ভৌতিক থ্রিলার #পাপের ক্ষরণ পর্ব-এক মাহবুবা বিথী

#ধারাবাহিকগল্প
#ভৌতিক থ্রিলার
#পাপের ক্ষরণ
পর্ব-এক
মাহবুবা বিথী

রায়হান জোয়ার্দার প্রিয়তমা স্ত্রীর জন্য টঙ্গীর অদূরে তুরাগ নদীর ধারে বিশাল বাংলো বাড়ি বানিয়েছেন। আজ একযুগ পূর্তি বিবাহবার্ষিকীতে বউকে বাড়িটি উপহার দিবেন। বাড়িটি বানাতেও বারোবছর লেগে গেলো। অবশেষে কমপ্লিট করতে পেরেছেন। সেই জন্য রায়হানের আজ ভীষণ ভালো লাগছে।

রায়হান জোয়ার্দার এই মূহুর্তে দেশের নাম্বার টপটেন বিজনেস টাইকুন। দেখতে যেমন সুদর্শন স্টাইলসেন্সে তার জুড়ি মেলা ভার। বেশ স্বাস্থসচেতন। রেগুলার জিমে যান। শুধু দেখতে অপূর্ব নয় কাজকর্মে তুখোড়। বহু নারীর স্বপ্নের পুরুষ। ওর প্রিয়তমা স্ত্রী ও অপূর্ব সুন্দরী। ওর নাম রশ্নি। রশ্নির নিজের একটা এনজিও আছে। ছাত্রী জীবনে তুখোড় বিতার্কিক ছিলেন। ইংরেজী মাধ্যমে পড়ার সুবাদে ইংরেজীর উচ্চারণ খুব চোস্ত। গানের গলাটাও বেশ। ধর্মের জ্ঞানটা বেশ প্রখর। এক ওয়াক্ত নামাজ কাজা করে না। সবাই বলে পারফেক্ট কাপল।
রায়হান বাংলোবাড়িটার নাম রেখেছে রশ্নিমহল। পুরো বাড়িতে আলোর রোশনাই যেন ঝলমল করছে। সন্ধার পর সবগুলো আলো জ্বলে উঠেছে। সুইমিংপুলের কাছে নীলাভ আলোগুলো যেন চারিদিকে মায়ার আবেশ ছড়িয়ে রেখেছে। বাংলো বাড়িটার চারিদিকে আভিজাত্যের ছোঁয়া। বিশাল গেট পেরিয়ে প্রথমে একপাশে গ্যারেজ। পাশে বিশাল বাগান। কিছু সুন্দর ডিজাইনের লোহার চেয়ার বাগানে বসার জন্য দেওয়া হয়েছে। পুরো বাড়ি জুড়ে নানা পদের ফলের গাছ লাগানো হয়েছে। বাড়ির ভিতরে প্রথমেই বেশ বড় আধুনিক ডিজাইনের কিচেন। পাশে লিভিং আর ডাইনিংরুম। আর একপাশে বড় হলরুম। দোতলায় বড় চারটা এটাচ বাথ সহ বেডরুম। ছাদের চিলেকোটায় বিশাল লাইব্রেরি। তারপাশে খোলা ছাদ রয়েছে। বাড়ির প্রতিটি কোনায় কোনায় বনেদি ছাপ রয়েছে। বিদেশ থেকে আনা মার্বেল পাথরে সিঁড়ি মেঝে বাথরুম সব মুড়িয়ে রাখা হয়েছে। মোটকথা আভিজাত্যের ঝা চকচকে আলো যেন বাড়িটা দিয়ে ঠিকরে বের হচ্ছে। আর এবাড়ির সবচেয়ে সুন্দর মায়াবী স্থান হচ্ছে সুইমিংপুল। রশ্নির ভীষণ পছন্দ হয়েছে। রায়হানের চোখ হঠাৎ পুলের পানির দিকে গেলো।দূর থেকে পুলের পানিটাকে খুব অদ্ভূদ মনে হচ্ছে। পানিটা যেন চুম্বকের মতো টানছে। রায়হান পানির দিকে তাকিয়ে একটু অবাক হলো। ওর চোখে যেন মনে হচ্ছে কেউ সাঁতার কাটছে। বাড়ির কেয়ারটেকারকে রায়হান ডেকে বললো,
—-জব্বার এখন পুলে কে নেমেছে দেখতো? একটু পরেই গেস্টরা এসে পড়বে।
—না স্যার পুলে তো কেউ নামে নাই।
রায়হান আবার তাকিয়ে দেখে পানিটা স্থির হয়ে আছে। ও ভাবছে চোখের ভ্রম হতে পারে।
চৌদ্দ বছর ধরে এক হাতে আর,জে গ্রুপ অব কোম্পানিকে রায়হান সাফল্যের চূড়ায় নিয়ে গিয়েছে। আর,জে কোম্পানির ব্যবসার বিশাল সাম্রাজ্যে হাজার খানিক ব্যবসায়ী যুক্ত হয়েছে। চল্লিশ বছরের রায়হানকে এখনও বেশ যুবা মনে হয়। শারীরিক গঠন বেশ বলিষ্ট। জীবনে এতো প্রাপ্তি তারপরও রায়হানের নিজেকে অপূর্ন মনে হয়। বিয়ের বারো বছরে ওদের ঘরে এখনও কোনো সন্তান আসেনি। এই হাহাকার রায়হান আর রশ্নিকে কুঁড়ে কুঁড়ে খায়। জীবনের প্রাপ্তিগুলোকে শুন্য মনে হয়।
অনুষ্ঠানে অতিথিরা সবাই আসতে শুরু করেছে। রায়হান উপরে গিয়ে রুমে ঢুকে রশ্নিকে জড়িয়ে ধরে বললো,
—–ডার্লিং তোমাকে তো অপ্সরীর মতো লাগছে। চোখ ফেরানো যাচ্ছে না। এখনি তোমার মাঝে হারিয়ে যেতে মন চায়।
রশ্নি ও দুষ্টমি করে বললো,
—-অপেক্ষার ফল অনেক মিষ্টি হয় ডার্লিং। আজ তো শুক্লপক্ষের পঞ্চমীর চাঁদ আকাশে উঠেছে। চাঁদের আলোয় আজ আমাদের নতুন বাসর হবে।
রশ্নি ভাবছে বিয়ের এতো বছরেও রায়হানের ভালবাসায় এতটুকু কমতি নেই। তারপরও দুজনের মনে হাহাকার।
রায়হানের কথায় রশ্নি সম্বিত ফিরে পেলো
—কি ভাবছো,মাই সুইটহার্ট। গেস্টরা চলে এসেছে।
তারপর রুম থেকে বের হয়ে দুজনে মিলে অভ্যাগতদের স্বাগত জানালো। আমন্ত্রিত অতিথি বৃন্দের মুখে মুখে রায়হান আর রশ্নির সাকসেসের গল্প ঘুরে বেড়াতে লাগলো। রশ্নির মা বাবাও এই অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন।
রায়হানের মা বেঁচে নেই। বাবা হাসান জোয়ার্দার বেঁচে আছেন। উনিও আজকে এই উৎসবের বাড়িতে এসেছেন। ইদানিং উনার হৈ হট্টগোল তেমন একটা ভালো লাগে না। কিন্তু ছেলে আর বউয়ের মন রক্ষার্থে এসেছেন। এতো প্রাপ্তির মাঝেও ছেলের সংসারে অপূর্নতা রয়েছে। ভিতরে ভিতরে ছেলে আর বউমার সন্তানের হাহাকার। তাই হাসান ছেলে আর বউমাকে খুশী রাখতেই এই অনুষ্ঠানে এসেছেন। হাসান একমাত্র ছেলে আর বউমার সাথেই বারিধারার ফ্লাটে বসবাস করেন। আজকের এই ব্যবসার গোড়াপত্তন উনার হাতেই শুরু। আল্লাহপাকের অশেষ রহমতে ছেলের হাতে এই ব্যবসা ফলবান বৃক্ষে পরিনত হয়েছে। হাসান সবসময় দোয়া করে ব্যবসার মতই যেন রায়হানের ঘরখানা আনন্দে ভরে উঠে। আল্লাহপাক যেন একটা সন্তান ওদের সংসারে দান করেন। এমন সময় রশ্নি এসে বললো,
—বাবা রায়হানকে দেখেছেন? রাত হয়ে গেছে। সবাই বিদায় নিবে। গেস্টরা ওকে খুঁজছে। এতো বড় বাড়িতে ওকে কোথায় খুঁজবো।
—-ফোন দিয়ে দেখ কোথায় আছে?
—-দিয়েছিলাম বাবা ফোনতো রিসিভ করছে না।
—আচ্ছা আমি দেখছি।
হাসান দূর থেকে সুইমিংপুলের আলো আঁধারির মাঝে তাকিয়ে দেখলো কেউ একজন পানির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। দেখতে অনেকটা রায়হানের মতই লাগছে। কাছে এসে দেখলো রায়হান পুলের পানির দিকে তাকিয়ে আছে। হাসান ছেলেকে বললো,
—-তুই পানির দিকে তাকিয়ে কি দেখছিস? গেস্টরা এখন চলে যাবে। তোকে সবাই খুঁজছে।

—-বাবা আমার দূর থেকে মনে হচ্ছে পানিতে কেউ সাঁতার কাটছে। কাছে এসে দেখি কেউ নাই। আজকে এ বাড়িতে আসছি পর থেকেই আমার কয়েকবার এরকম হলো।
—ও কিছু না। তুইতো আবার সাঁতার কাটতে পছন্দ করিস। হয়ত এইজন্য তোর মনের অজান্তে পানিতে নামতে ইচ্ছে করছে। এখন ওদিকে ফর্মালিটিসগুলো মেইন্টেন কর।
রায়হান অতিথিদের বিদায় দিয়ে উপরে চলে গেলো।
আজকে সবাই এই রশ্নি মহলেই রাত্রিযাপন করবে। রায়হানের বাবা এশার নামাজ পড়ে শুয়ে পড়লো। রশ্নির বাবা মা ওদের রুমে ঘুমিয়ে পড়েছে। রায়হান নিজের বেডরুমে এসে নামাজ পড়ে নিলো। আর আল্লাহপাকের কাছে প্রার্থনা করলো ওর পাপ ক্ষমা করে বুকের হাহাকার দূর করে একটা সন্তান যেন আল্লাহপাক ওকে দান করেন। তারপর নামাজ শেষ করে দেখে রশ্নি বারান্দায় বসে জোৎস্নার আলোয় স্নান করছে। দূর থেকে চাঁদের আলোয় রায়হানের কাছে রশ্নিকে পৃথিবীর সবচেয়ে রুপবতী কন্যা মনে হচ্ছে। রশ্নিকে কোলে তুলে কপালে ভালবাসার চুম্বনে বিছানায় শুয়ে দিলো।

হঠাৎ একটা শব্দে রায়হানের ঘুম ভেঙ্গে গেলো। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো রাত তিনটা বাজে। বাড়িতে কেয়ারটেকার, গার্ড, বাগানের মালী, রান্নার হেলপার থেকে শুরু করে আট দশজন লোক রয়েছে। কিন্তু এই মূহুর্তে পুরো বাড়ি নির্জনতায় ঢেকে রয়েছে। রায়হানের মনে হচ্ছে কেউ যেন পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে সাঁতার কাটছে। রায়হান রশ্নির দিকে তাকিয়ে দেখলো রশ্নি গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। ও বিছানা ছেড়ে উঠে বারান্দায় গিয়ে বসলো। চারিদিকে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শোনা যাচ্ছে। চাঁদের আঁট সাঁট শরীর বেয়ে জোৎস্না চুয়ে চুয়ে পড়ছে। গাছের ফাঁক গলে চাঁদের আলো মাটির বুকে ছায়া ফেলে অদ্ভূত রহস্যময় পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। বারান্দা থেকে সুইমিংপুলটা দেখা যায়। রায়হানের চোখ সুইমিংপুলের দিকে নিবদ্ধ হলো। হ্যা খুব পরিচিত একজনকে দেখা যাচ্ছে। এরকম এক জোৎস্নার রাতে যার রুপে সে মাতাল হয়ে ছিলো। রায়হানকে মনে হয় সে ইশারা করে ডাকলো। রায়হান ঘর থেকে বের হয়ে মোহবিষ্টের মতো পুলের দিকে হাঁটতে লাগলো। রাতের নির্জনতা কাঁপিয়ে কোথায় যেন একটা কুকুর করুন সুরে ডেকে উঠলো। গাছের ডালে নাম না জানা পাখিটাও ডানা ঝাপটালো। রায়হানের আঙ্গুলের ফাঁকে সিগারেটটা তখনও জ্বলছিলো।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here