ভোরের_আলো পর্ব-৩৬

0
908

#ভোরের_আলো
৩৬.

আশফাকের কথায় একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো কৌশিক৷ চেয়ারটাতে হেলান দিয়ে শরীরের ভার ছেড়ে বসলো। তাকে এভাবে দেখতে কষ্ট হচ্ছে খুব। মনে হচ্ছে যেনো মানুষটার সমস্ত ইচ্ছেগুলো মরে গেছে। আশফাকের সেসব দুর্বিষহ দিনগুলোতেও এতটা ভেঙে পড়তে দেখেনি যতটা আজ দেখতে পাচ্ছে। চেয়ার টেনে আশফাকের কাছাকাছি এসে বসলো কৌশিক। একহাত চেপে ধরে বললো,

– তোর বউ তোকে আমি এনে দেবো। কিছু খা ভাই। বউ ঘরে তুলতে হবে না? অসুস্থ হলে বউ ঘরে তুলবি কি করে?
– কিভাবে আনবি তুই?
– কান টানলে মাথা আসে। কান ধরে টান দিবো। মাথাটা আপনা আপনি চলে আসবে।
– যদি না আসে?
– তুই এভাবে হাল ছাড়লে কিভাবে হবে? তুই হাল ছাড়ার মানুষ না।
– অন্যায়টা যে খুব বড় ছিলো।
– হ্যাঁ ছিলো। ওর প্রতি তোর ভালোবাসাটাও তো গভীর তাই না? নিজের ভালোবাসার উপর কনফিডেন্স নেই তোর?
– ওর জায়গায় আমি থাকলে তো কখনো ফিরে যেতাম না।
– এত যুক্তি দেখছিস কেনো? এইসব যুক্তি দেখতে যেয়েই সেদিন রাতে অঘটনটা ঘটিয়েছিস। সব কথা সুড়সুড় করে বউকে বলে দিলি। কোনো প্রয়োজন ছিলো? ছিলো না। এখনও এত যুক্তি দেখার কোনো প্রয়োজন নেই। যদি বউ ফেরত চাস তো সব যুক্তি ভুলে যা। নিজে কি চাচ্ছিস সেদিক ফোকাস কর। এখন তোর সামনে একটাই টার্গেট যুক্তি বা পরিস্থিতি যেমনই হোক না কেনো যেভাবে হোক বউ ফেরত আনতে হবে।
-……………..
– আবিদের নাম্বার দে।
– সুইচ অফ।
– মুক্তা?
– অফ।
– অন্য কারো নাম্বার জানিস?
– না।
– ভালো করে মনে কর। কখনো কি অর্পিতা বাসার কারো নাম্বার থেকে কল করেছিলো?
– করেছিলো তো বোধহয়,,,,,
হ্যাঁ করেছিলো। একবার রাগ করে কথা বলিনি। তখন ওর বাসার সবার নাম্বার থেকে ডায়াল করেছিলো। সবগুলো নাম্বারে ব্লক করে দিয়েছিলাম। ব্লক লিস্টে আরও পাঁচটা নাম্বার আছে। কোনটা কার জানিনা।
– যেহেতু দারোয়ান বাদে বাসায় আর কেও নেই তারমানে সবাই একসাথেই আছে। সবগুলো নাম্বার আনব্লক কর। কল দিলেই তো বুঝা যাবে কোনটা কার নাম্বার।

বিছানার উপর থেকে আশফাকের ফোনটা নিলো রিমন। সবগুলো নাম্বার সে আনব্লক করেছে।

– কল দিয়ে কাকে চাইবো?
– কাকে আবার? অর্পিতা আছে কিনা জিজ্ঞেস করবি।
– ঝামেলা হলে?
– হলে হবে। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। ঝামেলা ছাড়া উপায় নেই।

আচ্ছা, দাঁড়া। দরকার তো আবিদকে। অর্পিতার সাথে কথা বলে তো লাভ নেই। অর্পিতা বাদ। আবিদের কথা জিজ্ঞেস করবি আছে কিনা।
– আচ্ছা।

লিস্টে থাকা প্রথম নাম্বারে কল করলো রিমন। রিং হচ্ছে। তিনবার রিং হওয়ার পর ওপাশ থেকে একটা মহিলা কলটা রিসিভ করেছে। সাথে সাথেই কৌশিকের দিকে ফোনটা এগিয়ে দিলো রিমন।

– হ্যালো,,,
– জ্বি, আপনি কি আবিদের আম্মু?
– হ্যাঁ। কে?
– আসসালামু আলাইকুম আন্টি।
– ওয়া আলাইকুম আসসালাম।
– আন্টি আমি আবিদের বন্ধু। ওর ফোনের সুইচটা তো অফ৷ খুব জরুরী দরকার ছিলো। একটু ফোনটা ওকে দিবেন প্লিজ?
– ওহ্। আচ্ছা একটু দাঁড়াও। আমি দিচ্ছি।

মায়ের ফোনে বন্ধু কল করেছে শুনে বেশ চমকে গেলো আবিদ। বেশ বিস্মিত ভঙ্গিতে মায়ের হাত থেকে ফোনটা নিলো সে। ছেলের হাতে ফোন দিয়েই রুম থেকে বেরিয়ে এলো লিপি।

– হ্যালো,,,,,,
– ভালো আছো আবিদ?
– হুম ভালো। কে?
– নাম শুনলে ফোনটা কেটে ব্লক করে দিবে না তো?
– সেটা নামের উপর নির্ভর করবে।
– দেয়ার সম্ভাবনাই বেশি। তবুও বলছি। আমি কৌশিক।
– ওহ্। ভালো আছো ভাইয়া?
– এইতো।
– আশফাক ভাইকে নিয়ে কথা বলার জন্য ফোন করেছো তাই না?
– এসব কেনো করছো আবিদ?
– কি করেছি?
– আশফাক অসুস্থ। শুধুমাত্র তোমার বোনের জন্য। গত ছয়দিন ধরে খাওয়া দাওয়া বন্ধ। ব্যবসা বানিজ্য সব বন্ধ। রাতদিন একঘরে বসে কান্নাকাটি চলছেই।
– তো এখানে আমার বোনকে টানছো কেনো?
– ওকে পাচ্ছে না বলেই তো এমন করছে। আজকে কতগুলো দিন পেরিয়ে গেলো অর্পিতার কোনো খোঁজ ও পাচ্ছে না।
– কোনোদিন পাবেও না।
– আবিদ, তোমার বোন আশফাকের প্রেমিকা না৷ ওর ওয়াইফ। চাইলেই তুমি ওদের সেপারেট করতে পারো না।
– কিসের ওয়াইফ শুনি? তোমার বন্ধু যখন আমার বোন ফেলে আরেক মেয়ের সাথে সেক্স করছিলো তখন তুমি কোথায় ছিলে? আমার বোন যে মরতে বসছিলো তখন কোথায় ছিলে?
– তখনও ছিলাম। শুরু থেকে আমি তোমার বোনের সাফাই গেয়ে এসেছি। আমি একবারও বলিনি আশফাক অন্যায় করেনি। জঘন্য কাজ করেছে ও। এটার জন্য ও অনুতপ্ত।
– কুকুরের লেজ কখনো সোজা হয়না৷ আমি আমার বোনকে এভাবে আগুনে যেতে দিবো না৷ উনি খুব জোর আমার বোনকে তিনমাস মাথায় তুলে নাচবে। তারপর আছাড় মেরে মাটিতে ফেলে দিবে৷ তখন আমার বোন কি করবে শুনি? তখন তো ঠিকই ডিভোর্স হবে। আশফাক ভাই খুশিমনে অর্পিতাকে ডিভোর্স দিবে। এরচেয়ে ভালো এত ঘটনা ঘটার আগেই ডিভোর্স হয়ে যাক।
– তোমার কি মনে হচ্ছে না তুমি দুইলাইন বেশি বুঝছো?
– তোমার বোন হলে তুমি কি করতে? জেনেশুনে এমন একটা মানুষের হাতে বোনকে দিতে পারতে?
– তোমার মতো আগে ভাগেই লাফালাফি করতাম না। যাচাই করে সিদ্ধান্ত নিতাম। যদি দেখতাম ছেলে আমার বোনের জন্য বদলে গেছে তাহলে বোনকে এমন ছেলের হাতেই তুলে দিতাম। কেও যদি ভালো হতে চায় তাকে অবশ্যই সুযোগ দেয়া উচিত।
– আমি দিবো না। আমি তোমার মত এত মহৎ না।
– আশফাকের হাল একটাবার নিজ চোখে দেখে যাও। তাহলেই বুঝবে ও কতটা কষ্ট পাচ্ছে। মানুষটা এভাবে আর তিন চারদিন থাকলে মারা যাবে।
– মরলে মরুক। কে মরলো কে বাঁচলো সেগুলো আমার দেখার বিষয় না৷ আমার বোন আমার কাছে আগে, তারপর পুরো দুনিয়ার মানুষ। আমি তো বোনের ভালোটাই দেখবো না কৌশিক ভাই?
– কি ধরনের ভালোর কথা ভাবছো?
– ও আশফাক ভাইয়ের চেয়ে আরও ভালো ছেলে ডিজার্ভ করে। আমার বোনকে আমি আরও ভালো জায়গায় বিয়ে দিবো।
– ঐ ছেলেও যদি ক্যারেক্টারলেস হয়?
– হবে না৷ আমি দেখেশুনে দিবো।
– মানুষের মনের খবর তুমি কি করে জানবে শুনি? কয়টা পুরুষের থলের খবর জানো? ঘরে বউ রেখে দিব্যি পাঁচ ছয়টা প্রেম করে বেড়াচ্ছে অথচ সে কথা কেও জানে না। দুনিয়ার মানুষ তাকে বউ পাগলাই জানে৷ এক কথায় বউয়ের বিশ্বস্ত কুত্তা। এমন পুরুষের অভাব নেই। আর সবচেয়ে বড় কথা, তোমার বোন তোমাদের কাউকে না জানিয়ে প্রেম করেছে। বিয়ে করেছে। তোমার বাসায় ওর বেডরুমে রাতও কাটিয়েছে। অর্পিতার রুমের ঠিক দুটো রুম পরেই তো তোমার মা বাবা থাকে। কই তোমরা কেও তো এসব প্রেম- বিয়ে, আশফাকের তোমার বাসায় রাত কাটানো এসব কিছুই টের পাওনি৷ বিয়ে করে, বাসর-টাসর সব করে ফেলেছে অথচ নিজের বোনের মনের খবরই তো জানতে পারোনি। আর সেই তুমি কিনা বলছো আরেক লোকের মনের খবর বের করে ফেলবে?
– তুমি,,,,,,,
– থামো৷ আমার কথা শেষ হয়নি। তোমার বোন আরো ভালো ছেলে ডিজার্ভ করে তাহলে আমার বন্ধুর কাছে মরতে এসেছিলো কেনো? ও কি অন্ধ? দেখেশুনেই তো আশফাকের জন্য পাগল হয়েছে। ওর কাছে মনে হয়েছে আশফাক ওর যোগ্য এজন্যই আশফাককে বিয়ে করতে দ্বিতীয়বার ভাবেনি৷ বিয়ে করেছে ও, সংসার করবে ও। আশফাক যোগ্য কি যোগ্য না সেসব তুমি বলার কে ভাই?
– আমি ওর বড় ভাই। ওর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার আমার আছে।
– হ্যাঁ তুমি ওর ভাই। বড় ভাই, বড় ভাইয়ের মতো থাকো। সতীন হওয়ার চেষ্টা করো না। আশফাক অন্যায় করেছে৷ সেটা নিয়ে অর্পিতাকে ঘাটাঘাটি করতে দাও। তুমি মাঝখানে কেনো আসছো। ডিভোর্স হবে কি হবে না এটা ওদের একান্ত ব্যাক্তিগত ব্যাপার। ওদের সিদ্ধান্ত ওদেরকে নিতে দাও। সতীনের মত জোর জবরদস্তি অর্পিতাকে ওর লাইফ থেকে সরাতে চাচ্ছো কেনো? তোমার উচিত ছিলো এই মুহূর্তে অর্পিতা আর আশফাকের ব্যাপারটা কিভাবে সলভ করা যায় সেটা ভাবা। বিয়ে মানে বুঝো তুমি? হ্যাঁ? যখন খুশি বিয়ে করলাম যখন খুশি ডিভোর্স নিলাম তাই না? খেলা পেয়েছো?
– আশফাক ভাই কি বিয়ের মানে বুঝে?
– আশফাকও বুঝে না, তুমিও বুঝো না৷ ও যদি বিয়ে মানে বুঝতো তাহলে এতবড় অন্যায়টা করতো না, আর তুমি যদি বুঝতে তাহলে ও নিজের অন্যায় স্বীকার করে অনুতপ্ত হওয়া সত্ত্বেও বিয়ে ভাঙার জন্য উঠে পড়ে লাগতো না৷ দেখো ভাই, দু’পক্ষই বহু ফাইজলামি করেছো। এবার একটা সমাধানে আসো। যেখানেই আছো কাল সকাল নাগাদ রওয়ানা দাও। ওরা দুজন আলাদা কথা বলে একটা সমাধান করুক। এরপর আমি আমার বাবা, বড় ভাই আর আশফাককে নিয়ে তোমার বাসায় আসবো বিয়ের ব্যাপারে তোমার বাবা মায়ের সাথে কথা বলতে।
– আমি আমার বোনকে নিয়ে ঢাকা আসবোও না, আশফাক ভাইয়ের কাছে বোনকে দিবোও না।
-আমি কতবড় হারামী স্বভাবের লোক তা কিন্তু তুমি জানো। যদি আপোষে কাল চলে আসো তো ভালো। না আসলে তোমার বোনের সম্মানের কথা আমি ভাববো না। তোমার ফ্যামিলি সোসাইটিতে মুখ দেখাতে পারবে না। তোমার বাবা ইসলামপুরে সসম্মানে দোকান নিয়ে ব্যবসাও করতে পারবে না৷ সম্মান গেলে যাক। আমার বন্ধু আমার কাছে আগে তারপর পুরো দুনিয়ার মানুষ। আমি তো আমার বন্ধুর ভালোটাই দেখবো তাই না আবিদ? তাছাড়া এখনো বাংলাদেশের মাটিতেই আছো। যে চিপাতেই থাকো না কেনো তোমাকে আজকে রাতের মধ্যে খুঁজে বের করে টেনে হিঁচড়ে স্বপরিবারে সেখান থেকে ঢাকায় আমার ক্ষমতাটুকু আমার আছে। টেনেহিঁচড়ে আনতে আমারও ভালো লাগবে না, তোমারও পছন্দ হবে না। এরচেয়ে ভালো হবে কাল নাগাদ আমার বন্ধুর বউকে তুমি নিজে বন্ধুর বাসায় বন্ধুর চোখের সামনে এনে হাজির করবে। তার হাতে আমার বন্ধু খাবার খাবে৷ আশফাকের কিছু হলে তোমার বোনও শান্তি পাবে না এতটুকু জেনে রেখো।

কলটা কেটে দিলো কৌশিক৷ নিজেকে এই মুহূর্তে দিশেহারা মনে হচ্ছে আবিদের৷ কৌশিক সম্পর্কে সে ভালোই অবগত। মানুষটা বেশ বেপরোয়া স্বভাবের। কোনো অঘটন ঘটানোর আগে দ্বিতীয়বার ভাবে না। তাছাড়া বিয়ের কথাটা অর্পিতার কাছে চেপে যাওয়াটাও তার কাছে অন্যায় মনে হচ্ছে৷ শত হোক বিয়ে তো হয়েছে৷ এটা তো অস্বীকার করা যাবে না৷ কাল নাগাদ বাসায় না ফিরলে কৌশিক যে বাজে রকমের ঝামেলা বাঁধাবে সে ব্যাপারে নিশ্চিত আবিদ। এভাবে অর্পিতাকে আড়াল রেখে কতদিন? এরচেয়ে ভালো ওরা দুজন মুখোমুখি বসে কথা বলুক। আশফাককে সরাসরি অর্পিতা ডিভোর্সের কথা জানাক। জোর করে তো আর অর্পিতাকে আশফাক আটকে রাখতে পারবে না। অর্পিতাকে যত আড়াল করার চেষ্টা করবে ততই পরিস্থিতি ঘোলাটে হবে। সমস্ত কথা মুখোমুখি হয়ে গেলেই ভালো৷ মায়ের রুমের দিকে যাচ্ছে আবিদ। আজ রাতেই সব প্যাক করে কাল সকালে ফিরে যাওয়ার কথা বলতে হবে।

– তোর বউ কালকে আসছে। এখন তো একটু খাবার মুখে নে।
– যদি না আসে?
– আবিদ আমাকে হাড়ে মাংসে চিনে৷ না আসার দুঃসাহস ও দেখাবে না। আর যদি না আসে তাহলে আর কি? বললামই তো টেনে হিঁচড়ে আনবো।
– অর্পিতা আসলেই খাবো।
– শোন, ও তো তোর কথা শুনতে চাইবে না। ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে সব কথা শোনাতে হবে। ও নিজেকে ছাড়াতে চাইবে৷ তোকে আরও শক্ত করে ওকে আঁকড়ে ধরতে হবে যাতে নড়তে চড়তে না পারে। তুই তো একেবারে দুর্বল হয়ে গিয়েছিস৷ ওর সাথে ধস্তাধস্তি করে পারবি? পারবি না তো৷ শরীরে শক্তি করতে হবে না? না খেলে শক্তি হবে? আজকে সারারাত খাবি৷ কালকে সারাদিন খাবি। খেয়ে শক্তি সঞ্চয় করবি৷ এরপর সন্ধ্যায় দরজা আটকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে মনের সব কথা বলবি৷ ও মানার আগ পর্যন্ত ওকে ছাড়বি না। ঠিকাছে?

আশফাক মুচকি হেসে বললো,

– আমি ডিম দিয়ে ভাত খাবো।
– রিমন, যা তো হুমায়ুন ভাইকে বল জলদি ডিম ভেজে দিতে।

অবশেষে রিমনের মনে হচ্ছে মাথা থেকে চিন্তার পাহাড় নেমেছে। আগামীকাল শুধু অর্পিতা চলে আসলেই হয়।
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here