ভোরের_আলো পর্ব-৪৩

0
890

#ভোরের_আলো
৪৩.

ছাদে বসে আঙুলের আংটিটা নাড়াচাড়া করছে অর্পিতা৷ আজরাতেই আংটিটা আশফাক ওর আঙুলে পড়িয়ে দিয়ে গেছে। দমটা বন্ধ বন্ধ লাগছে৷ মনে হচ্ছে যেনো জীবনটা একটা নর্দমায় থমকে দাঁড়াচ্ছে। আশফাকের হাতের স্পর্শ ফের ওর গায়ে লাগবে মনে হতেই গা গুলিয়ে উঠছে৷ কিভাবে এই মানুষটার সাথে বাকি জীবনটা কাটানো সম্ভব?

– শোন, তোর উনার সাথে সংসার করতে হবে না। ব্যাগ গুছা। আজরাতেই তোকে নিয়ে অন্য কোথাও চলে যাবো। পাসপোর্ট তো তোর আছেই। শুধু ভিসার জন্য এপ্লিকেশন করতে হবে। ভিসাটা হয়ে গেলে লন্ডন চলে যাবো তোকে নিয়ে।

আবিদের কথায় ঘোর কাটলো অর্পিতার। মুখটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে বললো,

– নাহ্। আর না৷ বাবা খুব কষ্ট পেয়েছে আমি জানি। এসব করে আর কষ্ট দিতে চাই না। বাবা যা বলবে এখন তাই হবে।
– এটা হয়না অর্পিতা।
– এর জন্য তো আমিই দায়ী তাই না?
– একটা ভুলের জন্য তো তোকে সারাজীবন সাফার করতে দিতে পারিনা।
– বাবা কি বলেছে শুনিসনি? আশফাককে হাসিমুখে মেনে নিতে। হাসিমুখে মেনে নে ভাইয়া৷ আর নয়তো লোকে সন্দেহ করবে।
– করলে করুক। বিয়েটাই ভেঙে যাক। উনার পাশে তোকে কল্পনা করলেই মাথাটা ঘুরে যায় আমার৷
– আমি এসব আর শুনতে চাচ্ছি না৷ ভালো লাগছে না। চুপ কর।

অর্পিতাকে এমন নির্বিকার দেখে বেশ বিরক্ত আবিদ। বাবা বললেই মানতে হবে? এটা হয়না৷ কোনোদিক দিয়েই হয়না৷
– আচ্ছা আমাকে একটা কথা বলতো? তোর চেয়ে বয়সে এত বড় একটা মানুষের প্রেমে পড়লি কোন রুচিতে? এত ডিফারেন্সে কেও কারো প্রেমে পড়ে?
– চোখে ছানি পড়েছিলো। তাই বয়স মাপতে পারিনি৷ এখন যা এখান থেকে৷

অর্পিতার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে আবিদ। শীতল ক্রোধ ভেসে উঠছে ওর চোখে মুখে। মনে মনে নিজের সাথে বোঝাপড়াটা চলছে তোড়জোড় হয়ে৷ করুক বোঝাপড়া। এমন গুরুত্বপূর্ণ মুহুর্তে বিরক্ত না করাটাই শ্রেয়। সেখান থেকে বেরিয়ে এলো আবিদ। সিঁড়ির গোঁড়াতেই দাঁড়িয়ে আছেন আমজাদ সাহেব। আবিদ নিচে নামা মাত্রই ছেলের কাঁধটা জড়িয়ে ধরলেন তিনি।

– চল আমার সাথে যাবি।
– কোথায়?
– যাই একটু চা-সিগারেট খেয়ে আসি বাপ ব্যাটা মিলে।
– এতরাতে?
– টং দোকান খোলা থাকে একটা-দেড়টা পর্যন্ত। কতদিন হয় তোর সাথে আলাদা বসে একটু গল্প করা হয়ে উঠেনি। আজকে জমিয়ে গল্প করবো।

বাবা-ছেলে মিলে রাস্তার মাথার দিকটাতে থাকা টং দোকানে বসে আছে। দু একটা রিকশা যাচ্ছে রাস্তা ধরে। বেশিরভাগ বাসারই লাইট বন্ধ। কেও ঘুমিয়ে গেছে আবার কেওবা ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। চায়ে চুমুক দিয়ে ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন,

– রাগ করেছিস আমার উপর তাই না?
– ঠিক রাগ না৷ আমি তোমার সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারছি না। সোসাইটির কথা ভেবে এমন বাজে একটা ডিসিশন তুমি নিতে পারো না।
– সোসাইটির কথা ভেবে ডিসিশন নিয়েছি তোকে কে বললো?
– আর নয়তো কি। তুমি বারবার এক কথা বলছো লোকে অর্পিতার বিয়ের কথা জানলে ঝামেলা হবে৷ তাই তুমি নিজেই এখন অর্পিতাকে আশফাক ভাইয়ের হাতে তুলে দিচ্ছো।
– আয়, তোকে একটা গল্প শোনাই। মোমিনকে তো চিনিস?
– হ্যাঁ, চিনবো না কেনো?
– ওর বড় মেয়েটা নিজে পালিয়ে বিয়ে করেছিলো৷ ওর গল্পটা অর্পিতার মতো না। একটু ভিন্ন। ও আগে মোমিনকে বলেছিলো ছেলের কথা। ও রাজি হয়নি৷ অন্য জায়গায় বিয়ে ঠিক করেছে। বিয়ের আগের রাতে মেয়ে পালিয়ে গিয়েছিলো। মাসখানেক পর অবশ্য মোমিন মেনেও নিয়েছিলো। বিয়ের তিনমাস পর জানা গেলো ছেলে আরো মেয়েদের সাথে মেলামেশা করে৷ এরপর মেয়েকে ওখান থেকে ডিভোর্স দিয়ে এনে অন্য জায়গায় বিয়ে দিলো। এখন যার সাথে বিয়ে হয়েছে সে বলতে পারিস মানসিক রোগী৷ প্রচুর সন্দেহপ্রবন। মা বাবার বাসায় এসেও মেয়েকে থাকতে দেয়না৷ প্রতিসপ্তাহে নিয়ম করে পেটায়৷ তাও যেনো-তেনো মার না৷ একদম মেরে যা তা অবস্থা করে ফেলে মেয়েটার। আর আগের হাজবেন্ডটা আবার বিয়ে করেছে। সুন্দর সংসার করছে। বাজে অভ্যাস আর নেই। ছেলেটা ডিভোর্সের সময় মোমিনকে বহুবার রিকুয়েস্ট করেছিলো তাকে যেনো একটা সুযোগ দেয়া হয়। মোমিন দেয়নি৷
– তাই এখন কি তুমি সেই সুযোগটা আশফাক ভাইকে দিতে চাচ্ছো?
– আমার কি দেয়া উচিত না?
-…………………
– শোন আবিদ, তুই যে ধারনা করছিস সোসাইটির কথা ভেবে অর্পিতাকে আশফাকের হাতে তুলে দিচ্ছি এটা তোর পুরোপুরি ভুল ধারনা৷ সোসাইটির কথা যে ভাবছিনা ঠিক তাও না৷ ভাবছি। আমি তো আর জঙ্গলে থাকিনা। যেহেতু সমাজে থাকি সমাজের পাঁচটা লোকের কথা ভেবে কাজ করতে হবে এটাই স্বাভাবিক। তবে সমাজের লোকের চেয়ে বেশি প্রায়োরিটি দিচ্ছি অর্পিতাকে। বোনকে তুই অন্য জায়গায় বিয়ে দিবি কথাটা যত সহজ আসলে ততটাও সহজ না৷ পরের জামাইটাও যদি খারাপ হয় তখন কি করবো? ওর কাছ থেকে আবার ছাড়িয়ে আনবো? দুধে ধোঁয়া তুলসি পাতা কেও নারে আবিদ। অধিকাংশ পুরুষই খারাপ। কারো কুকর্ম চোখে পড়ে কারোটা পড়ে না৷ আশফাকেরটা চোখে পড়েছে বলে উতলা হয়েছিস বোনের সাথে ডিভোর্স করানোর জন্য। পরেরটা যদি এমন হয় তখন? এরচেয়ে ভালো না যেটা বর্তমানে আছে তাকে শুধরে নেই? তাছাড়া ও শুধরাতে চাচ্ছে নিজেকে৷ আমাদের কি উচিত না ওকে একটা সুযোগ দেয়া? আমি যতদূর জানি ও জীবনে অনেক সাফার করেছে, সেই মানুষটা যদি আমার মেয়ের মাঝে সুখ খুঁজে পায় তো ওর কাছে নিয়ে যাক না৷ সমস্যা কোথায়?
– সমস্যা তো এটা না। সমস্যা হচ্ছে উনি যদি ঠিক না হয়?
– হবে।
– এতোটা সিওর কিভাবে হচ্ছো?
– মানুষ দেখলে চিনিরে আবিদ। হাজার হাজার মানুষের সাথে কথা বলেছি এই জীবনে৷ প্রতিদিন কত জাতের মানুষ আসে আমার কাছে৷ তাদের কথা শুনি, বলি,,মিশি, বুঝি। মানুষ চেনার ক্ষমতা কিছু হলেও আছে।
– তাহলে ঐ কাজটা করলো কেনো?
– অর্পিতাকে বোধহয় তখনও অনুভব করতে পারেনি। দূরে গিয়ে অনুভূতিটা টের পেয়েছে৷ তবে ও যে অর্পিতাকে ভালোবাসে সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই। ভালোবাসে বলেই মেয়েকে ওর হাতে দিচ্ছি। আর নয়তো কখনো দিতাম না।
– ভালোবাসে তার কি গ্যারান্টি?
– ভালো না বাসলে কখনো অর্পিতাকে পাওয়ার জন্য এমন পাগল হয়ে যেতো না। ছেলের যেই খারাপ দিকটার কথা তোরা বলছিস সে হিসেবে ও যা চাচ্ছিলো তা ও পেয়ে গেছে৷ অর্পিতাকে আর কোনো দরকার নেই। তবু ও পাগলের মত পেছন পেছন ঘুরছে। কেনো? দরকারটা কি ওর ঘোরার? ওর কি দরকার ছিলো আমার পা ধরে বসে থাকার?
– জানি না আব্বু। মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে সব৷ উনি আসলে কতটা শুধরেছে বুঝে উঠতে পারছি না৷ কিন্তু অর্পিতার পাশে উনাকে চিন্তা করলে মাথা খারাপ হয়ে যায়।
– একতরফা অর্পিতার ভাই হিসেবে বিবেচনা করলে মেজাজ খারাপ হবেই৷ ওদের দুজনের দিক থেকেই ভেবে দেখ। ব্যালেন্স করতে পারবি।
– তুমি কিভাবে এই ব্যাপারটা হজম করছো বুঝতে পারছি না।
– আমি বাবা। আমাকে ঠান্ডা মাথায়ই সিদ্ধান্ত নিতে হয়। তোমাদের মত গরম মাথায় সিদ্ধান্ত নিলে জীবনে এতকিছু করতে পারতাম না৷ আমার একটা উল্টা পাল্টা সিদ্ধান্ত আমার মেয়ের জীবনটাকে শেষ করে দিবে৷ বহু চিন্তা-হিসেব করে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আর এখানে আমি আমার মেয়ের লাভ লোকসানের কথাই বেশি ভেবেছি। আর যদি আশফাক ঠিক নাহয় তো সমস্যা নেই৷ মেয়েকে ফেরত আনবো৷ বাবা মা বিয়ে দেয়ার পর ডিভোর্স হয়েছে শুনলে এতটাও লোকমুখে চর্চা হবে না।
– আমরা নাহয় সবদিক বিবেচনা করে মেনে নিলাম৷ কিন্তু অর্পি? নিজ চোখে দেখেছে ও। ঐ মানুষটার সাথে কিভাবে বাস করবে আব্বু? চাইলেও ও কখনো আশফাক ভাইকে সেকেন্ড চান্স দিতে পারবে না৷ এটা কেউই দিবে না।
– কে বললো কেও দেয়না? কয়টা ঘরের খবর জানিস তুই?
– হ্যাঁ, দেয়৷ কিন্তু আজীবন মনে একটা ক্ষত আর ঘৃনা নিয়ে সংসার করে। ওটাকে আসলে সংসার করা বলে না৷ নিজেকে তিল তিল করে শেষ করে দেয়া বলে।
– অর্পিতার এমন কিছু হবে না। আশফাক ঠিকই মানিয়ে নিবে।
– আমি বুঝে পাচ্ছি না তুমি উনাকে এত সাপোর্ট কেনো করছো?
– যেদিন আমার কথাগুলো সত্যি হবে সেদিন বুঝবি।
– কি জানি আব্বু! তোমার কথা সত্যি হলেই ভালো। অর্পিতা ভালো থাকলে আমরাও ভালো থাকবো।

-অর্পি, আশফাক ভাই কল করেছে। নে ধর।
– কেনো?
– আমি কি জানি?
– ভালো লাগছে না৷ পরে কথা বলবো।

কথাটা বলেই মুক্তার হাত থেকে ফোনটা নিয়ে কলটা কেটে দিলো অর্পিতা৷ দিশেহারা লাগছে নিজেকে। মানুষের মন বড় অদ্ভুত। অনুভূতি জাগতেও দেরী নেই৷ মরতেও দেরী নেই৷ হুট করে একদেখাতেই লোকটাকে ভালো লেগে গেলো। প্রেমে পড়ে গেলো। প্রথম প্রথম কন্ঠস্বরটা শুনলে মনে হতো এই বুঝি হার্টবিট মিস হবে। ইচ্ছে হতো আশফাককে সারাদিন সামনে বসিয়ে রেখে ওর কথা শুনতে ওর হাসিটা দেখতে৷ আর এখন সেই কন্ঠস্বরটা শুনলে অসহ্য যন্ত্রণা হয়। মানুষটার ছায়া দেখলেও গা গুলিয়ে উঠে। ঘৃনার চরম স্তরে এখন এই মানুষের বসবাস৷ কি করে সম্ভব তার সাথে বাকি জীবনটা পাড়ি দেয়া? কি দেখলো বাবা এই লোকটার মাঝে?
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here