ভালোবাসি আমি যে তোমায় ২পর্ব:৪৪

0
1431

#ভালোবাসি_আমি_যে_তোমায়_২
#Sohani_Simu

৩৮.

দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে রাতের আকাশ দেখছে আরাফ।নিপা গুটি গুটি পায়ে আরাফের পেছনে দাঁড়িয়ে মুচকি হেসে বলল,

‘আবার বিয়ে করার কোন প্রয়োজন ছিল না।আমি এমনি তেও সারাজীবন আপনার সাথেই থাকবো,যদি আপনি রাখেন।’

আরাফ আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল,

‘বিয়ে করেছি দেখে অধিকার নিতে আসিস না।আবার ডিভোর্স দিতে দুবার ভাববো না।’

নিপা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলল।আজ ইচ্ছেমতি আর প্রান্তর বিয়ের পর আরাফ আর নিপারও আবার বিয়ে হয়।আরাফই আগ্রহ করে বিয়েটা করে নেয়।যদিও কখনও নিপাকে ভালোবাসতে পারবেনা তাও নিপার জন্য সহানুভূতি হয় তার।এই মেয়েটার মা মারা গেলে আর কেউ নেই।কার কাছে থাকবে না থাকবে আর আরাফের বাবা-মা নিপার বাবাকে কথা দিয়েছিল নিপাকে আরাফের সাথে বিয়ে দিয়ে সারাজীবন তাদের কাছেই রাখবে।নিপা যেহেতু আরাফের কাছে কোন অধিকার চায়না তাই আরাফ আর কিছু না ভেবে আবার বিয়ে করে নেই।এতে সবাই অনেক খুশি হয়।নিপা পেছন থেকে আরাফের দিকে তাকিয়ে বলল,

‘অন্ত নির্ভীক ভাইয়ার সাথে ভাল আছে।ওর খুশি আর ভাল থাকা দেখে আপনার ভাল লাগছে না?’

‘না।’

‘না?’

আরাফ ব্যথা ভরা চোখে নিপার দিকে তাকালো।কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে বলল,

‘ওকে এমনই হাসি খুশি দেখতে চাই কিন্তু আমি মেনে নিতে পারিনা নির্ভীকের সাথে ওকে।অন্ত যদি নির্ভীকের সাথে থেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মেয়েও হয় তাও আমি চাইনা ও নির্ভীকের সাথে থাকুক।ওর এই সুখ সহ্য করতে পারিনা আবার ওর তিল পরিমান কষ্টও আমি সহ্য করতে পারবোনা।ওকে না পাওয়ার যন্ত্রণা কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে আমাকে।’

‘ভালোবাসা মানে কি শুধু স্বামী-স্ত্রীর জীবনযাপন?আর কোন সম্পর্ক কি গড়ে উঠতে পারেনা?ভালোবাসার এমন কোন সম্পর্ক হয়না যেই সম্পর্কের কোন নাম থাকেনা?যেখানে কোন চাওয়া-পাওয়া থাকেনা?’

এমনইভাবে একের পর এক প্রশ্ন করে নিপা।আরাফ বিস্ময়ের জগত থেকে নিপাকে দেখতে থাকে।মনে মনে বলে এমন কোন নামহীন ভালোবাসার সম্পর্কের কথা বলতে চাইছে নিপা?পরক্ষণেই আরাফ বুঝতে পারে অন্তর সাথে তার সম্পর্কের কোন নাম নেই।তার ভালোবাসা কোন নাম পায়নি,কোনদিন পাবেও না।সবাই শুধু জানবে আরাফ অন্তকে ভালোবাসতো আর সারাজীবন ভালোবাসেছে।

আরাফ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে দূরে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে বলল,

‘তোকে আমি স্নেহ করি।কোনদিন অন্তর ব্যাপারে আর কিছু বলতে আসবিনা।তোর প্রতি যেই ভাল লাগা আছে সেটা এভাবেই থাকতে দে।তুই থাকতে না পারলে চলে যা,কেউ ধরে নেই।’

নিপা আরাফের পাশাপাশি দাঁড়ালো।আরাফ একনজর নিপার দিকে তাকালো।হলদেটে ফর্সা মুখে রাজ্যের মায়া এসে ভর করেছে।নিপার পরনে হালকা মেরুন রঙের সালোয়ার কামিজ।নাকের উপর চকচক করছে এক বিন্দু ডাইমোন্ডের নাক ফুল।আরাফ অন্যদিকে তাকালো।নিপার এই সৌন্দর্য তার হৃদয়কে স্পর্শ করতে পারছেনা।নিপার এত সুন্দর রুপ কিছুতেই আরাফের কাছে আকর্ষণীয় মনে হচ্ছেনা। নিপা সামনের দিকে তাকিয়ে বলল,

‘ভাল লাগা আর ভালোবাসার দূরুত্ব কি খুব বেশি?কতটা বেশি?আজকের ভালোলাগা দশবছর কিংবা তারও অধিক সময় পর ভালোবাসা হতে পারেনা?আপনি সেই দূরুত্ব সারাজীবনে একবারও পেরুতে পারবেন না?আপনার ভাল লাগা এক মুহূর্তের জন্য ভালোবাসা হতে পারবেনা?’

আরাফ স্পষ্ট করে বলল,
‘না।’

নিপার একটা দীর্ঘশ্বাস বাতাসের সাথে মিলিয়ে গেল।মুহূর্তেই সব বিষাদ মন থেকে ঝেরে ফেলে বলল,

‘শোনো আরাফ ভাইয়া?’

আরাফ চমকে নিপার দিকে তাকালো।নিপা ছোটবেলায় আরাফকে তুমি বলতো।আজ এতগুলো বছর পর আবার বলছে।নিপা মুচকি হেসে বলল,

‘ভেবেছিলাম তোমাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কটা এগিয়ে নিয়ে যাব কিন্তু ওটা এগুবে না।আমরা নাহয় বন্ধু হয়ে থাকলাম।তুমি যেমন অন্য কাউকে ভালোবাসতে পারবেনা আমিও পারবোনা।আমি হয়তো তোমার আদার হাফ হতে পারিনি কিন্তু তুমি আমার আদার হাফ।যখন তোমার আশেপাশে থাকি আই ক্যান আন্ডারস্ট্যান্ড হুয়াই থিংকস ডিডন’ট ওয়ার্ক আউট উইথ এনিওয়ান এলস কজ আই লাভ ইউ।ভালোবাসি আমি যে তোমায়।’

সব আলো নিভে যায়।ঘুটঘুটে অন্ধকারে নিপা আরাফের এক হাত আলতো করে জড়িয়ে ধরে।ঠিক এমনই করে যেন কোনো একদিন আরাফকে স্পর্শ করেছিল নিপা।ঠিক কোনদিন নিপার মনে নেই।আরাফ নিশ্চুপ হয়ে অন্ধকার আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে।ভালোবাসার কথা ভেবে শূন্যতা আর হাহাকারে তার দুচোখের পাড়ি ডিঙ্গিয়ে গড়িয়ে পড়লো মোটা মোটা দুফোটা অশ্রু।যেই অশ্রু বার বার একই কথা বলে,

ভালোবাসি,ভালোবাসি,ভালোবাসি আমি যে তোমায়।

রজনীগন্ধা ফুলের গন্ধে পুরো ঘর ম ম করছে।সাদা চাদরে ঢাকা বিছানায় অসংখ্য গোলাপের পাপড়ি ছড়ানো আছে।ঘরের এক কোনায় টিমটিম করে জ্বলছে ছোট-বড় আর মাঝারি সাইজের তিনটে মোমবাতি।ইচ্ছেমতি লাল বেনারসি পরে একহাত ঘোমটা টেনে বিছানার মাঝখানে বসে আছে।মধ্যরাত পার হয়ে গিয়েছে প্রান্ত এখনও ঘরে আসছেনা।তিনঘণ্টা ধরে বসে থেকে থেকে ইচ্ছেমতির পায়ে ঝিন ধরে গিয়েছে।ফোন টিপে টিপে ফোনের চার্জও শেষ তাই ইচ্ছেমতি খুব বিরক্ত হচ্ছে।ডান পা বিছানায় সটান করে মেলে দিতেই দরজা খুলে হুড়মুড় করে প্রান্ত ঘরে ঢুকলো।বন্ধুরা প্রান্তর কাছ থেকে ঘর সাজানোর টাকা নিয়ে তাকে এক প্রকার ধাক্কা দিয়ে ঘরের ভিতর ঢুকিয়ে দিয়েছে।প্রান্তকে দেখেই ইচ্ছেমতি তড়িৎ গতিতে পা গুটিয়ে ঠিক হয়ে বসলো।প্রান্ত ইচ্ছেমতির দিকে অপ্রস্তুত হেসে বিছানার কাছে এগিয়ে এসে বলল,

‘হ্যালো।’

ইচ্ছেমতির মেজাজ খারাপ হয়ে গেল।ঘন্টার পর ঘন্টা তাকে একা ঘরে বসিয়ে রেখে মহারাজ এতক্ষণে এসে বলছেন হ্যালো।ইচ্ছেমতি এই হ্যালো শব্দটা নিতে পারলোনা।এক ঝটকায় ঘোমটা সরিয়ে প্রান্তর দিকে তাকিয়ে তেজী গলায় বলল,

‘হোয়াট হ্যালো?কয়টা বাজে জানেন?অলমোস্ট দুটো বাজে।দুটোর সময় ঘরে ঢুকে বলছেন হ্যালো?আপনি থাকুন আপনার হ্যালো নিয়ে গুড নাইট।’

ইচ্ছেমতি ফট করে অন্যপাশ ফিরে শুয়ে পরলো।প্রান্ত ব্যস্ত হয়ে বিছানায় বসে বলল,

‘ওয়েট ওয়েট ওয়েট,কিছু কথা আছে তোমার সাথে।’

ইচ্ছেমতি চোখ বন্ধ করে রেগে বলল,

‘শুনুন আপনার শাঁকচুন্নি গার্লফ্রেন্ডের কথা আমাকে আর কখনও বলবেন না।মনে রাখবেন আপনার বিয়ে হয়ে গেছে।এখন মন দিয়ে সংসার করবেন একদম অন্য মেয়েদের পেছনে ঘুর ঘুর করবেন না।’

প্রান্ত মুচকি হেসে বলল,

‘বউ পাত্তা না দিলে তো অন্য মেয়ের পেছনেই ঘুরতে হবে।যাই আমি বরং গার্লফ্রেন্ডের সাথে কথা বলি,তুমি ঘুমাও।গুড নাইট।’

ইচ্ছেমতি উঠে বসলো।থমথমে মুখ করে বলল,

‘বলুন।’

প্রান্ত হালকা কেশে নিল।সে এখন ইচ্ছেমতিকে ভালোবাসার প্রপোজাল দিবে।প্রান্ত জীবনেও কোনদিন কোন মেয়েকে প্রপোজ করেনি তাই একটু নার্ভাস ফিল করছে।প্রান্ত ইচ্ছেমতির মুখোমুখি বসলো।ইচ্ছেমতির ডানহাতটা টেনে নিয়ে একটা ফুটন্ত লাল গোলাপ দিয়ে হাত ছেড়ে দিল।ইচ্ছেমতি গোলাপ পেয়ে খুব খুশি কিন্তু সেটা প্রকাশ করলোনা।ভ্রু কুচকে গোলাপের দিকে তাকিয়ে থাকলো।প্রান্ত মুচকি হেসে বলল,

‘আই উইল লাভ ইউ।’

ইচ্ছেমতি ভ্রু কুচকে প্রান্তর দিকে তাকিয়ে বলল,

‘ইউ উইল?আপনি আমাকে ভালোবাসবেন?এখন বাসেন না?আগে বাসেননি?’

প্রান্ত আত্মবিশ্বাসের সাথে বলল,

‘না আগে কখনও তোমাকে ভালোবাসিনি এখনও বাসিনা বাট ফিউচারে বাসবো।সেজন্য প্রপোজ করলাম,ওই গোলাপ দিয়ে।উইল ইউ লাভ মি?’

ইচ্ছেমতি মুচকি হেসে বলল,

‘আসলে আমি আপনাকে ভালোবাসতাম ইভেন এখনও ভালোবাসি বাট ফিউচারে ভালোবাসবোনা।’

প্রান্ত মৃদু হেসে বলল,

‘ওকে,ইট ডাজন’ট ম্যাটার।তুমি যে আমাকে ভালোবাসতা আর এখনও বাসো,আই মিন সব সময় প্রেজেন্ট ফর্মে থাকবা এটাই ইনাফ আর আমি ডিসিশন নিয়েছি কাল থেকে তোমাকে প্রচুর ভালোবাসবো।’

ইচ্ছেমতি মুখ বাঁকা করে অন্যদিকে তাকিয়ে বলল,

‘আজ থেকে নয় কেন?’

প্রান্তর ফোন বেজে উঠলো।নির্ভীক ফোন করেছে।প্রান্ত কিঞ্চিৎ রেগে ফোন কানে ধরে বলল,

‘কিরে?কার কাছে ফোন করেছিস?কল যে আমার কাছে আসলো।তোরা কি আমাকে ডিস্টার্ব করার প্ল্যান করছিস নাকি?’

ওপাশ থেকে নির্ভীকের উত্তেজিত কন্ঠ শোনা গেল,
‘প্রান্ত?তোর বাইকের কিটা কোথায় রেখেছিস?এখনই লাগবে ওটা।’

প্রান্ত ভ্রু কুচকে চিন্তিত হয়ে ব্যালকনির দিকে যেতে যেতে বলল,

‘কেন কি হয়েছে?এতরাতে বাইক কি করবি?’

‘আমি এখানে থাকতে পারবোনা।ইম্পসিবল!পাগল হয়ে যাব।কোথায় রেখেছিস কি?’

প্রান্ত মুচকি হেসে বলল,

‘আম্মুর কাছে আছে মনে হয়।’

নির্ভীক আর কিছু না বলে কল কেঁটে দিয়েছে।প্রান্ত হাসতে হাসতে ব্যালকনি থেকে ঘরে আসলো।ইচ্ছেমতি চিন্তিত হয়ে বলল,

‘কি হয়েছে?’

প্রান্ত বিছানায় বসে বলল,

‘নির্ভীক বাসায় যাবে।বউ ছাড়া থাকতে পারছেনা।’

‘অহ।’

‘তাহলে?’

ইচ্ছেমতি ভ্রু কুচকে বলল,

‘কি তাহলে?’

প্রান্ত ইচ্ছেমতির একহাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে মুচকি হেসে বলল,

‘ভালোবাসা বাসির ঝামেলা মিটে গেল?’

ইচ্ছেমতি ঝারা মেরে হাত সরিয়ে নিয়ে রেগে বলল,

‘ঝামেলা?ভালোবাসা আপনার কাছে ঝামেলা?’

কথা কথা কথা,কথা পাকানো,কথা মোচড়ানো,কথা নিয়েই লড়াই করতে করতে একসময় দুজন সব ঝামেলা মিটিয়ে নিল।ভালোবাসা দিয়েই শুরু করলো ভালোবাসার নতুন জীবন।

চলবে…………

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here