ভালোবাসি তাই পর্ব-৮

0
1775

#ভালোবাসি তাই
part:8
Writer :Afifa Jannat Maysha

🍁

হাসপাতালের করিডোরে বসে আছি সবাই। সবার চোখে মুখে চিন্তার ছাপ। কেউ কিছু বলছে না। হয়তো কি বলা উচিৎ সেটাই বুঝতে পারছে না। সাদাব ভাইয়া, ফাহাদ ভাইয়া আর রাহুল ভাইয়া গেছে ডক্তারের সাথে কথা বলতে। যে লোকটা আমাকে ফোন করেছিলেন তিনিও আমাদের সাথেই আছেন। তার বর্ণণানুসারে সায়ন ভাইয়া অনেক স্পিডে বাইক চালাচ্ছিলেন আর তখনই একটা প্রাইভেট কারের সাথে ধাক্কা খান।

এককোণে চুপচাপ মাথা নিচু করে বসে আছি আমি। আমার পাশেই বসে আছে আপু। আপু বরাবরই একটু বেশি ইমোশনাল। একটুকিছুতেই কেঁদে কেঁদে গা ভাসিয়ে দেয়। স্বভাবানুসারে এখনও চুপ করে চোখের পানি ফেলে চলেছে সে।

– কেনো করলি এরকম? তখন যদি তুই এমনটা না করতি তাহলে উনি এতো স্পিডে বাইক চালাতো না আর এক্সিডেন্টও হতো না। এখন ভালো লাগছে তোর?

আপুর কথায় কষ্ট পেলেও কিছু করার নেই আমার। সত্যিই তো, আমিই সায়ন ভাইয়ার এক্সিডেন্টের জন্য দ্বায়ী। আমি তো জানতাম সায়ন ভাইয়ার রাগ অনেক বেশি। তবু্ও তখন কেনো যে এমন করলাম।

রাহুল ভাইয়ার ডাকে আমরা সবাই সামনে তাকালাম। সাদাব ভাইয়া আর ফাহাদ ভাইয়ার কাঁধে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন সায়ন ভাইয়া। উনার মাথায় আর পায়ে ব্যান্ডেজ করা। খালামনি দৌড়ে গেলেন সায়ন ভাইয়ার কাছে। কান্না করতে করতে বললেন

– তুই ঠিক আছিস তো বাবা?খুব লেগেছে না? কেনো যে এই বাইক নিয়ে পরে থাকিস? আজকে যদি তোর কিছু একটা হয়ে যেতো তাহলে আমি আর তোর বাবা কি করতাম?

– ওফ মা কান্নাকাটি থামাও তো। কিছু হয় নি আমার। শুধু মাথায় আর পায়ে একটু লেগেছে।

ফাহাদ ভাইয়া বললেন

– হ্যাঁ আন্টি, টেনশন করবেন না। বেশি কিছু হয়নি। ডাক্তার বলেছে একটু রেস্ট নিলেই পায়ের আর মাথার ক্ষত ভালো হয়ে যাবে। ব্যাস এটুকুই।

ফাহাদ ভাইয়ার কথা শুনে সবাই একটু স্বস্তির নিশ্বাস নিলো যেনো।সায়ন ভাইয়াকে নিয়ে খালামনিদের বাসায় চলে এলাম সবাই। এর মধ্যে আমি একবারও সায়ন ভাইয়ার দিকে চোখ তুলে তাকায়নি। কি করে তাকাতাম? আমি।নিজেই তো এর জন্য দ্বায়ী। উনার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলার সাহস আমার নেই। মা আর ভাইয়া বাসায় চলে গেছে। খালামনি আমাকে আর আপুকে যেতে দেয় নি। আমরা খালামনির বাসায় থাকবো। রাহুল ভাইয়ারাও থেকে গেছে আজকের জন্য। সায়ন ভাইয়া তার ঘরেই শুয়ে আছেন। সবাই উনার সাথে কথা বলেছেন। কিন্তু আমি দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছি। উনি যদি আমাকে দেখে আরো উত্তেজিত হয়ে পরেন? উনার এখন উত্তেজিত হওয়া একদম ঠিক হবে না।

সবাই একে একে বেরিয়ে যাচ্ছে রুম থেকে। সায়ন ভাইয়া নাকি একটু একা থাকতে চাইছে। কিন্তু আমার যে উনার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে। উনি রাগ করবেন জেনেও উনার ঘরে যেতে ইচ্ছে করছে। সব দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাটিয়ে পা বারালাম সায়ন ভাইয়ার রুমের দিকে। কিন্তু ভেতরে ঢুকার আগেই কেউ পিছন থেকে আমার হাত টেনে ধরলো। আমি পিছনে ঘুরে দেখি আপু আমার হাত ধরে আছে।

– কোথায় যাচ্ছিস?

– সায়ন ভাইয়ার ঘরে।

– তোর কি একটুও বুদ্ধি নেই মাইশা?

– কেনো?

– সায়ন ভাইয়া যদি তোকে দেখে আরো রেগে যান, তখন?

– তুমি কি করে জানো যে উনি রেগে যাবেন?

– এটা এমনিতেই বুঝা যায়। তখন তো তোর সাথে রাগ করেই চলে এসেছিলেন। এখন আবার তোকে দেখলে রেগে যাবেন না?

– কিন্তু আমি কোনো কথা বলবো না। শুধু দেখেই চলে আসবো।

– ওফ, তুই বুঝতে চাইছিস না কেনো? থাক তোর আর বুঝতে হবে না। তুই এখান থেকে যা।

– আপু…

– মন খারাপ করিস না। উনি রাগ না করলে আমি অবশ্যই তোকে যেতে দিতাম।

– ইটস ওকে আপু। আমি মন খারাপ করিনি।

আমি ঘরে না গিয়ে ছাদে চলে এলাম।খালামনির বাসার এই ছাদটাই আমার সবচেয়ে বেশি প্রিয়। উনার বাসায় এসেছি অথচ ছাদে আসিনি এমন কখনো হয়নি। তবে ছাদে আসার আরেকটা বড় কারণ হলো সায়ন ভাইয়া। এখানে এলে প্রত্যেকবারই উনার কোনো কথা শুনে মন খারাপ হয়ে যায়। আর আমি মন ভালো করতে চলে আসি ছাদে।

কেবল রাত আটটা বাজে। আজকে আকাশে মস্ত বড় থালার মতো একটা চাঁদ উঠেছে। জোৎস্নার আলোতে পুরো ছাদটাই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। ছাদের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছি আমি। সায়ন ভাইয়াকে দেখার জন্য মনটা ছটফট করছে খুব। কিন্তু আমার তো কিছুই করার নেই।

কারো পায়ের শব্দে পিছনে ফিরলাম। রাহুল ভাইয়া ছাদে এসেছেন। আমাকে দেখে হালকা হেঁসে পাশাপাশি এসে দাঁড়ালেন উনি।

– এতো রাতে ছাদে কি করছো?

– এতো রাত কোথায়? কেবল আটটা বাজে।

– তবুও, ভয় করে না তোমার?

– ভয় করবে কেনো?

– না অনেকেরই তো রাতে একা একা ছাদে আসতে ভয় করে।

– আমার করে না। আমি রাত বারোটায়ও একা ছাদে আসতে পারি।

– তার মানে তুমি সাহসী।

– একা ছাদে আসতে পারলেই সাহসী হওয়া যায়?

– ঠিক তা না। তোমাকে আমার কাছে সাহসী মেয়েই মনে হয়। এনিওয়ে, মন খারাপ?

– না তো।

– মিথ্যা কথা বলছো কেনো?

– আপনি কি করে জানেন আমার মন খারাপ?

– গেস করলাম। বাই এনি চান্স তুমি কি সায়নের এক্সিডেন্টের জন্য নিজেকে দ্বায়ী করছো?

রাহুল ভাইয়ার প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়ে ছলছল চোখে উনার দিকে তাকালাম। উনি কত সহজেই আমার মনের কথা বুঝতে পেরে গেলেন।

– তার মানে আমিই ঠিক। আরে এখানে তোমার দোষটা কোথায় বলোতো? সায়ন যদি এতো জোরে বাইক চালায় তাহলে তুমি কি করতে পারো?

– কিন্তু উনি তো আমার কথা শুনেই রাগ করে এতো স্পিডে বাইক চালাচ্ছিলেন।

– ওহহো আবার এই একই কথা। তখনতো সায়নও তোমার সাথে খারাপ ব্যবহার করেছিলো। তাই তোমার নিজেকে অপরাধী ভাবার কোনো কারণ নেই। বুঝলে?

– হুম বুঝলাম।

– কিচ্ছু বোঝনি তুমি।

– আপনাকে কে বললো আমি কিচ্ছু বুঝিনি?

– কেউ বলেনি। তুমি যদি আমার কথা বুঝতে তাহলে এখনও মন খারাপ করে থাকতে না।

– আমি মন খারাপ করে নেই তো।

– তাহলে একটু হেঁসে দেখাও তো।

– আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে আপনি কোনো বাচ্চার মন ভালো করতে চাইছেন।

– যেমনই মনে হোক এখন তোমাকে হাঁসতে হবে। এটাই শেষ কথা।

– আপনি আমাকে জোর করে হাঁসাবেন নাকি।

– জোর করবো না। কিন্তু তুমি এখন না হাঁসলে আমি কেঁদে দেবো।

রাহুল ভাইয়ার এমন বাচ্চামো কথা শুনে আমি জোরে হেঁসে দিলাম। আমি হাঁসছি আর উনি আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমিও হাঁসি থামিয়ে উনার দিকে
তাকালাম। উনার চোখে বিরাজ করছে একরাশ মুগ্ধতা। চাঁদের আলোতে কি স্নিগ্ধ লাগছে উনার মুখটা। উনার চোখের দিকে তাকালে যে কেউই মায়ায় পরে যাবে। চোখজোড়ার গভীরতা যে অনেক। আমি তারাতাড়ি নিজের দৃষ্টি সংযত করলাম। এই প্রথম সায়ন ভাইয়া ছাড়া অন্য কোনো ছেলের দিকে এভাবে তাকালাম আমি। এখন নিজের কাছেই কেমন লাগছে আমার। কি ভাবলেন উনি।

উনি আমার কানের কাছে এসে বললেন

– চাঁদের হাঁসির সাথে আরেকটা পরীর হাঁসি দেখতে পেরে আমি নিজেকে ধণ্য মনে করছি মেডাম। তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ আমায় এ সুযোগটা দেওয়ার জন্য। এই চাঁদনি রাতটা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে আমার কাছে।

আমি রাহুল ভাইয়ার কথার কোনো মানে বুঝতে পারছি না। এখান পরী পেলেন কোথায় উনি? কই আমি তো দেখতে পারছি না? আর আমিই বা পরী দেখার সুযোগ করে দিলাম কি করে? রাহুল ভাইয়া আর কিছু না বলে চলে গেলেন। আমি কতক্ষণ ধরে চিন্তা করেও কোনো উত্তর না পেয়ে চলে এলাম ছাদ থেকে।

🍁

রাত প্রায় দুইটা বাজে। কিছুতেই ঘুম আসছে না আমার। সায়ন ভাইয়াকে দেখতে ইচ্ছে করছে ভীষণ। এখন তো উনি ঘুমাচ্ছেন। আমি যদি এই ফাকে গিয়ে উনাকে দেখে আসি তাহলে তো উনি বুঝতেও পারবেন। হ্যাঁ, এটাই ভালো হবে। মাথার কাছ থেকে ওড়নাটা নিয়ে গলায় জরিয়ে হাঁটতে লাগলাম সায়ন ভাইয়ার ঘরের দিকে।

পা টিপে টিপে উনার ঘরে এসে দাঁড়ালাম আমি। ঘরের লাইটটা অফ করা। তবু্ও ঘরের সবকিছুই স্পষ্ট। আস্তে আস্তে উনার মাথার পাশটাতে গিয়ে বসলাম। উনার শ্বাসের ঘনত্ব থেকেই বুঝতে পারছি উনি গভীর ঘুমে নিমগ্ন। মাথার ব্যান্ডেজটাতে হালকা হালকা রক্তের ছোপ। রক্ত দেখেই বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠলো আমার। উনার এই অবস্থার জন্য কোনো না কোনোভাবে আমিই দ্বায়ী এটা কিভাবে মেনে নেবো আমি?

আমি উনার হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে আস্তে আস্তে বলতে লাগলাম

– সরি, আমি তখন এমনটা করতে চাইনি। কিন্তু রাগে মাথা ঠিক ছিলো না। আপনিই বলুন, রাহুল ভাইয়া তো একটা বাইরের লোক। হতে পারে আপনার বেস্ট ফ্রেন্ড কিন্তু আমার কাছে তো একজন বাইরের লোক। আপনি উনার সামনে আমাকে অপমান করছিলেন। আমি সেটা মেনে নিতে পারিনি। তাই বলে আপনি এতো জোরে বাইক চালাবেন? আপনার কিছু হলে তো আমি মরেই যেতাম। আপনি আমায় ভালো না বাসলেও আমি তো বাসি। সেদিন বলেছিলাম আপনার প্রতি ভালোবাসাটা আর প্রকাশ করবো না তাই দেখুন এই রাতের বেলা লুকিয়ে লুকিয়ে এখানে এসেছি। আমার ভালোবাসা অপ্রকাশিত হয়েই পরে থাক কিন্তু আপনি কষ্ট পান এটা আমি কখনোই চাইনি।

কথা বলতে বলতে কখন চোখ থেকে পানি পরা শুরু করেছে বুঝতেই পারিনি আমি। তারাতাড়ি চোখ মুছে উঠে দাঁড়ালাম। এখানে আর দাঁড়িয়ে থাকা ঠিক হবে না। উল্টোদিকে ঘুরতেই হাতে অনুভব করলাম। ভয়ে বুক ধুকধুক করছে আমার। তাহলে কি সায়ন ভাইয়া জেগে গেলো? উনি কি এবার অনেক রাগারাগি করবেন? কি হবে এখন? ভয়ে ভয়ে পিছনে ফিরলাম আমি। যা ভাবছি তাই। সায়ন ভাইয়া জেগে গেছেন। তবে উনার চোখে মুখে রাগের কোনো অস্তিত্ব নেই। আমি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছি।

– এভাবে লুকিয়ে লুকিয়ে আমার ঘরে আসার কারণটা কি আমি জানতে পারি?

– আসলে আপনাকে দেখতে ইচ্ছে করছিলো তাই….

– তাই তুই এতো রাতে একটা ছেলের ঘরে চলে এলি।

-…………….

-কি হলো এখন কথা বলছিস না কেনো?

– আপনি রেগে যাবেন না প্লিজ। আপনার শরীরের জন্য ভালো হবে না।

– হুহ, নিজেই কষ্ট দিয়ে এখন নিজেই যত্ন করছিস?

উনার কথায় অবাক হলাম আমি।

– আমি আপনাকে কষ্ট দিয়েছি?আমার কোন কাজে আপনি কষ্ট পেয়েছেন বলুন না। আমি তা শুধরে নিতে চেষ্টা করবো।

– রাহু…..না কিছু না। তুই তোর ঘরে যা মাইশা। কেউ দেখতে পেলে খারাপ ভাববে।

– হ্যাঁ, যাবো তো। এক্ষুনি চলে যাবো। আপনি শুধু বলুন আমার কোন কাজে আপনি কষ্ট পেয়েছেন।

– তোকে আমি যেতে বলছি না।তাহলে দাঁড়িয়ে আছিস কেনো? তারাতাড়ি যা।

– হুম যাচ্ছি। আপনি শুয়ে পরুন।

-সেটা তোর ভাবতে হবে না।

ধীর পায়ে হেঁটে চলে এলাম ঘরে। আপু গুটিশুটি হয়ে ঘুমিয়ে আছে। আমিও পাশে শুয়ে পরলাম। অনেক্ষন যাবৎ এপাশ ওপাশ করার পরও ঘুমাতে পারলাম না আমি। ঘুমানোর ব্যার্থ চেষ্টা না করে চলে গেলাম বেলকনিতে। চেয়ারে বসে গ্রিলে মাথা ঠেকিয়ে তাকিয়ে রইলাম বাইরে। আজ রাতটা হয়তো এভাবে নির্ঘুমই কেটে যাবে আমার।

চলবে……

[রাহুলকে হিরো বানিয়ে দিলে কেমন হবে গাইজ? আপনার মতামত জানাবেন। ভুল ত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। ধন্যবাদ ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here