ভালোবাসি প্রিয় পর্ব-১৩

0
949

#ভালোবাসি_প্রিয়
( রিপোস্ট)
#পর্ব_১৩

©জারিন তামান্না

ফোন হাতে নিয়ে বিছানায় বসে আছে তিয়ান।ম্যাসেজটা সিন হয়েছে কিন্তু রিপ্লাই আসেনি কোনো। বিষয়টা খারাপ লাগছে তার।কিঞ্চিৎ হলেও খারাপ লাগছে।ধরে না রাখলেও সত্যি তো এটাও ছিল যে একটা সময় সেও চেয়েছিল এক হতে। কিন্তু সময়ের স্রোতে নিজের জন্য তীর খুঁজতেই মাঝ সাগরেই তাকে একলা ছেঁড়ে এসেছিল সে। কিন্তু, আজও… এতগুলোদিন পরেও ব্যাপারগুলো ভাবলেই মাথা ভার ভার লাগে তার। সূক্ষ একটা ব্যাথা চিনচিন করে বুকের বা’পাশটায়। কিন্তু তারও কিছুই করার নেই। সে তো নিজেই ছেড়ে দিয়েছিল।তাহলে এখন আর নিজের জন্য জায়গাটা দাবী করার কোন উপায় নেই। একেবারেই নেই। অন্যকেউ তাকে নিজের করে নিয়েছে। এখন সে সুখী হলেই হলো। তবে সে রিপ্লাই কেন করেনি? এতদিন যোগাযোগ ছিল না বলেই কি ভুলে গেছে তাকে? নাকি মনে করতে চাইছেনা বলেই সিন করেও রিপ্লাই দেয়নি! কল করবে কি একবার?ঠিক হবে সেটা? -এত সব কথা ভেবে ভেবে বিষণ্ণতায় ছেঁয়ে গেল মনটা তার। ফোনের ডাটা অফ করে বেরিয়ে এলো ম্যাসেঞ্জার থেকে। মনটা রিফ্রেশ করা দরকার। একটা ড্রিংক হলে মন্দ হতো না। এই ভেবেই গাড়ির চাবি নিয়ে রাত ১১ টায়ও বেরিয়ে গেল নাইট ক্লাবের উদ্দেশ্যে।

_________________________________

বিয়ের শপিং এ এসছে সিফাত, রিহান, রুকু, ইয়ানা আর রেহনুমা আলম। সারাকেও বলেছিল কিন্তু সে কাজের বাহানা দিয়ে আসবে না বলে দিয়েছে।পলকের জন্য শাড়ি কিনবে বলেই সিফাতকে ধরে বেঁধে নিয়ে এসেছে তারা। সিফাতের কথা, পলকের জন্য শাড়ি কিনবে তো পলককে নিয়ে যাক। নয় তো মা আর বোন মিলেই নিজেদের পছন্দমত কেনাকাটা করুক। তাকে এসব মেয়েদের শপিং এ নেওয়ার কি মানে! কিন্তু, রুকুর কথা, তোর বউয়ের জন্য শপিং করবো তো তুই সেসব পছন্দ করে দিবি। পলকেরও তো জানা দরকার তার হবু স্বামীর পছন্দ অপছন্দ কেমন। রুকুর কথা সে এমনিতেও ফেলতে পারে না। অগ্যতা একপ্রাকার বাধ্য হয়েই সিফাতকে আসতে হয়েছে।কিন্তু সে তো রিহানকে ছাড়া কিছুতেই যাবে না। তাই ভাইয়ের আবদার রাখতে বাধ্য হয়ে অফিস বাদ দিয়ে রিহানকেও আসতে হয়েছে সাথে।

দোকানে বসে একের পর এক শাড়ি দেখছে রুকু আর রেহনুমা। রিহান এক কোণায় বসে ফোনে যতটা সম্ভব অফিসের কাজ করছে। সিফাত আর ইয়ানা পাশাপাশি বসে তাদের কান্ডকারখানা দেখছে। হঠাৎ ইয়ানা তাকে বললো,
_আচ্ছা পাপা,তুমি কেন কোন শাড়ি দেখছো না?
_আমি কি এসবের কিছু বুঝি নাকি আম্মু।শুধু শুধু নিয়ে আসছে আমাকে। -বিরস গলায় বললো সিফাত।
_তাহলে চলো আইসক্রিম খেয়ে আসি আমরা দুজন।
_আচ্ছা,আম্মুর তাহলে আইসক্রিম খেতে ইচ্ছে করেছে। -সিফাতের কন্ঠে ইয়ানাকে বুঝে ফেলার উচ্ছ্বাস। আর এটা দেখে খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো ইয়ানা। তারপর সিফাত রুকুকে উদ্দেশ্য করে বললো,
_আপা,তোরা বসে শাড়ি দেখ। আমি আর আম্মু এক্ষুনি আসতেছি। সিফাতের কথা শুনে রুকু বিরক্ত সুরে বললো,
_এখন আবার কই যাবি তোরা। চুপচাপ বস এখানে। শাড়ি দেখ। রুকুর কথায় রেহনুমা আলমও সায় দিলেন। কিন্তু তাদের আপত্তিকে পাত্তা না দিয়ে সিফাত বললো,
_আরেএ..তোরা দেখনা শাড়ি আমরা আসতেছি। তারপর রিহানকে বললো,
_রিহান…তুই কি যাবি আমাদের সাথে?সিফাতের কথা শুনে ফোনের স্ক্রিন থেকে চোখ সিরিয়ে সিফাতের দিকে চাইলো রিহান।সে খেয়াল করেনি সিফাত ঠিক কি বলেছে।তাই বোকার মত তাকিয়ে রইলো সেকেন্ড কয়েক। তাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে সিফাত বুঝলো ভাই তার কাজে ডুবে ছিল। সে কি বলেছে সেটা ওর কানের ভেতর গেছে ঠিকই কিন্তু মাথায় এন্ট্রি না করে সোজা উপর দিয়ে ফ্লাই করে গেছে। তাই সরাসরি বললো,
_উঠ,,চল বাইরে। -বলেই ইয়ানাকে কোলে নিয়ে বাইরে চলে গেল।
রিহান কি বুঝলো কে জানে। চুপচাপ উঠে দাঁড়ালো ভাইয়ের কথা মতো। তারপর সিফাত আর ইয়ানার পিছু পিছু বেরিয়ে গেল সেও।
_________________________________

শপিং মলের চার ত’লায় একটা আইক্রিম পার্লারে গিয়ে ঢুকলো তারা। ইয়ানাকে তার ফেভারিট চকো চিপস আইসক্রিম দিয়ে রিহানের আনা কফি নিয়ে বসলো দুভাই। কফিতে চুমুক দিতে দিতে রিহান বললো,
_তোহ..ক’টা শাড়ি চুজ করলি রে ব্রো?
_আমি কোন শাড়ি চুজ করিনি। করতে পারবো না বলেই চুপচাপ কেটে পড়েছি ওখান থেকে।এসব আমার কাজ নয়। বলেই সকৌতুক হাসলো সিফাত।
_কাজ নয়.. পারবি না এসব বললে কি হয়? বিয়ে করতেছিস কত কি করতে হবে..পারতে হবে এখন!-বলেই চোখ মারলো রিহান। আর রিহানের কথায় সিফাত কি বুঝলো সেই জানে..কফিতে সবেই চুমুক দিয়েছিল বেচারা,কথাখানা শুনেই বিষম খেয়ে গেল একদফা। কাশতে কাশতেই বললো,
_স্টপ ইট ইয়ার।
সিফাতের এমন রিয়্যাকশন দেখেই সজোরে হেসে দিলো রিহান। ঠিক সে সময়ই সিফাতের ফোন বেজে উঠলো।রুকু কল করেছে। ফোনটা রিসিভ করে কানে ঠেকাতেই রুকুর ঝাড়ি শোনা গেল।
_এই,কই রে তোরা সব? এক সাথে কই গায়েব হইছিস সবগুলা?
_আরেএএ…কুল ডাউন ডিয়ার সিস্টার। আমরা মলেই আছি। চার ত’লায়। ইনু আইসক্রিম খাবে বলছিল তাই এখানে এসেছি।
_হ্যাঁ,,,ইনুর জন্য গিয়েছো নাকি নিজের জন্য সেটা তো আমি বেশ ভালোই জানি।-রুকুর এহেন কথায় সিফাত হেসে দিল। বোনটা তাকে এত কেন বোঝে,কিভাবে বোঝে সেটা সে ভেবে পায় না। আবার সারা কখনো তার এতটা ক্লোজ হয়নি। শুধুমাত্র কিছু আবদার করার হলেই ভাইকে মনে পড়ে তার। ছোট বোন বলে রুকু আর সিফাত দুজনেই বেশ আদর আহ্লাদ করে তাকে। কিন্তু, সে তুলনায় ভাই বোনদের সে খুব একটা কেয়ার করে না। এই যে আজও এলো না বিয়ের শপিং এ। অথচ তার একটামাত্র ভাইয়ের বিয়ের শপিং এটা। ব্যাপারটা মনে হতেই ম্লান হাসলো সিফাত। শান্ত ভঙ্গিতে বললো,
_হু। বস তোরা। আসছি আমরা। বলেই কল কেটে দিয়ে ইয়ানাকে বললো,
_আম্মু চলো এখন। তোমার আম্মু যেতে বলেছে।
ইয়ানাও মাথা কাত করে সায় দিল।তারপর তারা ফিরে গেল শাড়ির দোকানটায়।

শাড়ির দোকানে যাওয়া মাত্রই রুকু কয়েকটা শাড়ির সামনে বসিয়ে দিল সিফাতকে। বললো,
_এখান থেকে চুজ কর। হলুদে কোনটা পড়বে। আর বিয়েতে শাড়ি নাকি ল্যাহেঙ্গা কি পড়বে বল। সেটা দেখি এবার।

_আরে..বিয়েতে কি পড়বে সেটা আমি কি করে বলবো?ওকেই জিজ্ঞেস করেনে না!
_আচ্ছা। তাও হয়। তুই ওকে কল করে জিজ্ঞেস কর তো। -পাশ থেকে রেহনুমা আলম বললেন।
_তোমার বউমা,তুমিই কল করে জিজ্ঞেস করলেই তো পারো। আমি এসব কি করে জিজ্ঞেস করি!
_এই বেশি কথা বলিস না। আমার কাছে ফোন নাম্বার থাকলে তো আমিই কল দিতাম। নেয়া হয়নি নাম্বারটা। তোর কাছে তো আছে। তুই কল দে। -শেষ কথাটা খানিক খোঁচা মেরেই বললেন রেহনুমা।বলেই মিটিমিটি হাসতে লাগলেন।আর তা দেখে রুকু আর রিহানও মিটিমিটি হাসছে।তাদের এভাবে হাসতে দেখে বেশ লজ্জাই পেল সিফাত। গলা খাকড়ানি দিয়ে নিজের পক্ষপাতিত্ব করে বললো,
_আমার কাছেই যে নাম্বারটা আছে এমনটাই বা কে বললো তোমাকে?
_সেটা তুই তোর ভাইকেই জিজ্ঞেস কর। বলেই আবার দুষ্টু হাসলেন উনি। মা যে রিহানের কথা বলছে এটা বুঝতে একটুও অসুবিধা হলো না সিফাতের। চোখ গরম করে রিহানের দিকে তাকালো। যার মানে,একলা পাই, হচ্ছে তোমার আজ। সিফাতের এমন চাহনী দেখে রিহানের হাসি হাওয়ায় মিলিয়ে গেল নিমিষেই। ভয় পাওয়া গলায় আমতা আমতা করে বললো,
_ভাই তু.. তুই আমাকে কি দেখছিস? এই তো কত্ত শাড়ি,,এগুলা দেখ।বলেই একটা শাড়ি টেনে নিজের মুখের সামনে ধরে নিজেকে আঁড়াল করে নিল সে। এটা দেখে ইয়ানা খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো। আর ইয়ানার হাসি আর যাবতীয় কান্ডকারখানা দেখে রুকু রেহনুমা এমনকি দোকানদারও না হেসে পারলো না। আর যাই হোক,হাসি বড্ড ছোঁয়াচে ব্যাপার!

সিফাত ভীষণ লজ্জায় পড়ে গেল এবার। রিহানের উপর রাগও লাগছে খানিকটা। কেন সব কথা খালা আর বোনকে বলতে হবে তার! নিজেকে শান্ত করতে রিহানের থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে অন্যদিকে দৃষ্টি দিলো সে। আর ঠিক তখনই একটা শাড়ির উপর তার চোখ আটকে গেল। কুসুম হলুদ আর অফ হোয়াইটের কম্বিনেশনের জামদানি শাড়ি। চকিতেই তার কল্পনায় পলকের অবয়ব ভেসে উঠলো। এই শাড়িতে তার মৃন্ময়ীকে ভেজা মাটির গায়ে মিঠে রোদ্দুরের মতই শুদ্ধ আর স্নিগ্ধ লাগবে দেখতে।এটা ভাবতেই একটা মৃদু হাসি ফুঁটে উঠলো তার ঠোঁটের কোণে।বেশ কয়েকটা শাড়ির মাঝ থেকে টেনে বের করে হাতে নিল শাড়িটা। তারপর রুকুকে দেখিয়ে বললো,
_হলুদের জন্য এটা দিবি।মানাবে ওকে।
শাড়িটা দেখে দোকানে উপস্থিত সকলেই মুগ্ধ হলো। দোকানদার তো রীতিমত সিফাতের প্রশংসা শুরু করে দিল,তার এত সুন্দর চয়েজ দেখে। রুকু, রেহনুমাও খুব পছন্দ করলেন শাড়িটা। এরপর রেহনুমা বললেন, যাক একটা তো হলো। এবার বাকি রইলো মেহেদী, বিয়ের আর বৌভাতের শাড়িগুলো। এগুলাও দেখ তাড়াতাড়ি। বাকি যা লাগে আমরা কিনে নেবো।বিয়ের শাড়ির কথা শুনেই রুকু বললো,
_হ্যাঁ রে ভাই,এরমাঝে তুই ইন্ডিয়া যাবি না রে?
_হ্যাঁ,যেতে পারি হয় তো। কেন?
_না বলছিলাম,বিয়ের শাড়িটা তুই ওখান থেকেই কিনে নিস তাহলে। আর বৌভাতের শাড়িটা আমি আর দিহান দিবো বলে ঠিক করেছি। ওটা তোর না কিনলেও চলবে।
_বেশ তো। তোরা যা ভালো মনে করিস।
ভাইয়ের সম্মতি পেয়ে রুকু খুশি হয়ে গেল। তারপর তারা সবাই মিলে মেহেদীর ফাংশনের জন্য একটা হালকা ডিজাইনের মধ্যে গাঢ় জলপাই রঙ এর লেহেঙ্গা কিনলো। আর বিয়ের পরে পড়ার জন্য হালকা কয়েকটা শাড়িও নিল। তখনই রুকু বললো,
_ভাই, আমাদের হয়ে গেছে।এবার তুই একটা কাজ কর। পলককে একবার কল দে তো।
_কেন?ওর আবার এখন এখানে কি কাজ?শাড়ি তো সব কেনা হয়েই গেছে। ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করলো সিফাত।
_আহ! শুধু শাড়ি কিনলেই হবে? ব্লাউজ বানাতে দিতে হবে। মাপ লাগবে তো।আর টুকিটাকি জিনিসও আছে কেনার।ওকে দরকার পড়বে তখন। তুই আসতে বল ওকে।

বোনের কথা শুনে হাত ঘড়িতে সময় দেখে নিল সিফাত।দুপুর ১:২০ বাজে। এ সময় তো পলক স্কুল থেকে বেরিয়ে যায়। কই আছে কে জানে! তাও বোনের কথায় ফোন বের করে ডায়াল করলো পলকের নাম্বারে।

কিছুক্ষণ হলো স্কুল থেকে বেরিয়েছে পলক। বাসের জন্য দাঁড়িয়ে আছে। তখনই ফোনটা বেজে উঠলো। এই অসময় সিফাতের কল দেখে খানিকটা অবাক হলো পলক।তবুও ফোন রিসিভ করে স্বভাবসুলভ শান্তকন্ঠে সালাম জানালো,
_আসসালামু আলাইকুম।
_ওয়ালাইকুম আসসালাম। পলকের কন্ঠ শুনেই প্রশান্তির হাসি হেসে জবাব দিল সিফাত।তারপরেই বললো,
_আপনি কি ফ্রি আছেন এখন?
_জ্বী। বাসের জন্য ওয়েট করছি। বাসায় যাবো।
_অহ, আচ্ছা। তাহলে বাসটা ছেড়ে দিন। আর ওখানেই ওয়েট করুন। আমি আসছি।
_আপনি আসছেন মানে? কোন সমস্যা হয়েছে কি?
_না। কোন সমস্যা হয়নি। আসলে মা, আপা আপনার জন্য বিয়ের শপিং এ এসেছে। আপা বললো আপনাকে দরকার একটু। তাই আর কি…
_অহ। ছোট্ট করে বললো পলক।
_হ্যাঁ। তো আপনি ওখানেই থাকুন আমি আসছি আপনাকে পিক করতে।
_না..না..আপনাকে আসতে হবে না। কোথায় আসতে হবে বলুন আমি চলে আসবো।
_না। আপনাকে যেটা বলেছি সেটাই করুন।জাস্ট ২০ মিনিট কষ্ট করে ওয়েট করুন, আমি আসছি।
_আচ্ছা। ঠিক আছে।-সারাদিনের ক্লান্তির পরে এখন আর সিফাতের সাথে তর্কে জড়াতে চাচ্ছে না পলক। তাই বিনা বিরোধিতায় মেনে নিল তার কথা।
_গুড। জাস্ট ওয়েট দেয়ার। আ’ম কামিং সুন। বলেই মুচকি হাসলো সিফাত।
_হুম। বলেই ফোন রেখে দিল পলক।

পলকের সাথে কথা শেষ করেই রুকুকে উদ্দেশ্যে করে বললো সিফাত,
_আপা,তোরা রিহানের সাথে রেস্টুরেন্টে যা। লাঞ্চ করে নে।আমি মৃন্ময়ীকে নিয়ে আসছি।
_কাকে নিয়ে আসছিস? -চট করেই প্রশ্ন করলো রুকু।রুকুর এহেন প্রশ্নে বেশ অপ্রস্তুত হয়ে গেল সিফাত।মনে মনে জিভ কেটে বললো,
_ধুর…কি একটা অভ্যাস হয়েছে।সবার সামনেই মৃন্ময়ী বলছি এখন!
_কি রে..মৃন্ময়ী কে?-তাড়া দিয়ে বললো রুকু।

সিফাত কিছুটা ইতস্তত করছে,কিভাবে বলবে এদের সামনে..রুকু একা হলেও হতো,সাথে মা আছে। তার সামনে কি করে বলবে যে আস্ত একটা নাম থাকতেও সে পলককে আলাদা করে মৃন্ময়ী বলে ডাকে! মা-ই বা কি ভাববে! তারপর বললো,
_ইয়ে..মানে..
_আরেএ দি..ভাবীকে আনতে যাচ্ছে। চলো আমরা লাঞ্চে যাই। ভাই তুই বেরিয়ে পড়। ভাবী ওয়েট করছে হয় তো।-পাশ থেকে বললো রিহান।

সিফাত যেন মহাবাঁচা বেঁচে গেল। রিহানটা সময়মত উদ্ধার করে দিয়েছে। মনে মনে ভাইকে ধন্যবাদ জানালো। আর মুখে বললো,
_আ..ব..হ্যাঁ। তোরা যা,আমি আসছি। বলেই বেরিয়ে এলো শোরুম থেকে। আর সে বেরিয়ে যেতেই ব্যাপারটা আদতে কি ছিল সেটা বুঝতে পেরেই একচোট হেসে নিল রুকু, রিহান আর মিসেস. রেহনুমা
।ছেলেটা বুঝি তাদের শেষমেশ প্রেমে পড়েই গেল এবার।ব্যাপারটা তাদের জন্য আনন্দের। একলা থাকা ছেলেটার একটা গতি হবে এবার। কিন্তু ছোট্ট ইয়ানা এসবের কিছুই বুঝতে না পেরে ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে রইলো শুধু।
_________________________________

শপিং মলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে পলক। সিফাত তাকে এখানেই অপেক্ষা করতে বলে গাড়ি পার্ক করতে গেছে। ঠিক তখনই নিজের পি.এ আসিফের সাথে কথা বলতে বলতে মল থেকে বেরিয়ে এলো তিয়ান। একটা বিজনেস মিটিং এর জন্য এসেছিল এখানে। সিড়ির শেষ মাথায় নেমে আফিসকে বললো ড্রাইভারকে কল করে গাড়ি নিয়ে আসতে বলার জন্য। পলক তার পাশেই দাঁড়ানো। গাড়ির জন্য অপেক্ষা করতে করতে হঠাৎ পাশ ফিরে চাইতেই তিয়ান ছোটখাটো একটা ঝটকা খেলো। কত বছর পরে দেখলো এই মুখ?উউউউমমম…৪ বছর?! হ্যাঁ,চার বছর আগেই শেষবারের মত মুখোমুখি দেখা হয়েছিল এই মুখখানা। কিন্তু চিনতে একটুও অসুবিধা হচ্ছে না আজও।পরিবর্তন বলতে বাচ্চা বাচ্চা মুখখানি এখন প্রাপ্তবয়স্ক রমণীর মুখশ্রীতে পরিণত হয়েছে। এটা ভাবতেই একটা মুচকি হাসি ফুঁটে উঠলো তার চোখে মুখে।এক ধ্যানে সে দেখছে পলককে।

এদিকে পলক বেশ কিছু সময় ধরে অনুভব করছে, যেন কেউ তাকে একনজরে দেখছে। কিন্তু পাশ ফিরে তাকাতে সহস পাচ্ছে না। সাহসের চাইতেও বেশি অস্বস্তি লাগছে তার। যদি সত্যিই এমন কিছু হয়,কেউ তাকে দেখছে,তাহলে সে তাকালেই তো চোখাচোখি হয়ে যাবে। লোকটার নজরে কি থাকবে কে জানে। খারাপ কিছু হলে? ভাবতেই বুকের মধ্যে একটা বিচ্ছিরি রকমের ভয় কাঁটা দিয়ে উঠলো। কিন্তু এভাবে সহ্যও তো করা যাচ্ছে না। কি করবে না করবে এসব ভাবতে ভাবতেই একটা কালো রঙের গাড়ি এসে দাঁড়ালো তার সামনে। তিয়ানের সেদিকে খেয়াল নেই।তাই পাশ থেকে আসিফ ডাক দিল,
_স্যার,চলুন। গাড়ি এসে গেছে।
আসিফের কথায় ধ্যান ভাংলো যেন। পলকের থেকে নজর সরিয়ে পাশে তাকিয়ে আসিফকে জবাব দিল।
_হ্যাঁ..তুমি বসো,আসছি আমি।
_জ্বী স্যার। বলেই আসিফ গাড়িতে গিয়ে উঠে বসলো।

হঠাৎই এক চির পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনে চমকে পাশে তাকালো পলক। তিয়ানও শেষবারের মত একনজর দেখার জন্য পলকের দিকেই তাকাচ্ছিল। তাই পলকের তাকানোর সাথে সাথেই দুজনের চোখাচোখি হয়ে গেল। পলক হতভম্ব। কতগুলো বছর পরে এতটা কাছ থেকে দেখলো সে এই মানুষটাকে! আগের থেকে কতটা পরিণত দেখাচ্ছে তাকে।একজন সুদর্শন পুরুষে পরিণত হয়েছে মানুষটা। কত বছর পরই আবার শুনলো এই কণ্ঠস্বর সে? ২’৫ বছর হবে হয় তো। বা এর থেকেও কিছুটা বেশি। কিন্তু এই কণ্ঠস্বর যেন তার ভেতরে গাঁথা। ভোলা অসম্ভব। কিন্তু সে তো চলে গিয়েছিল। তাহলে কবেই বা এলো?এসেছে বলেই কি সেদিন ম্যাসেজ করেছিল? কিন্তু পলকের যে সাহসে কুলায়নি রিপ্লাই দেওয়ার।অসম্ভব রকমের একটা কষ্ট এসে চেপে ধরেছিল তাকে। সেটা উপেক্ষা করে সে কিছুই বলতে পারেনি। তাই রিপ্লাইও করা হয়নি।

পলকের চোখে বিস্ময়,প্রশ্নের ভীড় স্পষ্ট। যেটা না চাইতেও অস্বস্তিতে ফেলছে তিয়ানকে। অনুশোচনায় পোড়াচ্ছে। তাই এর থেকে মুক্তি পেতে নিরবতা ভেঙে মুচকি হেসে নিজেই জিজ্ঞেস করলো।
_কেমন আছো পলক?
পলকের মুখে কোন কথা নেই। সে পাথরের মূর্তির মত চুপচাপ তাকিয়ে আছে তিয়ানের দিকে। হঠাৎ সে খেয়াল করলো তিয়ানের দৃষ্টি তার দিক থেকে সরে তার পাশে গিয়ে ঠেকেছে। সেই দৃষ্টি অনুসরণ করতেই দেখলো সিফাত তার পাশে দাঁড়ানো। সিফাতের মুখের দিকে তাকাতেই তার বিচলিত মুখখানা হুশ ফেরালো পলকের।নড়েচড়ে উঠলো সে। তাকে এমন বিধ্বস্তরূপে দেখে চিন্তিত স্বরে প্রশ্ন করলো সিফাত,
_Are u ok, Mrinmoyi?
_মৃন্ময়ী?! অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো তিয়ান। মেয়েটা তো পলক। তাহলে এই লোকটা ওকে মৃন্ময়ী বলে ডাকছে কেন? তবে কি সে অন্য কাউকে পলক ভেবে ভুল করলো?

এদিকে তিয়ানের এমন অবাক করা কন্ঠে মৃন্ময়ী বলা শুনে চকিতেই তার দিকে তাকালো সিফাত আর পলক। পলকের মস্তিষ্কে উত্তেজনা বাড়ছে। ভেতর ভেতর ক্রমশ অস্থিরতা বাড়ছে। তার অনাগত ভবিষৎকে পাশে নিয়ে তারই দাফন হওয়া অতীতের সম্মুখে দাঁড়িয়ে আছে সে। তবুও নিজেকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে চলেছে। পাশ ফিরে সিফাতকে দেখলো একবার। তার চোখ মুখে অবাকতা আর একটা প্রশ্ন স্পষ্ট। পলক সেটা ঠিক বুঝতে পারলো। তারপর পরিস্থিতি সামলে নিতেই সম্মুখে ফিরে তিয়ানকে উদ্দেশ্য করে বললো,
_হ্যাঁ,,উনি আমাকে মৃন্ময়ী বলেই ডাকেন।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here