকালো।নিপা মলিন মুখে আরাফের দিকে তাকিয়ে আছে।আরাফ নিচু স্বরে নিপাকে ধমক দিয়ে বলল,

‘ওখানে কি করছিস?ওর পাশে শুয়ে পর।’

নিপা ভেবেছিল আরাফ তাকে মেঝেতেই থাকতে বলবে কিন্তু তার ভাবনাকে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে আরাফ তাকে বিছানায় যেতে বলছে।নিপা খুশি হয়ে মেঝে থেকে বালিশ তুলে নিয়ে অন্তর পাশে শুয়ে পরলো।আরাফ মাঝখানে একটা কোলবালিশ দিয়ে বলল,

‘বর্ডার ক্রস করবিনা,ওর হাতে যেন না লাগে।’

নিপা কিছু না বলে অন্যপাশ ফিরে শুলো।আরাফও লাইট অফ করে সোফায় গিয়ে শুয়ে পরলো।ডিম লাইটের কমলা আলোয় অন্তর দিকে অপলক তাকিয়ে থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে গেল।

সকাল থেকেই বাসায় উৎসবমুখর পরিবেশ।আজ আফ্রার গায়ে হলুদ।মেয়েরা সবাই পার্লারে গেল আর অন্ত এখনও মরার মতো ঘুমোচ্ছে।ইচ্ছেমতি অন্তর গাল টেনে ধরে বলল,

‘এই উঠ,আর কত ঘুমাবি?দুপুর হয়ে যাচ্ছে তো।’

অন্ত নড়েচড়ে বিরক্ত হয়ে ইচ্ছেমতির দিকে তাকালো।ইচ্ছেমতি রাগী কন্ঠে বলল,

‘কি হল উঠ।ভাইয়ার ঘরে এসে শুয়েছিস কেন?আজ প্রথম ভাইয়া ভাবি এক ঘরে থাকলো তাও তোকে নিয়ে।তুই মেয়ে আচ্ছা একটা মাথা মোটা।’

অন্ত ফট করে উঠে বসলো।আশেপাশে তাকিয়ে ঘুম ঘুম কন্ঠে বলল,

‘আমি তো নিপা আপুর সাথে গল্প করতে এসেছিলাম।মেঝেতে শুয়ে ছিলাম এখানে কি করে আসলাম?’

আরাফ তখনও সোফায় শুয়ে ঘুমোচ্ছিল,কথার আওয়াজ কানে যেতেই বিরক্ত হয়ে বলল,

‘এই তোরা বাহিরে গিয়ে কথা বল।ডিস্টার্ব করিসনা।’

ইচ্ছেমতি অন্তর দিকে তাকিয়ে নিচু গলায় বলল,

‘চল উঠ।অ্যান্টি ফোন করে তোকে নিয়ে যেতে বলল,তোর হাতের ড্রেসিং করিয়ে দিবে।ওখান থেকে এসে আবার পার্লারে যেতে হবে।আপুরা পার্লারে চলে গিয়েছে।রাযীন ভাইয়া বলেছে রাত আটটার আগেই যেন হলুদ সন্ধ্যা শেষ হয়ে যায় আর নির্ভীক ভাইয়া বলছে দুপুরে গোসলের আগেই ওসব হলুদের ঝামেলা মিটিয়ে নেওয়ায় ভাল।হলুদ পার্টিতে উনারা বিরক্ত হচ্ছেন কিন্তু আমরা ঠিক করেছি পার্টি মধ্যরাত পর্যন্ত হবে।ছাদে কি সুন্দর করে স্টেজ বানাচ্ছে চল গিয়ে দেখবি।’

গায়ে হলুদ,পার্লার,ডেকোরেশন এসব নিয়ে অন্তর কোন আগ্রহ নেই।নির্ভীকদের বাসায় যাওয়ার কথা শুনে অন্ত দ্রুত নিজের ঘরে আসলো।ফ্রেশ হয়ে আকাশী কালার কামিজ আর কালো প্লাজু-ওড়না পরে তৈরী হতে লাগলো।ইচ্ছেমতিকে দিয়ে মাথায় চিড়ুনি করিয়ে নিল।কপালে একটা ছোট্ট কালো টিপ আর ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক লাগিয়ে গলায় নির্ভীকের দেওয়া চেইন পরে বলল,

‘চল।’

ইচ্ছেমতিও অন্তর সাথে হালকা পাতলা সেজেছে।দুজনকে যমজ বোনদের মতো লাগছে।দুজন হাত ধরে নির্ভীকদের বাসায় গেল।

বিয়ে উপলক্ষে নির্ভীকদের বাসায় অনেক গেস্ট এসেছে।ড্রইং রুমে একগাদা ছেলে দেখেই অন্ত আর ইচ্ছেমতি অসস্তিতে পরে গেল।নির্ভীকের মায়ের ঘরে যেয়ে দেখে সেখানেও কিছু বয়স্ক মহিলা বসে আছে।অন্ত আর ইচ্ছেমতিকে দেখে সবাই তাদের দিকে তাকাচ্ছে আর বলছে এরা কার মেয়ে?ইচ্ছেমতি অন্তর হাত ধরে কিচেনে আসলো।খালার কাছে শুনলো নির্ভীকের মা ছাদে আছে।দুজন মিলে ছাদে আসলো।ছাদে গায়ে হলুদের স্টেজ বানানো হচ্ছে।নির্ভীকের মা নির্ভীকের সাথে কিছু একটা নিয়ে কথা বলছেন।নির্ভীককে দেখেই অন্তর মুখে হাসি ফুটে উঠলো কিন্তু কাছে এগিয়ে যেতেই নির্ভীক অন্তকে দেখে রাগী মুখ করে চলে গেল।অন্ত মন খারাপ করে নির্ভীকের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে।নির্ভীকের মা অন্তকে নিয়ে নিচে আসলেন।একটা ঘরে বসে সুন্দর করে অন্তর হাত ড্রেসিং করে দিলেন।ড্রেসিং করার সময় অন্ত কেঁদেছে হাতের ব্যথায় নয় মনের ব্যথায়।

নাক চোখ লাল করে অন্ত নির্ভীকের ঘরের সামনে এসে দাঁড়িয়ে আছে।ইচ্ছেমতি নির্ভীকের চাচাতো বোন তরীর হাতে মেহেদী পরিয়ে দিচ্ছে।সেই সুযোগে অন্ত ভাবলো নির্ভীকের সাথে কথা বলবে।নির্ভীক কেন কথা বলছেনা তাকে জানতে হবে।সে যদি কোন ভুল করে থাকে তাহলে সরি বলে সব ঝামেলা মিটিয়ে নিবে।অন্ত নির্ভীকের দরজায় টোকা দিল।ভেতর থেকে নির্ভীক বলল,

‘কামিং।’

অন্ত গুটি গুটি পায়ে ভেতরে এসে নির্ভীকের পেছনে দাঁড়ালো।নির্ভীক টেবিল চেয়ারে বসে ল্যাপটপে ই-মেইল লিখছে।অন্ত মলিন মুখ করে বলল,

‘আপনি কয়দিন ধরে আমার সাথে কথা বলছেন না কেন?আমি কি কোন ভুল করেছি?করলে সরি।’

নির্ভীক অন্তর কথা শুনে পেছনে তাকালো।অন্ত অসহায় মুখ করে তাকিয়ে আছে।নির্ভীক ছোট্ট শ্বাস ফেলে বলল,

‘সরি?সরি ফর হোয়াট?’

অন্ত অপ্রস্তুত হল।ঠিকই তো,কিসের জন্য সরি বললাম।অন্তর অবচেতন মন বলছে নিশ্চয় আমি কোনভাবে কষ্ট দিয়েছি উনাকে নাহলে এমনি এমনি উনি আমার সাথে কথা বলা বন্ধ করবেন না।অন্ত মলিন মুখ করে বলল,

‘আমার মনে হচ্ছে আমি আপনাকে কোনভাবে কষ্ট দিয়েছি সেজন্য সরি।আপনি প্লিজ আমার উপর রাগ করে থাকবেন না।’

‘ওকে।’

বলে নির্ভীক সামনে ঘুরে নিজের কাজে মন দিল।অন্ত এবার নির্ভীকের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলল,

‘আপনি এখনও রেগে আছেন।’

নির্ভীক মাউসে হাত রেখে বলল,
‘রেগে নেই।’

‘তাহলে কথা বলছেন না কেন?বলছি তো সরি।’

নির্ভীক অন্তর দিকে তাকালো।শান্ত কন্ঠে বলল,

‘আমি মানুষ খুব খারাপ,তুমি বোধ হয় জানো না।ভুল করলে সরি টরি আমি নিইনা,পানিশমেন্ট দিই কিন্তু তোমার পানিশমেন্ট পরে হবে।এখন তুমি আসতে পারো।গেটলস্ট।’

অন্ত মাথা নিচু করে কেঁদে ফেলেছে।নির্ভীক ল্যাপটপের দিকে তাকালো।মনে মনে বলল কাঁদো যত ইচ্ছে কাঁদো।একদম তোমাকে প্রশ্রয় দিবনা।ভালোবাসা পেয়ে পেয়ে তুমি আদরে বাদর হয়ে গিয়েছো।সাহস কি করে হয় আমার লাইফ নিয়ে ছিনিমিনি খেলার!

অন্ত নাক টেনে হেঁচকি তুলতে তুলতে বলল,

‘আমি কি কান ধরবো?দশবার উসবস করি?’

নির্ভীক এমন কিউটনেস আর এভয়েড করতে পারলো না।অন্তর হাত টেনে নিজের কোলে বসিয়ে জড়িয়ে ধরে বলল,

‘উঠবস করতে হবেনা কান্না থামাও আগে আর আমাকে প্রমিস কর কালকের মতো ভুল আর কখনও করবা না।জানো কত ভয় পেয়েছিলাম?দম বন্ধ হয়ে মরে যাচ্ছিলাম।তুমি জানো আমি তোমাকে কত ভালোবাসি তাও সবসময় আমাকে কষ্ট দাও।সবার সাথে কত সুন্দর করে মিলেমিশে থাকো শুধু আমার কাছে আসলেই পালাই পালাই কর।ওই কাজিন ছেলেগুলোর গলা ধরে বসে থাকো আর আমি হাত ধরলেই কেমন কেমন কর।কেন?তুমি কি আমাকে ভালোবাসো না?কিন্তু ওই ডায়েরী তে তো লিখেছো তুমি আমাকে ভালোবাসো।প্রিয়তা অন্য কেউ নয়,শুধু তুমি।ট্রাস্ট মি।তোমাকে ছাড়া কাউকে কোনদিন ভালোবাসিনি।যেদিন ভাইয়ার বিয়ের কথা বলতে বাবা তোমাদের বাসায় গিয়েছিল সেদিন বাবাকে বলেছিলাম আমার বিয়েও যেন তোমার সাথে ঠিক করে আসে।বাবা আমার কথা বলেনি কারন জব করিনা,বেকার।সেদিন রেগে আম্মুর ডাইনিং টেবিল ভেঙ্গে বাসা থেকে বেড়িয়ে গিয়েছিলাম।এসব তোমাকে বলছি কারন তখনও আমি তোমাকে দেখিনি।না দেখে ভালোবেসেছি।আমি ছোটবেলা থেকেই তোমাকে পছন্দ করতাম,স্নেহ করতাম।সেই স্নেহ মমতা বড় হয়ে ভালোবাসার রুপ নিয়েছে।আর…..’

নির্ভীকের কথার মাঝেই নির্ভীকের চাচাতো বোন টোয়া ঘরে ঢুকে অন্তকে নির্ভীকের কোলে দেখে চেচিয়ে বলল,

‘এসব কি নির্ভীক?’

নির্ভীকের হাত আলগা হয়ে গেল।অন্ত হকচকিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে মাথা নিচু করে দূরে গিয়ে দাঁড়ালো।নির্ভীক চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,

‘তোর উচিত ছিল দরজাটা ভিরিয়ে দিয়ে এখান থেকে চলে যাওয়া তা না করে শেয়ালের মতো চেঁচাচ্ছিস কেন?’

টোয়া রেগে আগুন হয়ে আছে।অন্তর দিকে তাকিয়ে রেগে কিছু বলার আগেই টোয়ার বোন তরী দরজায় এসে দাঁড়িয়ে বলল,

‘এই তো অন্ত আপু এখানে।ইচ্ছে আপু খুঁজছে তোমাকে যাও।’

অন্তকে আর পায় কে।এমন অসস্তিকর পরিস্থিতি থেকে বাঁচতে দৌঁড়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে গেল।

চলবে………………….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here