ভালোবাসি প্রিয় পর্ব-৩৬

0
991

#ভালোবাসি_প্রিয়
(রিপোস্ট)
পর্ব_৩৬
©জারিন তামান্না

ঘরের এ মাথা থেকে ও মাথা অবদি পায়চারী করে চলেছে পলক। মেজাজ খারাপ তার। প্রচন্ড মেজাজ খারাপ। অপেক্ষা করছে সিফাতের ঘরে আসার। কিন্তু,নতুন জামাইকে পেয়ে গল্পে মেতে উঠেছে আমজাদ আলী,পলাশ,পলকের চাচা, মামা আর অন্যান্য অনেক আত্মীয়স্বজনই। আজ দুপুরে ফিরানিতে এসেছে তারা পলকদের বাড়িতে। ফেব্রুয়ারি মাসেও দিন মোটামুটি ভালোই ছোট হয়। সময় চলে যায় তাড়াতাড়ি। তাই,,নতুন জামাই বরণ করে,,সবার আদর আপ্যায়ন করতে করতে দুপুরের খাওয়াটাই দেরি হয়ে গেছিল। আর সেই সন্ধ্যা পর থেকে একে একে মানুষ আসছে নতুন জামাই দেখতে। তার সাথে কথা বলতে। আর সিফাতও নিরলস আর বিরামহীনভাবে তাদের সাথে পরিচিত হচ্ছে। গল্প করছে। আর পাড়া -প্রতিবেশীদের বিদায়ের পর বাসার মানুষজন ঘিরে ধরেছে সিফাতকে।

সবাই নতুন জামাইয়ের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। পলকের এত ভালো ভাগ্য নিয়েও অনেকেই অনেক কথাই বলছে। আবার অনেকে অনেক ধরণের বিব্রতিকর প্রশ্নও করেছে তাকে। যার উত্তর পলক দিতে পারেনি। যার কারণ অনেকটা সিফাতও। তাই সে সিফাতের সাথে একটা বোঝা পড়া করবে বলে অপেক্ষা করছে তার।

____________________________________

রাত ১১:৩০ মিনিট।

সবেমাত্র ঘরে এসেছে সিফাত। পলকের ঘরটাতেই আজ রাতের জন্য থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে তাদের। ঘরে ঢুকে পলককে বললো, ব্যাগ থেকে তার জামা কাপড় বের করে দিতে। কিন্তু,,পলক সেটা শুনেও যেন শুনলো না। নিজের মত পায়চারি করে যাচ্ছে সারা ঘরময়।

ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে হাতের ঘড়িটা খুলে রাখছিল সিফাত। আয়নায় চোখ পড়তেই দেখলো পলক ওভাবে পায়চারী করছে ঘরে। এখনো শাড়িই পড়ে আছে সে। চেঞ্জ অবদি করেনি। ঘড়িটা ড্রেসিংটেবিলের উপর রেখে বললো, পেটে ব্যাথা করছে কি আপনার?
সিফাতের এহেন প্রশ্নে থতমত খেয়ে গেল পলক। হতবাক স্বরে প্রশ্ন করলো,
_পেটে ব্যাথা করবে কেন?!
_সে তো কত কারণেই করতে পারে। কিন্তু, আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে পেট ঠিক আছে আপনার। তাহলে এভাবে ইঁদুরের মত ঘরময় পায়চারী করছেন কেন?
_কিহ? ইঁদুর! আমাকে ইঁদুরের মতো লাগছে আপনার?
_না..আ.. আ। আপনাকে ইঁদুরের মত লাগবে কেন, আপনার কাজটা লাগছে। তাই বললাম আর কি! যাই হোক, হয়েছেটা কি সেটা বলুন।
_কি আর হবে, মানুষের হাসি ঠাট্টার পাত্রী হতে হয়েছে আমাকে। মানুষগুলা এমন কেন!!
পলকের মুখ কাঁদো কাঁদো। পলক খুব সহজে কাঁদে না,এটা সিফাত জানে খুব ভালো করেই। তাই তাকে এভাবে কাঁদো কাঁদো অবস্থায় দেখে চিন্তায় পড়ে গেল সিফাত। দ্রুত পায়ে এগিয়ে গিয়ে পলকের মুখোমুখি হয়ে দাঁড়ালো সে। আলতো হাতে এক হাত পলকের গালে রেখে চিন্তিত স্বরে জিজ্ঞেস করলো তাকে,
_কি হয়েছে মৃণ্ময়ী? কে কি বলেছে আপনাকে?
_কে আবার বলবে! ওরাই তো বলেছে।
_কারা?
_আমাকে দেখতে এসেছিল যারা।
সিফাত সঠিক বুঝলো না পলক ঠিক কাদের কথা বলছে। তাই এই প্রসঙ্গ এড়িয়ে জিজ্ঞেস,
_আচ্ছা ঠিক আছে। কিন্তু,কি বলেছে সেটা তো বলবেন?
_এটা কি উপহার দিয়েছেন আপনি আমাকে বাসররাতে হ্যাঁ?? রাগ রাগ গলায় বললো পলক।
_কি গিফট দিবো আবার! বিছাটা তো দিয়েইছি। কেন আরও কিছু লাগতো আপনার? I mean, অন্য কিছু লাগবে? লাগলে বলুন আমি কিনে দিবো।
_ধুর!
_কিইই??
_আচ্ছা,,,আপনাকে কে বলেছিল এত কিছু থাকতে এই বিছাটাই দিতে? আপনি জানেন আজকে অনেকেই আমাকে জিজ্ঞেস করেছে বাসররাতে আপনি কি দিয়েছেন আমাকে!
_হ্যাঁ,,তো? আপনি বলেননি কি দিয়েছি?
_বলেছিল তো! আর বলেই তো কাল হয়েছে আমার!!
_মানে??
_বিছা দিয়েছি বলার পরে তারা দেখতে চেয়েছিল। কিন্তু আমি দেখাতে পারিনি। তার জন্য আমাকে কত কি বলেছে জানেন?
_না জানিনা.. – সিফাতের নির্বিকার উত্তর। তা দেখে পলকের মেজাজ আরও খারাপ হলো। গাল থেকে সিফাতের হাত সরিয়ে দিয়ে উত্তেজিত কন্ঠে বললো,
_বলেছে আমি আমাদের বাসর রাতের চিহ্ন দেখাতে চাইছিনা বলেই বিছাটা দেখাচ্ছি না। অনেকে তো বলেইছে যে আপনি কিছুই দেননি আমাকে তাই দেখাচ্ছি না।মিথ্যা বলছি। কি একটা বাজে অবস্থায় পড়তে হয়েছিল আমাকে ভাবুন তো!
সিফাত পুরো হতভম্ব। সামান্য একটা বিছা দেখানো নিয়ে এমন কি ঘটলো যার জন্য পলক এভাবে রিয়্যাক্ট করছে..বুঝতে পারলো না সিফাত। তাই তার সেই হতভম্ব স্বরেই প্রশ্ন করলো পলককে,
_বাসর রাতের চিহ্ন মানে?
_বাসররাতের চিহ্ন বোঝেন না আপনি?? লাভ সাইন চিনেন না?? লাভ সাইন!! ওটাকেই বুঝিয়েছে ওরা!! সবাই বুঝে অথচ আপনিই বুঝছেন না। হড়বড়িয়ে বলে ফেললো পলক।
সিফাত এতক্ষণে বুঝলো ব্যাপারটা কি! ব্যাপারটা ধরতে পেরে একটা দুষ্টু বুদ্ধি খেলে গেল তার মাথায়। পলক মুখ ভার করে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বড্ড হাসি পেল সিফাতের কিন্তু সে সেটা চেপে গেল। তারপর, পলকের পেছনে গিয়ে পেছন থেকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো তাকে। মিশিয়ে নিল তার বুকের সাথে পলকের পিঠ। পলক এতে কিছুই বললো না। কোন প্রতিক্রিয়াও দেখালো না। তার এখন এসবে খেয়াল নেই। কিন্তু, তার কোমড় চেপে ধরে তার কাঁধে থুঁতনি ঠেকাতেই সিফাতের খোঁচা খোঁচা দাঁড়ির স্পর্শে ঈষৎ কেঁপে উঠলো পলক। কিন্তু,মুখে কিছুই বললো না। কাঠ হয়ে মিশে রইলো সিফাতের সাথে। পলককে ওভাবে জড়িয়ে ধরেই সিফাত বললো,
_তা ক’টা লাভ সাইন দিতে পেরেছি আমি বলুন তো? যার জন্য ওরা এত কিছু ভেবে নিয়েছে। আমার তো ঠিক মনে পড়ছে না। আসলে গুণে দেখা হয়নি সে রাতে। আপনি জানেন বোধয়,,বলুন তো আমাকে!
সিফাতের এহেন কথায় থতমত খেয়ে গেল পলক। চট করেই তার খেয়েল হলো হড়বড়িতে কি বলে ফেলেছে সে সিফাতকে। ভীষণ রকম লজ্জায় পড়ে গেল পলক। কিন্তু,সিফাতও নাছোড়বান্দা। তার প্রশ্নের উত্তর না নিয়ে সে ছাড়বেই না পলককে আজ। তাই আবারও জিজ্ঞেস করলো পলককে,
_আপনিও গুণেননি বোধয়। ব্যাপার নাহ,,দাঁড়ান আমিই গুণে নিচ্ছি আজ।
ভয় পেয়ে গেল পলক সিফাতের এহেন কথায়। সিফাত তাকে সবরকম ভাবে স্পর্শ করার অধিকার রাখে, এটা জানে পলক। কিন্তু, আচমকা এমন কিছুর জন্য মোটেও প্রস্তুত নয় সে।আর এমনিতেই সে তার এহেন নির্বোধতায় লজ্জায় পড়ে আছে তারওপর সিফাত যেভাবে বলছে তাকে পুরোপুরি সিরিয়াস মনে হলো পলকের। একবার সিফাতের বাঁধন হতে মুক্ত হওয়ার চেষ্টা করলো সে।কিন্তু,সিফাতের বলিষ্ঠ শরীরের আয়ত্ত আর শক্ত বাঁধনের কারণে সম্ভব হলো না সেটা। তাই ভয়ার্তক কন্ঠে আমতা আমতা করতে করতেই বললো পলক,
_এ…এ..এমন কিছু না। আ..আ…আমি তো আসলে ওভাবে বলিনি। মানে,,আমি তো অন্য কারণে ওটা দেখাতে পারিনি।
_অন্য কারণ? আচ্ছা! তা কি কারণ শুনি?
_আ..আমি তো লজ্জায় দেখাতে পারিনি। ওভাবে শাড়ির আঁচল উঠিয়ে দেখানো যায় নাকি কাউকে কিছু!! লজ্জা লাগে তো!
_এক্স্যাক্টলি মৃন্ময়ী! উচ্ছ্বাসিত স্বরে বললো সিফাত।
_কি? অবাক স্বরে প্রশ্ন করলো পলক।
_এই যে আপনি লজ্জায় কাউকে দেখাতে পারেননি। আর আপনি যাতে কাউকে দেখাতে না পারেন তাই জন্যই তো দিয়েছি ওটা। বলেই মুচকি হাসলো সিফাত।
_মানেএএ?? বিস্মিত কন্ঠে পলকের জিজ্ঞাসা!
_উউউমমম…মানে! মানে হচ্ছে, আপনাকে আমি কি দিয়েছি সেটা অন্যকে কেন দেখাতে হবে বলুন তো? হাজবেন্ড ভালোবেসে তার ওয়াইফকে কিছু গিফট করবে সেটা অন্যকে দেখিয়ে শো অফ কেন করতে হবে! আর হাজবেন্ড ওয়াইফের মাঝে ঘরের চারদেয়ালে কি ঘটে না ঘটে কিংবা কার বাসররাতে কি হলো এটা বাইরের কারও জানতে চাওয়াটা কোন ভদ্র মানসিকতার পরিচয় বলতে পারেন?
বিছাটা আমার ভালো লেগেছে,তাই ওটাই দিয়েছি আমি,,আপনি ব্যাতিত আপনাকে দেখার একমাত্র হকদারও আমি। বাকি সবার থেকেই স্বাভাবিক বা পর্যাপ্ত পর্দা করা জায়েজ আপনার জন্য।শুধু মাত্র পরিস্থিতির প্রয়োজনে আমি আর আপনি ব্যাতিত কোন মহিলা বা পুরুষ আপনাকে আংশিক পর্দাহীন দেখতে পারে। সেটাও সংযতভাবে। তাহলে পাড়া প্রতিবেশির মহিলা বা আপনার বোন বান্ধুবীদের কেন এভাবে শাড়ির আঁচল সরিয়ে আপনার গয়না দেখাতে হবে?
_এটা এক ধরণের সামাজিকতা। বিয়ের পর স্বাভাবিক ভাবেই দেখতে চায় সবাই।
_যে সামাজিকতা আপনাকে অস্বস্তি বা বিব্রতিকর অবস্থায় ফেলবে সেটা মানার কোন মানে নেই মৃন্ময়ী। এহেন সামাজিকতা এড়িয়ে চলতে পছন্দ করি আমি। আর এখন থেকে আপনিও তাই করবেন। ওকে?
_পলক চুপ। বলছে না কিছু। তা দেখে সিফাত বুঝলো তার কথাগুলো পলকের কানে গেলেও মাথায় ঢুকেনি। তাই তাকে বোঝানোর জন্য আবার বললো,
_দেখুন মৃন্ময়ী…হাজবেন্ড ওয়াইফের সম্পর্কটা ধার্মিক তথা সামাজিক হলেও সম্পর্কের বসবাস, বৃদ্ধি, বিচ্ছেদ কিংবা ভিত্তি যাই বলুন না কেন সেটা কিন্ত দুটো মানুষ আর চারদেয়ালের মাঝেই ঘটে। সেই সম্পর্কে ভালোবাসা,মান অভিমান যাই ঘটুক না কেন তা কেবল চার দেয়ালেই রাখাতে হয় শুধুমাত্র কোন ভাইটাল ইস্যু হলে সেটা ঘরের চার দেয়াল থেকে বাড়ির চার দেয়াল অবদি নেওয়া যেতে পারে। আবার পরিস্থিতি বিবেচনায় এর থেকে বেশিও হতে পারে সেই গন্ডি। তাই আপনার আমার ভালোবাসার জন্ম, বৃদ্ধি, বেড়ে ওঠা এই সব কিছু থাকবে আপনার আমার মনে,শরীরে আর আমাদের ঘরের চারদেয়ালে। কেবল সম্পর্কের টিকে থাকা, স্বাভাবিকতা, সুস্থতাটা দেখবে অন্যরা। আর আমি আপনাকে কি দিচ্ছি না দিচ্ছি,বা আমি আপনার থেকে কি পাচ্ছি বা না পাচ্ছি এটা যেমন আমি বাইরের কারও কাছে প্রকাশ করতে যাবো না,তেমনি আপনিও বলতে যাবেন না।
ঠিক আছে?
_জ্বী।
_এই তো গুডগার্ল।
_স্যরি। অপরাধী কন্ঠে বললো পলক।
_কেন?
_আমি আসলে ওভাবে ভেবে দেখিনি। তাই তাদের কথায় কাজে মেজাজ খারাপ হয়ে গেছিল আমার।ওই জন্যই ওভাবে বলে ফেলেছি আমি। ওভাবে বলাটা ঠিক হয়নি আপনাকে। স্যরি।
পলকের কথা শুনে আলতো হাসলো সিফাত। মেয়েটা এত সহজ সরল! আবার ভীষণ মিষ্টিও।আস্ত মায়াবতী একটা।
_No problem ! বলেই টুক করে একটা চুমু খেলো সে পলকের টলটলে গালে।আচমকা সিফাতের এহেন কাজে চোখ বড় বড় হয়ে গেল পলকের। থতমত খাওয়া গলায় প্রশ্ন করলো, এইটা কি হইলো??
_কেন ঠিকঠাক হয়নি? বোঝেননি আপনি? আচ্ছা,,দেখাচ্ছি আবার। বলেই আরেকটা চুমু খেলো পলকের অন্য গালে। তবে এবারেরটা একটু গভীরই ছিল বটে। তারপর বললো, আদর করলাম।এবারেরটা কিন্তু ডীপ এন্ড লং ছিল। বুঝতে পেরেছেন নিশ্চয় ঠিকমত? বলেই দুষ্টু হাসলো সিফাত।
পরপর দুবার এমন আদুরে আক্রমণে পুরোদস্ত অপ্রস্তুত হয়ে গেছে পলক। অনেকটা ইলেকট্রিক শকের মতই ঝটকা ছিল এগুলো তার জন্য। আর তারপরে আবার সিফাতের এহেন কথায় পলক পুরো ‘থ’! লজ্জায় মরি মরি অবস্থা তার। আর এদিকে পলকের কোন সাড়া না পেয়ে সিফাত বুঝলো,এই মূহুর্তে ঠিক “ধীরেসে লাগা জোরকা ঝাটকা” টাইপ অবস্থা তার মৃন্ময়ীর। তাই তাকে আর বিব্রত না করতেই তাকে ছেড়ে মাথায় একবার হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো, যান…জামা কাপড় বের করুন। চেঞ্জ করে ঘুমাবো।টায়ার্ড লাগছে। সিফাতের থেকে ছাড়া পেয়ে পলক আর এক মূহুর্ত দেরি করলো না। ঝটপট সিফাতের কাপড় বের করে দিয়ে রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেল। তার এহেন লাজুকতা দেখে সরোজে কতক্ষণ হাসলো সিফাত। তারপর, জামা কাপড় নিয়ে চলে গেল ওয়াশরুমে।

পলক যখন ঘরে ঢুকলো তখন রাত ১২:৪০ বাজে। সে ইচ্ছে করেই দেরি করে এসেছে যেন তাকে সিফাতের সামনে না পড়তে হয়। নইলে যে আরও লজ্জা পাবে সে। আর রোজ তাকে যেভাবে জড়িয়ে ধরে ঘুমানোর আগে,তাতেও লজ্জা পায় পলক। কিন্তু,সিফাতকে বারণ করতেও ইচ্ছে করে না তার। রোজ সিফাতের বিলি কেটে দেওয়া, ঘুমানোর আগে,ঘুম থেকে উঠার আগে কপালে তার স্পর্শ পেতেও ভালো লাগে তার। তাই লজ্জা লাগলেও মুখ ফুঁটে বলেনা সেটা। কিন্তু,আজ যা করলো সে,তারপরে তার সামনে যেতেও লজ্জা লাগছে পলকের।তাই সিফাতের ঘুমিয়ে যাওয়ার অপেক্ষা করছিল সে। আর সিফাত বলেছিল টায়ার্ড লাগছে তার।তাই এতক্ষণে হয় তো ঘুমিয়েও গেছে সে।

চুপ করে ঘরে ঢুকলো পলক। আস্তে করে জামা কাপড় নিয়ে চলে গেল ওয়াসরুমে। ফিরে এসে শুতে গিয়ে দেখলো বালিশটা রোজকার মতই রাখা তার জন্য। পলক বুঝে না কেন সিফাত এই কাজটা করে! শুধুমাত্র তাকে জড়িয়ে ধরতে সুবিধা হয় বলে? কিন্তু সেটা তো এমনিতেও ধরতে পারে।তবুও এমন করার কি কারণ, ভেবে পায় না পলক।বাধ্য হয়ে তাই পলককেও ওখানেই শুতে হলো।আর শোয়া মাত্রই সিফাত তার রোজকার কাজটাই করলো। পলকে নিজের কাছাকাছি নিয়ে আজ খানিক শক্ত করেই জড়িয়ে ধরে বললো, আর একদিন যদি আপনাকে টানাটানি করতে হয় না মৃন্ময়ী, তাহলে কিন্তু এটুকু ছেড়ে পুরোটা জাপটে ধরবো আপনাকে! পরে আপত্তি করতে পারবেন না আপনি কোন। আর করলেও আমি শুনবো না। বলেই পলকের দিকে ঝুঁকে গভীরভাবে চুমু দিলো তার কপালে। বললো, ঘুমোন এবার। গুড নাইট। তারপর, বাচ্চাদের মত তাকে জাপটে ধরে পলকের মাথায় বিলি কাটতে কাটতেই চোখ বুজলো সে।

পলক বাকরুদ্ধ!একটুপরে পলক টের পেল সিফাতের ঘন ঘন নিঃশ্বাস এসে ছড়িয়ে পড়ছে তার ঘাঁড়ে। সিফাত ঘুমিয়ে গেছে। সেটা টের পাওয়া মাত্রই অন্যহাতে তার পেটের উপর রাখা সিফাতের হাতটায় হাত বুলালো পলক। তারপর ওটাকে আলতো করে ধরেই চোখ বুজলো সে।

____________________________________

এক সপ্তাহ পর,

বিছানায় শুয়ে এপিঠ ওপিঠ করছে পলক।।কিন্তু, ঘুম আসছে তার একদমই। আসবেই বা কি করে,আজ তাকে কেউ জড়িয়ে ধরে নেই। কেউ তার মাথায় বিলি কাটছে না। দেয়নি তার কপালে নিজের প্রেমময় স্পর্শ। মাত্র ১০ দিনেই। একপ্রকার অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে সিফাত তার। প্রতি রাতে তার জড়িয়ে ধরা, মাথায় বিলি কাটা তাকে এটা ওটা বলা সবকিছুই ভীষণভাবে মিস করছে সে। আজ সন্ধ্যার ফ্লাইটে লন্ডন গেছে সিফাত। বাসা থেকে বেরিয়েছে দুপুরের পর পরই। আজ তার ছুটি শেষ হবার পর প্রথম ফ্লাইট। অফিসিয়াল ফর্মালিটিজ কমপ্লিট করে জয়েন করতে হবে আজ। তাই আগেই বেরিয়ে গেছে। বিয়ের পর আত্মীয়দের বাড়িতে দাওয়াত খেতে, তাদের খাওয়াতেই কেটে গেছে এ ক’দিন।তাই দিন দাহারে একত্রে কাটানোর মত খুব একটা সময় নিজেরা না পেলেও ,নিয়ম করে প্রতিটি রাত আর ভোরের সময়টা কাছে পেয়েছে সিফাতকে সে। তাই আজ সে যাওয়ার পর থেকেই কেমন যেন খালি খালি লাগছে। আজকে সারাদিন খুব ব্যস্ততায় গেছে তার। যতবারই সে ঘর থেকে বেরিয়েছে সিফাত ডেকে এনেছে। এই ওই বলে করিয়ে ঘরেই বসিয়ে রেখেছিল একপ্রকার। এমনকি নিজের কাজগুলো নিজে করা মানুষটাও আজ তার প্যাকিং এর প্রতিটা জিনিস পলককে দিয়ে প্যাক করিয়েছে। দুপুরে পলকের প্লেটেই একসাথে খেয়েছে সে। যাওয়ার আগে পলকের কপালে দেওয়া চুমুটাও বেশ গভীর আর দীর্ঘছিল আজ। সেই সব কিছুই বারবার মনে পড়ছে পলকের আর অস্থিরতা বাড়ছে তার ভেতর ভেতর। এই মূহুর্তে তাকে কল করাও সম্ভব না। ফ্লাইটে সে এখন। সিফাত বলে গেছে হোটেলে গিয়ে কল করবে তাকে। কিন্তু,,পলকের অপেক্ষার সময় যেন কাটছেই না। নিজের ফোনটা বের করে গ্যালারিতে ঢুকলো পলক। সিফাত আর তার বিয়ের কিছু ছবি আছে সেখানে। ওগুলো দেখতে দেখতেই কাটিয়ে দিল নির্ঘুম একটা রাত।

ফজরের নামায পড়ে কফিটাও খাওয়া হলো না আজ তার। সিফাত নেই। রোজ তো সেই বানায়। মসজিদ থেকে ফিরে সোজা কিচেনে গিয়ে একমগ কফি নিয়ে তবেই ঘরে ঢুকে সে। রোজ একইভাবে পলককে ধরে দাড়িয়ে কফি খায়। এটা ওটা নিয়ে গল্প করে। তারপর নিজের অর্ধেকটা কফিসমতে মগ পলকের হাতে ধরিয়ে দিয়ে তার চুলের উপর চুমু দিয়ে জগিং এর জন্য যায়। আজ এসবের কিছুই হয়নি। সারারাত ঘুম হয়নি। ভালো লাগছেনা তার। এখন শুধু অপেক্ষা চলছে পলকের…তার ক্যাপ্টেনের একটা কলের।

__________________________________

গুণে গুণে তিনদিন পরে বাড়ি ফিরলো সিফাত। এই তিনদিনে একটা বারের জন্যও পলকের সাথে কথা বলেনি সে। বাড়িতে ফোন করে জানিয়ে দিয়েছিল সে পৌঁছেছে ঠিক মত। বাড়ি ফিরে আসার পর ঘরে গিয়ে দেখলো পলক ঘরে নেই। অবাক হলো সিফাত। ওয়াশরুমে গিয়ে দেখলো ওখানেও নেই। মৃন্ময়ী.. মৃন্ময়ী বলে দুবার ডাকলোও। কিন্তু,পলকের কোন সাড়া পাওয়া গেল না। সিফাতকে বলা হয়েছে পলক ঘরেই আছে। সে এসেছে বেশ রাত করেই। ঘড়িতে এখন ২ :০৯ বাজে। অথচ পলক ঘরে নেই। কি ভেবে যেন বেলকোনিতে গেল সিফাত। বেলকোনিতে গিয়ে দেখলো সেন্টার টেবিলের কাছে ঠ্যাস দিয়ে মেঝের বসে ঘুমাচ্ছে পলক। দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেল সে পলকের দিকে। বেঘোরে ঘুমাচ্ছে পলক। ফ্লোরে হাঁটু গেড়ে বসে পলককে ডাকলো সিফাত। কিন্তু, সে উঠলো না। চুলগুলো ফ্লোরে ছড়িয়ে আছে। অন্ধকারে তার মুখটা স্পষ্ট দেখতে পেল না সিফাত।পলকের কোন সাড়া না পেয়ে তাকে পাঁজকোলা করে কোলে তুলে নিল সিফাত। ঘরে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিতে গিয়ে পলককে দেখে চমকালো সে। তিনদিনেই কি হাল হয়েছে পলকের! চোখমুখ শুকিয়ে গেছে। চোখের নীচে কালচে হয়ে আছে। হঠাৎ এমন হওয়ার কোন কারণ খুঁজে পেল না সিফাত। পলককে ঠিকভাবে শুইয়ে দিয়ে বিছানা ছেড়ে দাঁড়াতেই দেখলো সাইড টেবিলের উপর ঘুমের ঔষধের স্লিপ রাখা। নতুন স্লিপ। আর ওখান থেকে একটা ঔষধ খাওয়া হয়েছে। সিফাতের আর বুঝতে বাকি রইলো না ওটা পলকই খেয়েছে। তাই এমন বেঘোরে ঘুমাচ্ছে সে। প্রচন্ড রাগ হলো সিফাতের। কি অবস্থায় রেখে গিয়েছিল আর কি অবস্থা হয়েছে তার মৃন্ময়ীর! এখন শুধু পলকের ঘুম ভাঙার অপেক্ষা তার। যা বোঝাপড়া হওয়ার তখনই হবে।

পলককে রেখে ফ্রেশ হয়ে বিছানায় এলো সিফাত। পলককে কাছে নিয়ে মনভরে দেখলো বেশ কিছুক্ষণ। বেঘোরে ঘুমাচ্ছে সে। তিনদিন সে তার মৃন্ময়ীকে দেখেনি। একটাবার কল বা ম্যাসেজও করেনি। সে আসলে দেখতে চেয়েছিল পলক কি করে। তাকে মিস করে কিনা! কিন্তু পলকও কেন যেন একবারও কল করেনি তাকে। তবে ফিরে এসে পলকের এমন অবস্থা দেখার বিন্দুমাত্র ধারণা তার ছিল না।
পলকের কপালে খুব শক্তপোক্ত একটা চুমু খেলো সিফাত। তারপর অভ্যাস মতো তাকে জাপটে ধরে শুয়ে রইলো। পলকের মাথায় বিলি কেটে দিতে দিতে একটা সময় তারও চোখ বন্ধ হয়ে এলো!

………………………………………………………………………………………

সকাল ৬: ১৯ মিনিট।

আসসালামু আলাইকুম মৃন্ময়ী। ঘুম ভালো হলো? নাকি দু চারটে স্লিপিং পিলস লাগবে আরও তোমার?

সবেই পিটপিট করে চোখ খুলছিল পলক। আচমকা সিফাতের গলা শুনে চমকে উঠে বসলো সে। পাশে তাকাতেই দেখলো আয়নায় সিফাতকে দেখা যাচ্ছে।তারই পাশে বসে আছে সিফাত। সিফাত কখন এসেছে মনে করতে পারছে না পলক। কিন্তু,সিফাতের কথা শুনে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে ভীষণ রেগে আছে সে। খানিক ভয় পেল পলক। মিনিমিনে গলায় সালামের জবাব দিলো সে।
_ওয়ালাইকুম আসসালাম। কখন এসেছেন আপনি? ডাকেননি কেন আমাকে?
_স্লিপিং পিল কেন খেয়েছিলে মৃন্ময়ী?
_ওওও..ওটা আসলে..
_চেহারার এই হাল হয়েছে কেন তোমার? তোমাকে কি এই অবস্থায় রেখে গিয়েছিলাম আমি? খানিক ধমকের স্বরেই বললো সিফাত। ভয়ে কেঁপে উঠলো পলক। আমতা আমতা করে বললো,
_আ..আসলে ঘুম হচ্ছিল না দু’দিন ধরে , তাই আর কি একটা…
_ঘুম না হওয়ার কারণ?
_জানি না ঠিক।
_উঠো রেডি হও। ডাক্তারের কাছে যাবো আমরা।
_ডাক্তার কেন?!
_তোমার চেক আপ করাতে। ঘুম কেন হচ্ছে না সেটা দেখাতে। উঠো। Do fast.
_ না..না..ডাক্তার লাগবে না। ঠিক হয়ে যাবে এমনিতেই।
_চুপচাপ রেডি হও মৃন্ময়ী।
_আরেএএ….ডাক্তার লাগবে না বলছি তো। আপনি এসেছেন এবার এম্নিতেই ঘুম হবে আ… বলতে বলতেই থেমে গেল পলক। সিফাত হতভম্ব চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে।
_এটা কি ধরণের লজিক মৃন্ময়ী?
_কিছুনা। দেখি সরুন। যেতে দিন আমায়।স্কুলে যেতে হবে।
_কবে জয়েন করেছো?
_গতকাল থেকে।
_অহ, আচ্ছা।
_বিছানা ছেড়ে নেমে চুলগুলো খোপা করছিল পলক। আচমকা পেছন থেকে তাকে জড়িয়ে ধরলো সিফাত। বললো,
_কেমন আছেন মৃন্ময়ী?
_আলহামদুলিল্লাহ, আপনি?
_ভালোই।
_কখন এসেছেন?
_গতকাল রাতে। আপনি ঘুমিয়ে ছিলেন বলে টের পাননি।
_হ্যাঁ,,ওই মেডিসিনের এফেক্টের কারণে।
_বেলকনিতে কেন গিয়েছিলেন এত রাতে?
_ঘরে ভালো লাগছিলনা তাই বসেছিলাম গিয়ে। কিন্তু কখন ঘুমিয়ে গেছি টের পাইনি।
_ মিস করেছেন আমায়?
_হ্য…বলতে গিয়েও’ না’ বললো পলক। সিফাতের প্রতি অভিমান হয়েছে তার। তাই সে কিছুতেই স্বীকার করবে না এ কথাটা।
_অহ।
_দেখি ছাড়ুন আমায়। দেরি হয়ে যাচ্ছে।
কিন্তু সিফাত ছাড়লো না তাকে। বরং আগের থেকেও শক্তকরে জড়িয়ে ধরে আর ঘোর লাগানো কন্ঠে বললো,
_মৃন্ময়ী!
_জ্বী?
_ভালোবাসি!
_আচ্ছা।
_৩ দিনে একবারও কল করেননি আপনি আমায়,মনে পড়েনি আমার কথা তাই না?
_আপনি ভুলে গেছিলেন আমায়। তাই গিয়ে কল করবেন বলেও করেননি। আমিও তাই আর বিরক্ত করিনি আপনাকে।
সিফাত এবারে বুঝলো আসল ব্যাপারটা।অভিমানে নিখোঁজ হয়েছিল তার মৃন্ময়ী তার থেকে। কি একটা ভেবে যেন মুচকি হাসলো সে। তারপর পলককে ধরে তার মুখোমুখি দাঁড় করালো। দু’হাতের আঁজলায় তুলে নিল পলকের অভিমানী মুখখানি। বললো,
_ভালোবাসেন আমায় মৃন্ময়ী?
নজর ঝুঁকিয়ে রেখেছিল পলক। সিফাতের এহেন কথায় ঝট করে চোখ তুলে চাইলো সে সিফাতের মুখপানে। সিফাতের চোখে ঘোর। তার মৃন্ময়ী ঘোর। সে চোখে পলকের প্রতি ভালোবাসাটাও স্পষ্ট। কিন্তু,,পলকের চোখ মুখে সংশয়। সে সিফাতকে ভালোবাসে না। সিফাত কাছে থাকলে ভালো লাগে তার সঙ্গ। তার অনুপস্থিতিকে তার কথা মনে পড়ে পলকের। বেশ কিছুদিন কারও সাথে থাকার পর দূরে গেলে এমন হয়। মানুষের স্বাভাবিক মনস্তাত্ত্বিক প্রকৃতি এটা।আজকাল সিফাত তার একরকম অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। তাকে ভালো লাগে পলকের। সম্মান, শ্রদ্ধাবোধও কাজ করে তার জন্য পলকের মনে।তাকে নিজের জন্য চায় পলক। কিন্তু এখনো মন থেকে ভালোবেসে উঠতে পারেনি সে সিফাতকে। আসলে ভালোবাসা বিষয়টা বড্ড অদ্ভুত। কারও কারও ক্ষেত্রে চট করেই হয়ে যায় আবার কারও কারও সময় লাগে। মোহ থেকে যে ভালোবাসার সৃষ্টি সেটা হতে খুব একটা সময় লাগে না,,কিন্তু ভালো লাগা থেকে ভালোবাসার পথটা একটু দীর্ঘই। মোহিত হওয়া মানুষ বা কোন কিছুর প্রতি শুরু একটা আকর্ষণ কাজ করে। আকর্ষণ দীর্ঘস্থায়ী হলে পরে একটা সময় তা ভালোবাসায় পরিণত হয়। কিন্তু, ভালো লাগাটা সময়ের সাথে বাড়তে বাড়তে একসময় অভ্যাসে পরিণত হয়।আর অভ্যাসটাই হয়ে যায় ভালোবাসা। কখনো কখনো তীব্র বদভ্যাসও হয়ে ওঠে এই ভালোবাসা। কিন্তু,পলকের ক্ষেত্রে এসব কিছুই তো ঘটেনি। তাই সিফাতকে সে ভালোবাসে কিনা এই প্রশ্নের উত্তরে ঠিক কি বলবে সেটা বুঝতে পারছে না পলক। মিথ্যা সে বলতে চায় না আর সত্যি বললে সিফাত কষ্ট পাবে হয় তো। ফলে কিছুই বলতে পারলো না সে। পুনরায় চোখ নামিয়ে নিল সে। সিফাত তা দেখে নিরাশ হয়ে ছোট্ট একটা শ্বাস ফেললো। তারপর পলকে বুকে জড়িয়ে তার চুলের উপর গভীরভাবে চুমু দিলো সে। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,
_স্যরি। আর কখনো হবে না এমন।
পলক কিছু বললো না। কেবল মাথা ঠেকিয়ে চুপচাপ লেপ্টে রইলো সিফাতের বুকে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here