ভালোবাসি_বলেই_তো পর্ব – ৪৫

0
937

#ভালোবাসি_বলেই_তো ♥️
লেখিকা – #আদ্রিয়া_রাওনাফ
পর্ব – ৪৫

চারপাশের হৈ চৈ এর শব্দ ভেসে আসতেই পূর্ণতা টিপ টিপ করে চোখ খুলে তাকিয়ে বালিশের সাইড থেকে ফোনটা হাতে নিয়ে স্ক্রিনে ট্যাপ করতেই দেখল ১১ টা বাজে ।

সময় দেখে শোয়া থেকে একলাফে উঠে বসে ভাবতে শুরু করল ,

– আজ তো গায়ে হলুদ । নিশ্চয়‌ই সব আত্মীয় স্বজনরা আসতে শুরু করেছে তাই তো এত শোরগোল ।

তারপর বিছানা থেকে নেমে দাঁড়াতে দাঁড়াতে ভাবল ,

– ইশশ , কাল রাতে মেহেদী দেওয়ার অনুষ্ঠান আড়াইটায় শেষ হয়েছিল বলেই তো ঘুমাতে ঘুমাতে আরো দেড়ি হয়ে গেল । অন্যদিন হলে তো আম্মু ডেকে ডেকে কান পঁচিয়ে ফেলত । আজ বাদে কাল বিয়ে বলেই হয়তো আম্মু আমাকে ঘুম থেকে আগে ভাগে ডেকে তোলে নি ।

ফ্রেশ হয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হতেই ফোনে কল বেজে উঠল ।

পূর্ণতা ফোনটা হাতে নিয়ে দেখল প্রেনা কল করেছে । কলটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে প্রেনার গলা শোনা গেল ,

– উঠেছিস ? আমার কিছু কাজিন এসেছে । ওরা তোর সাথে দেখা করতে চাইছে ।

– ওও , আচ্ছা আমি রেডি হয়ে নিচে আসছি , তুই গল্প কর ।

– রেডি হয়ে তুই নিচে আসবি মানে ? ব্রেকফাস্ট করেছিস ?

– না । মাত্র‌ই তো উঠলাম ।

– আচ্ছা , তাহলে সোজা বুফে তে চলে আয় । আমরা এখানেই আছি ।

– আচ্ছা ।

পূর্ণতা রাতের ড্রেসটা চেঞ্জ করে একটা ব্ল‍্যাক ইউথ হানি ইয়োলো কালার ড্রেস পড়ে নিয়ে চুলটা খোপা করে ওরনাটা গলায় ঝুলিয়ে রুম থেকে বের হয়ে দরজাটা লক করে নিচে নেমে সোজা মাঠ পেরিয়ে রেস্টুরেন্টের দিকে এগিয়ে গেল ।

রেস্টুরেন্টের কাছাকাছি পৌঁছাতেই প্রেনার সাথে দেখা হলো । প্রেনা পূর্ণতা কে জড়িয়ে ধরে হেসে তারপর ওর হাত ধরে কাজিনদের সামনে নিয়ে গিয়ে ওদেরকে উদ্দেশ্য করে বলল ,

– এই যে আমার সুন্দরী বেষ্টু !

পূর্ণতা প্রেনার কাধে বারি মেরে বলল ,

– নিজে কি কম সুন্দর নাকি ?

প্রেনার কাজিনরা এগিয়ে এসে বলল ,

– সত্যিই , তুমি দেখতে খুব সুন্দর !

পূর্ণতা হেসে বলল ,

– ধন্যবাদ ।

এর‌ই মধ্যে কোথা থেকে জিব্রান এসে ওদের কথা শুনে দাঁত কেলিয়ে বলল ,

– শুধু কি পূর্ণতা ই সুন্দর ? নাকি আমিও সুন্দর ??

জিব্রানের কথা শুনে প্রেনার বোনেরা প্রেনার দিকে ভ্রু কুচকে তাকাতেই প্রেনা হেসে বলল ,

– এটাই জিব্রান ভাইয়া ! পূর্ণতার ভাই ! উনিও আজকের বরদের তালিকায় থাকা একজন ব্যক্তি !

এই কথা শুনে প্রেনার বোনেরা হেসে বলল ,

– আহারে , এভাবে আমাদের ছ্যাকা দিলি । ভাইয়ার উপর ক্রাশ খেতে না খেতেই শুনি ভাইয়ার বিয়ে অলরেডি ঠিক তাও আজকে । এর চেয়ে দুঃখের আর কি হতে পারে ?

পূর্ণতা , প্রেনা আর জিব্রান ওদের কথা শুনে হু হা করে হেসে উঠল ।

জিব্রান হাসি থামিয়ে বলল ,

– ওকে , পরে কথা হচ্ছে । আমার প্রচুর ক্ষুধা পেয়েছে । আমি এখনো ব্রেকফাস্ট করি নি ।

পূর্ণতা বলল ,

– তাহলে তোমার সাথে আমাকেও নিয়ে চলো ভাইয়া । আমিও ব্রেকফাস্ট করি নি ।

– ঠিক আছে চল ।

পূর্ণতাও জিব্রানের মতো সবাইকে বিদায় জানিয়ে সেখান থেকে জিব্রানের সাথে রেস্টুরেন্টের দিকে গেল ব্রেকফাস্ট করবে বলে ।

ব্রেকফাস্ট টেবিলে শুধু জিব্রান আর পূর্ণতা । পূর্ণতা বলল ,

– ভাইয়া !

জিব্রান ফোনে স্ক্রলিং করতে করতে ব্রেকফাস্ট করছিল । পূর্ণতার ডাক শুনে সাড়া দিতে বলল ,

– বল ।

– আমাকে শেষ বারের মতো খাইয়ে দিবে !!

পূর্ণতার মুখে হঠাৎ এমন কথা শুনে জিব্রান ফোনের দিক থেকে চোখ উঠিয়ে পূর্ণতার দিকে তাকালো । দেখল পূর্ণতা এক গাল হেসে ওর দিকে তাকিয়ে আছে । কিন্তু জিব্রানের বুঝতে বাকি নেই যে ছোট বোনের এই হাসি মাখা আবদারের পেছনে বুক ভরা কষ্ট লুকিয়ে আছে ।

জিব্রান ফোনটা টেবিলে রেখে পূর্ণতার মুখের সামনে খাবার তুলে বলল ,

– হা কর ।

পূর্ণতা হা করে ভাইয়ের হাত থেকে খাবার টা মুখে নিয়ে ধীরে ধীরে চিবাতে চিবাতে বলল ,

– তুমি খুশি তো ??

জিব্রান আবারো পূর্ণতার মুখে খাবার দেবে বলে প্লেটে রেডি করতে করতে বলল ,

– খুশি মানে !! অসম্ভব খুশি ! তুই জানিস না তুই আমাকে ঠিক কত বড় একটা চিন্তা থেকে মুক্ত করেছিস !

এই বলে পূর্ণতার মুখের সামনে আবারো খাবার তুলে ধরলো ।

পূর্ণতা আবারো খাবারটুকু মুখে নিয়ে বলল ,

– তুমি খুশি হয়েছো এইজন্য আমিও খুশি । আমি তো বোন হিসেবে কখনো তোমাকে কোনো হেল্প করতে পারিনি কারন আমার মাথায় বুদ্ধি-জ্ঞান কম । আমি বোকা । আমি নিজের ভালো মন্দ ই বুঝি না , তোমাকে কি করে হেল্প করতাম বলো ?

জিব্রান অপর হাতটা দিয়ে পূর্ণতার মাথায় হাত রেখে বলল ,

– তোকে অনেক জ্বালিয়েছি তাই না রে ? কত কথা বলেছি ! কত বকা দিয়েছি ! দুষ্টুমি করে কত কিছু বলেছি ! তোর সেসব শুনে খুব খারাপ লেগেছে তাই না রে ??
কিন্তু দেখ শেষে তুই ই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় সুখটাকে আমার কাছে এনে দিতে সক্ষম হলি । কারন , তুই এখন বুঝতে শিখেছিস , এখন তুই আর বোকা নেই । রাস্তা ঘাটে চলতে গেলেও মিনিমাম ডিফেন্স টুকু জানিস । পড়াশোনার পাশাপাশি সব দিকেই এগিয়ে আছিস ।
Now , I’m proud of you my LiL sis…♥️

জিব্রানের কথা গুলো শুনে পূর্ণতা আর কষ্ট গুলো বুকে চেপে রাখতে পারলো না । হু হু করে কেঁদে জিব্রান কে জড়িয়ে ধরে বলল ,

– ভাইয়া , তুমি যেও না প্লিজ । প্লিজ তুমি যেও না । তুমি চলে গেলে কে আমাকে কথা শোনাবে ? কে আমাকে জ্বালাবে ? কে আমার সাথে দুষ্টুমি করবে ? কে ই আদর করে তোমার মতো “পুচকি” বলে ডাকবে ?? বলো ভাইয়া বলো ! চুপ করে থেকো না । কি করে একা একা থাকবো ? কি করে ? তোমার মতো তো কেউ পারবে না আমাকে আর মাকে আগলে রাখতে ! কেউ পারবে না !!

জিব্রান ও পারলো না ছোট্ট বোনের এই মায়াভরা কথা শুনে নিজের মনকে সামলাতে । চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে পূর্ণতা কে জড়িয়ে ধরে বলল ,

– কাদিস না পুচকি ! তুই যদি আমাকে এভাবে দুর্বল করে দিস আমি তো যেতে পারবো না রে ! আর আমি যদি যেতে না পারি তাহলে তো বাবার আমাদের ব্যবসাটা এই বয়সে একার পক্ষে সামলাতে কষ্ট হয়ে যাবে । সবার কথা ভেবেই তো আমাকে যেতে হচ্ছে রে । কিন্তু আমি তো আর সারাজীবনের জন্য তোদের ছেড়ে যাচ্ছি না , আমি তো আসবো প্রতিবছর । নাহলে আমার পুচকি কাকে ‘ভাইয়া’ বলে ডাকবে ??

দুজন‌ই দুজনকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাদছে ।

চারিপাশে থেকে আধিরা আনজুম , মিলি রহমান , শিউলি রহমান , নাজমা বেগম , ইশিতা আলম , প্রেনা , আয়মান , ফাহিম , তাসিন , আবরন , নাদিরা , জল , রুহি , নীরা , সায়ন এবং কিছু লোকজন ভিড় করে এই ভাই বোনের ভালোবাসা দেখছে । তবে কেউ আটকাচ্ছে না । কাদুক ওরা , কাদুক । এই ভালোবাসা যেন চিরকাল অটুট থাকে । পৃথিবীর সমস্ত ভাই বোনের সম্পর্ক গুলো যেন এমন‌ই হয় । হাজার লড়াই ঝগড়ার মাঝেও যেন সত্যিটা এক‌ইরকম থাকে ।

সবার চোখের কোনে পানি জমেছে । তবে মিলি রহমান , শিউলি রহমান , প্রেনা , জল , নাদিরা এরাও জিব্রান আর পূর্ণতার মতোই চোখের পানি ছেড়ে কাদছে ।

জিব্রান আর পূর্ণতা কান্না থামিয়ে আশেপাশের পরিস্থিতি দেখে শান্ত হয়ে গেল । জিব্রান পরিস্থিতি ঠিক করতে হেসে পূর্ণতা কে বলল ,

– আরে পুচকি ! তোর বিয়েতে কি আরো এক ট্রাক শুটকি উপহার চাস ??

পূর্ণতা জিব্রানের কথা শুনে হেসে বলল ,

– শুটকির পেছনে লুকিয়ে থাকা চকলেট খেতে খেতে তোমার বোনের দাঁত সব পোকায় কেটে ফেলবে তখন কে বিয়ে করবে তোমার বোনকে ??

জিব্রান বলল ,

– সায়ন !! তুই কি আমার বোনের ফোকলা দাঁত দেখে বিয়ে করতে রাজি আছিস ?

সায়ন হেসে সামনে এগিয়ে গিয়ে বলল ,

– ইশশ , ঠ্যাকা নাকি ? ছবিতে ক্যাটরিনা দেখিয়ে অস্ট্রেলিয়া থেকে বাংলাদেশ নিয়ে এসে যদি বলো সখিনাকে বিয়ে করতে তাহলে আমি কি রাজি হবো নাকি ?

আবরন বলল ,

– আয় হায় , তাহলে পূর্ণতা বিয়ে না করলে তো আমার বিয়েটাও ক্যান্সেল । আর আমার বিয়ে ক্যান্সেল মানে তো জলের বিয়েও ক্যান্সেল ।

জল বলল ,

– তাহলে মাঝখান থেকে আমাকে আর সায়ন ভাইকে কষ্ট দিয়ে লাভ হবে কি ?

আবরন বলল ,

– কষ্ট না দিয়ে একটা কাজ করা যেতে পারে । যেহেতু সায়ন কষ্ট করে এসেছে তাহলে সায়নের সাথে তুমি বিয়ে করে নাও জল । তাহলে সায়নকে খালি হাতে ফিরে যেতে হলো না আর তোমাকেও কষ্ট পেতে হলো না ।

আবরনের লজিক শুনে সেখানে উপস্থিত সবার মুখে হাসির রোল দেখা দিল । কিন্তু আবরনের কথা শুনে জল হেসে সায়নের দিকে তাকাতেই দেখল সায়ন‌ও ওর দিকে তাকিয়েই হাসছে ।

সায়ন বলল ,

– আবরন কিন্তু আইডিয়াটা খারাপ দেয় নি !

জিব্রান বলল ,

– তবে রে !! তুই আমার বোনকে বিয়ে না করে এখন মত বদলাচ্ছিস ??

সায়ন হেসে বলল ,

– আ’ম জাষ্ট কিডিং ব্রো !!

সবাই হেসে উঠলো ।

…………………………………………………

বিকেল সাড়ে ৫ টা ,

গায়ে হলুদের জন্য‌ আজ‌ও রেস্টুরেন্টের দোতলাতেই বড় স্পেস আছে বলে নতুনভাবে ডেকোরেশনের কাজ করা হচ্ছে ।

সবার প্যারেন্টস অতিথি আপ্যায়নের কাজে ব্যস্ত সাথে বিয়ের বর-কনেদের গার্ডিয়ানরা নিজেদের ছেলে মেয়ের ড্রেস আপ এবং সাজ গোজের ব্যাপার নিয়ে কথা বার্তা চালাচ্ছে ।

পূর্ণতার রুমে পার্লার থেকে আসা কিছু মেয়ে এবং প্রেনা আছে । আর নাদিরার রুমেও পার্লারের মেয়েরা সাথে ওর কাজিনরা আছে । এদিকে জলের কোনো রিলেটিভস নেই । তাই শাদমান চৌধুরী জলের কিছু ফ্রেন্ডসদের ইনভাইট করে আগে ভাগেই জলের সাথে থেকে হেল্প করার জন‍্য চলে আসতে বলেছিলেন । এখন ওর রুমে সাজিয়ে দেওয়ার জন্য পার্লারের মেয়েরা এবং ওর কিছু বান্ধবীরা আছে ।

পূর্ণতা কে পার্লারের মেয়েরা সাজাতে সাজাতে বলল ,

– আপু , আপনাকে আপনার হবু বর বলেনি কিভাবে সাজলে সুন্দর লাগবে ?

পূর্ণতা বলল ,

– না ।

প্রেনা বলল ,

– ছেলেরা বোঝে নাকি কিভাবে সাজলে মেয়েদের সুন্দর লাগবে ?

– হ্যা , বোঝে তো । উনি উনার মনের মতো চিন্তা করে যেভাবে আপনাকে সাজতে বলবে সেভাবে সাজলে দেখবেন আপনাকে খুবই সুন্দর লাগবে !

পূর্ণতা বলল ,

– আমাকে বলে নি । আপনি আমাকে হালকা সাজ দিয়ে দিবেন !

প্রেনা বলল ,

– হলুদের দিন হালকা সাজলে সুন্দর লাগবে নাকি ?? আপু আপনি ওর কথা না শুনে আমার কথা শুনুন । গাঢ় সাজ দিয়ে দিন ওকে , নাহলে তো বিয়ের কনের গায়ে হলুদ বলে মনে হবে না ।

পূর্ণতা বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে দরজার সামনে দৌঁড়ে গিয়ে দরজা খুলে বের হয়ে যেতে যেতে বলল ,

– আল্লাহর ওয়াস্তে মাফ‌ ও চাই , দোয়া ও চাই । আমাকে তোমরা সবাই মিলে শাক চুন্নি সাজাতে এসো না প্লিজ ।

প্রেনা পূর্ণতা কে পালাতে দেখে দৌড়ে ওর পেছনে যেতে যেতে বলল ,

– পূর্ণতা ! পাগলামি করিস না !! একটু পর‌ই স্টেজে যাওয়ার জন্য ডাকবে । তোর জন্য আমিও কিন্তু এখনো রেডি হ‌ই নি ।

পূর্ণতা পেছনে তাকিয়ে প্রেনার কথা শুনতে শুনতে সিড়ি বেয়ে নিচে নেমে যাচ্ছিল কিন্তু হঠাৎ সিড়ি বেয়ে ওপরে আসা কারো সাথে ধাক্কা খেয়ে উল্টে পড়তেই যাচ্ছিল কিন্তু সেই ব্যক্তি ওর কোমড় পেঁচিয়ে ওকে ধরে নিল ।

প্রেনা ঘটনা দেখে চিৎকার করে চোখ বন্ধ করে সেখানেই থেমে গেল এই ভেবে যে পূর্ণতা হয়তো পড়ে গিয়েছে ।

পূর্ণতা তাকিয়ে দেখল যে আবরন ওকে ধরে রেখেছে । আবরন রেগে বলল ,

– এভাবে কেউ দৌঁড়ায় ? তুমি কি এখনো বাচ্চা ? আরেকটু হলেই তো পড়ে যাচ্ছিলে । আজ বাদে কাল বিয়ে আর সে এখনো দৌঁড়াদৌঁড়ি করছে । কোথায় যাচ্ছিলে এভাবে দৌঁড়ে ?

পূর্ণতা আবরনকে ধরে ওর পেছনে গিয়ে লুকিয়ে বলল ,

– আমাকে বাঁচান !

আবরন বলল ,

– কেন ? কি হয়েছে ?

– প্রেনা আমাকে ভুতের মতো সাজিয়ে দিতে চাইছে । আমি এত সাজতে রাজি না ।

– আর ইউ সিরিয়াস ! এই জন্য দৌড়ে পালাচ্ছিলে ?

– হু ।

প্রেনা আবরনের গলা শুনে চোখ খুলে সিড়ি বেয়ে নিচে নেমে দেখল আবরন আর ওর পেছনে পূর্ণতা দাঁড়িয়ে আছে ।

পূর্ণতা প্রেনাকে দেখে বলল ,

– এই যে শাকচুন্নিটা চলে এসেছে আমাকে ধাওয়া করতে করতে !

আবরন প্রেনার দিকে তাকিয়ে বলল ,

– তোমরা এখনো বাচ্চাদের মতো করো !

প্রেনা বলল ,

– ভাইয়া , একদম আমার দোষ দেবেন না ! আজ পূর্ণতার গায়ে হলুদ আর সাজবে না বলে জিদ ধরেছে ।

পূর্ণতা বলল ,

– একদম মিথ্যা বলবি না প্রেনা ! আমি একবারো বলেছি যে সাজবো না । আমি বলেছি হালকা করে সাজবো কিন্তু তুই পার্লারের মেয়েদের বলেছিস আমাকে গাঢ় সাজ দিয়ে দিতে ।

আবরন বলল ,

– ঠিক আছে পূর্ণতা । তুমি আমার সাথে চলো আমি ওনাদের বলে দিচ্ছি ।

পূর্ণতা বলল ,

– কি বলবেন ?

– গেলেই বুঝবে । চলো ।

– আচ্ছা ।

আবরন পূর্ণতা আর প্রেনাকে সাথে করে নিয়ে পূর্ণতার রুমের দিকে এগোতে লাগল । প্রেনা যেতে যেতে আবরনকে জিজ্ঞেস করল ,

– ভাইয়া , আপনি আপনার বাংলো ছেড়ে এই বাংলোতে কি করেন ?

– আরে আমি জিব্রান ভাইয়ার কাছে যাচ্ছিলাম । আমাদের জন্য জেন্টস পার্লার থেকে ছেলেদের ডেকে আনা হয়েছে । কিন্তু ওরা ভাইয়ার রুমে সবাই । ওদের সাথে কথা বলতেই এদিকে আসা ।

– ওও ।

পূর্ণতার রুমে প্রেনা আর পূর্ণতা ঢুকে ভেতরে বসতেই আবরন দরজার কাছে দাঁড়িয়ে পার্লার থেকে আসা মেয়েদের উদ্দেশ্য করে বলল ,

– পূর্ণতা এমনিতেই সুন্দর ! ওকে আরো সুন্দর বানাতে গিয়ে ভুত বানানোর কোনো দরকার নেই । জাষ্ট হালকা একটা সাজ দিয়ে দিন যেন হলুদের কনে বলেই মনে হয় ।

পার্লারের মেয়ে গুলো হেসে হেসে বলল ,

– প্রথমেই আপুকে জিজ্ঞেস করেছি যে আপনার বর কিভাবে আপনাকে দেখতে চায় তা বলেছে কিনা , তাহলে আমরা সেভাবেই সাজাবো । কিন্তু আপু তো বলল , আপনি নাকি কিছু বলেন নি ।

এই বলে আবারো হাসলো ওরা ।

পূর্ণতা মেয়েগুলোর কথা শুনে বরফের মতো জমে গিয়েছে ।

আবরন শুধু প্রেনা কে উদ্দেশ্য করে বলল ,

– বোঝাও এদের । আমি গেলাম ।

আবরন চলে যেতেই প্রেনা বলল ,

– আরে তোমরা না জেনে বুঝে কি যে বলে ফেললে ! এটা তো পূর্ণতার বর না । এটা জল আপুর বর , মানে আমাদের আরেক কনের বর । পূর্ণতার বর তো সায়ন ভাইয়া ।

ওরা সরি বলে পূর্ণতা কে সাজাতে শুরু করলো । কিন্তু প্রেনার কথাগুলো পূর্ণতার মনে গিয়ে বিঁধলো তবুও কিছু বলে তা প্রকাশ করলো না । হাসি মুখে ই সেজে নিল ।

…………………………………………………

অবশেষে সব কনেদের আর বরদের হলুদের পোশাক পড়িয়ে এক এক করে নিয়ে গিয়ে স্টেজে বসানো হলো ।

জিব্রান আর সায়ন এক‌ই পাঞ্জাবি পড়েছে । হালকা হলুদ পাঞ্জাবিতে সাদা রং এর কাজ করা পাঞ্জাবির গলায় ও বুকে । ওরা দুজন সেইম লুকে হলুদ মাখাতে স্টেজে এসে বসেছে । জিব্রানের বন্ধুরা সব এসেছে । ওরা ই জিব্রান আর সায়নকে নিয়ে এসে স্টেজে বসিয়েছে ।

এদিকে আবরন পড়েছে হলুদ পাঞ্জাবি যাতে লাল , কালো এবং কালো সুতোর কাজ করা । পাঞ্জাবির হাতা ফোল্ড করে ড্যাশিং লুক নিয়ে বন্ধুদের সাথে এগিয়ে আসতেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত সবাই ওর দিকে তাকালো । আবরনকে ফাহিম , তাসিন আর আয়মান সাথে করে নিয়ে এসেছে ।

হলুদের জন্য আজ মুখোমুখি দুটো স্টেজ বানানো হয়েছে । একপাশে তিন বর একসাথে বসবে । অপরটাতে তিন কনে একসাথে বসবে ।

আবরন গিয়ে জিব্রানের পাশে বসতেই সব সেই স্টেজের সামনে গিয়ে ভিড় করলো ছবি তুলবে বলে ।

জিব্রান বলল ,

– আবরন , তুই মাঝে বস । তুই একটু ইউনিক লুকে এসেছিস । আমি আর সায়ন তো সেইম , তো আমরা তোর দুপাশে বসি ।

– ঠিক আছে । যেভাবে বলবে ।

সবাই এখন তিন বরের সাথে ছবি তুলছে ।

অনুষ্ঠানে উপস্থিত সকল ছোট থেকে বড় ছেলেরা এক‌ই ডিজাইন এবং এক‌ই রং এর পাঞ্জাবি পড়েছে । ওদের সবার পাঞ্জাবি কলাপাতা রংএর আর তাতে ম‍্যাজেন্ডা রং এর ডিজাইন করা । আর হলুদের কনেরা বাদে বাকি সকল ছোট থেকে বড় মেয়েরা পড়েছে ম্যাজেন্ডা রং এর শাড়ি যেগুলোর পাড় এবং আঁচল কলাপাতা কালার ।

আর সব বাবারা পড়েছে এক‌ই রকম অ্যাশ কালারের পাঞ্জাবি এবং সব মায়েরা সেই সাথে ম্যাচিং করে অ্যাশ কালারের শাড়ি যাতে মেরুন পাড় আর আঁচল সম্পূর্ণ মেরুন রং এর ।

সবাই রেডি হয়ে স্টেজের সামনে উপস্থিত । শুধু বাকি হলুদের কনেরা এবং তাদের সাথের কাজিন এবং বান্ধবীরা ।

তিন কনে কে একসাথে সবাই মিলে স্টেজের দিকে নিয়ে যেতেই সবাই সেই দিকে লক্ষ্য করে চিল্লিয়ে উঠে পেপার বোম্ব ফাটাতে শুরু করলো ।

নাদিরার জন্য জিব্রানের সাথে ম্যাচিং করেই শাড়ি কেনা হয়েছিল । কাচা হলুদের সাথে সাদা মিক্স করা আঁচল আর পাড় । তাই ওকে গাঁজরা আর গোলাপ ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে ।

এদিকে জলের জন্য কেনা হয়েছিল হলুদের সাথে সবুজ পাড় এবং আঁচলের শাড়ি । ও সেটাই পড়েছে সাথে গোলাপ ফুল দিয়ে ওকে গহনা বানিয়ে পড়ানো হয়েছে ।

আর অবশেষে রয়েছে পূর্ণতা । ওকে পড়ানো হয়েছে টাটকা হলুদের সাথে লাল টকটকে আঁচল এবং লাল পাড়ের শাড়ি । ওর গোলাপ ফুলে এলার্জি তাই আর ওকে ফুল দিয়ে সাজানো হয় নি । মিলি রহমান আর আধিরা আনজুম পছন্দ করে কিছু গহনা কিনেছিলেন সেগুলো ই পড়িয়ে ওকে হালকা সাজে স্টেজে এনে বসানো হলো ।

নাদিরাকে মাঝে বসতে দিয়ে জল আর পূর্ণতা দুজন দুইপাশে বসলো ।

সবাই উপস্থিত হতেই শুরু হলো হলুদের অনুষ্ঠান ।

প্রথমে তিন ছেলের বাড়ির লোকজন এলো তিন মেয়েকে হলুদ ছোঁয়াতে । তিন বাটিতে আলাদা আলাদা ভাবে হলুদ এনে তিন ছেলের তিন মা তাদের পুত্র বধুকে হলুদ ছোঁয়াতে এলো । এরপর এলো তিন বাবা তিন পুত্রবধুকে হলুদ ছোঁয়াতে । পূর্ণতা কে একজন অচেনা লোক হলুদ ছোয়াচ্ছিল । পূর্ণতা বলল ,

– আপনি কি ….

– সায়নের বাবা । সাহেদ হাসান ।

পূর্ণতা সালাম দিয়ে বলল ,

– আপনি কখন এলেন ! দেখা ই হলো না !

সাহেদ হাসান মুচকি হেসে পূর্ণতার কপালে হলুদের ছোঁয়া দিয়ে বলল ,

– আমি সকালেই এসেছি । কিন্তু জার্নি করে আসায় নিজের রুমে ঘুমাচ্ছিলাম মা ।

– ওও ।

কথা শেষ করে তিন বাবা স্টেজ থেকে নেমে যেতেই তিন বাটি হলুদ নিয়ে আবার তিন মেয়ের দুই মা গেল ছেলেদের হলুদ ছোঁয়াতে । কারন , জলের মা অনুপস্থিত । তাই জলের মায়ের জায়গায় মিলি রহমান আবরনের গায়ে হলুদ ছোঁয়ালেন ।

আবরনকে যখন হলুদ ছোঁয়ানো হচ্ছিল আবরন হেসে হলুদের ছোঁয়া নিচ্ছিল । বিষয়টা পূর্ণতার চোখে পড়তেই ওর মন বলল ,

– কি হাসি খুশি ভাবে উনি হলুদের ছোঁয়া নিচ্ছেন ! হয়তো এই অনুষ্ঠানে সবাই খুশি শুধু আমি বিহীন ।

নিজের কষ্টটাকে কোনো মতে চাপা দিয়ে সবার সাথে হাসি মুখেই ছবি তোলা ও হলুদের ছোয়া নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল পূর্ণতা ।

উভয় পক্ষের আসল ব্যক্তিদের হলুদ ছোঁয়ানোর পর্ব শেষ হতেই সবাই এক এক করে গিয়ে উভয় পক্ষকে হলুদ ছোঁয়াতে শুরু করল ।

এরপর অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছেলে মেয়েরা নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ করে মজা করতে করতে হলুদ ছোঁয়া ছোঁয়ি করলো ।

রাত ১২ টা ,

হলুদ ছোঁয়ানোর পর্ব শেষ হতেই সব বর কনে কে স্টেজ থেকে নামিয়ে এনে সবাই নাচ গানের মজা নিতে মেতে উঠল ।

সবাই যখন ব্যস্ত অনুষ্ঠানে এর ফাঁকে জিব্রান নাদিরাকে হলুদ ছোয়াতেই নাদিরাও জিব্রানের গালে হলুদ লাগিয়ে দৌড়ে আবার সবার সাথে ভিড়ে মিশে গেল যেন জিব্রান ওর ওপর প্রতিশোধ নিতে না পারে ।

এদিকে সবাই মজা করলেও পূর্ণতা দাঁড়িয়ে আছে একপাশে । সবার সাথে দেখা হলে টুকটাক কথা বলছে কিন্তু নাচ গান করছে না , মজাও নিচ্ছে না ।

আবরন বিষয়টা খেয়াল করতেই ভিড়ের মাঝে পূর্ণতা কে টেনে সোজা এই রুম থেকে বাহিরে বের করে নিয়ে গিয়ে সোজা সিড়ি বেয়ে নিচে নেমে সুইমপুলের কাছে এনে দাঁড় করালো । আবরনের এমন আচরনে পূর্ণতার রাগ লাগছিল । তাই রাগ করেই বলল ,

– কি সমস্যা আপনার ? হঠাৎ হঠাৎ টেনে নিয়ে যান কেন ??

আবরন পূর্ণতার হাত চেপে ধরে ওকে কাছে এনে বলল ,

– সবাইকেই কম বেশি হলুদ লাগিয়েছি কিন্তু তোমাকে লাগানো হয় নি !

– তো !

– তো কি ! হলুদ লাগাবো এখন !

পূর্ণতা আবরনের কাছ থেকে নিজের হাত ছাঁড়িয়ে চলে যেতে যেতে বলল ,

– হলুদ লাগাতে এখানে আনতে হয় নাকি ? উপরে লাগালে কি হতো ?

আবরন পূর্ণতার হাত ধরে আবারো ওকে আগের জায়গায় এনে দাঁড় করিয়ে বলল ,

– উপরে তো তোমার খাটাশ বর টা আছে । যখন দেখবে আমি তোমাকে হলুদ লাগাচ্ছি তখন তেড়ে এসে তোমাকে আমার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যাবে ।

– তাহলে আর কি করবে ? আপনি নিজের ব‌উকে ফেলে অন্যের ব‌উকে গিয়ে হলুদের ছোঁয়া দিবেন ……….

পূর্ণতা বলে শেষ করার আগেই আবরন পূর্ণতার পেটে ঠান্ডা হলুদের ছোঁয়া দিতেই পূর্ণতা চোখ বন্ধ করে কথা বলা বন্ধ করে জোরে জোরে শ্বাস নিতে শুরু করলো ।

আবরন হেসে বলল,

– কি যেন বলছিলে ? চুপ করে গেলে কেন ?

পূর্ণতা বলল ,

– ছাড়ুন আমাকে । কি হচ্ছে টা কি ? আপনি এমন কেন করেন ?

আবরন আরেক দফা হলুদ পূর্ণতার গালে ছোঁয়াতেই যাচ্ছিল কিন্তু পূর্ণতা আবরনের হাত ধরে ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল ,

– আপনি আর আমাকে এই হাত দিয়ে ছোঁবেন না । আপনার কোনো অধিকার নেই আমাকে এই হাত দিয়ে ছোঁয়ার ।

আবরন হাত উঁচু করে বলল ,

– ওকে ফাইন । হাত দিয়ে ছোঁবো না ।

এই বলে পূর্ণতার কাছে গিয়ে পূর্ণতা বুঝে উঠার আগেই নিজের গালে লাগানো হলুদ ওর গালে ঘষা দিয়ে লাগিয়ে দিয়ে বলল ,

– হাত দিয়ে ছুঁতে বারন করেছো , গাল দিয়ে নয় ।

এই বলে আবরন হেসে উঠল ।
পূর্ণতা কান্না করে বলল ,

– আপনি একটা বাজে লোক । অসম্ভব রকমের বাজে লোক !

– ঠিক বলেছো । এই জন্যই তো এমন জায়গায় হলুদ লাগিয়েছি যে কেউ খুঁজেই পাবে না ।

এই বলে হাসতে হাসতে সেখান থেকে চলে গেল ।

আবরন চলে যেতেই পূর্ণতা পেটের কাছ থেকে শাড়ি সরিয়ে দেখল আবরনের পাঁচ আঙ্গুলের দাগ হলুদ লেগে আছে পেটে । পূর্ণতা আবরনের আঙ্গুল বরাবর নিজের হাত পেটে রেখে আঙ্গুল গুলো সে বরাবর দিয়ে মনে মনে বলল ,

– কেন আপনি বুঝতে পারছেন না যে আমি আপনাকে ভালোবাসি ! আপনি ভালোবাসার নাটক করলেও আমি সত্যিই আপনাকে ভালোবাসি । কেন বোঝেন না আপনি ?? কেন ??

এই বলে চোখ থেকে বেরিয়ে যাওয়া পানি টুকু মুছে নিয়ে আবারো রেস্টুরেন্টের দোতলায় ফিরে গেল পূর্ণতা ।

#চলবে ♥️

বিঃদ্রঃ ভেবেছিলাম আর ৩-৪ পর্বে শেষ করবো , কিন্তু এখন তো মনে হচ্ছে বিয়ের আনন্দ শুরু হলে সহজে শেষ হয় না । আল্লাহ ই জানে আরো কত পর্ব লিখতে হয় !! 😐

গল্পের ভুল ত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন । ধন্যবাদ । ♥️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here