ভালোবাসি তাই পর্ব-৭

0
2053

#ভালোবাসি তাই
part:7
Writer: Afifa Jannat
Maysha

🍁

পড়ন্ত বিকেল । সুর্য মামা জানান দিচ্ছে তার অস্ত যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। বাসন্তি রঙের শাড়ি পরে রাস্তার মাঝখান দিয়ে হেঁটে চলেছি আমি। রাস্তার দুপাশে মস্ত বড় বড় ঝাউগাছ মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। চারদিকে প্রবাহিত হচ্ছে উষ্ণ বাতাস। আমার পায়ের নুপুরের শব্দের সাথে বাতাসের শব্দ মিলিত হয়ে তৈরি হয়েছে এক অন্যরকম সুর। এককথায় রোমাঞ্চকর একটা পরিবেশ।

এরকম পরিবেশে প্রিয়জনের সাথে থাকতে পারাটা অনেক আনন্দের। তাই আমিও আনন্দিত। আমার পাশাপাশি হেঁটে চলেছেন সায়ন ভাইয়া। উনার গায়েও বাসন্তি রঙের পাঞ্জাবী। পাঞ্জাবীর বুকের দিকটায় লাল রঙের সুতার কাজ করা যেমনটা আছে আমার শাড়ীর আঁচলে। চুপচাপ হেঁটে চলেছি দুজন। দুজনের নিরবতাটাই যেনো বলে দিচ্ছে একে অপরের না বলা কত কথা।

হঠাৎ করেই সায়ন ভাইয়া আরো কাছে এসে আমার একটা হাত নিয়ে নিলো নিজের হাতের দখলে। সাথে সাথে কেঁপে উঠলাম আমি। এক অন্যরকম ভালোলাগা ছেয়ে যাচ্ছে আমার হৃদয়ে। ইশ! ভালোবাসার মানুষটার এতটা কাছে আসলে বুঝি এমনই ভয়ানক অনুভুতি হয়?

আমি নির্লজ্জের মতো উনার মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। শেষ বিকেলের সুর্যের লাল আভায় উনার ফর্সা মুখ জ্বলজ্বল করছে। এক অদ্ভুত মায়া ভেসে উঠছে উনার মুখে। আজ মনে হচ্ছে “মায়াবী ” শব্দটাও উনার জন্য ব্যবহৃত হতে পেরে নিজেকে ধণ্য মনে করছে। আমি উনার মুখের দিকে তাকিয়ে আছি সেটা সায়ন ভাইয়া ঠিকই বুঝতে পেরেছেন কিন্তু কিছু বলছেন না। নিরবতা কাটিয়ে আমিই প্রশ্ন করলাম

– আমরা কোথায় যাচ্ছি?

উনি সামনের দিকে তাকিয়েই বললেন

– যাওয়ার পরেই দেখতে পারবি।

– প্লিজ বলুন না কোথায় যাচ্ছি।

– তুই কি আমায় বিশ্বাস করিস না?

– এমা না না। আমি আপনাকে নিজের থেকেও বেশি বিশ্বাস করি।

– কেনো করিস?

– ভালোবাসি তাই।

আমার উত্তরে উনি মুচকি হাঁসলেন শুধু। কিছু বললেন না। আমিও আর প্রশ্ন করলাম না। কিছু কিছু সময় পরিবেশটা নিরব থাকলেই ভালো লাগে।

হঠাৎ কানে এলো মিষ্টি একটা মেয়েলি কন্ঠ। কেউ আমার নাম ধরে ডেকে চলেছে পেছন থেকে। আমরা দুজনেই পিছনে তাকালাম। এই মেয়েটা আর কেউ না, আমার আপু। সেও ঠিক আমার মতই সাজিয়েছে নিজেকে।

আপুকে দেখেই মনের মাঝে এক অজানা ভয় সৃষ্টি হলো। কেনো যেনো মনে হচ্ছে সায়ন ভাইয়াকে হারিয়ে ফেলছি আমি। উনি কি আপুর কাছে চলে যাবেন? আর আমার সাথে হাঁটবেন না? আমার সাথে হাঁটতে ভালো লাগছে না উনার? নাকি উনার ভালোলাগাটুকু আপুর মাঝেই নিহিত? না আর ভাবতে পারছি না আমি। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে ভীষণ। ভাবনাগুলো দলা পাকিয়ে যাচ্ছে মাথায়। এ কেমন অসহ্যকর অনুভুতি। নিজের বোনকে দেখে এতটা ভয় পাচ্ছি কেনো আমি?

আপু আমার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। আমি শক্ত করে জরিয়ে ধরলাম সায়ন ভাইয়ার হাত। আপু আলতো করে নিজের হাতটা রাখলো আমার গালে। আমার চোখের দিকে তাকিয়ে আস্তে করে বলেই চলেছে

– এই মাইশা, মাইশা। চোখটা খোল নারে বাবু। আমার দিকে তাকা। আরে তুই শুনতে পারছিস? আরে তাকা না আমার দিকে।

আপু এমন অদ্ভুত কথা বলছে কেনো? আমি তো তার দিকেই তাকিয়ে আছি। কই, আমার চোখ তো বন্ধ নয়। চোখ যদি বন্ধই না থাকে তাহলে খোলবো কি করে? আমাকে সায়ন ভাইয়ার সাথে দেখে কি আপু পাগল হয়ে গেছে? এতক্ষন আস্তে আস্তে কথা বললেও এবার আমার নাম ধরে জোরে চিৎকার করলো আপু।

চোখ পিটপিট করে তাকালাম আমি। একি, আমি তো আমার বিছানায়। আমার গায়ে তো শাড়ী নেই। আর না আমার পাশে আছে সায়ন ভাইয়া। এবার আপুর দিকে তাকালাম। আপুও তো শাড়ী পড়ে নি। তারমানে এতোক্ষন আমি স্বপ্ন দেখছিলাম? হ্যাঁ, স্বপ্ন বলেই তো সায়ন ভাইয়া এতো ভালো বিহেভ করছিলো আমার সাথে। বাস্তবে যেটা কখনোই সম্ভব নয়। কিন্তু এটা আমার জীবনের বেস্ট স্বপ্ন ছিলো। আপুর কথায় স্বপ্ন নিয়ে চিন্তা করা বাদ দিলাম আমি।

– কিরে ঘুম শেষ হয়েছে?

– হুম।

– দুপুরে খাওয়ার পরে কেউ এভাবে রাতের মতো ঘুমায়?

– আমি ঘুমাই।

– বুঝলাম। এবার চল তারাতাড়ি রেডি হো।

– কেনো আমরা কি কোথাও যাচ্ছি?

– হ্যাঁ, সবাই না। শুধু তুই আর আমি।

– কোথায়?

– সেটা গেলেই বুঝতে পারবি। প্লিজ না করিস না?

আমি বিছানা থেকে নামতে নামতে বললাম

– ঠিক আছে তুমি রেডি হও। আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।

একটুপর রেডি হয়ে আপুর ঘরে গেলাম। আপু আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চোখে কাজল দিচ্ছে। আমি যেতেই আমার দিকে কাজলটা বারিয়ে দিয়ে বললো

– নে তুইও লাগিয়ে নে।

– আমার প্রয়োজন নেই। তুমি তো জানো আমার কাছে সাজতে ভালো লাগে না।

– তাই বলে সামান্য কাজল লাগানো যাবে না?

– যাবে তো। কিন্তু আমার ইচ্ছে করছে না। প্লিজ আপু জোর করো না।

– ঠিক আছে তোর যা ইচ্ছা।

🍁

সেই কখন থেকে একটা রেস্টুরেন্টে বসে আছি আমি আর আপু। এখনে এভাবে বসে থাকতে মোটেও ভালো লাগছে না আমার। কিন্তু আপুকে কিছু বলতেও পারছি না। আপু বললো কেউ একজন আসবে তার জন্য অপেক্ষা করতে। “অপেক্ষা ” শব্দটা কোনো কালেই পছন্দ নয় আমার। তার উপর এমন একটা জায়গায় কারো জন্য অপেক্ষা করাটা আরো বেশি অপছন্দের।

প্রত্যেকটা টেবিলেই কাপলসরা বসে আছে। শুধুমাত্র আমাদের টেবিলেই আমরা দুবোন বসে আছি। এত্ত এত্ত কাপলের মাঝে আমাদের দুবোনকে বেমানান লাগছে নিশ্চই। কেউ যে কারণেই হাঁসছে না কেনো আমার কাছে মনে হচ্ছে আমাদের দেখেই হাঁসছে। কিন্তু আপুর অন্য কোনো দিকে নজর নেই। সে রেস্টুরেন্টের ছাদের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ভাবছে আর মুচকি মুচকি হাঁসছে। বুঝলাম না, ছাদে কি কোনো কমেডি শো চলছে? কিন্তু আমি তো দেখতে পারছি না।

আমার চোখ আটকে গেলো রেস্টুরেন্টের দরজার দিকে। রেস্টুরেন্টে ঢুকছে সায়ন ভাইয়া। একদম কালো গেটাপ। দুধসাদা শরীরে কালো রঙটা অনেক সুন্দর মানিয়েছে। কিন্তু উনি এখানে কি করছেন? আপুর দিকে তাকিয়ে দেখি সে টেবিল থেকে উঠে দাঁড়িয়ে পড়েছে। তার মানে আমরা এতোক্ষণ সায়ন ভাইয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলাম।

সায়ন ভাইয়া এগিয়ে এসে বললো

– সরি, একটু দেরি হয়ে গেলো। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করিয়ে ফেলি নি তো তোমাকে?

– না না ঠিক আছে।

আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি শুধু। এই প্রথম সায়ন ভাইয়ার মুখ থেকে আপুকে তুমি করে ডাকতে শুনলাম। আগে তো উনি আমাদের দুজনকেই তুই করে ডাকতেন। তারমানে উনি আপুর সাথে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করছেন। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম আমি।

এখন এই দীর্ঘশ্বাসটাই আমার সঙ্গী। সায়ন ভাইয়া বোধ হয় এতক্ষণ খেয়াল করেন নি আমায়। কিন্তু যখন আমার দিকে তাকালেন তখনই রাগে লাল হয়ে গেলো উনার চোখ। উনি রাগটাকে যথাসম্ভব নিয়ন্ত্রণ করে নিয়ে আপুকে উদ্দেশ্য করে বললেন

– ও এখানে কি করছে, মালিশা?

– না মানে আমার সাথে এসেছে।

– কেনো?

– আমিই নিয়ে এসেছি।

– কেনো? একা আসলে কি হতো? আমি কি বাঘ না ভাল্লুক যে তুমাকে খেয়ে ফেলতাম।

– না আসলে আমার একা আসতে কেমন লাগছিলো। তাই ভাবলাম মাইশাকে নিয়ে আসি।

– আমাদের কি কোনো প্রাইভেসি নেই? আমাদের দুজনের মধ্যে থার্ড পারসন হিসেবে ওকে নিয়ে আসা কি খুব জরুরী ছিলো?

সায়ন ভাইয়া যে আমাকে ইন্ডাইরেক্টলি অপমান করছেন তা বেশ বুঝতে পারছি আমি। কিন্তু কিছু বলছি না। আপুর সামনে আমি কোনো সিনক্রিয়েট করতে চাইছি না।

– ও নিজেই নিশ্চই তোমার সাথে এসেছে? আমার তো এটাই মনে হচ্ছে। সত্যি, মানুষ এতোটা ছেচড়া কি করে হতে পারে?

– না না আপনি ভুল বুঝছেন। ওতো জানতোই না যে আমরা আপনার সাথে দেখা করতে এসেছি।

– মিথ্যা বলে লাভ নেই। আমি সব বুঝতে পারছি।

আপু আর সায়ন ভাইয়ার কথার মাঝেই রাহুল ভাইয়ার গলা শুনা গেলো।

– আরে সায়ন, তুই এখানে কি করছিস?

– এসেছি একটা কাজে। এবার বল তুই এখানে কি করছিস?

– আমি তো এখান দিয়েই যাচ্ছিলাম কিন্তু তোকে দেখে ভেতরে ঢুকলাম।

– ওহ।

এবার রাহুল ভাইয়া আপুর দিকে তাকিয়ে বললেন

– আই থিঙ্ক, তুমি মালিশা। মাইশার বোন। এম আই রাইট?

– জ্বি।

– বুঝতেই পারছিলাম। তোমাদের চেহারার মিল আছে। এনিওয়ে মাইশা, মালিশা নাহয় ওর উডবির সাথে দেখা করতে এসেছে। তুমি কেনো এসেছো?

আমি কিছু বলার আগেই সায়ন ভাইয়া বললেন

– কেনো আবার। অন্যের প্রাইভেসি নষ্ট করতে।

এতোক্ষণ ধরে সব সহ্য করলেও এবার আর রাগটা ধরে রাখতে পারলাম না। একটা বাইরের লোকের সামনে উনি আমাকে অপমান করে চলেছেন। আমি চিৎকার করে বললাম

– শেষ হয়েছে বলা? শান্তি পাচ্ছেন এখন? আমাকে অপমান করে কি লাভ হয় আপনার? সেই কখন থেকে বলেই চলেছেন। আরে আপু যে বলছে আমি জানতামও না যে আপনি এখানে আসবেন। সেটা বিশ্বাস হচ্ছে না? সত্যি বলছি, আমি যদি জানতাম যে এখানে আপনার সাথে দেখা হবে তাহলে কখনোই আসতাম না। ট্রাস্ট মি, আপনার এই মুখটা দেখার কোনো ইচ্ছে নেই আমার।

আপু আমাকে থামাতে চেষ্টা করছে। কিন্তু আমি থামছি না। রেস্টুরেন্টের সবার দৃষ্টি এখন আমাদের দিকে। বাঙালির এই এক স্বভাব, কোথাও কোনো ঝামেলা হচ্ছে আর তারা সেদিকে তাকাবে না সেটা তো হতে পারে না। এক পর্যায়ে রাহুল ভাইয়া আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে যেতে বললো

– তোরা কথা বল। আমি মাইশাকে নিয়ে যাচ্ছি।

রাহুল ভাইয়ার একথা শুনে যেনো সায়ন ভাইয়া আরো রেগে গেলেন। আপুকে কিছু একটা বলে খুব দ্রুত বেরিয়ে গেলেন রেস্টুরেন্টের বাইরে৷ উনি বাইক নিয়ে এসেছিলেন বলে বাইকে উঠে হাই স্পিডে চলে গেলেন। সবাই চুপ করে আছে। রাহুল ভাইয়া আমাকে বললেন

– বুঝতে পারছি না সায়ন ইদানিং এমন অদ্ভুত বিহেভ করছে কেনো? তুমি মন খারাপ করো না।

আমি কিছু বললাম না৷ আপু আমার কাছে এসে বললো

– এতোটা সিনক্রিয়েট না করলেও পারতি। অন্তত আমার জন্য হলেও চুপ করে থাকতি। তোর থেকে এটা আশা করি নি আমি।

আপুর কথা শুনে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। আমি সিনক্রিয়েট করেছি? অথচ সায়ন ভাইয়া যে আমাকে অপমান করলো সেটা চোখে পরলো না আপুর? আজকাল আপুও কেমন হয়ে যাচ্ছে।

🍁

বাসায় আসার পর থেকে আমার সাথে একটা কথাও বলছে না আপু। বুঝতে পারছি না ওখানে আমার দোষটা কি ছিলো। মন খারাপ করে ছাদে দাঁড়িয়ে আছি আমি। এখন মনে হচ্ছে এরকমটা না করলেও পারতাম। আবার মনে হচ্ছে যা করেছি ঠিকই করেছি। আচ্ছা, আমি কি আজকাল সায়ন ভাইয়ার সাথে বেশি রুড বিহেভ করে ফেলছি?

ফোনের রিংটোনে ধেয়ান ভাঙলো আমার। এটাতো সায়ন ভাইয়ার নাম্বার। উনি আমায় ফোন করছেন কেনো? ফোন ধরতেই ওপাশ থেকে অপরিচিত কেউ একজন বলে উঠলো

– আপনি কি মাইশা বলছেন?

– জ্বি।

সায়ন আপনার কি হন?

– জি আমার খালাতো ভাই।

– ওহ। আপনি তারাতাড়ি একটু সিটি হসপিটালে চলে আসুন।

– কেনো?

– মিস্টার সায়নের এক্সিডেন্ট হয়েছে।

লোকটার কথা শুনে শরীর কাঁপছে আমার। মাথায় শুধু ঘুরছে ” আমাকে হস্পিটালে যেতে হবে “। কোনোভাবে ছাদ থেকে নেমে এলাম আমি।

চলবে…..

[গল্প অনেক আগেই লিখা শেষ কিন্তু ওয়াই-ফাইয়ের কানেকশন প্রবলেম হচ্ছিলো বলে পোস্ট করতে দেরি হলো। আজকে বিকালের দিকে আরেকটা পার্ট দিবো ইনশাআল্লাহ। ভুল ত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। ধন্যবাদ ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here