ভোরের_আলো পর্ব-৪২

0
1032

#ভোরের_আলো
৪২.

দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে এসেছে। কবির সাহেব চলে যাওয়ার পর থেকে দরজা আটকে ঘরে বসে আছেন আমজাদ সাহেব। অর্পিতার মা আর চাচী বিমর্ষ হয়ে বসে আছেন আবিদের ঘরে। আবিদের মুখে আশফাক সম্পর্কে জানার পর থেকে কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছেন দুজন। দুপুরের দিকে মুক্তা দরজা খুলে বেরিয়ে এলেও অর্পিতা এখনও বের হয়নি৷ কয়েকদফা আবিদের ডাকাডাকি শুনেও বেরিয়ে আসেনি। বাবাকে ডেকেও কোনো লাভ হয়নি। বাপ বেটি দুজন দুইরুমে খিল দিয়ে বসে আছে।

সারাদিন ধরে বহু হিসেব কষেছেন আমজাদ সাহেব। একবার হিসেব মিলছে তো আরেকবার মিলছে না। আশফাক এবং মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে চুলচেড়া গবেষনার পর একটা সিদ্ধান্তে এসে পৌঁছেছেন তিনি। হাত বাড়িয়ে বেডসাইড টেবিলের উপর থেকে মোবাইলটা হাতে নিয়ে কবির সাহেবকে ফোন করলেন৷ রিং হওয়ার সাথে সাথেই কল রিসিভ করলেন তিনি। মনে হচ্ছে যেনো এই কলটার অপেক্ষায়ই তিনি ফোন হাতে বসেছিলেন।

– জ্বি ভাই।
– আমি আমার মেয়েকে আনুষ্ঠানিকভাবে তুলে দিতে চাই। ওরা নিজেরা বিয়ে করে ফেলেছে এই কথা আমি চাইনা দুই পরিবারের বাহিরে যাক। সবার নজরে এটা দুই পরিবারের সম্মতির বিয়ে দেখাতে চাই।
– আলহামদুলিল্লাহ।
-এই শুক্রবারের পরের শুক্রবার বিয়ের তারিখ ঠিক করতে চাচ্ছি। কোনো আপত্তি নেই তো?
– কোনো আপত্তি নেই৷ আপনি যদি বলেন কালকে বিয়ে তো কালকেই হবে।
– সন্ধ্যার পর আপনারা বাসায় এসে আনুষ্ঠানিকভাবে কথাবার্তা সেড়ে যাবেন। অর্পিতার মামাদের আসতে বলবো৷ তাদেরকে শোনানো হবে ছেলেমেয়ে দুজন দুজনকে পছন্দ করে৷ আমরা দুই পরিবার খোঁজ নিয়েছি৷ আমাদের পছন্দ হয়েছে। তাই বিয়ের কাজটা সেড়ে ফেলছি।
– জ্বি। আমরা সন্ধ্যার পর আসবো। বলছিলাম, আজ কি আংটি পড়িয়ে যাবো?
– আংটি পড়াবেন নাকি পড়াবেন না সেটা আপনাদের ব্যাপার।
– জ্বি তাহলে আমরা সময়মতো চলে আসবো।

দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন আমজাদ সাহেব। দরজা খোলার আওয়াজ পেয়ে সবাই ছুটে এলো দরজার কাছে৷ উৎসুক নজরে তাকিয়ে আছে সবাই তার দিকে৷ সেদিকে খেয়াল নেই আমজাদ সাহেবের। তিনি নিজের মত এগিয়ে গেলেন মেয়ের রুমের দিকে। বাহির থেকে অর্পিতাকে দুই তিনবার ডাক দিতেই দরজা খুলে দিলো অর্পিতা৷ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে বাবার মুখোমুখি। কান্নাকাটি করে চোখ-মুখ ফুলিয়ে ফেলেছে৷ বেশ অসুস্থ দেখাচ্ছে ওকে৷ মেয়ের হাত ধরে বিছানায় নিয়ে বসালেন আমজাদ সাহেব। ঘরের দরজা আটকে দৃঢ় কন্ঠে মেয়েকে জিজ্ঞেস করলেন,

– তুই কেনো এই কাজ করেছিস তোকে সেসব জিজ্ঞেস করবো না৷ যা ঘটিয়েছিস সেটা কতটা খারাপ সিদ্ধান্ত ছিলো তা তুই নিজেই টের পাচ্ছিস। অতএব তোকে সেসব জিজ্ঞেস করে কোনো লাভও নেই। একটা কথা জিজ্ঞেস করি। বাবাকে বিশ্বাস করিস তো?
– হুম।
– তোর কি এতটুকু বিশ্বাস আছে বাবা যা করবে তোর ভালো চিন্তা করেই করবে?
– হুম।
– ধরে নে তোকে আমি মাঝসমুদ্রে ভাসিয়ে দিলাম, তখন কি বাবার প্রতি অবিশ্বাস জাগবে?
– উহুম।
– আশফাকের সাথে এই শুক্রবারের পরের শুক্রবার তোর বিয়ে ঠিক করেছি৷ সবাইকে সামনে রেখে ওর হাতে তোকে তুলে দিবো।

বাবার দিকে মুখ তুলে তাকালো অর্পিতা৷ বিস্ময়ের চূড়ান্ত সীমামায় পৌঁছে গেছে সে৷ কিভাবে সম্ভব? সব জেনেশুনেও? কেনো?

– অবাক হচ্ছিস? কি ভাবছিস সমাজের কথা ভেবে তোকে আমি ওর হাতে তুলে দিচ্ছি?
-……………
– হ্যাঁ, সমাজের কথা ভাবছি। যেহেতু সমাজে থাকি, সমাজের লোক নিয়ে তো ভাবতেই হয় তাই না? তবে সমাজের জন্য যতটা না চিন্তা করেছি তারচেয়ে বেশি চিন্তা করছি তোর জন্য। তোকে আপাতত সেসব বুঝালেও বুঝবি না৷ সময় হোক, বাবা কেনো এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি বুঝে যাবি। মানসিকভাবে প্রস্তুত হ। যাকে ঘৃনা করিস তার সাথে একছাদের নিচে বাস করা খুবই পীড়াদায়ক। তবে অসম্ভব না।
-……………
– সন্ধ্যার পর উনারা আসবে। মুখোমুখি বসে আলাপ সাড়বো। তোর মামারাও আসবে। আমি চাই তুই স্বাভাবিক থাক। আশফাকের সাথে বর্তমানে তোর কি চলছে সেসব আমি চাই না কারো কানে যাক। সারাদিন কিছু খাসনি। ভাত খাবি চল।

অর্পিতার রুম থেকে বেরিয়ে এলেন
আমজাদ সাহেব। পাখিকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

– ভাত খাবো। প্লেটে খাবার দে।

লিপি, মিনু আমার সাথে এসো। কথা আছে।

খাবার টেবিলে বসে ভাত খাচ্ছেন আমজাদ সাহেব। মুখোমুখি চেয়ার দুটোতে বসে আছেন লিপি এবং মিনু। মায়ের পিছনে দাঁড়িয়ে আছে আবিদ।

– সন্ধ্যার পর কবির ভাই আসবে ফ্যামিলি নিয়ে। এই শুক্রবারের পরের শুক্রবার অনুষ্ঠান।
– কিসের অনুষ্ঠান?
– আশফাক আর অর্পিতার বিয়ে। আমি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে মেয়ে তুলে দিবো।

আমজাদ সাহেবের কথা শুনো উপস্থিত সবার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার উপক্রম। ড্রইংরুমে বসে আমজাদ সাহেবের কথা শুনছিলো মুক্তা আর সায়েম। সেখান থেকে তারা উঠে চলে এলো ডাইনিংরুমে। আবিদের মেজাজ সপ্তম আসমানে উঠে যাচ্ছে।
– কিহ্! এটা কি বললে আব্বু? তুলে দিবে মানে?
– তুলে দিবো মানে তুলে দিবো।
– কেনো? তুমি ওর হাতে কিভাবে অর্পিকে তুলে দিতে পারো? আমি দিবো না ওর হাতে বোনকে। ডিভোর্স করাবোই।
– সেটা বুঝার মত জ্ঞান তোমার থাকলে তুমি প্রথম যেদিন শুনেছিলে তোমার বোন বিয়ে করেছে সেদিনই তুমি আমার কাছে এসে কথাগুলো বলতে। সমাধানের একটা চেষ্টা করতে৷
– কিসের সমাধানের কথা বলছো? হ্যাঁ?আবিদ তো ঠিকই বলছে। ঐ ছেলের হাতে তুমি আমার মেয়েকে তুলে দিতে পারো কিভাবে?
– ভাই, এটা ঠিক না। ও ছোট মানুষ। ও ভুল করে ফেলেছে। আমরা তো বড় হয়ে এমন ভুল করতে পারি না।
– হ্যাঁ, আমি তো শখের বশে মেয়েকে ওর হাতে তুলে দিচ্ছি তাই না? কি মনে হয় তোমাদের? কলিজা ছিঁড়ে যাচ্ছে আমার। তবু দিচ্ছি। এছাড়া আর কি করার আছে? তোমার বোন কোনো রাস্তা খোলা রেখেছে আমার জন্য? ওদের ঘটনা প্রেম পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকতো একটা কথা ছিলো। ঐ ছেলে কিচ্ছু করতে পারতো না। তোমার বোন ঐ ছেলের ওয়াইফ। প্রেমিকা না। বিয়েটা চেপে রাখার কোনো বিষয় না। তোমার বোনের উপর আমার চেয়ে বেশি অধিকার বর্তমানে ঐ ছেলের। বয়স ৩০ এর কোঠায় ঠেকেছে তোমার। মেপে-ঝেপে কাজ করতে শিখো। লাফ দিয়ে বলে ফেললে ডিভোর্স করাবোই। করাবে কিভাবে শুনি? ডিভোর্স বিয়ের মত এত্ত সহজ না। এই ছেলে তোমার বোনকে এত সহজে ডিভোর্স দিচ্ছে না৷ দুনিয়া উল্টে পাল্টে ফেলবে।
– তো? উল্টে ফেললে উল্টাক। আমরা কি হাতে হাত রেখে বসে থাকবো নাকি?
– হাতে পায়েই যা লম্বা হয়েছো। মাথায় তো কিচ্ছু নেই। তোমরা চিন্তা করো আজকের কথা৷ আর আমি চিন্তা করি দশবছর পর কি হবে সেসব নিয়ে। ডিভোর্সের কারন কি দেখানো হবে? ছেলে চরিত্রহীন। এখন যদি ছেলে নিজেকে শুধরে নিয়েছে দাবি করে আর সেটা যদি প্রমান হয় তোমার বোন ওকে কোনোভাবেই তালাক্ব দিতে পারবে না। তাছাড়া কোর্ট থেকে নিম্নে একমাস একসাথে থাকার নির্দেশ দিবে৷ সেটা আমাদের মানতেও হবে। এই মুহুর্তে ডিভোর্সের ঝামেলায় যাওয়া মানে পুরো এলাকা জানাজানি হবে ওরা নিজেরা বিয়ে করেছে এখন আবার একমাস যেতে না যেতেই তালাক্বও হচ্ছে৷ কি একটা বিশ্রি পরিস্থিতি তৈরী হবে ভেবে দেখো। ওকে যখন অন্য কোথাও বিয়ে দিতে যাবো তখন তো ডিভোর্সি ছেলের কাছেই দিতে হবে। সেই ছেলে যে খারাপ হবে না তার কি কোনো নিশ্চয়তা আছে? নিশ্চয়ই নেই। ঐটাও যদি খারাপ হয় তখন কি করবো? কোর্ট থেকে যেহেতু বলবেই একসাথে কিছুদিন থাকার কথা এরচেয়ে ভালো আমরাই মেয়ে তুলে দিই। ছেলে যেহেতু জানপ্রান দিয়ে দিচ্ছে অর্পিতাকে পাওয়ার জন্য তাহলে সেটা আমরাই যাচাই করে দেখি ও কতটা শুধরিয়েছে। শুধুশুধু আপাতত ডিভোর্স অব্দি যাওয়ার দরকার নেই। ছেলে যদি শুধরে থেকে থাকে তাহলে তো ডিভোর্সের কোনো প্রয়োজন নেই। সংসার করবে ছেলের সাথে। খোঁজ নিয়েছি আমি। ছেলে এমনিতে খারাপ না৷ সব দিক দিয়েই ঠিকঠাক শুধু এই দিকটা ছাড়া। আর এটাও ঠিক বেছে বেছে ও ওর স্বভাবের মেয়েদের সাথেই প্রেম করে। ভুলে তোমার বোনের পাল্লায় এসে পড়েছে। এখন আর তোমার বোনের পিছু ছাড়তে চাচ্ছে না।
– এটা কেমন সিদ্ধান্ত নিলে আব্বু? শুধরে গেলে সংসার করবে মানে কি? সে শুধরে গিয়ে থাকলেও তো অর্পিতা ওর সাথে সংসার করতে পারবে না। বারবার ওর ধোঁকা নজরে ভাসবে। যে ধোঁকা দিয়েছে তাকে আপন করে নেয়া কিভাবে সম্ভব?
– কতবড় ধোঁকা দিয়েছে আশফাক? তোমার বোনের চেয়ে বড়? তোমার বোন আমাদের ধোঁকা দেয়নি? বিশটা বছর বুকে আগলে ওকে বড় করেছি। ভালোবাসায় তিল পরিমাণ ঘাটতি কি কখনো রেখেছি? কি মূল্য দিলো তোমার বোন? চারমাসের পরিচয়ের একটা ছেলেকে তার বাবা মায়ের চেয়ে বেশি আপন মনে হলো। বাবা মা কষ্ট পাবে কি না একবারও তো ভাবলো না। নিজের সুখটাকেই বড় ভাবলো। তোমার বোন যদি ২০ বছরের ভালোবাসাকে ধোঁকা দিতে পারে সেখানে আশফাকের সাথে পরিচয় তো মাত্র চার পাঁচ মাসের। তোমার বোন ধোঁকা দেয়া সত্ত্বেও ওকে আমরা দূরে ঠেলে দেইনি। এখন অব্দি আমরা ওর ভালোর কথাই ভাবছি৷ কারন আমরা ওকে ভালোবাসি৷ অর্পিতাও তো আশফাককে ভালোবাসে। তাহলে অর্পিতা কেনো আশফাককে সুযোগ দিবে না? ওকে কেনো সুযোগ না দিয়েই দূরে ঠেলে দিচ্ছে? প্রতিটা মানুষ একটা সুযোগ ডিজার্ভ করে। তাছাড়া ছেলের মাঝে আমি আরও একটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছি যেটার উপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত নিয়েছি ওর হাতে মেয়ে তুলে দিবো।
– কি দেখেছো?
– সেটা এখন বলবো না। আমার ধারনা সত্যি হবে কিনা জানি না৷ তবে আশা করছি আমার ধারনা ঠিক হবে৷ যাক না কিছুদিন৷ এরপর বলবো৷ তাছাড়া আমি তো আছিই। সুযোগ পাওয়ার পরও যদি ও না শুধরায় তাহলে তো ওকে আমি ছাড়ছি না৷ প্রয়োজনে আমি কতটা খারাপ হতে পারি সেটাও ওকে দেখাবো।
-…………….
– ব্যাপারটা সহজভাবে নিতে চেষ্টা করো৷ সে এখন এই বাড়ির জামাই। এই বাড়ির ছেলেও। আমার মেয়ে যেমন অন্যায় করেছে, ছেলেও অন্যায় করেছে৷ মেয়েকে যদি আমি মাফ করতে পারি তো ছেলেকেও করতে পারবো। ওদের দুজনের ব্যাপারটা ওরাই সামাল দিক৷ আমরা এর মধ্যে যাবো না। অর্পিতা ওর সাথে কেমন ব্যবহার করবে সেটা ওর ব্যাপার। তবে তোমাদেরকে বলবো ওর সাথে কেও কোনো খারাপ ব্যবহার করো না। অর্পিতাকে আমরা বিয়ে দিলে যেমন খাতিরদারী হতো তেমনি ওকেও সেই খাতিরদারী করা হবে। সুযোগ যেহেতু দিচ্ছি সেখানে আমি চাইনা কোনো কমতি থাকুক। বিয়ে চাইলে ১০ টা করা যায়। কিন্তু সেটা কোনো সমাধান না৷ যাকে বিয়ে করেছো তারমাঝে ঘাটতি থাকলে সেটাকে ঘষেমেজে ঠিক করে নিয়ে সংসার করাটাই বেস্ট।

বাবার কথায় রাগ খানিকটা নিস্তেজ হয়ে এসেছে আবিদের। তবে মেনে নিতেও কষ্ট হচ্ছে। বাবার কথায় যুক্তি ছিলো। তবু কোথাও একটা ভয় লেগে আছে। যদি সে না শুধরে থাকে তখন?
ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে আমজাদ সাহেব বললেন,

– দ্বিধা বাদ দাও। বোনের জন্য দোয়া করো যেনো সব ঠিকঠাক হয়।

লিপি তোমার ভাইদের আসতে বলবো। ভালোমত রান্নার আয়োজন করো। আর অর্পিতা আগে বিয়ে করে ফেলেছে সেটা যেনো আমরা এই কয়জন বাদে কেও না জানে। কেও না মানে কেও না। সবাইকে জানানো হবে ছেলে মেয়ে দুজন দুজনকে পছন্দ করে৷ এখন আমরা ওদের বিয়ে দিচ্ছি।
– ঠিকাছে।
– খেয়েছো কিছু?
– না।
– কেউই খাওনি?
– না।
– জলদি খেতে বসো। খাওয়া দাওয়া করে কাজে লেগে পড়ো। আর মুক্তা, যা অর্পিতাকে ডেকে আন। খেয়ে দেয়ে রেডি হোক৷

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here