#ভুলবশত♥
#PART_16
#FABIYAH_MOMO🍁
🥀🍁
বামচোয়ালে চারটে আঙ্গুলের স্পষ্ট ছোঁয়া টের পাচ্ছি। বুড়ো আঙ্গুলটা ঘড়ির কাটার মতো গোলাকার পথে ঠোটের চারপাশে চালান দিচ্ছে। চোখ এখনো বদ্ধ অবস্থায় অটল হয়ে আছে। সামনে সাগ্রত, ‘বিপদ’ হয়ে আছে! আমি একদম নিরুপায়! সে আমাকে ছাড়বে না নির্ঘাত! তার একটি হাত আমার মুখের উপর ঠোটের সাথে “আঙ্গুল ছোয়া’ খেলায় মত্ত থাকলেও আরেকহাতের শক্ত দাপটে আমার দুহাত উল্ট করে পিঠের সাথে চেপে ধরেছে।আমি নড়লেই গগনচুম্বী চিৎকার সমত বিকট চিৎকার দিয়ে উঠবো! হাড়ভাঙার মতো অসহ্য অব্যক্ত ব্যথায় স্থির জ্ঞান হারাবো! এই সাগ্রত কখন কি করে ফেলে তা বলাই বাহুল্য রাখে না!! ‘কি করি’ ভেবেও আমি কোনো সলিড উপায় বের করতে পারছিনা! সাগ্রত তার মুখ আমার কানের কাছে খুব ধীরসুস্থে আনলো। কানের উপর ছড়িয়ে থাকা কয়েকটা ছোট চুলকে ফু দিয়ে সরিয়ে দিলো। আমি হঠাৎ অল্পতরের বাতাস পেয়ে চমকে উঠি। আবারো পিঠের পেছন থেকে হাতজোড়া ছাড়ানোর জন্য দাপাদাপি শুরু করি। সাগ্রত আমার অবস্থা দেখে তার হাতের মুঠোয় চেপে ধরা আমার দুহাতের কবজি একসঙ্গে চিবিয়ে ধরার মতো ধরলো। উল্টো চেপে ধরাতে আরো কয়েকধাপ পেরিয়ে ব্যথার উৎকোচ আরো বেড়ে গেল, আমি লোয়ার লিপ কামড়ে স্থির হয়ে গেলাম। চোখে টলটলে পানির স্রোত ভিড়তে লাগলো।। সাগ্রত আলতো শব্দে কানের কাছে, ‘সরি স্নেহময়ী!’ বলতেই হঠাৎ আমার মুখের উপর কাপড় টাইপ কিছু চেপে ধরার অনুভব হলো ! আমি চোখ খুলতেই সাগ্রত বিনা শব্দে ঠোট নাড়িয়ে বলে উঠলো, ‘সরি মিস!’। সাগ্রত আমার মুখের উপর ক্লোরোফর্ম যুক্ত রুমাল চেপে ধরেছে। আমি পিঠের পেছন থেকে হাত ছাড়ানোর জন্য নড়াচড়া কয়েকগুণ বেশি শুরু করলে মুখের উপর রুমাল চাপার বেগ আরো দৃঢ় হয়ে যায়! না চাইতেও ছোটাছুটি, দাপাদাপি করলে লাভ হয়না! ক্লোরোফর্মের মেডিসিন নিশ্বাসের সাথে নাকের নাসাপথ দ্বারা ততক্ষণে নার্ভযুক্ত ব্রেনে চলে যায়। আমি বেহুঁশ হয়ে পড়ি। চোখের সামনে স্পষ্ট দেখতে দেখতে হঠাৎ ঝাপসা ঘোলাটে দেখতে থাকি, একপর্যায়ে ক্লোরোফর্মের কার্যকারিতা এতোই তীব্রভাবে হতে লাগলো… আমি আর সজ্ঞানে থাকতে পারিনা। চোখ বন্ধ করে কারো ধকধক ছন্দে মাতানো যন্ত্রবিশেষ স্থানে অবচেতন অবস্থায় ঢলে পড়ি। মাথার পেছন সাইডে চুলের উপর হাতের আলতো ছোয়া পেতেই….পুরোপুরি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি।।
একমণ ভারী মাথা নিয়ে চোখ খুলার চেষ্টা করি। চোখের সামনে অস্বচ্ছ ঝাপসা দেখছি, মাথা ঘুরিয়ে আসছে। মাথা উঠিয়ে আমি আধবোজা চোখে পিটপিট করে তাকালাম। আমার শরীর দুলছে।। চোখের সামনে যা দেখছি সবকিছু পেছনের দিকে ধাবিত হচ্ছে। আমি দু’চোখ কচলিয়ে আবারো দেখার চেষ্টা করলাম। এবার একটু পরিস্কার দেখতে পাচ্ছি। ছোট ছোট চোখ করে আশেপাশে তাকাতেই দেখি সাগ্রত আমার পাশের সিটে বসে আছে। হাতে ‘Humor Logistics’ নামের বই। খুব মনোযোগ দৃষ্টিতে বইয়ের ভেতরে চোখ স্থির করে আছে। মাথা এখনো ঘুরাচ্ছে। বামহাত তুলে মাথা ধরে আছি। খারাপ লাগছে, গা গুলিয়ে বমিবমিভাব হচ্ছে। মুখভর্তি বমি করতে পারলে নচেৎ আমার শান্তি লাগতো! আমার শরীরের সাথে মাথাটাও যেনো অক্ষম হয়ে আসছে। আমার হুশে ফিরার উপস্থিতি টের পেয়ে বসলো সাগ্রত। দ্রুত হাতের বইটা রেখে গলা ছেড়ে বললো-
–স্বাধীন! পানির বোতলটা পাস করো প্লিজ!
আমি মাথা ধরে সাগ্রতের দিকে একপলক তাকিয়ে, সামনের সিটের দিকে তাকাতেই কেউ মিনারেল ওয়াটারের বোতলটা পিছনের দিকে পাস করলো। চেহারাটা দেখতে পেলাম। হসপিটালে থাকা সেই ছেলেটা, যে সাগ্রতের পার্সনাল ডিটেলস নিয়ে আমার সাথে কথা কাটাকাটি করেছিলো।। সাগ্রত চট করে বোতলটা নিয়ে ইনটেক বোতলের মুখ খুলতে খুলতে সামনের সিটে কালো স্যূট পড়া স্বাধীন বলে উঠলো-
–স্যার? লেবুর শরবত দিবো? উনার তো মাথা হ্যাং হয়ে আছে।।
সাগ্রত বোতলের মুখ খুলতেই ব্যস্ত ছিলো। স্বাধীনের উত্তর আর দিলো না। বোতলটা নিয়ে আমার কাছে এসে আমার সাইডের জানালাটা খুলে দিয়ে বললো-
–পানিটা খেয়ে নাও স্নেহময়ী। তোমার ভালো লাগবে।। আমি এসি অফ করে দিচ্ছি, তুমি প্লিজ স্ট্যাব্যাল হয়ে বসো।
নরম গলায় কথাগুলো বলে উঠলো সাগ্রত। আমার সাইডে থাকা গাড়ির জানালা খুলে দিয়ে আমাকে ঠান্ডা হতে বললো। আমি পানির বোতলটা হাতে না নিলেও সাগ্রত আমার হাতে ধরিয়ে ছাড়ে। স্বাধীনকে দৃঢ় কন্ঠে আদেশসূচকে বলে উঠে-
–কানে যায়নি এসি অফের কথা বলেছি! তোমাকে কি ইনভিটেশন দিয়ে এসি অফের কথা বলতে হবে ইডিয়েট! এক্ষুনি এসি অফ করো !
স্বাধীন সাগ্রতের হুংকার দেওয়া আদেশে ছটফট হাতে এসির বাটনে টিপে দিলো। এসির হাওয়া কমতে কমতে ক্রমশ বন্ধ হলো। আমি ছোট ছোট চুমুকে বোতলে মুখ লাগিয়ে পানি খাচ্ছি। সিটে হেলান দিতে যাবো সাগ্রত পিছন থেকে একটা ছোট্ট কুশন নিয়ে পিঠের পেছনে রেখে দিলো। মুখ খুলে বললো, ‘হেলান দাও’। আমি সিটে পুরোপুরি হেলান দিয়ে বসি। জানালা দিয়ে শো শো করে প্রচুর ঠান্ডা বাতাস আসছে। আকাশে কালো কালো মেঘ জমেছে। সকালের দাপট দেখানো রোদের ভেলকি কালোমেঘের আড়ালে ঢেকে গেছে। বাতাসও ছেড়েছে স্নিগ্ধ কোমল ঠান্ডা। বাতাসটা আমার প্রাণচাঞ্চল্য করলেও চুলের অবস্থা নাজেহাল বানিয়ে দিয়েছে। আমি পানি খেতে গেলেই একদল চুল এসে মুখের উপর লুকোচুরি খেলছে।। সাগ্রত সিটবেল্ট খুলে আমার দিকে সম্পূর্ণ ঘুরে বসলেও আমার সেদিকে চোখ দিতেই লজ্জা করছে।। আচ্ছা কেন লজ্জা করছে? তাও কি জানি না?? আসলেই তো জানি না!! ব্রেন সিগন্যাল দিচ্ছে, স্নেহা তোমাকে এখন সাগ্রতের দিকে তাকাতেই হবে! নাহলে হবে তোমার সাথে আড়ি, আড়ি, আড়ি! আমি ছিনিমিনি করতে করতে সাগ্রতের তাকিয়ে থাকা উপেক্ষা লিস্টে তালিকাভুক্ত করছি।। আচ্ছা সাগ্রত কি জানে তাকে হোয়াট শার্টে ভ্যানিলা কেকের ক্রিমের মতো লাগছে!! দেখতে পুরোই কেকের সেই ফ্লেভারটার মতো লাগছে! মানুষকে কি কেকের মতো লাগে? ধ্যাত্ ! আমি না! মাথা নির্ঘাত নষ্ট হয়ে গেছে! ক্লোরোফর্মের নেশায় আমি ফর্ম পাল্টে কি সব ভাবছি!! ছিঃ ছিঃ স্নেহা ভুলভাল কথা ভাবতে নেই! যদি সাগ্রত শুনে ফেলে তাহলে? কি বড় ঝামেলায় পড়বি জানিস? আচ্ছা তুই কিছু না বলবে সাগ্রত জানবে কি করে? কেমন নষ্টালজিক থিংকিং করছিস! এমনেই তুই পাত্তা দিস না বলে সে ঘুরঘুর করছে! আর তুই ওকে নিয়েই সারাটাদিন ভাবিস, কল্পনা করিস…এগুলো জানলে তো সাগ্রত ফিট খেয়ে মরবে! ওর ফোল্ডেড হাতের সিচুয়েশন দেখার পর কি আমি ঠিক সত্যি আছি? কে জানে সে কথা! কবজির উল্টপিঠে কাটা দাগটা আমাকে অদ্ভুতভাবে মোহিত করছে!! কথা কি কেউ জানবে সেটা! অন্য হাতের রেডো ব্রান্ডের ঘড়ির কাটাটা টিকটিক করে চললেও আমার মনের মধ্যে অজানা শব্দটা ঠিকঠিকানা বেকিয়ে বসছে।। কেমন প্রপঞ্চে ফেসে যাচ্ছি?? আমার ভাবনার প্রহর গুটিয়ে দিয়ে সামনের সিট থেকে রসকসহীন গলায় বললো-
–স্যার, লেবুর শরবতটা দিবো?
কঠিন গলায় অশ্রাব্য গালি দিতে ইচ্ছে করছিলো! মুখটা আমি সিট থেকে হাফ দেখতে পেলাম। এটা স্বাধীন ছিলো! স্বাধীনের মতো কাবাবে হাড্ডি ওয়ালা পার্সন একেকটা মিনকা শয়তান হয়! রোমান্টিক সিচুয়েশনে এক চামচ বিরক্তির ফ্লেভার মিস্কড করতে এরা প্রচুর পারদর্শী হয়! অবশ্য আমি রোমান্টিক ভাবে নিজের সাথে কল্পবিলাস করলেও সাগ্রতের পক্ষ থেকে আদৌ কোনো রিসপন্স খেয়াল করলাম না। আমি মাথা বাকিয়ে দেখি, সাগ্রত আমার দিকে না…তাকিয়ে আছে জানালার বাইরে কালো ঘন আসমানের দিকে! বামপাশে সিটে হেলে গালে হাত দিয়ে চলন্ত গাড়ির বাইরের দৃশ্যপট উপভোগ করছে। মনটা খারাপভাবে খারাপ হলো, আমি বুকভরা না বলা অভিমান জমিয়ে বোতলটা জানালার বাইরে ফেলে দিলাম। রাস্তায় পানির আধভরা বোতলটা ঠাসস করে পড়লো। ধ্যান হটলো সাগ্রতের, গাল থেকে হাত সরিয়ে স্বাভাবিক হয়ে বসলো।। আমার দিকে অবুঝ বাচ্চার মতো কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলে উঠলো-
–তুমি বোতলটা ফেললে কেন? ওভাবে বোতলটা ফেলার মানে কি ছিলো?
আমি ডোন্ট কেয়ার মুড নিয়ে বসে আছি। উদ্দেশ্য আমি কোনো কথা বলবো না। পাশ থেকে অপর ব্যক্তি কতটা কথা বলতে পারে তাই দেখতে ইচ্ছুক।। গাড়ি যে কোন্ গন্তব্যে ছুটছে তাও কিছু জানি না। হাইওয়ের রোড ছেড়ে কোন্ জায়গায়র রাস্তায় ঢুকেছে তাও চিনি না। বিগত পচিশ মিনিটের বেশি সময় ধরে সাগ্রত চুপ। ফোনের স্ক্রিনে জরুরি কিছু করছে এমন ভঙ্গিতে উদ্যোগ নিয়ে বসেছে খুব। আমার হাতের হাতঘড়িতে সময়টা দেখলাম। দুপুর ৩.৪০ বেজেছে। মাথায় চিন্তার ঘন্টা বাজলো। আমি প্রায় তিনঘন্টা ধরে গাড়িতে চড়ে সাগ্রতের সাথে আছি। তিনটা ঘন্টা পিলপিলিয়ে কিভাবে চলে গেল মাথায় ঢুকছেনা!! সারাটা রাস্তা বেহুশ থেকে সাগ্রতের সাথে একা যাওয়ার মানে হয়না! আমি শক্ত গলায় সাগ্রতকে জিজ্ঞেস করলাম-
–আমাকে কোথায় নেওয়া হচ্ছে! কোথায় যাচ্ছি আমরা!
সাগ্রত ফোনের উপর থেকে চোখ না সরিয়ে স্ফীত কন্ঠে বললো-
–কালিয়াকৈর, গাজীপুরের কাছাকাছি।।
চোখ কপালে না উঠে মাথার তালুতে উঠার প্রবাদ থাকা উচিত ছিলো! কেননা, ঢাকা ছেড়ে গাজীপুরের উদ্দেশ্যে রওনা দেওয়া মারাত্মক শুভাকাঙ্খীর লক্ষন না!আমি ভেতরে ভেতরে হুলস্থুল পাকালেও বাইরে থেকে সংযম আছি। আরেক দফায় প্রশ্ন করলাম! সাগ্রত ফোনের স্ক্রিন অফ করে আমার দিকে তাকালো-
–আপনি আমায় কিডন্যাপ কেন করেছেন! কি চাই আপনার!
সাগ্রত একগাল হাসলো। হাসিটা খুব মানায়। সবার গম্ভীর চেহারায় হাসিটা মানায় না, সাগ্রতের মতো ত্যাড়াবাকা দাতের ছেলেদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা সুন্দরভাবেই মানায়।। সাগ্রত ফোনটা সিটের উপর রেখে আমার দিকে চেপে আসলো।।আমি জানালার দিকে চেপে বসলাম।। সাগ্রত আরো চাপলো। আমি জানালার সাথে প্রায় লেগে বসেছি, সাগ্রত এবার চেপেচুপে আমার সাথে গা সওগাত হয়ে বসলো।। একটা হাত আমার পিঠের পিছন থেকে বামবাহুতে রাখলো। আমি সাগ্রতের দিকে কঠিন চোখে তাকালাম। সাগ্রত বামবাহুতে জোরে চাপ দিয়ে নিজের সাথে মিশিয়ে ধরলো।। আমি পুনরায় ওর কাছ থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্য কৌশল খাটালেও সব ব্যর্থ! সাগ্রত বাম ভ্রু উচু তুলে বলে উঠলো-
–কোথায় যাচ্ছি জানো? আমার বাসায়, আমায় ভিটেমাটিতে যাচ্ছি।। যেখানে এই সাগ্রত বড় হয়েছে সেখানে ঘুরতে যাচ্ছি। পরিবেশটা তোমার ভালো লাগবে না আই নো ইট! তাও এফ্রটটা তো করতেই পারি!!
আমি ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকলে সাগ্রত হেসে দেয়।।ডানপাশের চোখা দন্ত বিশিষ্ট ত্যাড়া সাদা চকচক দাতটি হাসিতে উকি দিলো।। হার্টবিট ফাস্ট করা মারাত্মক একটা হাসি! বাম ভ্রু তে একটা কাটা দাগ আছে। ওটা কি ফ্যাশনেব্যাল স্টাইল? নাহ্ তো! ওখানে খুব গভীরভাবে কেটে গিয়েছিলো সেই দাগ! ভ্রুর কাছে খুব গভীর হয়েই দাগ বসেছে সাগ্রতের। একটা সেলাই ঢাকা পড়েছে ভ্রুর কাছে।। অদ্ভূত অদ্ভূত দাগগুলো যে অদ্ভুতাকারে অভিভূত করছে!! কি আছে এই সিরিয়াল কিলারের মধ্যে?? একটা কিলার কি কখনো কিলার লুক দিতে পারে?? কিলার হয়ে যে অন্যকেও খতম করছে!! ”একটা কিলারের কিলার লুক, আহত করেছে খুবই অদ্ভুত!”
বেলা চারটা। গাড়িটা থামানো হয়েছে নিরিবিলি কোনো এক জায়গায়। পাকা রাস্তার দুধার ধরে সারি সারি গাছগাছালি। সন্ধ্যা না হতেই এই জায়গায় যে অন্ধকার নামে খুব করে অনুমান করছি।। গাড়িটা একটা টিনের বাড়ির কাছে থামানো হয়েছে। চারকোনা বিশিষ্ট ঢেউটিন দ্বারা নির্মিত দুটো জানালা দেওয়া একটি বাড়ি। স্বাধীন সিট থেকে নেমে সাগ্রতকে নিয়ে বাড়িতে ঢুকেছে।আর আমি? তারা আমাকে গাড়ির মধ্যে লক করে গিয়েছে। পালানোর কোনো স্কোপ নেই। মিনিটের কাটা পনের মিনিট যেতেই সাগ্রত হনহনিয়ে চলে আসলো।। গাড়ির রিমোট টিপে টুটটুট শব্দ হতেই দরজা খুলে আমাকে বের হতে বললো। আমি কৌতুহল দৃষ্টিতে দরজা খুলে বের হতেই সাগ্রত আমার হাত টান দিয়ে সামনের সিটে বসতে বললো। ও ড্রাইভিং সিটের দরজা খুলে সিটে বসতে বসতেই বলে উঠলো-
–কি হলো! বসতে বললাম না!
আমি হাবার মতো দরজা খুলে গাড়িতে বসে সিটবেল্ট বাধলাম।। সাগ্রত গাড়ি স্টার্ট দিয়ে স্পিড বারিয়ে চালাতে লাগলো।। আমি কৌতুহল কাটাতে পারছিলাম না। না পারতে বলে বসি-
–আপনার সাঙ্গু চলে গেল কেনো? কি হয়েছে!
সাগ্রত এক্সিলেটর চেপে বলে উঠলো-
–ডোন্ট কল হিম সাঙ্গু! ওর নাম স্বাধীন। আমার এসিসটেন্ট! নট সাঙ্গু!
–ওইতো একই কথা। “যেই লাউ সেই কদু”।
–কি বললে??
–মানে…আপনি বললেন না, ও আপনার এসিসটেন্ট হয়। তাই খাটি বাঙালি ভাষায় এদের সাঙ্গু, পাঙ্গু, চামচা, চামচিক্কা বলা হয়।
–চামচিক্কা?
–হ্যা চামচিক্কা। কালো ভুটকা গুলিকে চামচিক্কা কালাচান বলা হয়।।
–ও তো ওই ক্যাটাগরির কেউ নাহ্।
–তাহলে ধলা চামচিক্কা! গেম ফিনিশ!
–তুমিও না স্নেহময়ী! খুব ফানি!!
–আপনি স্পিড বাড়াচ্ছেন কেন?
–হেভি স্পিডে ভয় করছে?
–ককই…ননাহহ ততো
–আই হেভ গট দ্যা আন্সার স্নেহময়ী।। আমার স্পিড ছাড়া গাড়ি চালিয়ে শান্তি নেই। সো ইউ হেড টু একসেপ্ট দিজ স্পিড।আর স্বাধীন? এই স্বাধীন একটা ইডিয়েট! স্পিড দেখছো? কত লো ছিলো? মনে হচ্ছে গাড়ি না, সাইকেল চালাচ্ছে!
–আপনি একটা কোয়েশ্চ্যানের আন্সার দিবেন?
–Of course! Please ahead,
–কিডন্যাপ কেন করেছেন?
–ওহ্ ওহ্….কোয়ান্টিটি টাইম স্পেন্ড করবো বলে।। স্নেহময়ী তুমি আমার উপর বিরক্ত?
–আপনি রুমে কিভাবে ঢুকেছেন! কিভাবে আমাকে গাড়ি পযর্ন্ত আনলেন!
–আমি আগে যেটা জিজ্ঞেস করেছি সেটা বলো।
–আমি কথা রিপিট করা পছন্দ করি না!
–ওকে, ওকে বলছি।। তোমাদের বাসার শর্মিলা বুয়াকে কিছু টাকা দিয়েছি। সে টাকার লোভে আমাকে ভেতরে আসতে দিয়েছে। আর গাড়ি পযর্ন্ত আনার কথা?? সেটা আরো ইজি! শর্মিলা খালা তোমার ফুপির পানির গ্লাসে ঘুমের ডোজ মিশিয়েছে। ব্যস!
–আপনি…!!
–ইয়াহ্ আমি স্মার্ট! বেশি প্রশংসা করতে হবে না স্নেহময়ী!! নাহলে লাইন ছেড়ে মাটিতে পড়বো বুঝলে।।
হাই স্পিডের চক্করে গাড়িতে বসে আরো সময় পেরিয়ে গৃল। বিকেলের গোলাপি রঙের আভা মিলিয়ে গেল। আকাশে হালকা বেগুনি রঙের গাঢ়ত্ব ধারন করে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো।। রাস্তা ধরে গাড়ি এসে থামলো রেস্তোরাঁর কাছে। ‘মায়ের দোয়া রেস্তোরা’।। ইলেকট্রিসিটির দোকান থেকে শুরু করে রিকশার গায়ে পযর্ন্ত এই নাম দেখে দেখে নামটা ফেমাস করেছি! এখন দেখি রেস্তোরাঁর নামই ‘মায়ের দোয়া’! সাগ্রত গাড়ি থেকে নেমে আমাকে নামতে বললো। আমি নামলাম। আমাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো-
–আসো স্নেহময়ী। খাবো!
বুঝতে পারলাম সাগ্রত শহরের আভিজাত্য ছেড়ে ছোটোখাটো রেস্তোরাঁর রেসিপি দিয়ে পেটপূর্তি করবে।। সাগ্রত ভেতরে ঢুকলো। আমিও তাকে অনুসরন করে পিছু পিছু গেলাম। রেস্তোরাঁর মালিক এককোণায় চৌকির উপর আসন গেড়ে পান চিবুচ্ছে। চৌকির উপর ক্যাশবাক্স, সিগারেটের প্যাকেট, পান সুপারি সাজানো প্লেট। দেখেই বোঝা যাচ্ছে এই বুড়ো ভুড়িপেটের তালুখালি মাথার লোকটি হলো মালিক।। লক্ষ করলাম পাচঁ / ছয়টা কম বয়সী ছেলে কাস্টমার সামলাতে এদিক সেদিক ছোটাছুটি করছে। বাবুর্চি সহ রান্নার আরেকজন রাধুনি চুলোয় নানা পদ চড়াতে ব্যস্ত।। সাগ্রত খালি স্থান দেখে একটা টেবিল দুটো চেয়ারের কাছে গেলো। টেবিলটা অপরিস্কার। মনে হয় কেবল কেউ হাত ধুয়ে উঠেছে। সাগ্রত চেয়ারে আরাম করে বসলেও আমার এমন উটকো পরিবেশে বসতে খুব সমস্যা হচ্ছে। সাগ্রত কিভাবে যেন পুরো ব্যাপার আচঁ করতে পারলো। সাদা শার্টের হাতাটা কনুইয়ের কাছে উঠাতেই হাক ছেড়ে বললো-
–এই পিচ্চি! এইযে এখানে আসো।
হাক দিতে দেইরি সঙ্গে সঙ্গে দুটো কিশোর উপস্থিত হতে দেরি না। যেন সাগ্রতের একটা ইশারার জন্য অপেক্ষায় ছিলো। ট্রে হাতে ছেলেটি আগ বারিয়ে বললো-
–স্যার, আফনের কিছু লাগবো? কি আনমু কন।। আমগোর এইহানে হগলকিছু ইসপেশাল।।
–টেবিলটা পরিস্কার করার ব্যবস্থা কর ছোট ভাই। তোর ভাবী আসছে বুঝলি। সব কিন্তু স্পেশাল স্পেশাল লাগবে।।
–আমনে খালি আদেশ করবেন বড় ভাই! এই আবদুল ওয়াদা! সব ইসপেশাল হইবো!!
— আজকের আইটেম কি,
ট্রে হাতে ছেলেটির নাম আবদুল। আবদুলের পালে থাকা ছেলেটি দ্রুত একটা কাপড় দিয়ে টেবিল পরিস্কার করে দিলো। ট্রে থেকে দুটো কাচের গ্লাসে পানি রাখলো টেবিলে।। ট্রে খালি হওয়াতে আবদুল সেটা বগলের নিচে গুজে আঙ্গুলের দাগে গুণতে গুণতে বলে উঠলো-
–পারোটা ভাজি, মাছের কালিয়া, সাদা ভাত, ডাইল, কালাভুনা, মোগলাই পারোটা, মুরগি তরহারী, খাসির রেজালা।।আফনে কি খাইবেন কন খালি।।
সাগ্রত চোখ ঘুরিয়ে আমাকে বিপরীত চেয়ারে বসতে বললো। আমি নাফরমানী না করে চুপচাপ বসলাম। সাগ্রত পকেট থেকে ফোন বের করতে করতে বলে উঠলো-
–এক কাজ কর দুইটা মোগলাই পরোটা নিয়ে আয়।। একদম গরম গরম আনবি।।
–এহনি আনতাছি বড় ভাই।…..ও মতিন চাছা, দুইডা মোগলাই দিয়েন! এক্কেরে গরমাগরম দিবেন কইলাম! আমার বড় ভাই ভাবিরে লইয়া আইছে।। ইসপেশাল লাগবো!
🥀🍁
আমাদের সামনে দুই প্লেট দুইটা মোগলাই আইটেম পেশ করা হলো। একটা সাগ্রতের সামনে, আরেকটা আমার সামনে।। সাগ্রত তার বামহাতের ঘড়িটা কবজি থেকে খুলে ফেললো। ফোনটা টেবিলের উপর রেখে গরম গরম ধোয়া উঠা মোগলাই পরোটা দেখে জিহবা দিয়ে আলতো করে জিভটা ভিজিয়ে নিলো।। ময়দার দলার সাথে খুব সুকৌশলে ডিমের পেয়াঁজ মরিচের কারুকাজ ঢেলে বানানো হয় মোঘল শাসনামলের ”মোগলাই পরোটা”।। খেতে দারুন! মোগলাই পরোটার উপর সসের কারসাজি খুব বেশি পরিমাণে দেওয়া। তাছাড়া আবদুল ছেলেটা এক্স্ট্রা কেয়ার দেখিয়ে দুটো সসের বেশি প্যাকেট দিয়ে গেছে।। দুটো সাগ্রত আমার পরোটার উপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিয়েছে। কাটাচামচ থাকা সত্ত্বেও সাগ্রত হাত ধুয়ে হাত দিয়ে খাচ্ছে। তার খাওয়ার মধ্যে বাচ্চাসুলভ কান্ড কারখানা দেখতে পাচ্ছি। মুচকি মুচকি বাকা হাসছি। ঠিক একটা বাচ্চা ছেলে যেন খাইখাই স্বভাবে পরোটা খাচ্ছে!! আমি তার দিকে তাকিয়ে হাসতে থাকলে সাগ্রত হঠাৎ আমার দিকে তাকিয়ে ইশারায় জিজ্ঞেস করে, “হাসছো কেন?”। আমি চোখ বন্ধ করে ডানেবামে মাথা নাড়িয়ে ‘কিছু না’ বোঝালাম। সে বাকা দাতের কোন্দলে চেপে খানিকটা হাসলো। আমাদের খাওয়া শেষে টাকা পরিশোধ করে আসতে নিলে আবদুলও পিছু পিছু আমাদের বিদায় জানাতে আসে। আমি গাড়িতে উঠে বসলে, সাগ্রত আবদুলকে বিদায় জানাতে কাধে হাত দিয়ে কথা বলতে থাকে। কিছু কথা এমন ছিলো-
–ছোট ভাই, কাজ করিস ভালো করছিস। কিন্তু পড়াশোনা এ উছিলাতে লাটবাজারে তুলিস না। পড়াশোনা করিস। কিছু এমাউন্ট হাতে দিয়ে গেলাম, স্কুলের বেতন চুকিয়ে নতুন একটা শার্ট কিনবি। তোর টাকার প্রয়োজন হলে কল করবি! নো হাংকি পাংকি! আমি আসছি, নিজের খেয়াল রাখিস।।
সাগ্রত চোখের পলকে আবদুলের ছেড়া শার্টের পকেটে টাকার নোট গুজে চলে আসলো। গাড়িতে উঠেই স্টার্ট দিয়ে আগের মতো স্পিডে গাড়ি চালাতে লাগলো। আমি কিছুকালব্যাপী সাগ্রতের দিকে তাকিয়েই কাটিয়েছি। আবদুল নামক রেস্তোরাঁয় কাজ করা ছেলের প্রতি আলাদা সহানুভূতি দেখেছি। এ যেন অন্য সাগ্রত! ভিন্ন দুনিয়ার তাশরীফ সাগ্রত! যাকে কেউ চিনে না, আদৌ কেউ বুঝবে না। সাগ্রত খুব পার্ফেক্টলি ড্রাইভ করছে। ড্রাইভিংয়ের ক্ষেত্রে বোঝা যাচ্ছে খুব প্র্যাকটিস আছে তার। হাতের দিকে তাকাতেই মনে হলো, রেস্তোরাঁয় হাতের ঘড়িটি ফেলে এসেছে সে।। আমি প্রশ্নসূচক কন্ঠে জিজ্ঞেস করি-
–আপনি খুব কেয়ারলেস, হাতঘড়িটা ফেলে এসেছেন জানেন! গাড়ি ঘুরান! ঘড়ির প্রাইস কম হলেও তিন চার হাজার টাকা! অযথা সেটা ফেলে আসলেন কেন?
আমার কথায় মুচকি হেসে ঠান্ডা গলায় বলে উঠলেন-
–কিছু জিনিস ফেলে আসতে হয়। তাতে কারো না কারো উপকার হয়। অন্যের উপকারটা কিভাবে হবে তা হয় উপকাহিনী থাকুক!! ঘড়িটা বেচে আবদুলের সঙ্গি কিছু কিনবে…তাতে তার মুখে একচিলতে হাসি ফুটুক!!
–আবদুলের সঙ্গি কি তাহলে টেবিল পরিস্কার করা ছেলেটি?? সেকি মুখ খুলে টাকার প্রয়োজনীয়তা বলতে পারে না?
–সবাই টাকার চাওয়ার মতো সাহসিকতা দেখাতে পারেনা। মইন ঘড়ির সাথে নোটটা পড়ে খুশি হবে স্নেহময়ী।।
আমি খুব অবাক হয়ে বলে উঠলাম-
–নোট? কিসের নোট?
–“ছোট ভাই নাম্বার টু! প্লিজ ঘড়িটা অন্তত গ্রহন করিস! নগদ টাকা তো হাতেনাতে নিবি না!! ঘড়িটা বেচে কিছু কিনে নিস!”
-চলবে🍁
-Fabiyah_Momo🍁