ভরদুপুরে দু’বোনে আরাম করে বিছানায় ঘুমিয়ে আছি। দোতলা বাড়ি এখন খালি। সুনশান নিরব হয়ে থমকে গেছে দুপুরের প্রহরে। চারপাশ স্তব্ধ। হঠাৎ গোঙানো চিৎকারের কান ধাধানো শব্দ এলো! ঘুমের রেশ মূহুর্তেই পাতলা হয়ে ভেঙে গেল! আমি উঠলাম। বুকটা ধ্বক ধ্বক করছে প্রচণ্ড।। ঝট করে শয্যা ত্যাগ করার পরিনাম বুকের হার্টবিট বাড়িয়ে দিয়েছে প্রচুর।। বুকের উপর হাত রেখে ঘন ঘন শ্বাস ছাড়ছি।। আপু গালে হাত দিয়ে ঘুমিয়ে আছেন। পুনরায় আহাজারি চিৎকারের আওয়াজটা আসলো! চমকে উঠলাম আবারো! অসময়ে কে গোঙালো? কার এতো বিপদ ঘটলো? হায় খোদা, রক্ষা করো! বাড়িতে দুইবোন একা একা। ভয়টা কাবু করেছে আচ্ছা। কি করি? আপুকে ডাকলাম।
–আপু!! আপু? এই আপু উঠ্! আপু কে যেন গোঙাচ্ছে!! আপু উঠ্ প্লিজ!
আপু গাল থেকে হাত সরিয়ে অগ্রাহ্যমুখে বলে উঠলো-
–তুই ভুল শুনছিস। ঘুমা তো। গভীর ঘুম পেয়েছে। ডাকাডাকি করিস না।
আমি ভয়ের ক্রোশে আপুকে ধাক্কিয়ে যাচ্ছি। আপু উঠ্ প্লিজ! আমি ভুল শুনছিনা! একবার শুনে দেখ্ আমি ঠিক শুনছি! কেউ চিৎকার চেচামেচি করছে আপু ! উঠ্!
আপু উঠলোনা। বেঘোরে ঘুমের দেশে নিমিষেই তলিয়ে গেল। পাশের ফ্ল্যাট থেকে চিৎকারের আওয়াজ আসছে! কি ভয়াবহ চিৎকার! মনে হচ্ছে মাথা থেকে শরীর আলাদা করে দিয়েছে! সেইরকম ভয়ংকর চিৎকার! গোঙানির ফ্যাসফ্যাসে গলায় আধটু চেচামেচিও শোনা যাচ্ছে। আমি ভয়ের প্রকান্ড স্তুপ মনে গুটিয়েই বিছানা থেকে পা নামালাম। পাচঁ কালেমা ঠোঁটের আগায় জপাজপ পড়া শুরু করলাম। কে দুপুরের মধ্যভাগে চিৎকার করবে!!গোঙানি করবে? কে বিদঘুটে পরিস্থিতির শিকার হবে? কে? কে ও?
থরথর করে পায়ের হাটুর থেকে পাতা পযর্ন্ত কাপছে। কাপাকাপির মধ্য দিয়ে পা ফেলে ভয়ংকর চিৎকারে উৎসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। হাতের ভাজে আঙ্গুল মিলিয়ে ঘষে চলছি। কে হবে? প্রেত হবে? অশরীরী হবে? কে হবে? এলাকা ভালো না। গুজবে শুনেছি রাতের অন্ধকারে এলাকার কিছু মানুষ অদ্ভুত কিছু দেখেছে। কি বিশাল বিশাল পা-ওয়ালা ভয়ংকর কিছু নাকি দেখেও ফেলেছে। কালেমা জপতে জপতে শীতল হয়ে আসছিলো শরীর। তবুও বাধ না মেনে হেঁটে চলছি তার দিকে। সদর দরজা খুলে উকি দিয়ে দেখলাম ঘটনার বিষয়বস্তু কি আসলে। যতটুকু বুঝলাম, পাশের ফ্ল্যাট থেকে কোনো ছেলের চিৎকারের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। বাদামী রঙের বার্নিশ করা চকচক দরজাটা একটুখানি ফাকা। লক করা নেই মোটেও। হুট করে কারোর ফ্ল্যাটে ঢুকা, শালীনতার কাতারে পড়ে না। কিন্তু কিছু করার দেখছিনা! নিতান্তই চেচানোর শোরগোল বেড়েই চলছে। আমি আল্লাহর নাম নিয়ে ভেতরে গেলাম!
সত্যি কোনো এক ছেলে চেচাচ্ছে! পেটের ডানপাশ খামচে ব্যথায় কাতরাচ্ছে। ফ্লোরে শুয়ে অসহ্য যন্ত্রনায় গোঙাচ্ছে। মনের মধ্যে এলোমেলো হয়ে আসছে আমার! কি করবো? কোথায় যাবো? কাকে ডাকবো? একটা ছেলে ব্যাথায় কাতরাচ্ছে! বসে বসে দেখবো? কি আশ্চর্য? এতো বুদ্ধিমতি গুনসম্পন্ন মেয়ে আমি! কাজের বেলায় মাথাই কাজ করছেনা? ছেলেটা যন্ত্রণার মধ্যেই চোখ পিটপিট করে তাকালো। কালো টিশার্টের গেন্জিটা হাতের পাচঁ আঙ্গুলের জোরে ডানপাশে গুটে আছে। আরেকহাত ডানদিকের চামড়া খামচে ধরে আছে। আমি আহত চাহনিতে ফ্লোরে হাটুগুজে বসলাম। সে অসহনীয় ব্যাথার চোটে গলা দিয়ে জোরপূর্বক বলে উঠলো-
–এপেনডিক্স। পেইন হচ্ছে প্রচুর! আমায়..আমায় হেল্প করুন! হসপিটালে নিয়ে চলুন!
রেলস্পিডে ‘হ্যা’বোধকে মাথা নাড়ালাম। আমি উঠে দাড়ালাম। দৌড়ে নিজের রুমে গেলাম। হন্তদন্তে বরফের মতো শিরশির করে কাপছি! কপালে ঘাম জমে লম্বাটে গড়িয়ে পড়ছে! ছেলেটা কে — চিনে না! নাম কি –জানিনা! আনচান মনে তবুও তার প্রতি বেচ্যাইন কাজ করছে! কেন করছে –জানি না! ছেলেটা অসহ্য ব্যাথায় কতক্ষন যাবৎ পড়ে আছে, কে জানে? নাম্বার ডায়াল করলাম ফুপির। রিসিভ ফুপি করলো না। দাতে দাত কটকট করে আসছে, শীতে যেরূপ কনকনে ভাব আসে। আপু বিছানায় শুয়ে। ইচ্ছে হলো দেই এক লাত্থি। সময় নেই।।। সময় কম।। এপেনডিক্স খুব গুরুতর! এক্ষুনি হাসপাতালে না নিলে মৃত্যুর ঝুকি অনেকাংশে বাড়বে আরো। কিছু আমার নিজেরেই করতে হবে!
আমি স্নেহা মাহমুদ। অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে নতুন উঠেছি। ছোট ফুপির সাথে দোতলা বিল্ডিংয়ে বসবাস করছি।। বিল্ডিংটা ফুপিদের। ছোট ফুপি, ফুপাজি এবং ফুপাতো বোন সাফা বিন রহমানের সাথে এ বাসায় থাকি। ছোট ফুপির ছেলে নেই। একমাত্র মেয়ে আছে তার। আমিও অবশ্য ছোট থেকেই মেয়ের তালিকায় দ্বিমাত্র হিসেবে যোগ হয়েছি। তাতে মেয়ে বানিয়ে রাখার খাতিরে ফুপি ও ফুপাজির কোনোপ্রকার আপোষ নেই। বড্ড ভালোবাসেন আমায়।
রিকশায় বসিয়ে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছি। ছেলেটা ঠোট কামড়ে চোখ খিচে ব্যাথা চেপে বসেছে। রিকশাওয়ালা মামার সহযোগীতায় রুম থেকে রিকশায় তুলতে সক্ষম হয়েছি। নয়তো ওতো বড় জোয়ান মর্দ ছেলেকে রিকশা উঠানো আমার জন্য ব্যাপক ঝামেলার সৃষ্টি হতো। মামা প্যাডেলে পা চালিয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নিকটবর্তী জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছে। পনের মিনিটের মাথায় হাসপাতালের সামনে থেকে স্ট্যাচারে শুইয়ে ওয়ার্ড বয় দ্বারা ভেতরে নেওয়া হলো। রিসেপশনিস্ট আমায় ভেতরে যেতে আটকে দিলো। কিছু ফর্মালিটিস পূরণ করা অতীব জরুরী। ফর্ম ফিলআপ করাটা হসপিটালের কঠিন রুল! আমি ভেতরে গেলাম না। একপানে চেয়ে রইলাম ছেলেটার কাতরানো চিৎকারের দিকে। কি যন্ত্রনাই না হচ্ছে!!হাসপাতালে এসে ব্যাথাটা যেন বেড়ে গিয়েছে। রিকশায় যা কম ছিলো।
সব ফর্মালিটিস ফিলাপ করে রিসেপশনিস্টের কাছ থেকে টেলিফোন দিয়ে কল করলাম।
–হ্যালো ফুপি!! ফুপি তুমি আমার কল রিসিভ করলে না কেন? কতোবার তোমায় কল করলাম তুমি ফোন চেক করবেনা??
–অনেকগুলো ফোন করেছিস!! কোনো বিপদ রে? স্নেহা কি হয়েছে? এটা কার নাম্বার? টেলিফোন নাম্বার! কোথায় তুই!
–ফুপি হাসপাতালে আছি। জেনারেল হাসপাতালে। তুমি প্লিজ নগদ কিছু টাকা নিয়ে এখানে আসতে পারবে? খুব জরুরী!
–স্নেহা! তুই ঠিক আছিস মা? তোর কিছু হয়েছে? তুই হাসপাতালে কেন? সাফা কোথায়?
–আরে ফুপি টেনশনের বাতি আগেই জ্বালিয়েও না। শান্ত হও! আমি আপু সুস্থ আছি! বিপত্তি ঘটেছে পাশের ফ্ল্যাটে! পাশের ফ্ল্যাটের ছেলেটা, ফুপি এপেনডিক্সের ব্যাথায় কাতরাচ্ছিলো। আমি তাকে নিয়ে হাসপাতালে এসেছি।
–সর্বনাশ! আজই একটু বড় আপাকে দেখতে বেরুলাম। তার মধ্যেই এতোকিছু ঘটে গেল? তুই থাক মা! আমি এক্ষুনি তোর সোহেল ভাইকে নিয়ে রওনা দিচ্ছি!
–সোহেল ভা…
কথাটুকু শেষ করে বলতে পারলাম না ফুপি তাড়াহুড়ো করে কল কেটে দিলেন। সোহেল আমার বড় ফুপির ছেলে, এক চুল তাকে সহ্য করতে পারিনা! সে ভীষন জ্বালায় আমাকে! মাঝেমাঝে অপ্রীতিকর কান্ড ঘটিয়ে ফেলে যার কারনে, লজ্জায় পানি পানি হতে হয় আমাকে। বড় ভাই –বলে সম্মানের খাতিরে কিচ্ছু বলিনা।।
অপারেশন করতে ছেলেটাকে থিয়েটার রুমে নেওয়া হয়েছে। নার্স ও ডক্টর বিশেষ পোশাক পড়ে অপারেশন থিয়েটারে প্রবেশ করেছে। আমি দেয়ালে হেলান দিয়ে হাত ভাজ করে দাড়িয়ে আছি। নিজের দিকে তাকালাম। ছিঃ ছিঃ বাসার সাদামাটা পোশাকে কিভাবে বেরিয়ে পড়েছি!! লোকে কি বলবে!! বলবে কোন্ বাড়ির কাজের মহিলা সাহেব বাবু দেখভাল করতে এখানে এসেছে!! ছিঃ কি লজ্জার কথা! সাদা এফ্রন পড়া একটা নার্স বোর্ড হাতে সামনে এলো।
–ছেলেটা আপনার ভাই?
–নাহ্।
–কি হয় রিলেটিভ?
–নাহ্ রিলেটিভ না। কিছু দরকার?
–ওহ্ বুঝেছি। প্রেমিক আপনার!!
–আপনি বেশি বেশি বুঝে ফেলেছেন নার্স। সে আমার কিছুই লাগেনা। আমাদের ফ্ল্যাটে নতুন ভাড়ায় এসেছে। এই আর কি। কোনো প্রেমিক টেমিক না।
–ও দুঃখিত। ছেলেটাকে আপনার সাথে দেখে মনে হলো প্রেমিকা আপনি। তার এপেনডিক্সের পেইন দেখে ছুটে এসেছেন হসপিটালে। তা ছেলের নাম কি বলুন? ফর্মে ছেলের নাম পরে লিখবেন বলে, লিখেননি।
–জ্বী পরে লিখবো বলেছিলাম কারন আমি ছেলেটার নাম অবধিও জানি না। আমার ফুপিকে আসতে বলেছি। তিনি আসলেই বাকি ফর্মালিটিস শুধরে দিবেন। অপেক্ষা করুন।
–”নার্স! ছেলের নাম সাগ্রত লিখুন। ”
হঠাৎ পুরুষালী কন্ঠের গলা পেয়ে হকচকিয়ে নার্স ও আমি পিছনে ফিরে তাকাই।। ব্ল্যাক স্যূট। সাদা শার্ট। গলায় ব্ল্যাক কালারের টাই ঝুলানো। পায়ে সাইনিং সুজ। দেখতে স্মার্ট। মুখে একরাশ বিরক্তির ছোপ! উচা-লম্বা, ওয়েল পার্ফেক্ট ফিগার বিশিষ্ট। বুড়োআঙ্গুল পকেটে ঢুকিয়ে শক্ত হয়ে দাড়িয়ে আছে। পোশাকআশাক বলে দিচ্ছে কোনো ভালো সোসাইটির ফ্যামিলি থেকে বিলং করে। কে সে? যেখানে হাসপাতালেও ভাবসাব নিয়ে স্ট্রেটলি আছে, মনে তো হচ্ছে বিজনেসম্যান! আবার অন্যকিছুও হতে পারে! মাফিয়া নয়তো আবার? পকেটে পিস্টল রাখে? ভারী পিস্টল? A-2J73 নামের গান থাকবে?ওহ্ মাই গড্!
-চলবে
#ভুলবশত♥
#সূচনা_পর্ব
#Fabiyah_Momo🍁