মধ্যাহ্নে মাস্টারমশাই পর্বঃ১৮

0
1213

#মধ্যাহ্নে_মাস্টারমশাই (২য় খন্ড)
#মম_সাহা

পর্বঃ আঠারো

হাঁটে অন্যান্য দিনের তুলনায় আজ দ্বিগুণ মানুষ। “কন্যার সুখ” ভান্ডারের সামনে উপচে পড়া ভীড়। কারণ দোকানে বসে আছে সাদা রঙের থ্রি-পিস পড়া তিস্তা। হাতে তার মাধ্যমিকের ‘সাহিত্য কণিকা’ বই। বাংলা বলেই জানি যাকে। খুব মনযোগ দিয়ে পড়ছে বইটা। তার দোকানের সামনে যে অগণিত মানুষের ঢেউ, সেটা যেনো সে দেখেও দেখছে না।

মানুষ গুলো কী আর ভালো কাজে ভীড় জমিয়েছে? তারা তো কৌতূহল মিটানোর জন্য ভীড় জমিয়েছে। এদের দেখেও কী লাভ? ক্যাশ বাক্সে কী আর লক্ষী আসবে?

গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছে তিস্তার লজ্জাহীন কাজের কথা। মানুষ তো অর্ধেকই আসছে কথা সত্যি কিনা সেটা যাচাই করে চক্ষু স্বার্থক করতে।

আর তো ভালো লাগে না। এত ভীড় করার কোনো মানে আছে? এগুলার কী খেয়ে কাজকর্ম নেই? নাকি তিস্তাকে এর আগে কখনো দেখে নি? আজব!

তিস্তার ধৈর্য্যের বাঁধ ভাঙলো। বইটা বন্ধ করে উঠে দাঁড়ালো। ভীড়ের মাঝে তখন মানুষের কানাকানি চলছে। কেউবা বাজারের পন্যের মতন তিস্তাকে ক্রয় করা যায় কিনা সেই ছক কষতে ব্যস্ত।

হাতের বইটা শব্দ করে ক্যাশবাক্সের উপর রেখে উচ্চস্বরে বললো,
-‘কী সমস্যা আপনাদের? কী চাই এখানে? কিছু লাগলে নেন, নাহয় পথ ছাড়ুন।’

এবার যেনো মানুষ গুলো কথা বলার সুযোগ পেলো। বিশ্রী হেসে কয়েকজন বললো,
-‘এ দোকানে তোরেই খালি ভাল্লাগছে। তোরেই কিনতে চাই। ভরা বজারে, এ ব্যবসা করতে নামছোছ নাকি?’

তিস্তা ক্ষাণিকটা থমকে যায় কিন্তু দমে যায় না। সে তো তৈরী হয়েই এসেছে এসবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার জন্য। বাড়িতে যেভাবে ঘরের মানুষের সাথেই লড়ে আসলো, বাহিরে পারবে না?

দাদীর কুৎসিত কথা দাদীকেই ফিরিয়ে দিয়েছে। মাও আজ এই প্রথম দাদীর সাথে উচ্চস্বরে কথা বলেছে। দাদী চুপ হয়েছে। এখন চুপ হওয়ার পালা এদের।

তিস্তা একটু আগের কথাটা একদম গায়ে মাখে নি ভাব করে বললো,
-‘ওমা! মানুষ বুঝি বিক্রি করা যায়? তবে নাহয় তোমার ঘরের মা, বোন,বউ,মেয়েকেই আগে বিক্রি করো।’

ভীষণ সমাগম চুপ হয়ে যায়। কিছু মানুষ তো তাজ্জব বনে যায় তিস্তার হাবভাব দেখে। এ মেয়েটার এখনো এত তেজ?

যে লোকটা তিস্তাকে খারাপ কথা বলেছে সে-ই আবার তেড়ে এসে বললো,
-‘এই, এই, তোর মতন আমার ঘরের মাইয়া,বউ বেহায়া নাকি? না,বাজারের মেয়েছেলে? নষ্ট মেয়ে মানুষ। আবার আমার বাড়ির মেয়েছেলের সাথে নিজের তুলনা দেস? তোর কাছ থেইকা কেউ কিছু কিনবো না। মাইয়া মানুষ হইয়া গঞ্জের হাঁটে বহস আবার এত কথা।’

রীতিমতো মানুষ আরও বেশি জড়ো হয়ে গেলো। তিস্তা কণ্ঠে তেজ রেখে বললো,
-‘চাচা,মানুষ কথাটা তো সবার জন্যই প্রযোজ্য। ছেলে মেয়ে সবাই মানুষ। কিন্তু আমাদের সমাজ মানুষ শব্দটি কেবল ছেলেদের জন্যই ব্যবহার করে। আর মানুষ শব্দটির আগে খুব সন্তর্পণে “মেয়ে” নামক শব্দটি যোগ করে মানুষ নামক জাত থেকে আলাদা করে দেয় নারী জাতটাকে। কেবল “মেয়ে” নামক বিশেষণটি যোগ করে নারীদের চরম দুর্বল জাত হিসেবে প্রকাশ করে।

যদি আলাদা করতেই হয় তবে,পুরুষ জাতদের মানুষ শব্দটির আগে “ছেলে” বিশেষণটি কেনো যোগ করা হয় না?

তবে,মানুষ কী শুধুই পুরুষরা? নারী কেবল এক অসহায় জাত হয়েই থাকবে? নারীরা কখনো ঝলমলে চকচকে “মানুষ” হতে পারবে না? নারীরা কেবল মেয়ে মানুষ হয়েই থাকবে? বিশেষণটির এমন সৎ ব্যবহার বুঝি আমাদের সমাজের চেয়ে ভালো কেউ করতেই পারবে না।

আজ মেয়ে বলেই আমি সবটা সহ্য করার পরও দোষীর কাঠগড়ায়। ঘরে খাবার নেই চাচা, আজ পরিবারের মানুষের মুখে খাবার তুলে দিতে চেয়েছি মেয়ে হয়ে,সেটাই কী অপরাধ?

আমায় কিনবেন, চাচা? আপনার মেয়ের বয়সীই তো আমি। আমাকে এসব বলার আগে ওর কথা মাথায় এলো না? আমাদের মাঝে তো তফাত নেই।

নাকি আপনার ঘরের মেয়েরাই কেবল মেয়ে। আর,আমরা কোনো পণ্য?’

একদম চুপ পুরো জনসমুদ্রের ঢেউ। নিরব কথার বিস্ফোরণ যে সবার গহীনে কতটা স্পর্শ করেছে তা এ বিস্ফোরণ না দেখলে বুঝা’ই যেতো।

ভীড় ঠেলে নেপাল ঠাকুর তিস্তাদের দোকানের সামনে এলো। ভীষণ মমতাময় কণ্ঠে বললো,
-‘তিস্তা, আমারে আধা কেজি চিঁড়া দেও। সাথে এক খন্ড গুড়ও দিও।’

তিস্তার চোখে উপচে পড়া জল গুলো তিস্তা ঝড়তে দেয় নি। হাসিমুখে সে নেপাল ঠাকুরকে চিঁড়ে,গুড় দিলো। তার বিনিময়ে নেপাল ঠাকুর মূল্য পরিশোধ করলো।

আর কেউ দাঁড়ালো না দোকানের সামনে ভীড় করে। যে যার মতন নিজের গন্তব্যে পা বাড়ালো। নেপাল ঠাকুর প্রাণ ভরে তিস্তাকে আশীর্বাদ করলো। এই তিস্তা কী কেবল তিস্তা?

এ তিস্তার মাঝে আছে তার চঞ্চল ভ্রমরী,সব বাবা-মায়ের কন্যা।

নেপাল ঠাকুর যেতেই তিস্তা ছোট্ট শ্বাস ফেলে টুলটাতে বসে পড়লো। মনে পড়লো সকালের কথা। দাদী তাকে যখন বললো সে নোংরা মেয়ে ছেলের খাতায় যেনো নাম লেখায়,তখন তিস্তা হিংস্র বাঘিনীর ন্যায় ক্ষ্যাপে গেলো।

চোখ গুলো ঘৃণায় লাল হয়ে গেলো। একদলা থুতু উঠোনের মাঝে ফেলে বলেছিলো,
-‘তোমার কথার ধরণে আমার ঘৃণা হচ্ছে দাদী। তুমিও তো মেয়ে। নিজের নাতনীকে এমন কথা বলতে বিবেকে বাঁধলো না?’

দাদীও দ্বিগুণ রেগে গেলো। তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে বললো,
-‘তোর লগে কথা কইতে আবার বিবেক কিসের? ডুইবা মরতে পারোস নাই? নিলর্জ মেয়ে।’

এমন এক কথা দু কথায় দাদীর ভাষা শৈলী খারাপ হলো। অবশেষে দিক না পেয়ে তনয়া বেগম মেয়ের হয়ে কথা বলেন।

সকালের কথা ভাবতেই তিস্তার শরীরে আবার ঘিনঘিন ভাবটা জেগে উঠলো। কিছুক্ষণ মৌন থাকতেই মনে পড়লো আরও দরকারী একটা কথা। আজ তো মাস্টারমশাই এর বিয়ে। মানুষটা আর তার আছে তো?

___
‘বিয়েটা আমি করবো না, মা।’

কিছুক্ষণ পর যে ছেলের বিয়ে, সে ছেলের মুখে এমন কথা শুনেও আশ্চর্য হয় না আশালতা। মুখে আগের ন্যায় গাম্ভীর্যতা জড়িয়ে রেখেই বললো,
-‘এখানে তোমার অনুভূতির দাম আমি দিতে পারছি না।’
-‘কেনো,মা? আজ আমার চেয়েও আপনার জেদ বড় হলো?’

ছেলের প্রশ্নে ক্ষাণিকটা ব্যাথিত হলো আশালতা, কিন্তু প্রকাশ করলেন না বরং ক্ষীণ স্বরে বললেন,
-‘আমার জেদ না এটা। ধরতে পারো শেষ ইচ্ছে।’
-‘আপনার শেষ ইচ্ছে, আপনার ছেলের জীবনটা শেষ করতে পারে। তা জানেন তো?’

-‘কাউকে বাঁচাতে মাঝে মাঝে নিজে শেষ হলে ক্ষতি কী?’

মায়ের প্রশ্নে অবাক হলো প্লাবন। মা তো বেশ ছেলে ভক্ত। তবে আজ ছেলের শেষ হওয়াটাও মায়ের শরীরে লাগছে না?

ভাগ্য কী তবে, অন্য রকম খেলা খেলবে?

___

বিষাদিনী খুব যত্নে নিজের ব্যাগটা গুছিয়ে নিলো। এ বাড়িতে আজই তো তার শেষ দিন। এরপর সে চলবে সুখের ঠিকানায়। বিলাসিনী টা ভালো থাকতে পারবে তো?

অবশ্য বিলাসিনী খুব বুদ্ধিমান। সে নিজের ভালো থাকা খুঁজে নিবে। সবাই কী আর বিষাদিনীর মতন বিষাদ প্রেমী হয়?

___

গতকাল বিকেল অব্দি বাজারে ছিলো তিস্তা। বেচাকেনা খারাপ হয় নি। অনেকেই তার থেকে নিজেদের প্রয়োজনীয় জিনিস কিনেছে।

সন্ধ্যের পর ক্লান্ত হয়ে বাড়ি এসে ঘুমিয়ে গিয়েছিলো।

এখন ভোর। চারপাশে সদ্য আলো ফুটেছে। তিস্তা তখন বেঘোর ঘুমে।

তনয়া বেগম বাহির থেকে ছুটে এলেন। তিস্তাকে ধাক্কা দিয়ে ব্যতিব্যস্ত কণ্ঠে বললেন,
-‘তিস্তা,তাড়াতাড়ি উঠো। গ্রামে যে এক নতুন ঘটনা ঘটেছে।’

হঠাৎ ধাক্কায় ধড়ফড়িয়ে উঠে তিস্তা। ঘুমিয়ে থাকা মস্তিষ্কের বোধগম্য হয় না মায়ের আচরণ। ভীত কণ্ঠে সে বললো,
-‘কী হয়েছে,আম্মা?’

তনয়া বেগম শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখের কোণের অশ্রু মুছলেন। অসহায় কণ্ঠে বললেন,
-‘তোমার মাস্টারমশাই যে গ্রামে আসছে। সাথে তার নতুন বউ।’

তিস্তা কিছুটা সময় নেয় কথাটা বোঝার জন্য। কথাটা মস্তিষ্ক অব্দি যেতেই বিদ্যুৎ খেলে যায় তার শরীরে। কেবল কানে আর মস্তিষ্কে একটা কথায় বাজছে, “মাস্টারমশাই গ্রামে ফিরেছে নতুন বউ নিয়ে।”

তিস্তা চুপ রয়। মিইয়ে যাওয়া কণ্ঠে বললো,
-‘তবে কী সব,
ছিলো মিছে কলরব?’

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here