ভালোবাসি আমি যে তোমায় ২*পর্ব:৬

0
1999

#ভালোবাসি_আমি_যে_তোমায়_২
#Sohani_Simu

৫.

বিকেলে আমি,ইচ্ছে আর রিংকু বাসার সামনে কাঠগোলাপ গাছের নিচে বসে টবে মাটি তৈরী করছি।জারিফ ভাইয়া আমাদের ভ্যানভর্তি ফুলের চারা এনে দিয়েছে।ইচ্ছে তিন চারটে টবে মাটি তৈরী করেই দুই হাত ঝেরে টুল থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
–ধূর এসব করতে ভাল লাগছেনা।তোরা কাজ কর আমি বরং নির্ভীক ভাইয়ার কাছে যেয়ে দেখি উনি বেলকুনিতে দাঁড়িয়ে কি দেখছেন।(মুচকি হেসে বেলকুনির দিকে তাকিয়ে)

আমি ভ্রু কুচকে বেলকুনিতে তাকিয়ে দেখি উনি বেলকুনির গ্রীলে হেলান দিয়ে বুকে হাত গুজে দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন আর কুকুরটা উনার পায়ের কাছে শুয়ে আছে।রিংকু হাত ঝেরে উঠে দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,

—অন্ত আপু তুমি থাকো আমি চাঁদ ভাইয়ার সাথে একটা দরকারি কথা বলে আসি।
–কিসের দরকারি কথা?(টবে মাটি তুলতে তুলতে)
—কিভাবে ভাইয়ার ভার্সিটিতে ভর্তি হতে পারবো সেসব।(বাসার দিকে যেতে যেতে)

ইচ্ছেও রিংকুর পেছন পেছন চলে গেল।আমি উঠে দাঁড়িয়ে নির্ভীক ভাইয়ার দিকে তাকালাম।উনি মুচকি হাসলেন।আমিও উনাকে একটা সৌজন্য হাসি দিয়ে বাসার দিকে গেলাম।ভেতরে এসে দেখি রিংকু আর ইচ্ছে হাত ধুচ্ছে।আমিও ওদের সাথে হাত ধুলাম।নির্ভীক ভাইয়া সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে বললেন,
–কাজ শেষ তোমাদের?

ইচ্ছে বলল,
–না কেবল তো শুরু হলো এখনও অনেক কাজ।

রিংকু দ্রুত উনার পাশে যেয়ে উনার হাত ধরে টানতে টানতে বলল,
–চাঁদ ভাইয়া শোনো তোমার সাথে আমার ইমপর্টেন্ট কথা আছে।

–তোর আবার কিসের এত ইমপর্টেন্ট কথা?(ভ্রু কুচকে)

রিংকু উনাকে টেনে নিয়ে যেয়ে ড্রইং রুমের সোফায় বসালো।আম্মু ট্রে হাতে নিয়ে কিচেন থেকে বেড়িয়ে ট্রে টা ইচ্ছের হাতে দিয়ে বলল,
–এই নে তোদের নাস্তা সবাই খেয়ে নে।(ব্যস্ত কন্ঠে)

আম্মু আবার কিচেনে ঢুকে গেল।ইচ্ছে ট্রে নিয়ে সোফায় বসলো।এক বাটি নুডুলস্ নির্ভীক ভাইয়াকে আর একবাটি রিংকুকে দিয়ে নিজে একবাটি হাতে নিল তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
–ওই হ্যালো বেহেনজি!!এখানে আয়।

আমি ধীরে ধীরে ইচ্ছের পাশে গিয়ে বাটি নিয়ে সোফায় পা তুলে বসলাম।রিংকু খেতে খেতে বলল,
—আচ্ছা ভাইয়া?তোমার ভার্সিটিতে পড়লে ইন্জিনিয়ার হওয়া যায়?

নির্ভীক ভাইয়া চামচে নুডুলস পেচাতে পেচাতে বললেন,
—হুম যায়,তুই ইন্জিনিয়ার হবি নাকি?
–হুম আমিও তোমার সাথে ভার্সিটিতে যাবো।তোমাদের মিসের সাথে দেখা করলে আমাকে ভর্তি করে নিবে?(উৎসাহী হয়ে)

নির্ভীক ভাইয়া হাসতে হাসতে বললেন,
—ওই লিলিপুট আগে প্রাইমারি পাশ কর দেন সেকেন্ডারির মিসের সাথে গিয়ে দেখা করিস।

ইচ্ছে হাসতে হাসতে বলল,
–তুই নাকি ডক্টর হবি?ডক্টর হলে মেডিকেলে পড়তে যেতে হয় ভুটু।

রিংকু বলল,
–না না ডক্টর হবো না,অন্ত আপুর তো ডক্টর পছন্দ নয়।ডক্টর হলে অন্ত আমাকে বিয়ে করবে না,তাই না অন্ত আপু?

আমি বাটির দিকে তাকিয়ে খেতে খেতে বললাম,
–হুম।

রিংকু সবাইকে শুনিয়ে বলল,
–দেখেছ?আমি বললাম না ডক্টর হলে অন্ত আপু তাকে বিয়ে করবেনা।সেই জন্য আমি ইন্জিনিয়ার হবো।আম্মুকে বলেছি আমি অন্ত আপুকে বিয়ে করবো তাই আমাকে চাঁদ ভাইয়ার ভার্সিটিতে ভর্তি করিয়ে দিতে।আম্মু ভর্তি করিয়ে দিতে চেয়েছে।

ইচ্ছে হাসতে হাসতে বলল,
–তুই অন্তকে বিয়ে করবি?নির্ভীক ভাইয়া শুনেছেন?ও নাকি অন্তকে বিয়ে করবে।

নির্ভীক ভাইয়া হাতের বাটিটা শব্দ করে টেবিলে রাখলেন।শব্দ শুনে আমি উনার দিকে তাকালাম।উনি আমার দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে বললেন,
–তুমি এই মোটুটাকে বিয়ে করবা?

আমি মাথা ডানে বামে নাড়ালাম যার অর্থ না।উনি মুচকি হেসে বললেন,
—না?কেন করবা না?ছেলে তো মাশআল্লাহ নায়ক ডিপজলের মতো।কয়েকদিন পর ইন্জিনিয়ারও হয়ে যাবে তাও করবা না।

আমি মুখ কালো করে উনার দিকে তাকালাম।উনি কি আমাকে হিউমিলেট করলেন??বুঝতে পারলাম না।রিংকু বলল,
—ডিপজল নয় আমি অগির মতো দেখতে।

নির্ভীক ভাইয়া হাসতে হাসতে বললেন,
–এই অগিটা আবার কি জিনিস?

ইচ্ছে হাসতে হাসতে বলল,
–অগি কার্টুন।অন্তর অগি পছন্দ সেজন্য মনে হয় ভুটুটা অগি হতে চাইছে।ভুটুরে অনেক এগিয়েছিস আর এগোস না।(রিংকুর দিকে তাকিয়ে)

নির্ভীক ভাইয়া আমার দিকে তাকিয়ে নরম কন্ঠে বললেন,
–অহ তোমার অগি পছন্দ?
–হুম।(থমথমে মুখ করে)

বলেই আমি বাটি টেবিলে রেখে আম্মুর কাছে চলে গেলাম।একটু পর ফিরে এসে দেখি আমার বাটি খালি।আমি ভ্রু কুচকে ইচ্ছের দিকে তাকিয়ে রাগী কন্ঠে বললাম,
–সব খেয়ে নিলি?
–আমি খাইনি তো।(মুচকি হেসে)

রিংকু বলল,
–চাঁদ ভাইয়া তোমার বাটি খেয়েছে।

আমি রাগী চোখে নির্ভীক ভাইয়ার দিকে তাকালাম।উনি ইনোসেন্ট মুখ করে বললেন,
–আমি ভেবেছি তুমি আর খাবানা আমার তো অনেক ক্ষুধা পেয়েছিল তাই তোমারটাও খেয়ে নিয়েছি।তুমি আরও খাবা?এনে দিব?

আমি রাগী কন্ঠে বললাম,
—আপনি সকালেও আমার কফি খেয়েছেন।আপনি সত্যি একটা ডাইনোসর!!

বলেই আমি ফাঁকা বাটি নিয়ে কিচেনে যেতে লাগলাম।পেছন থেকে হাসির আওয়াজ পাচ্ছি।ওদের হাসি শুনে আমি মুৃখ ফুলিয়ে আম্মুর কাছে গেলাম।

রাতে ডিনার করে রুমের মধ্যে বেডে বসে ইচ্ছের সাথে হেসে হেসে গল্প করছিলাম তখনই ভাইয়া রুমে আসলো।আমরা ঠিক হয়ে বসতেই ভাইয়া এসে বেডে বসে বলল,
—কাল সকালে আমরা চলে যাচ্ছি।

আমি কান্না মুখ করে বললাম,
—ভাইয়া!!!

ইচ্ছে একটু মন খারাপ করে বলল,
—কালই যাবা আর দুদিন থেকে যাও।

ভাইয়া বলল,
–নাহ আর থাকা যাবেনা অফিসে প্রচুর কাজ।তোরা মন খারাপ করিস না।আর কয়েকটা দিন এখানে থাক সামনের মাসেই আমাদের বাসা কমপ্লিট হয়ে যাবে তখন আমি কুহেলীকে নিয়ে এখানে চলে আসবো।ছোটপাখি তুই বল,আমরা আসবো নাকি বাবা-মাকে পাঠাবো?দুমাস পর আফ্রার ফাইনাল এক্সাম তাই বাবা-মার ওখানে থাকায় ভাল হবে।আর এখানে নতুন অফিসে কাজের চাপ থাকবে প্রচুর বাবা এখন এত চাপ নিতে পারবেনা।আমি আর কুহেলী আসি তাহলে?(জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে)

আমি মুখ মলিন করে বললাম,
–আমি তো ঢাকায় প্রাইভেটে ভর্তি হতে চাইলাম।

ভাইয়া একটু রাগী কন্ঠে বলল,
—পাবলিক ছেড়ে প্রাইভেটে যাবি কেন?কি প্রবলেম এখানে তোর?তুই এখানেই থাকবি।এখানে তোদের কোন প্রবলেম হবেনা।

আমি দুঃখী মুখ করে বললাম,
–তোমরা চলে গেলে আমি এখানে থাকতে পারবোনা।

ভাইয়া রেগে বলল,
–কয়েকটা দিন থাকতে পারবিনা?এমন কেন তুই হ্যা?এসব নিয়ে আমি আর একটা কথাও শুনতে চাইনা।অনেক রাত হয়েছে ঘুমিয়ে পর তোরা।

বলেই ভাইয়া চলে গেল।সঙ্গে সঙ্গে আমি কম্বল মুড়িয়ে শুয়ে পরলাম।ইচ্ছে কম্বলের উপর দিয়ে আমার একবাহুতে হাত রেখে বলল,
–এই জানু?মন খারাপ করছিস কেন?আর কয়েকদিন পরই তো ভাইয়া আর ভাবি এখানে চলে আসবে।মাসের শেষেই তো ভাইয়ার বিয়ে।বিয়েতে কি করব না করব এসব ভাবতেই এই কয়দিন চলে যাবে।আমরা কাল থেকেই শপিং শুরু করে দিব ওকে?

আমি কিছু বললাম না চুপচাপ কান্না আটকানোর চেষ্টা করছি।সকাল হলেই ওরা চলে যাবে ভাবতেই কান্না পাচ্ছে।ইচ্ছের ফোন বাজতেই ও আমাকে ছেড়ে দিয়ে ফোন রিসিভ করে বলল,
ওপাশ:……
ইচ্ছে:তোমার কলিজা বসে আছে।এখন তার মন খারাপ কারন তার জানুরও মন খারাপ।

ওপাশ:……..

ইচ্ছে আমার মুখ থেকে কম্বল সরিয়ে দিয়ে আমার কানে ফোন ধরে বলল,
–কথা বল,ভাইয়া ফোন দিয়েছে।

আমি একপাশ হয়ে শুয়ে চোখ বন্ধ করে বললাম,

—আরাফ ভাইয়া!!!

আরাফ ভাইয়া কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
—আমার জানপাখি!কি করছো তুমি?মন খারাপ করে আছো কেন?

–ভাইয়া বকেছে।(মন খারাপ করে)
–আবার বকেছে?ওকে আমি নোট করে রাখছি দেশে ফিরলেই জারিফের হাড়গোর ভেঙ্গে দিব।
–তুৃমি শুধু ফিরে আসো একবার আমি তোমার হাড়গোর ভেঙ্গে দিব।(মুখ ফুলিয়ে)
–হুম ফিরবো তুমি এবার একটা কিউট স্মাইল দাও তো।
–দিব না।এলিয়েনদের সাথে আমি কথা বলিনা,বাই।

বলেই কল কেটে দিলাম।ইচ্ছে আমাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে বলল,
–ঘুম পাচ্ছে ঘুমা।

আমি চুপচাপ চোখবন্ধ করে শুয়ে থাকলাম।খুব মন খারাপ লাগছে।আম্মুকে ছাড়া কখনও বাহিরে থাকা হয়নি তাই আমার এই দশা।ইচ্ছের তেমন কিছু মনেই হয়না কারন ও ছোটবেলা থেকেই নিজের বাবা-মাকে ছেড়ে আমাদের বাসায় থেকেছে,আমি যেখানে ও সেখানে।

সকালে ঘুম থেকে উঠেই আমার কান্নাকাটি শুরু।আমাকে কাঁদতে দেখে ভাইয়া আর আম্মু আরও আগেই বেড়িয়ে গেল।ওরা যেতেই আমি আরও বেশি কান্না করতে লাগলাম।অ্যাঙ্কেল-অ্যান্টি কাজে চলে গিয়েছে।বাসায় শুধু আমি,ইচ্ছে,খালা আর নির্ভীক ভাইয়া আছি।আমি সোফায় বসে থেকে হেঁচকি তুলে কাঁদছি আর ওরা আমার দিকে মলিন মুখে তাকিয়ে আছে।নির্ভীক ভাইয়া আমার পাশে এসে বসলেন।আমি একটু সরে বসবো তখনই উনি আমার হাত ধরে আটকিয়ে নরম কন্ঠে বললেন,

–এত কাঁদছো কেন?ওরা চলে গিয়েছে,ইট’স ওকে।ওরা আবার আসবে নাহলে কয়েকদিন পর তুমি যাবা,আমি নিয়ে যাবো তোমাকে।প্লিজ ডোন্ট ক্রাই।

আমি একহাত দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বললাম,
–কবে যাবো আমরা?

উনি মুচকি হেসে বললেন,
–যাবো একদিন।এখন চলো তো গার্ডেনিং করব আমরা।না না ওয়েট আগে খেতে হবে তোমার।খালা নাস্তা নিয়ে আসো।(খালার দিকে তাকিয়ে)

আমি খেয়াল করে দেখলাম নির্ভীক ভাইয়ার হাত মৃদু কাঁপছে।আমি উনার থেকে আমার হাত ছাড়িয়ে নিতে নিতে বললাম,
–খাব না আমি।

ইচ্ছে আমার অন্যপাশে বসে আমার অন্যহাত ধরে বলল,
–খাবিনা মানে?খেতেই হবে।

নির্ভীক ভাইয়া আমার ডান হাতের আঙুলের ভাঁজে নিজের আঙুল গেঁথে বললেন,
–খাওয়া শেষ করে সবগুলো ফুলের চারা ছাদে নিয়ে যাব ওকে?(আমার দিকে তাকিয়ে)

আমি কিছু বললাম না।উনি আবার বললেন,
—ওকে বলো।

আমি মিন মিন করে ওকে বললাম।উনি মুচকি হেসে আমার চোখ মুছে দিয়ে আমাকে খাওয়াতে লাগলেন।

চলবে…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here