ভালোবাসি তাই পর্ব-১৪

0
1901

#ভালোবাসি তাই
Part:14
Writer: Afifa Jannat Maysha

🍁

সবাই মিলে বিচে ঘুরছি। চারপাশে হাজারো মানুষ। এতো লোকজনের চিৎকার চেচামেচিতে সমুদ্রের পানির আওয়াজটা শুনারও উপায় নেই। এখানে না এলে শব্দ দূষণ কাকে বলে বুঝতেই পারতাম না। ছোট ছোট ঢেউগুলো পায়ে এসে আছড়ে পরায় ছোটখাটো ধাক্কা অনুভুত হচ্ছে। সুর্যের আলোর তীব্রতার কারণে ভালো করে চোখ মেলে তাকানো যাচ্ছে না।

ছেলেদের মাঝে অনেকেই পানিতে নেমে পরেছে। আর আমরা মেয়েরা তীরে পা ভিজিয়ে দাঁড়িয়ে আছি।

সবাই নানা আনন্দ করতে ব্যাস্ত থাকলেও আমি ব্যাস্ত লজ্জা থেকে বাঁচতে। আমার লজ্জা পাওয়ার একমাত্র কারণ রাহুল ভাইয়া। সবার সাথে রাহুল ভাইয়াও আছেন। উনার মাঝে কোনোরকম অস্বাভাবিকতা দেখতে পারছি না আমি। প্রত্যেকের সাথেই দিব্যি স্বাভাবিক আচরণ করছেন উনি। অথচ আমি উনার দিকে তাকাতেই পারছি না। তাকালেই শুধু কালকের ঘটনার কথা মনে পরছে আমার।

একটা জিনিস সেই কখন থেকে লক্ষ্য করছি। আমি যতই রাহুল ভাইয়ার আড়ালে আড়ালে থাকতে চাইছি উনি ততই আমার আশেপাশে চলে আসছেন। বুঝতে পারছি উনি ইচ্ছে করেই এমন করছেন। আমাকে লজ্জা পেতে দেখে উনার কি লাভ কে জানে।

হঠাৎই সায়ন ভাইয়ার কথা মনে পরলো আমার। উনাকে দেখতে পারছি না কোথাও। না চাইতেও চোখদুটো শুধু উনাকেই খুঁজে চলেছে। দূরে একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম সায়ন ভাইয়াকে। মনে হচ্ছে ফোনে কারো সাথে কথা বলছেন।

আমি ধীরে এগুতে লাগলাম সেদিকে। উনার কাছে গিয়ে পেছন থেকে বললাম আমি

– এখানে একা একা দাঁড়িয়ে কি করছেন?

আমার গলা শুনে চমকে উঠলেন সায়ন ভাইয়া। হয়তো এমুহূর্তে আমাকে এক্সপেক্ট করেন নি উনি।

– কিছু না।

– তাহলে সবার সাথে ওখানে যান।

– ইচ্ছে নেই।

– এটা কেমন কথা? ইচ্ছে নেই কেনো?

– সেটা তোকে বলতে যাবো কেনো। আর তুইতো ভালোই ইনজয় করছিস সবার সাথে । হঠাৎ আমার কথা মনে হলো কেনো?

– বিশেষ কোনো কারণ নেই।ওখানে সবাই আছে শুধু আপনিই নেই। তাই আরকি….

– হুম সেটাই তো। বিশেষ কোনো কারণ থাকবে কেনো? তোর এই বিশেষ কারণের জন্য তো বিশেষ মানুষ আছেই।

– মানে?

– মানেটা তো তুইই ভালো জানিস।

– কিসব বলছেন আপনি। আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।

– না বুঝাই ভালো। থাকনা তুই তোর মতো। আমাকে নিয়ে ভাবতে হবে না তোর। তার জন্য তো মালিশা আছেই।

– হুম জানি।

আমার উত্তরটা মনে হয় পছন্দ হয়নি সায়ন ভাইয়ার। কাছে এসে আমার বাম গাল শক্ত করে চেপে ধরলেন উনি। আমি উনার এমন আচরণে আশ্চর্য হয়ে গেছি। মুহুর্তেই উনার চোখের রং লাল হয়ে গেলো। সায়ন ভাইয়ার এমন চাহনি আমি চিনি। উনি যখন খুব রেগে যান তখন উনার চোখ লাল হয়ে যায়। কিন্তু এখন এখন উনার রাগের কারণটা কি বুঝতে পারছি না।উনি আমার গাল চেপে ধরেই বলতে লাগলেন

– কেনো জানবি তুই? বল কেনো জানবি? আমায় নিয়ে ভাবার জন্য মালিশা কেনো থাকবে? অন্যদের নিয়ে ভাবতে এতই ব্যাস্ত হয়ে গেছিস যে আমার কথা ভাবতে ইচ্ছে করে না । কেনো এত ব্যাস্ততা তোর?

সায়ন ভাইয়া উনার মতো বলেই চলেছেন। আমি স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছি শুধু। উনার কোনো কথাই কানে আসছে না আমার।

সায়ন ভাইয়া রেগে গেলে কোনোকিছুই মাথায় আনেন না। তখন উনি কি করে বসেন নিজেই জানেন না। উনি আমার গাল ছেড়ে দিয়ে দূরে সরে দাঁড়ালেন। আমি এখনো ওভাবেই দাঁড়িয়ে আছি। চারপাশে কি হচ্ছে কিছুই মাথায় আসছে না আমার।

দুজনেই চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি। সায়ন ভাইয়া ইদানিং যেমন বিহেভ করছেন তা উনার সাথে যায় না। এই ভালো তো এই খারাপ। পাশে তাকিয়ে দেখলাম সায়ন ভাইয়া নেই। আমিও আর খুঁজে দেখার প্রয়োজন বোধ করলাম না। ভাবতে চাই না আর উনাকে নিয়ে। সত্যিই তো উনার জন্য তো আপু আছে। কিন্তু আমি অন্যদের নিয়ে ভাবতে ব্যাস্ত হয়ে গেছি এই কথাটা কেনো বললেন উনি? এসব চিন্তা করতে গিয়ে আজকের দিনটাকে মাটি করতে চাই না। কিছু কথার মানে নাহয় না-ই জানলাম।

আবার চলে এলাম সবার মাঝে। কেউ সেলফি তুলছে, কেউ ভিডিও করছে কেউবা স্পিডবোটে চড়ে ঘুরছে। সারাকে খুঁজছি আমি। বিচে আসার পর থেকেই সে উধাও। কোথায় আছে কে জানে। কিছুদূরেই দেখতে পেলাম সারাকে। একা একা ঝিনুক কুড়াচ্ছে সে।তার স্বপ্ন ছিলো কক্সবাজার এসে খালি পায়ে হেঁটে ঝিনুক কুড়াবে। এখন তা করছে ঠিকই তবে খালি পায়ে নয়। রোদের তাপে অনেক গরম হয়ে আছে বালি। তাই খালি পায়ে হাঁটা প্রায় অসম্ভব।

তার কাছে যেতেই সে চোখ তুলে তাকালো আমার দিকে। মুচকি হেঁসে উঠে দাঁড়ালো। কতক্ষণ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে চোখ ঘুরিয়ে নিলো সারা।

– চল হাঁটি।

সারার কথার মধ্যে কেমন গম্ভীরতা ফুটে উঠছে আজ। সবসময় বোকা বোকা কথা বলে আমায় রাগিয়ে তোলা মেয়েটার এমন গম্ভীর আচরণ অবাক হওয়ার বিষয়। আমিও অবাক হয়েছি। তবে আমার চেহারায় তা ফুটিয়ে তুলছি না। সারার প্রস্তাবে সম্মতি জানিয়ে হাঁটা শুরু করলাম তার পাশাপাশি।

চুপচাপ হাঁটছি আমি আর সারা। আমার কাছে এটা ভালো লাগছে না একটুও। সারার বকবক করাটাই ভালো লাগে আমার। এমন চুপচাপ স্বভাব নয়। আমি যখন সারার এমন আচরণ নিয়ে গবেষণা করতে ব্যাস্ত তখনই সে বলে উঠলো

– পারবি না। তুই কিছুতেই পারবি না।

ওর কথার আগামাথা কিছুই বুঝলাম না আমি। কথা নেই বার্তা নেই হুট করে বলছে পারবো না। কি পারার কথা বলছে সেটাই তো জানি না।

– কি পারবো না আমি?

– সায়ন ভাইয়াকে ভুলতে পারবি না।

– মানে?

এবার হাঁটা থামিয়ে আমার দিকে ঘুরলো সারা। আঙুল দিয়ে আমার গাল ইশারা করে বললো

– এমন অবস্থা হয়েছে কি করে?

– কেনো কি হয়েছে?

– পুরো গালটাই লাল হয়ে গেছে তোর।

– ওহ। না মানে আসলে তখন গালটা চুলকাচ্ছিলো তো। তাই খুব জোরে জোরে চুলকেছিলাম। এজন্য লাল কার্ড গেছে।

আমার উত্তরে আবারো হাঁসলো সারা। বুঝতে পারছি না এখানে হাঁসির কি আছে। আমি তো কোনো জোক্স শোনাই নি। ঠোঁটে হালকা হাসি ঝুলিয়ে রেখেই সারা বললো

– আমি সবিটাই দেখেছি। তাই মিথ্যে বলে লাভ নেই। এতোটা ভালো কি করে বাসিস তুই? হাজার অপমানের পরেও সায়ন ভাইয়াকে ভুলতে পারিস নি। হ্যাঁ, হয়তো আগের মতো পাগলামি করিস না। কিন্তু তুই স্বীকার করতে বাধ্য যে তুই এখনো উনাকে ভালোবাসিস। কি ঠিক বললাম তো?

– ভালোবাসা কি শেষ হয়ে যাওয়ার জিনিস? একদমই না। তবে হ্যাঁ, জীবনে চলার পথে একটাসময় হয়তো ভালোবাসাটা বাস্তবতার আড়ালে চাপা পরে যায়। কিন্তু শেষ হয়ে যায় না। আমার ক্ষেত্রেও হয়তো তেমন কিছুই হবে।

– তোকে একটা কথা বলি?

– তুই কিছু বলার জন্য পারমিশন নিস কবে থেকে? যা বলার বল

– সায়ন ভাইয়াকে ভুলার জন্য নতুন কাউকে তোর জীবনে জায়গা দিতে পারিস না?

– মানে?

– মানে, এমন কাউকে নিয়ে ভাব যে তোকে ভালোবাসে। তাকে নিয়ে নয় যাকে তুই ভালোবাসিস।বুঝতে পারছিস কি বলছি।

– তাহলেই কি সায়ন ভাইয়াকে ভুলে যাবো?

– পুরোপুরি জানি না। তবে আমার মনে হয় পারবি। অন্তত চেষ্টা তো করতে পারিস।

– ভেবে দেখবো।

– তোর যা ইচ্ছা। আমি জোর করছি না। কিন্তু এতে সবার ভালো হবে। সায়ন ভাইয়া আর মালিশা আপুর কথা ভেবেই নাহয় চেষ্টা কর। আর তোর আশেপাশেই হয়তো এমন কেউ আছে বলে আমার মনে হয়।

– জানি না আমি। প্লিজ, এসব কথা বাদ দে। আমার ভালো লাগছে না। ঘুরতে এসেও এসব ঝামেলা নিয়ে ভাবতে চাই না আমি।

– আচ্ছা ঠিক আছে। এখন চল।

– কোথায়?

– সামনের দোকানগুলোতে। অনেক কিছু কিনবো আজ।

– ঠিক আছে চল।

🍁

সমুদ্রের তীর থেকে একটু দুরেই দাঁড়িয়ে আছে কতগুলো ছোট ছোট দোকান। নানা ধরনের জিনিসে ভরপুর। ক্রেতাদের ভীড় অনেক। এই দোকাগুলোর বিক্রেতারা আবার চলিত ভাষায় কথা বলছে। তাই তাদের সবার কথা বুঝতে পারছি। তবে তাদের মধ্যে অনেকেই কথার শেষে “যে” শব্দটা ব্যাবহার করছে। এর কারণটা কি সেটা জানতে ইচ্ছে করছে ভীষণ । কিন্তু জিজ্ঞেস করার মতো কাউকে না পাওয়ায় ইচ্ছেটাকে নিজের মাঝেই দমিয়ে রাখলাম আমি।

ঘুরে ঘুরে দেখছি সব জিনিস। ইচ্ছে করছে সবকিছু কিনে ফেলি। বেশিরভাগ জিনিসই সামুদ্রিক উপাদান ব্যাবহার করে তৈরী। কতকিছু কিনে ফেলেছে সারা। কিন্তু আমি কিছুই কিনতে সফল হইনি এখনো। এতোকিছুর মধ্যে ঠিক কোনটা নেবো তা বুঝে উঠতে পারছি না। আমাদের সামনে যতবেশি অপশন রাখা হয় আমরা ততবেশি কনফিউজড হয়ে যাই।

ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ চোখ আটকে গেলো একটা পায়েলে। সাদা পাথরের সাধারণ একটা পায়েল। কিন্তু এই সাধারণ পায়েলটাকেই অসাধারণ লাগছে আমার কাছে। ওটা হাতে নিয়ে দোকানিকে দাম জিজ্ঞেস করতে যাবো তখনই সারার ডাক পরলো। কি হয়েছে দেখার জন্য চলে এলাম তার কাছে। পায়েলটা আর কেনা হলো না।

🍁

সারাদিন অনেক ঘুরাঘুরি করে এইমাত্র ফিরলাম হোটেলে।আজকেও ক্লান্ত হয়ে পরেছি আমি। রুমে এসেই ঢুকে পরলাম ওয়াশরুমে। সবার আগে ফ্রেশ হতে হবে আমায়। নয়তো কিছুতেই শান্তি পাবো না আমি।

ওয়াশরুম থেকে সোজা শাওয়ার নিয়ে বেরিয়ে এলাম। সারাদিনের ক্লান্তি যেনো মুহুর্তেই কেটে গেছে। এখন অনেকটাই ভালো লাগছে। পানি খাওয়ার জন্য বেড সাইড টেবিলের উপর রাখা গ্লাসটা হাতে নিতেই কিছু একটা পড়ে গেলো নিচে। দেখলাম ছোট একটা বক্স পড়ে আছে। ওটা তুলে আবার আগের জায়গাতে রাখতে গেলাম আমি। কিন্তু বক্সের উপর আমার নাম লিখা দেখে আর রাখলাম না।

কিছু না ভেবেই খুলে ফেললাম বক্সটা। অবাক হওয়ার বিষয় হলো বক্সের ভিতর সেই পায়েল। আমি পায়েলটা হাতে নিতেই নিচে একটা চিরকুট দেখতে পেলাম। চিরকুট খুলে আরো অবাক হলাম আমি। সেদিন ড্রেসের সাথে যে চিরকুট ছিলো সেটার হাতের লিখা আর এই চিরকুটের লিখা সেইম। তারমানে একই লোক পাঠিয়েছে এগুলো। কিন্তু কে পাঠিয়েছে? আর কেনোই বা পাঠিয়েছে? ভাবলাম পায়েলটা ফেলে দেবো। কে না কে পাঠিয়েছে। আমি কেনো রাখবো? নিজে এসে দিয়ে যেতে পারলো না?

কিন্তু পরক্ষনেই ভাবলাম একটা পায়েলই তো। ফেলে দেওয়ার দরকার নেই। তাছাড়া এটা আমার খুব পছন্দ হয়েছিলো। ফেলে দিতে ইচ্ছে করছে না। তাই বিছানায় বসে পায়েলটা পরে নিলাম আমি। চিরকুটের লেখাগুলোতে আরেকবার চোখ বুলিয়ে নিলাম । গুটিগুটি অক্ষরে লিখা

” বেস্ট ফ্রেন্ডের ডাক শুনে এটা ফেলেই চলে এলে? অন্যের জন্য এভাবেই নিজের পছন্দের জিনিসগুলো ছেড়ে দাও বুঝি? ”

লিখাটা পড়ে হাঁসি আসছে আমার। এটাতো তেমন কিছুই না। লোকটা তো আর জানে না যে আমি আমার জীবনের সবচেয়ে পছন্দের জিনিসটাই অন্যের জন্য ছেড়ে দিয়েছি।

চলবে……

[ হে হে হে 😅😅। কেমন আছেন সবাই 😅? গল্প দিতে দেরি হয়ে গেছে আমি জানি। আর আজকের পার্টটা ছোট হয়ে গেছে সেটাও জানি। তাই দয়া করিয়া চিল্লাচিল্লি করিবেন না। তাহলে কিন্তু আমি ঠেলা গাড়ির নিচে পরে শহীদ হয়ে যাবো। তখন আর গল্পই পাবেন না😁😁। সো, নো চিল্লাচিল্লি। ওকে ? 😛 ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here