ভোরের_আলো পর্ব-৪৪

0
900

#ভোরের_আলো
৪৪.

ছাদে পায়চারী করছেন আমজাদ সাহেব। সারাদিনের ঝক্কি ঝামেলা শেষে বেঘোর ঘুম ঘুমুচ্ছে সবাই। তার ধারনামতে অর্পিতা বোধহয় সজাগ৷ এমন পরিস্থিতিতে মেয়ের ঘুমানোর কথাও না৷ তারও ঘুম আসছে না। হৃদস্পন্দন যেনো ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। অস্থিরতাগুলো শরীরের রক্তে ছুটে বেড়াচ্ছে।

ফোন বাজছে আমজাদ সাহেবের৷ স্ক্রীনে ছোটভাই শাহীনের নাম ভেসে উঠেছে।

– তুই এতক্ষণে ফোন করলি শাহীন?
– ব্যস্ত ছিলাম খুব। আবিদটাতো চলে গেলো। পুরোটা তো আমাকেই সামলাতে হচ্ছে।

বহুকষ্টে সেই বিকেল থেকে চোখের পানি আটকে রেখেছিলেন আমজাদ সাহেব। পুরো পৃথিবীতে শাহীন হচ্ছে মন খুলে সমস্ত কথাগুলো বলার সবচেয়ে বিশ্বস্ত জায়গা। ভাইয়ের জীবনের ছোট বড় সমস্ত কথাগুলো শাহীনের মুখস্থ। সেই ছোট থেকে আজ অব্দি ভাইয়ের যেকোনো খারাপ পরিস্থিতিতে শাহীনই বড় ভাইয়ের খুঁটি হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো। সেই ছোটভাইয়ের গলার স্বর পেয়ে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারেননি আমজাদ সাহেব৷ ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করেছেন তিনি।

– ভাই, কেঁদো না তো। ভালো লাগে না তোমার কান্নাকাটি।
– অর্পিতা এটা কি করলো রে শাহীন?
– সেই সকাল থেকে এটা নিয়ে আমারও মাথা খারাপ হয়ে আছে৷ মিনু যখন ফোন দিয়ে ছেলের সমস্যার কথা জানালো, মনে হচ্ছিলো পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যাচ্ছে। নিজে বিয়ে করেছে সেটা নাহয় আমরা মেনে নিলাম৷ কিন্তু ছেলের যা সমস্যা এটা কিভাবে কি?
– জানি না আমি৷ ওকে আমি যথেষ্ট বুদ্ধিমতী ভাবতাম৷ এমন একটা ছেলেকে ও কিভাবে বিয়ে করলো? একটাবারও কি খোঁজ নেয়ার প্রয়োজন মনে করলো না?
– যা সিদ্ধান্ত নিয়েছো ভেবে চিন্তে নিয়েছো তো?
– দম বন্ধ হয়ে আসছে আমার। বুকের উপর পাথর চাপা দিয়ে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি৷ কাওকে ভেতরটা দেখাতে পারছি না৷ এই ছেলের হাতে মেয়েকে তুলে না দিয়েও কোনো উপায় পাচ্ছি না। আবার দিতেও ইচ্ছে হচ্ছে না।
– আচ্ছা মূলত তুমি তুলে দেয়ার সিদ্ধান্তটা কেনো নিয়েছো বলো তো।
– এত সহজে এই ছেলের কাছ থেকে মেয়েকে আনা যাবে না। তুলকালাম করে ফেলবে। অর্পিতার মত মেয়েকে বউ হিসেবে পাওয়া মুখের কথা না৷ না চাইতেই আকাশের চাঁদ পেয়ে গেছে ও। চাঁদ নিজে এসে ওর কাছে ধরা দিয়েছে। হ্যাঁ, যদি তুই ওর মেয়ে মানুষের নেশার কথা বাদ দিয়ে বাকি দিকগুলো বিবেচনা করিস তাহলে ছেলে খুবই ভালো। কিন্তু তবুও আমার মেয়ের বিয়ে এই ছেলের সাথে বেমানান৷ অর্পিতা আরও ভালো পাত্র ডিজার্ভ করে।
-ছেলের তো নাকি বয়সও ওর তুলনায় বেশি।
– বয়সটাকে আমি এতটাও সমস্যা হিসেবে দেখছি না।
– তবুও, এত বয়সের পার্থক্যে তো বেমানান লাগে।
– তুই বয়সের কথা চিন্তা করছিস? আমার মেয়ে ঐ ছেলের কোনো খোঁজ না নিয়েই বিয়ের পিড়িতে বসে গেছে৷ ওর বাবা মা কারো কথা অর্পিতা জানে না৷ আর তুই বলছিস বয়সের হিসাব! ছেলেকে দেখলে মনে হয় আবিদের ছোট৷ বয়স বুঝা যায় না।
– তবু আরেকবার ভেবে দেখো।
– অনেক ভেবেছি আমি৷ ছেলের সমস্ত খোঁজ নিয়েছি। প্রচুর বেপরোয়া স্বভাবের। কাজ করার আগে ভেবে চিন্তে করে না৷ ও ভুলেও ডিভোর্স পেপারে সাইন করবে না। আমার মেয়ে একবার হাতছাড়া হয়ে গেলে ও আর অর্পিতার মত আরেকটা কখনোই খুঁজে পাবে না। আমি আজকে ওকে দেখে যা বুঝেছি ও আমার মেয়েকে সত্যিই ভালোবাসে। কিন্তু কথা হচ্ছে এই সেইম ফিলিংটা তো অর্পিতাও পেয়েছিলো। তাহলে ও কিভাবে আরেক মেয়েকে বেডরুমে নিয়ে এলো?
– ঐ যে অভ্যাস৷ বাজে নেশা তো। বাজে নেশা কি এত সহজে কাটে?
– কষ্টটা হচ্ছে আমার মেয়েকে নিয়ে। ও সব দেখেছে নিজের চোখে। এরপরও কিভাবে ওর সাথে একছাদের নিচে বাস করবে?
– ভুল আমাদের মেয়েরই বেশি ছিলো ভাই।
– হ্যাঁ, ভুল তো ওরই। চারমাসের পরিচয়ে ও কেনো এই ছেলেকে বিয়ে করলো? এমন তো না ছেলে ওকে জোর করেছে। ও স্বেচ্ছায় ছেলেকে বিয়ে করেছে।
– আবিদ কি বলে?
– ও কি বলবে? ও তো পারলে বোনকে নিয়ে আজকেই পালিয়ে যায়৷ আশফাকের হাতে বোনকে কোনোভাবেই দিবে না৷ ওকে এটা সেটা বুঝিয়ে ঠান্ডা রাখছি৷
– শুধু কি ছেলে ঝামেলা করবে দেখেই ওর হাতে মেয়ে দিচ্ছো?
– ঝামেলা আমিও করতে পারবো৷ দেখা যাবে আমি যতটা না করবো তারচেয়ে দ্বিগুন ঝামেলা ও করবে৷ ঘরে টিকে থাকা দায় হয়ে যাবে৷ এসব ঝামেলা করে আমার মেয়ের ভবিষ্যৎ শেষ করতে চাই না৷ তাছাড়া ঝামেলা করে আমি বিশেষ সুবিধা করতে পারবো না। এটা কোনো রোডসাইড রোমিও না৷ এটা ওর হাজবেন্ড। তাও ও নিজে পছন্দ করে বিয়ে করেছে। তাছাড়া বিয়ে তো বিয়েই৷ বললেই কি ভেঙে দেয়া যায়?ছেলে জানপ্রাণ দিয়ে আরেকটা সুযোগ চাচ্ছে বিয়েটা টিকানোর। আমাকে বলেছেও বিয়ের পর আমার মাঝে খারাপ কিছু দেখলে মেয়ে নিয়ে চলে আসবেন৷ আমি বাঁধা দিবো না। ছেলের দিকে চিন্তা করলে মনে হয় আরেকটা সুযোগ দেয়া উচিত৷ মেয়ের মুখটা চোখে ভাসলে কান্না পায়। এই ছেলের সাথে আদৌ কি কখনো আমার মেয়ে স্বাভাবিক হতে পারবে? আমার মেয়ে এটা কি করলো? বিয়ে করার আর মানুষ খুঁজে পেলো না!
– কেঁদো না৷ যা হয়ে গেছে আমরা তো বদলাতে পারবো না৷ শান্ত হও৷ দুজনই ভুল করেছে৷ এখন আমরা তো আর ওদের মত ছোট না৷ এই সিদ্ধান্ত আমাদেরই ভেবে চিন্তে নিতে হবে। তোমার ডিসিশনটা খারাপ না৷ দিয়ে দেখো একটা সুযোগ। ছেলে যদি সত্যিই ভালো হয়ে যায় তো ভালো কথা৷ অর্পিতাকে কিভাবে ও স্বাভাবিক করে নিবে সেটা ও বুঝবে৷ আর যদি না শুধরায় তাহলেও সমস্যা নেই৷ মেয়ে আমরা নিয়ে আসবো৷ ভাই, আল্লাহ ভরসা। যা হওয়ার হবে৷ আমরা দেখেশুনে বিয়ে দিলেও তো খারাপ হতে পারতো তাই না?
– তুই দেশে আসবি না?
– কি বলো? মেয়ের বিয়ে আর আমি দেশে আসবো না?
– জলদি আয় ভাই৷ আমি একা এখানে হাঁপিয়ে যাচ্ছি৷ তুই থাকলে মনে জোর পাই।
– আসবো। আজ তো সময় পেলাম না। কালই যাবো টিকিট কনফার্ম করতে।

খাটে পাশাপাশি শুয়ে আছে আশফাক আর রিমন। দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছে কৌশিক। আশফাক গভীর মনোযোগ দিয়ে মোবাইলে কিছু একটা করছে। আশফাকের পায়ে আস্তে লাথি মেরে কৌশিক জিজ্ঞেস করলো,

– ফোনে কি করিস?
– আমার ভাই আর কি করবে? অর্পিতার ছবি দেখছে জুম করে।
– আশফাককে খুশি দেখাচ্ছে না। কেনো বলতো?
– হুম আমিও দেখছি। ভেবেছিলাম ঐ বাড়ির ঝামেলাটা মিটে গেলে ভাইয়া বেশ স্বাভাবিক হয়ে যাবে৷ কিন্তু তেমন কিছুই তো হচ্ছে না৷ সমস্যা কি ভাইয়া?
– সমস্যা মিটেছে ওর ফ্যামিলির সাথে। আমার বউয়ের সাথে তো আর মিটেনি।
– এখনই মিটে যাবে সেই আশা তুই কিভাবে করিস? ওকে সময় দে আশফাক। ওর ফ্যামিলি মেনে নিয়েছে এটাই আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় কর। তা না করে নাচানাচি করছিস অর্পিতার সাথে সমাধান করা নিয়ে।
– আমার তো ওকে প্রয়োজন। ও আমার সাথে কথা বলেনা। কথা না বলে তো আমি থাকতে পারছি না।
– কে কথা বলে না। রাতে ওদের বাসায় যাওয়ার পরও তো তোর সাথে কতক্ষন কথা বললো।
– কিভাবে কথা বলেছে দেখিসনি?
– কিভাবে?
– না পারতে কথা বলেছে। ওর মামী, মামাতো বোন ওদের সামনে আমার সাথে স্বাভাবিক থাকার নাটক করেছে।
– উফফ! তো তুই কি চাস? যা করেছিস এরপর কি ও এখন তোর গলা ধরে বলবে আসো চুমু খাই?
– আমি কি বলেছি নাকি চুমু খেতে?
– তোর কথায় তো তাই বুঝা যাচ্ছে।
– না। আমার কথায় সেসব বুঝা যাচ্ছে না।
-…………….
– জানিস, আগে যখন কথা বলতাম তখন অন্য কথা বলার ফাঁকে হুট করেই চোখ চোখ রেখে বলতো, ” অ্যাই আশফি, ভালোবাসি”। সাথে সাথেই কথার প্রসঙ্গটা পাল্টে বলতো, “হুম, কি যেনো বলছিলে। বলো।”
ও যখন ঐ কথাটা বলতো ওর চোখজোড়ায় গভীরতা দেখতে পেতাম৷ গভীরতাটা কিসের সেটা ঠিক আন্দাজ করতে পারতাম না৷ এখন বুঝি সেটা ওর ভালোবাসার গভীরতা ছিলো। যে গভীরে আমি পুরোপুরি ডুবে গেছি৷ কখন যে ডুবেছি টেরই পাইনি। যখন নিঃশ্বাসটা বন্ধ হতে শুরু করলো তখন বুঝলাম, হায়! আমি তো পুরোপুরি ডুবে গিয়েছি৷ এখন হয় আমাকে ঐ গভীরে জীবনভর সাঁতরে বেড়াতে হবে আর নয়তো ডুবে মরতে হবে। ওর হাসির শব্দ, হাত নেড়ে চোখ ঘুরিয়ে কথা বলা এসব আর দেখি না৷ ওর কথায় মনে হতো আমি ওর কত আপন! কত কাছের! এখন কথা বললে মনে হয় আমি ওর কেও না৷ দূরের কেও৷ অনেক দূরের। যার সাথে কথা বলতে মন সায় দেয় না। সহ্য হয়না আমার। মনে হয় যাকে ভালোবেসেছি সে আর পৃথিবীতে বেঁচে নেই। মারা গেছে বা হারিয়ে গেছে। আমার সামনে এখন যে দাঁড়িয়ে আছে সে একটা জীবিত লাশ বা অর্পিতার বেশ ধরে অন্য কেও। এটা আমার অর্পিতা না৷
– কবি কবি ভাব এসেছে তোর মাঝে না রে আশফাক? পিটিয়ে তোর কবি ভাব ছুটানো উচিত শালা বদমাইশ। বারবার বলেছিলাম অর্পিতা ঐরকম না৷ শুনিসনি৷ এখন বোঝ ঠ্যালা। তোর এই অবস্থা দেখলে একবার মায়া লাগে আরেকবার মনে হয় তোকে পিটিয়ে শেষ করে দেই। সুস্থ হাসিখুশি একটা মেয়েকে তুই অসুস্থ বানিয়ে দিলি।
– কৌশিক ভাই, আমারও না অর্পিতাকে দেখলে এখন এমনই লাগে৷ মানসিক রোগীর মতন। মনে হয় যেনো কোনোমতে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। কি চেহারা ছিলো আগে! আর এখন কি হয়েছে! আসলে ও মুখে যতই বলুক আমার ভাইকে ভুলে গিয়েছে কথাটা সত্যি না৷ অর্পিতা এখনো ভাইয়াকে বাদ দিতে পারেনি৷ ভাইয়ার ঘটনাটা ওকে ভিতরে থেকে শেষ করে দিচ্ছে। আসলে ও ভাইয়াকে অনেক ভালোবাসতো৷ ভাইয়া তো বুঝলো না। এই ঘটনাটা মানতে পারছে না এখনো। ও যতদিন না এটা মাথা থেকে সরাতে পারছে ততদিন ও এমনই থাকবে। ওকে আগের মত তুমি পাবে না।
– ওকে এভাবে সহ্য করা সম্ভব না। এরচেয়ে ভালো ওকে বলিস আমাকে মেরে ফেলতে। আমি আমার জীবিত অর্পিতাকে ভালোবেসেছি। মৃত অর্পিতাকে না।
– আচ্ছা কিছুদিন সময় দাও ওকে। ও তো বাসায় আসছেই। তখন নাহয় তুমি তোমার মত করে ওকে আগলে ধরে রেখো। কিছু ক্ষত থাকে সহজে সাড়ে না। ওরটাতেও সময় লাগবে। তোমাকে ধৈর্য্য ধরতে হবে৷ অন্যায় করেছো, শাস্তি পাবে না? ধরে নাও এটাই তোমার শাস্তি।
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here